চাপের মুখে বৈশ্বিক অর্থনীতি
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উন্নয়নশীল বিশ্বের আঞ্চলিক শক্তিগুলো বা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তিগুলো কূটনৈতিক দিক থেকে একটা চাপে পড়বে। তবে এ চাপে পড়ার কারণে তাদের যে স্নায়ুযুদ্ধের যুগের মতোই আচরণ করতে হবে তা নয়। কারণ তাদের স্বকীয় পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখারও একটা সুযোগ আছে। সেই সুযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা হয়তো তারা করবে। তবে এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব অর্থনীতির যে গতি-প্রকৃতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটি অবশ্যই উদ্বেগের। এ মুহূর্তে যুদ্ধের টেনশন এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতির রূপরেখা ক্রমেই পালটে যাচ্ছে। তবে অর্থনৈতিক রূপরেখা পালটে গিয়ে বিশ্ব কী ধরনের ব্যবস্থার দিকে যাবে, তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভেতরে বিভিন্ন দেশের যে আধিপত্য, সে আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তবে অতীতের মতো বিশ্ব অর্থনীতিকে পশ্চিমা বিশ্বের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়া অথবা কোনো বিশেষ কয়েকটি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়ার কাজটি সহজ হবে না। সেই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির সামনে একটা বিকল্প ব্যবস্থাও হয়তো আমরা দেখতে পাব। একদিকে পশ্চিমা বিশ্বের জোট, অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের একটি জোটের প্রভাব অর্থনীতির ক্ষেত্রেও দেখা যাবে।
অপরদিকে সামরিক দিক থেকে বিশ্ব অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অস্ত্র তৈরি এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে। বিভিন্ন দেশে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বে নিরাপত্তার বিষয়গুলো আপাতত অনেক গুরুত্ব পাবে। নিরাপত্তার বিষয়গুলো গুরুত্ব পাওয়ার কারণে বিশ্বে দারিদ্র্য, বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং আত্মপরিচয়-এ বিষয়গুলো একটা চাপের মুখে পড়বে।
সব মিলে আমার কাছে মনে হয়, আমরা যে একটা ট্রাঞ্জিশন বা উত্তরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলাম, সেটা আরও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে এবং বিশ্বের মেরুকরণের প্রবণতাটা আরও শক্তিশালী হচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে যে রাষ্ট্রগুলো প্রধান ভূমিকা রাখছে, সেগুলো কতটা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে, তার ওপর অনেকটা নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর গতিপথ কোন দিকে যাবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের দূরত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আমার মনে হয়, এ যুদ্ধে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই একটা চাপের মুখে পড়লেও তারা একটা সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে। এর মাঝখানে কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশলগুলো যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তির বিশ্বব্যবস্থায় একটা ভূমিকা রাখার সুযোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির যে এক ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিজস্ব শক্তি আছে, এর মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তাদের একটা ভূমিকা রাখার সুযোগ তারা পেতে পারে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলো যখন রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে ক্রমাগত বিরোধে লিপ্ত হবে এবং পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসাবে তারা আরও বেশি সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করবে এবং এক ধরনের মুখোমুখি অবস্থানে থাকবে, তখন সেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো ওই দুই জোটের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। পাশাপাশি তারা এ ব্যবস্থার ভেতরে তাদের সেই জায়গাটা আরও বেশি স্পষ্ট করার চেষ্টা করতে পারবে। এটা নির্ভর করবে ওই দেশগুলোর ভেতরে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতটা পরিপক্ব এবং কতটা সুদূরপ্রসারী চিন্তা তারা করতে পারে, তার ওপর। সেই সঙ্গে তাদের নিজস্ব শক্তির বিষয়টি তো আছেই।
২.
