স্মরণ
আপসহীনতাই কাল হয় তার
২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি। তখন বেলা দ্বিপ্রহর। খুলনা শহরের আহসান আহমেদ রোডের বাসায় জীবনসঙ্গীর সঙ্গে কন্যারা বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায়। পেশার পাশাপাশি সামাজিক কাজে সদা ব্যস্ত সাংবাদিক মানিক সাহা ঘরে ফিরে পরিবারের দায়িত্ব পালন করবেন। খুলনা প্রেস ক্লাব থেকে রওনা হয়েছিলেন রিকশায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আততায়ীর বোমা হামলায় থেমে যেতে হয় তাকে। মুহূর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্ক ছড়িয়ে যায় খুলনাসহ সারা দেশে। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে সারা দেশের সাংবাদিকসহ প্রগতিশীল সব রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন। ক্ষোভ, নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। মফস্বল শহরের একজন অতি সাধারণ জীবনযাপনকারী সাংবাদিকের কি এমন ক্ষমতা? হ্যাঁ! ক্ষমতা ছিল সততার, স্বচ্ছতার, বস্তুনিষ্ঠতার, দৃঢ়তার, একাগ্রতার; ক্ষমতা ছিল সব অন্যায়কে আপসহীনভাবে রুখে দাঁড়ানোর। সাংবাদিক মানিক সাহার এসব ক্ষমতাকে সমাজের সব কুচক্রী মহল, ষড়যন্ত্রকারী, দখলবাজ, সন্ত্রাসীদের ভীত করে তুলেছিল। তাই তাকে চিরতরে থামিয়ে দেওয়ার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে দুর্বৃত্তরা। সেই ষড়যন্ত্রকে আরও সফল করতে সহায়তা করেছে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের ঘটনার বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি।
গণমাধ্যমকর্মীদের অধিকার রক্ষায় একুশে পদকপ্রাপ্ত এ সাংবাদিক আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়ন, খুলনা প্রেস ক্লাব এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মতো সংগঠনের। ছাত্রজীবনে বামপন্থি রাজনীতিতে যুক্ত হন মানিক সাহা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বিদ্রোহ করে গ্রেফতার হয়েছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাংবাদিকতা ও রাজনীতির পাশাপাশি ছিলেন সাংস্কৃতিক সংগঠক ও মানবাধিকারকর্মী। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে জীবনের শেষ ১০-১২ বছর সাংবাদিকতাই ছিল তার মূল পরিচয়। কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। সাংবাদিক মানিক সাহাকে হত্যার পর খুলনা শহরে ছুটে আসেন দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধিরা। ছুটে আসেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মানিক সাহা হত্যার ন্যায়বিচার হবে। কেবল মানিক সাহা হত্যা নয়, সব হত্যা-নির্যাতনের বিচার হবে। স্বাধীন দেশের গণমাধ্যমকর্মীরা কাজ করবেন পূর্ণ স্বাধীনতায়। এরই মধ্যে পেরিয়েছে ১৮ বছর। আজও ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় আছেন মানিক সাহার জীবনসঙ্গী ও সন্তানরা। ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে। উন্নয়নের ধারায় যুক্ত হয়েছে অনেক মাইলফলক। তবে থেমে থাকেনি দেশের গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন-হামলা-মামলা, এমনকি হত্যার ঘটনা। কেবল ২০২১ সালেই দেশে দেড় শতাধিক সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। আর গত দেড় দশকে ২৩ সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন; আহত হয়েছেন ৫৬১ জন। সাংবাদিক মানিক সাহা হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয় ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর। রায়ে ১১ আসামির মধ্যে ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের দণ্ড দেওয়া হয়। হত্যা মামলায় এসব আসামির সাজা হলেও বিস্ফোরক মামলায় কোনো আসামিকে সাজা দেওয়া যায়নি। এ রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছিল তার পরিবারসহ সুহৃদ সাংবাদিক সমাজ। মানিক সাহার রায়ের পর সারা দেশের সাংবাদিকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করেছেন। পুনঃতদন্তের দাবি জানিয়েছেন। সে দাবি ওই পর্যন্তই। বাস্তবে কেউ আর সেটা আমলে নেয়নি। বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলবে।
সাকিলা পারভীন : মানিক সাহার সহকর্মী
আপসহীনতাই কাল হয় তার
স্মরণ
সাকিলা পারভীন
১৫ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি। তখন বেলা দ্বিপ্রহর। খুলনা শহরের আহসান আহমেদ রোডের বাসায় জীবনসঙ্গীর সঙ্গে কন্যারা বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায়। পেশার পাশাপাশি সামাজিক কাজে সদা ব্যস্ত সাংবাদিক মানিক সাহা ঘরে ফিরে পরিবারের দায়িত্ব পালন করবেন। খুলনা প্রেস ক্লাব থেকে রওনা হয়েছিলেন রিকশায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আততায়ীর বোমা হামলায় থেমে যেতে হয় তাকে। মুহূর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্ক ছড়িয়ে যায় খুলনাসহ সারা দেশে। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে সারা দেশের সাংবাদিকসহ প্রগতিশীল সব রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন। ক্ষোভ, নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। মফস্বল শহরের একজন অতি সাধারণ জীবনযাপনকারী সাংবাদিকের কি এমন ক্ষমতা? হ্যাঁ! ক্ষমতা ছিল সততার, স্বচ্ছতার, বস্তুনিষ্ঠতার, দৃঢ়তার, একাগ্রতার; ক্ষমতা ছিল সব অন্যায়কে আপসহীনভাবে রুখে দাঁড়ানোর। সাংবাদিক মানিক সাহার এসব ক্ষমতাকে সমাজের সব কুচক্রী মহল, ষড়যন্ত্রকারী, দখলবাজ, সন্ত্রাসীদের ভীত করে তুলেছিল। তাই তাকে চিরতরে থামিয়ে দেওয়ার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে দুর্বৃত্তরা। সেই ষড়যন্ত্রকে আরও সফল করতে সহায়তা করেছে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের ঘটনার বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি।
গণমাধ্যমকর্মীদের অধিকার রক্ষায় একুশে পদকপ্রাপ্ত এ সাংবাদিক আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়ন, খুলনা প্রেস ক্লাব এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মতো সংগঠনের। ছাত্রজীবনে বামপন্থি রাজনীতিতে যুক্ত হন মানিক সাহা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বিদ্রোহ করে গ্রেফতার হয়েছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাংবাদিকতা ও রাজনীতির পাশাপাশি ছিলেন সাংস্কৃতিক সংগঠক ও মানবাধিকারকর্মী। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে জীবনের শেষ ১০-১২ বছর সাংবাদিকতাই ছিল তার মূল পরিচয়। কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। সাংবাদিক মানিক সাহাকে হত্যার পর খুলনা শহরে ছুটে আসেন দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধিরা। ছুটে আসেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মানিক সাহা হত্যার ন্যায়বিচার হবে। কেবল মানিক সাহা হত্যা নয়, সব হত্যা-নির্যাতনের বিচার হবে। স্বাধীন দেশের গণমাধ্যমকর্মীরা কাজ করবেন পূর্ণ স্বাধীনতায়। এরই মধ্যে পেরিয়েছে ১৮ বছর। আজও ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় আছেন মানিক সাহার জীবনসঙ্গী ও সন্তানরা। ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে। উন্নয়নের ধারায় যুক্ত হয়েছে অনেক মাইলফলক। তবে থেমে থাকেনি দেশের গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন-হামলা-মামলা, এমনকি হত্যার ঘটনা। কেবল ২০২১ সালেই দেশে দেড় শতাধিক সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। আর গত দেড় দশকে ২৩ সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন; আহত হয়েছেন ৫৬১ জন। সাংবাদিক মানিক সাহা হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয় ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর। রায়ে ১১ আসামির মধ্যে ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের দণ্ড দেওয়া হয়। হত্যা মামলায় এসব আসামির সাজা হলেও বিস্ফোরক মামলায় কোনো আসামিকে সাজা দেওয়া যায়নি। এ রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছিল তার পরিবারসহ সুহৃদ সাংবাদিক সমাজ। মানিক সাহার রায়ের পর সারা দেশের সাংবাদিকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করেছেন। পুনঃতদন্তের দাবি জানিয়েছেন। সে দাবি ওই পর্যন্তই। বাস্তবে কেউ আর সেটা আমলে নেয়নি। বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলবে।
সাকিলা পারভীন : মানিক সাহার সহকর্মী
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023