বেঙ্গল গেজেটের জন্মদিন
আজ ২৯ জানুয়ারি। ১৭৮০ সালের এই দিনে ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্রের যিনি শুভ সূচনা করেছিলেন, তিনি হলেন জেমস অগাস্টাস হিকি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেটে’র সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন তিনি। সংবাদপত্রে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন, নিরপেক্ষ ও সাহসী এক পুরুষ। হিকি ছিলেন জাতিতে ইংরেজ। ১৭৭৪ সালে তিনি ভাগ্যান্বেষণে ইংল্যান্ডের বাকিংহাম থেকে ভারতের হিজলিতে আসেন। কর্মজীবনের প্রথমে তিনি জাহাজের ব্যবসা শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত এ ব্যবসায় বড় ধরনের মার খেয়ে খবরের কাগজ বের করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্তের ফসল হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’।
ট্যাবলয়েড সাইজের দুই পাতার ইংরেজি ভাষার সাপ্তাহিক এ পত্রিকাটি জনসাধারণের কাছে ‘হিকির গেজেট’ নামেই সমধিক পরিচিত ছিল। পত্রিকাটির অধিকাংশ জায়গাজুড়ে থাকত বিজ্ঞাপন। প্রথম সংখ্যায় সবার নজর কাড়ে ‘পোয়েটস কর্নার’ বা কবিদের জন্য বিভাগটি। প্রেম-ভালোবাসা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং এ ধরনের বিমূর্ত বিষয়সহ সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে এ পত্রিকায় কবিতা লিখতেন স্বয়ং হিকি এবং আরও কয়েকজন। হিকির গেজেটের পাঠক শ্রেণির অধিকাংশই ছিল বেসরকারি বণিক এবং ভারতবর্ষে বসবাসরত ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা। এতে পাঠকদের চিঠি প্রকাশিত হতো নিয়মিত। এসব চিঠিতে যেমন থাকত কলকতাসহ বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী ইউরোপীয়দের নানা অভাব-অভিযোগ ও অসুবিধার কথা, তেমনি থাকত প্রশাসনের দুর্নীতি ও অন্যায়ের খবরও। এমনি করে রোহিলা যুদ্ধ, মারাঠা যুদ্ধ এবং তৎকালীন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের ভুল নীতির কঠোর সমালোচনা করে চিঠি ও খবর প্রকাশিত হতে থাকে এ গেজেটে। তাছাড়া সেনারা কীভাবে প্রবঞ্চিত হচ্ছে, সরকারি সিক্কা মুদ্রা বাতিলের ফলে নেলদেনে কী অসুবিধার সৃষ্টি হল, আদালতে কী ধরনের বেআইনি কাজকর্ম চলছে ইত্যাদি বিষয়ের ওপরও খবর প্রকাশিত হতো হিকির গেজেটে।
পত্রিকাটিতে বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও সাহসী সংবাদ প্রকাশের ফলে হিকির গুণগ্রাহীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি তার শত্রুও বাড়তে থাকে। সরকারের অপকর্মের কঠোর সমালোচনা করায় হিকিকে জব্দ করার জাল যতই বিস্তৃত হতে থাকল, হিকিও ততই বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। বিশেষ করে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস আর সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইলিজা ইম্পে প্রচণ্ডভাবে ক্ষেপে যান হিকির ওপর এবং তাকে জব্দ করার উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। হেস্টিংস একের পর এক মামলা করতে থাকেন হিকির বিরুদ্ধে। এক সময় তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। হেস্টিংসের ইঙ্গিতেই ১৭৮২ সালের মার্চে প্রধান বিচারপতি ইম্পে বাজেয়াপ্ত করান হিকির প্রেস, ছাপার কাগজ, যন্ত্রপাতিসহ সবকিছু। ফলে বন্ধ হয়ে যায় হিকির গেজেট। আর এভাবেই অস্তমিত হয়ে যায় ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের রক্তিম সূর্য। এক সময় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে নিজ মাতৃভূমি ব্রিটেনে যাওয়ার অর্থ সংগ্রহের জন্য চীনের উদ্দেশে জাহাজে যাত্রা করেন হিকি। কিন্তু তার আর চীনে যাওয়া হয়নি। এর আগেই হিকি হয়ে যান সংবাদ। ১৮০২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘ক্যালকাটা গেজেটে’ প্রকাশিত হয় ছোট্ট একটি খবর- ‘চীনে যাওয়ার পথে সমুদ্রে জাহাজের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন জেমস অগাস্টাস হিকি।’
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বেঙ্গল গেজেটের জন্মদিন