করোনা মহামারির পর বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে শ্রীলংকায় এক ধরনের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। আর এ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শ্রীলংকার ভেতরে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য শ্রীলংকার এ সমস্যাগুলো আগে থেকেই ছিল। এটা হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। অর্থনেতিক সংকটের কারণে রাজধানী কলম্বোতে এপ্রিলের শুরুতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এ বিক্ষোভ বাড়তে বাড়তে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। খাবার জোগাড়ে ব্যয় বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এ কারণে অনেককেই অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। ওষুধের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। জনতার বিক্ষোভে গুলি চালিয়ে একজনকে হত্যাও করেছে প্রশাসন। এতে করে জনগণের মাঝে ক্ষোভের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। গণদাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। ক্রমান্বয়ে প্রায় সব মন্ত্রীই পদত্যাগ করেছেন, সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন সরকারদলীয় কয়েকজন এমপিও।
কার্যত শুকিয়ে ‘শূন্য’ হয়েছে শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দেশটি এমনিতেই আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, তার ওপর রিজার্ভ শূন্যতার কারণে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানিও করতে পারছে না। বলতে গেলে প্রধান খাদ্য ও জ্বালানির জন্য আর কোনো অর্থ তাদের হাতে নেই। ফলে মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়ে শ্রীলংকা। তাদের এ বিপর্যয়ের পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হলো, শ্রীলংকার সরকার করোনা মহামারি এড়াতে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম বৃহৎ খাত পর্যটন বন্ধ করে দেয়। সরকারের দাবি অনুযায়ী, তিন বছর আগে গির্জাগুলোতে সিরিজ বোমা হামলার কারণেও পর্যটকের সংখ্যা কমতে শুরু করেছিল। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, এ সংকটের জন্য দায়ী অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। পণ্য রপ্তানিতেও ভাটা পড়ে তাদের। এর ফলে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ায় কমতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সমালোচকরা বলেছেন, অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে চীনের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া ২০১৯ সালে মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্ষমতায় আসার পর বড় আকারের কর কমানোর প্রস্তাব দেওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা কেনার টাকাও কমে গেছে তাদের। প্রেসিডেন্ট এবং তার অর্থমন্ত্রী আলি সাবরি এখন স্বীকার করছেন, কর কমানো একটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ২০২১ সালের প্রথম থেকে দেশটিতে মুদ্রা ঘাটতিই কাল হয়ে দাঁড়ায়।
শ্রীলংকা সরকারের আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত দেশটিতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবে দেখা দেয়। সেটা হলো কৃষিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে জৈব সার ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত। সরকার বিদেশ থেকে রাসায়নিক সারের আমদানি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়। এর ফলে কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মুখ থুবড়ে পড়ে দেশটির কৃষিব্যবস্থা। এ কারণে খাদ্য ঘাটতি চরম আকার ধারণ করে।
শ্রীলংকার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। পাঁচবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী শ্রীলংকার ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা। তিনি শ্রীলংকার এই মহাদুর্যোগকে মোকাবিলা করে দেশকে কতদূর এগিয়ে নিতে পারবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
৩.
করোনার নেতিবাচক প্রভাব এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। বৈশ্বিক অস্থিতিশীল অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিও অভ্যন্তরীণভাবে চাপে রয়েছে। সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও রয়েছে প্রচণ্ড চাপে। দেশে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। সব মিলে চতুর্মুখী চাপে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। করোনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিনিয়োগে চলছে স্থবিরতা। নানামুখী অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলায় সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেমন চাহিদার বিপরীতে ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে কম প্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সুনির্দিষ্ট কয়েকটি খাতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির দেনা পরিশোধ ছাড়া অন্য কোনো খাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দেশে দেশে এ ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকাতে খুব শিগগির রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি দরকার। কিন্তু আমরা সেরকম কোনো পূর্বাভাস পাচ্ছি না। আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি সেটা হচ্ছে, মাঠ পর্যায়ের আচরণে অনেকটা যুদ্ধ এবং পরস্পরকে মোকাবিলা করার একটা প্রয়াস। অন্যদিকে শান্তি আলোচনা বা এর জন্য কূটনৈতিক আলোচনা যেটা হচ্ছে, তা এক ধরনের আইওয়াশ বলা যায়। ফলে এ পরিস্থিতি হয়তো আরও দীর্ঘদিন থাকবে। তারপরও একটা পর্যায়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে বা যুদ্ধবিরতি হবে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে ধরনের ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে অনেকটা বেগ পেতে হবে বিশ্বকে। যুদ্ধের ক্ষত পূরণ বা সেরকম একটি পরিবেশ তৈরি করতে হলে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে শক্তিশালী নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক দক্ষতা বাড়াতে হবে।
ড. দেলোয়ার হোসেন : সদস্য, সরকারি কর্ম কমিশন; অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
