মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক একটি ব্যতিক্রমী গ্রন্থ

 আহমেদ বাসার 
২৬ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বাঙালির আবেগ মনন ও প্রাতিস্বিক চেতনার এক অনিঃশেষ উৎস। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। একেএম শামসুদ্দিনের ‘মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’ এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন। মুক্তিযুদ্ধের নানা অজানা অধ্যায় এ গ্রন্থে লেখক পরম মমতায় তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা নয়, বরং ইতিহাসের আলোর বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বীরত্বগাঁথা ও আত্মদানের বর্ণনায় সমৃদ্ধ এ গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়। গ্রন্থটিতে মোট ২৪টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে।

এ গ্রন্থে আমরা জানতে পারি রংপুরের অকুতোভয় বীর শংকু সমজদারের কথা। ১২ বছরের এ বীর কিশোর ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের পর পাকবাহিনীর অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে মিছিলে যোগ দেন। মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হলে তিনি রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এ রকম আরও একজন বিস্মৃত বীর শাহেদ আলী কসাই। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই ২৩ মার্চ তিনি গেরিলা যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। পেশায় একজন গ্রাম্য কসাই শাহেদ আলী ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সূচনা করেন। দেশীয় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তিনি একজন পাঞ্জাবি সেনাকে হত্যা করেন। কিন্তু শাহেদ আলীর এ বীরত্বগাথা ইতিহাসে স্থান পায়নি।

‘ওরা কেউ ফিরে আসেনি’ প্রবন্ধে শহিদ বুদ্ধিজীবী প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের চিত্র উঠে এসেছে। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে রাজনৈতিক নেতারা ও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ঘনঘন মিটিংয়ে মিলিত হতেন। ফজলুর রহমানের বাসায়ও এ ধরনের মিটিং হতো। একাত্তরের ১ এপ্রিলে একদল পাকিস্তানি সেনা সদস্য তার বাসা ঘেরাও করে পরিবারের কয়েকজন সদস্যসহ তাকে হত্যা করে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আরও একজন বিস্মৃত বীর জগতজ্যোতি দাসের কীর্তি উঠে এসেছে এ গ্রন্থে। জগতজ্যোতি বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত গেরিলা দলের কমান্ডার ছিলেন। দলটির নাম ছিল দাস পার্টি। সুনামগঞ্জের বৃহত্তর ভাটি অঞ্চলে দাস পার্টির কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের কাছে দাস পার্টি ছিল এক মূর্তমান আতঙ্কের নাম। নভেম্বরের ১৬ তারিখে তিনি ও তার দল পাকসেনাদের ফাঁদে পড়ে শহিদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় জর্জ বাহিনীর জর্জ জেএম দাসের নামও এক্ষেত্রে স্মরণীয়। তৎকালীন ইপিআরের সদস্য জর্জ অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ ও ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম থেকেই তিনি গেরিলা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তিনি আনুমানিক ৪০০ মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে জর্জ বাহিনী গড়ে তোলেন। এ অকুতোভয় বীরের নামও অনেকেরই অজানা।

মুক্তিযুদ্ধে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবদানের প্রসঙ্গও আলোচ্য গ্রন্থে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাঁওতাল, ওঁরাও, গারো, হাজং, কোচ প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কয়েক হাজার লোক অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু তারা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সে অর্থে পায়নি।

লেখক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তীব্র আবেগ ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায় গ্রন্থের প্রতি অধ্যায়ে। আলোচ্য গ্রন্থে লেখক মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা অপরিচিত ও বিস্মৃত বীরদের কীর্তি তুলে ধরেছেন হৃদয়স্পর্শী ভাষায়। পাশাপাশি জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি ও প্রাপ্য মর্যাদা প্রদর্শনের দিকেও গুরুত্বারোপ করেছেন। তাই গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে গুরুত্ববহ।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন