মধুসূদন ও বাংলা সাহিত্য
অসাধারণ প্রতিভাধর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম পলাশীর যুদ্ধের ৬৬ বছর পর, ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। এর মধ্যে ইংরেজরা বাংলার শাসনক্ষমতায় ভালোভাবেই জেঁকে বসেছিল। ইংরেজদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছুরই প্রভাব পড়তে শুরু করে বাঙালির জীবনে। এমনই এক সময়ে যশোরের কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্ম হয় মধুসূদনের। বাবা রাজ নারায়ণ দত্ত ও মা জাহ্নবী দেবী।
অতি শৈশবেই মায়ের কাছে রামায়ণ-মহাভারতের দীক্ষা পান মধুসূদন। তারপর গ্রাম্য পাঠশালায় অধ্যয়ন শেষ করে ভর্তি হন কলকাতার হিন্দু কলেজে। সেখানে ডিরোজিও ও রিচার্ডসন নামের দুজন শিক্ষকের প্রভাব পড়তে শুরু করে মধুসূদনের জীবনে। ডিরোজিও তার ছাত্রদের ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে আলোচনা করে নিজেদের কর্তব্যপথ নির্ণয় করার শিক্ষা দেন। আর রিচার্ডসন ছিলেন মধুসূদনের আদর্শস্বরূপ। ইংরেজি সাহিত্যের এ অধ্যাপককে তার এতটাই পছন্দ ছিল যে তিনি সব সময় তাকে অনুকরণের চেষ্টা করতেন।
কলেজে পড়ার সময় মধুসূদন ইংরেজি কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং বিদেশে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। ১৮৪৩ সালে তিনি পিতৃধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। এ কারণে তাকে হিন্দু কলেজ পরিত্যাগ করে বিশপ্স কলেজে ভর্তি হতে হয়। ধর্মান্তরিত হওয়ায় বাবা তাকে অর্থ প্রদান বন্ধ করে দেন। কিছুদিনের মধ্যেই কবি মাদ্রাজে স্থানান্তরিত হন এবং সেখানে গিয়ে তীব্র অর্থ সংকটে পড়েন। অর্থ সংকট কাটাতে প্রথমে একটি অনাথ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা ও একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। মাদ্রাজে থাকাকালীনই কবি বিয়ে করেন রেবেকা নামের এক তরুণীকে। সম্পর্কটি বেশিদিন স্থায়ী না হলে ১৮৫৬ সালে তিনি বিয়ে করেন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের এক অধ্যাপকের কন্যা হেনরিয়েটাকে। এরই মধ্যে বাঙালি বন্ধুদের অনুরোধে তিনি বাংলা সাহিত্যেও মনোনিবেশ করেন। প্রকাশিত হয় মহাভারতের দেবযানী-যযাতি উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয় মধুসূদনের দ্বিতীয় নাটক ‘পদ্মাবতী’। পরের বছরই প্রকাশিত হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’। রাজপুত ইতিহাসের বিয়োগান্তক ঘটনা অবলম্বনে রচিত নাটকটি মধুসূদনকে অনন্য মর্যাদা এনে দেয়। তাছাড়া তিনি ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ নামে দুটি প্রহসন রচনা করেন। ১৮৬১ সালে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত তার অমর মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশিত হয়। রামায়ণের রাম-রাবণের কাহিনি অবলম্বনে ইউরোপীয় মহাকাব্যের সৌন্দর্য ও দীপ্ত শৌর্যের রং মাখিয়ে লেখা হয়েছে কাব্যটি।
তখনো কবির বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। অবশেষে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইউরোপে পাড়ি জমান তিনি। সেখানে গিয়ে বর্ণবাদ আর নিদারুণ অর্থ কষ্টে জর্জরিত হন। সে সময় ফ্রান্সে বসেও কবি দেশের প্রতি টান অনুভব করেন। শৈশবের স্মৃতিবিধুর কপোতাক্ষ নদকে নিয়ে লেখেন-‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!/ সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।’ মধুসূদনের শেষ জীবনও ছিল চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যে ভরা। অর্থকষ্টে জর্জরিত মধুসূদন ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন মৃত্যুবরণ করেন।
অমিত হাসান : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা কলেজ
amithasankiri@gmail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