আজ ২৯ জানুয়ারি। ১৭৮০ সালের এই দিনে ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্রের যিনি শুভ সূচনা করেছিলেন, তিনি হলেন জেমস অগাস্টাস হিকি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেটে’র সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন তিনি। সংবাদপত্রে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন, নিরপেক্ষ ও সাহসী এক পুরুষ। হিকি ছিলেন জাতিতে ইংরেজ। ১৭৭৪ সালে তিনি ভাগ্যান্বেষণে ইংল্যান্ডের বাকিংহাম থেকে ভারতের হিজলিতে আসেন। কর্মজীবনের প্রথমে তিনি জাহাজের ব্যবসা শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত এ ব্যবসায় বড় ধরনের মার খেয়ে খবরের কাগজ বের করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্তের ফসল হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’।
ট্যাবলয়েড সাইজের দুই পাতার ইংরেজি ভাষার সাপ্তাহিক এ পত্রিকাটি জনসাধারণের কাছে ‘হিকির গেজেট’ নামেই সমধিক পরিচিত ছিল। পত্রিকাটির অধিকাংশ জায়গাজুড়ে থাকত বিজ্ঞাপন। প্রথম সংখ্যায় সবার নজর কাড়ে ‘পোয়েটস কর্নার’ বা কবিদের জন্য বিভাগটি। প্রেম-ভালোবাসা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং এ ধরনের বিমূর্ত বিষয়সহ সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে এ পত্রিকায় কবিতা লিখতেন স্বয়ং হিকি এবং আরও কয়েকজন। হিকির গেজেটের পাঠক শ্রেণির অধিকাংশই ছিল বেসরকারি বণিক এবং ভারতবর্ষে বসবাসরত ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা। এতে পাঠকদের চিঠি প্রকাশিত হতো নিয়মিত। এসব চিঠিতে যেমন থাকত কলকতাসহ বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী ইউরোপীয়দের নানা অভাব-অভিযোগ ও অসুবিধার কথা, তেমনি থাকত প্রশাসনের দুর্নীতি ও অন্যায়ের খবরও। এমনি করে রোহিলা যুদ্ধ, মারাঠা যুদ্ধ এবং তৎকালীন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের ভুল নীতির কঠোর সমালোচনা করে চিঠি ও খবর প্রকাশিত হতে থাকে এ গেজেটে। তাছাড়া সেনারা কীভাবে প্রবঞ্চিত হচ্ছে, সরকারি সিক্কা মুদ্রা বাতিলের ফলে নেলদেনে কী অসুবিধার সৃষ্টি হল, আদালতে কী ধরনের বেআইনি কাজকর্ম চলছে ইত্যাদি বিষয়ের ওপরও খবর প্রকাশিত হতো হিকির গেজেটে।
পত্রিকাটিতে বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও সাহসী সংবাদ প্রকাশের ফলে হিকির গুণগ্রাহীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি তার শত্রুও বাড়তে থাকে। সরকারের অপকর্মের কঠোর সমালোচনা করায় হিকিকে জব্দ করার জাল যতই বিস্তৃত হতে থাকল, হিকিও ততই বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। বিশেষ করে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস আর সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইলিজা ইম্পে প্রচণ্ডভাবে ক্ষেপে যান হিকির ওপর এবং তাকে জব্দ করার উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। হেস্টিংস একের পর এক মামলা করতে থাকেন হিকির বিরুদ্ধে। এক সময় তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। হেস্টিংসের ইঙ্গিতেই ১৭৮২ সালের মার্চে প্রধান বিচারপতি ইম্পে বাজেয়াপ্ত করান হিকির প্রেস, ছাপার কাগজ, যন্ত্রপাতিসহ সবকিছু। ফলে বন্ধ হয়ে যায় হিকির গেজেট। আর এভাবেই অস্তমিত হয়ে যায় ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের রক্তিম সূর্য। এক সময় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে নিজ মাতৃভূমি ব্রিটেনে যাওয়ার অর্থ সংগ্রহের জন্য চীনের উদ্দেশে জাহাজে যাত্রা করেন হিকি। কিন্তু তার আর চীনে যাওয়া হয়নি। এর আগেই হিকি হয়ে যান সংবাদ। ১৮০২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘ক্যালকাটা গেজেটে’ প্রকাশিত হয় ছোট্ট একটি খবর- ‘চীনে যাওয়ার পথে সমুদ্রে জাহাজের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন জেমস অগাস্টাস হিকি।’
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com