জন্মদিন
মধুসূদন ও বাংলা সাহিত্য
অসাধারণ প্রতিভাধর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম পলাশীর যুদ্ধের ৬৬ বছর পর, ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। এর মধ্যে ইংরেজরা বাংলার শাসনক্ষমতায় ভালোভাবেই জেঁকে বসেছিল। ইংরেজদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছুরই প্রভাব পড়তে শুরু করে বাঙালির জীবনে। এমনই এক সময়ে যশোরের কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্ম হয় মধুসূদনের। বাবা রাজ নারায়ণ দত্ত ও মা জাহ্নবী দেবী।
অতি শৈশবেই মায়ের কাছে রামায়ণ-মহাভারতের দীক্ষা পান মধুসূদন। তারপর গ্রাম্য পাঠশালায় অধ্যয়ন শেষ করে ভর্তি হন কলকাতার হিন্দু কলেজে। সেখানে ডিরোজিও ও রিচার্ডসন নামের দুজন শিক্ষকের প্রভাব পড়তে শুরু করে মধুসূদনের জীবনে। ডিরোজিও তার ছাত্রদের ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে আলোচনা করে নিজেদের কর্তব্যপথ নির্ণয় করার শিক্ষা দেন। আর রিচার্ডসন ছিলেন মধুসূদনের আদর্শস্বরূপ। ইংরেজি সাহিত্যের এ অধ্যাপককে তার এতটাই পছন্দ ছিল যে তিনি সব সময় তাকে অনুকরণের চেষ্টা করতেন।
কলেজে পড়ার সময় মধুসূদন ইংরেজি কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং বিদেশে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। ১৮৪৩ সালে তিনি পিতৃধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। এ কারণে তাকে হিন্দু কলেজ পরিত্যাগ করে বিশপ্স কলেজে ভর্তি হতে হয়। ধর্মান্তরিত হওয়ায় বাবা তাকে অর্থ প্রদান বন্ধ করে দেন। কিছুদিনের মধ্যেই কবি মাদ্রাজে স্থানান্তরিত হন এবং সেখানে গিয়ে তীব্র অর্থ সংকটে পড়েন। অর্থ সংকট কাটাতে প্রথমে একটি অনাথ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা ও একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। মাদ্রাজে থাকাকালীনই কবি বিয়ে করেন রেবেকা নামের এক তরুণীকে। সম্পর্কটি বেশিদিন স্থায়ী না হলে ১৮৫৬ সালে তিনি বিয়ে করেন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের এক অধ্যাপকের কন্যা হেনরিয়েটাকে। এরই মধ্যে বাঙালি বন্ধুদের অনুরোধে তিনি বাংলা সাহিত্যেও মনোনিবেশ করেন। প্রকাশিত হয় মহাভারতের দেবযানী-যযাতি উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয় মধুসূদনের দ্বিতীয় নাটক ‘পদ্মাবতী’। পরের বছরই প্রকাশিত হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’। রাজপুত ইতিহাসের বিয়োগান্তক ঘটনা অবলম্বনে রচিত নাটকটি মধুসূদনকে অনন্য মর্যাদা এনে দেয়। তাছাড়া তিনি ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ নামে দুটি প্রহসন রচনা করেন। ১৮৬১ সালে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত তার অমর মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশিত হয়। রামায়ণের রাম-রাবণের কাহিনি অবলম্বনে ইউরোপীয় মহাকাব্যের সৌন্দর্য ও দীপ্ত শৌর্যের রং মাখিয়ে লেখা হয়েছে কাব্যটি।
তখনো কবির বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। অবশেষে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইউরোপে পাড়ি জমান তিনি। সেখানে গিয়ে বর্ণবাদ আর নিদারুণ অর্থ কষ্টে জর্জরিত হন। সে সময় ফ্রান্সে বসেও কবি দেশের প্রতি টান অনুভব করেন। শৈশবের স্মৃতিবিধুর কপোতাক্ষ নদকে নিয়ে লেখেন-‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!/ সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।’ মধুসূদনের শেষ জীবনও ছিল চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যে ভরা। অর্থকষ্টে জর্জরিত মধুসূদন ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন মৃত্যুবরণ করেন।
অমিত হাসান : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা কলেজ
amithasankiri@gmail.com