চাপের মুখে বৈশ্বিক অর্থনীতি
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উন্নয়নশীল বিশ্বের আঞ্চলিক শক্তিগুলো বা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তিগুলো কূটনৈতিক দিক থেকে একটা চাপে পড়বে। তবে এ চাপে পড়ার কারণে তাদের যে স্নায়ুযুদ্ধের যুগের মতোই আচরণ করতে হবে তা নয়। কারণ তাদের স্বকীয় পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখারও একটা সুযোগ আছে। সেই সুযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা হয়তো তারা করবে। তবে এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব অর্থনীতির যে গতি-প্রকৃতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটি অবশ্যই উদ্বেগের। এ মুহূর্তে যুদ্ধের টেনশন এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতির রূপরেখা ক্রমেই পালটে যাচ্ছে। তবে অর্থনৈতিক রূপরেখা পালটে গিয়ে বিশ্ব কী ধরনের ব্যবস্থার দিকে যাবে, তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভেতরে বিভিন্ন দেশের যে আধিপত্য, সে আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তবে অতীতের মতো বিশ্ব অর্থনীতিকে পশ্চিমা বিশ্বের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়া অথবা কোনো বিশেষ কয়েকটি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়ার কাজটি সহজ হবে না। সেই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির সামনে একটা বিকল্প ব্যবস্থাও হয়তো আমরা দেখতে পাব। একদিকে পশ্চিমা বিশ্বের জোট, অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের একটি জোটের প্রভাব অর্থনীতির ক্ষেত্রেও দেখা যাবে।
অপরদিকে সামরিক দিক থেকে বিশ্ব অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অস্ত্র তৈরি এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে। বিভিন্ন দেশে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বে নিরাপত্তার বিষয়গুলো আপাতত অনেক গুরুত্ব পাবে। নিরাপত্তার বিষয়গুলো গুরুত্ব পাওয়ার কারণে বিশ্বে দারিদ্র্য, বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং আত্মপরিচয়-এ বিষয়গুলো একটা চাপের মুখে পড়বে।
সব মিলে আমার কাছে মনে হয়, আমরা যে একটা ট্রাঞ্জিশন বা উত্তরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলাম, সেটা আরও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে এবং বিশ্বের মেরুকরণের প্রবণতাটা আরও শক্তিশালী হচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে যে রাষ্ট্রগুলো প্রধান ভূমিকা রাখছে, সেগুলো কতটা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে, তার ওপর অনেকটা নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর গতিপথ কোন দিকে যাবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের দূরত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আমার মনে হয়, এ যুদ্ধে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই একটা চাপের মুখে পড়লেও তারা একটা সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে। এর মাঝখানে কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশলগুলো যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তির বিশ্বব্যবস্থায় একটা ভূমিকা রাখার সুযোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির যে এক ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিজস্ব শক্তি আছে, এর মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তাদের একটা ভূমিকা রাখার সুযোগ তারা পেতে পারে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলো যখন রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে ক্রমাগত বিরোধে লিপ্ত হবে এবং পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসাবে তারা আরও বেশি সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করবে এবং এক ধরনের মুখোমুখি অবস্থানে থাকবে, তখন সেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো ওই দুই জোটের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। পাশাপাশি তারা এ ব্যবস্থার ভেতরে তাদের সেই জায়গাটা আরও বেশি স্পষ্ট করার চেষ্টা করতে পারবে। এটা নির্ভর করবে ওই দেশগুলোর ভেতরে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতটা পরিপক্ব এবং কতটা সুদূরপ্রসারী চিন্তা তারা করতে পারে, তার ওপর। সেই সঙ্গে তাদের নিজস্ব শক্তির বিষয়টি তো আছেই।
২.
করোনা মহামারির পর বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে শ্রীলংকায় এক ধরনের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। আর এ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শ্রীলংকার ভেতরে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য শ্রীলংকার এ সমস্যাগুলো আগে থেকেই ছিল। এটা হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। অর্থনেতিক সংকটের কারণে রাজধানী কলম্বোতে এপ্রিলের শুরুতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এ বিক্ষোভ বাড়তে বাড়তে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। খাবার জোগাড়ে ব্যয় বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এ কারণে অনেককেই অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। ওষুধের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। জনতার বিক্ষোভে গুলি চালিয়ে একজনকে হত্যাও করেছে প্রশাসন। এতে করে জনগণের মাঝে ক্ষোভের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। গণদাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। ক্রমান্বয়ে প্রায় সব মন্ত্রীই পদত্যাগ করেছেন, সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন সরকারদলীয় কয়েকজন এমপিও।
কার্যত শুকিয়ে ‘শূন্য’ হয়েছে শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দেশটি এমনিতেই আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, তার ওপর রিজার্ভ শূন্যতার কারণে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানিও করতে পারছে না। বলতে গেলে প্রধান খাদ্য ও জ্বালানির জন্য আর কোনো অর্থ তাদের হাতে নেই। ফলে মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়ে শ্রীলংকা। তাদের এ বিপর্যয়ের পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হলো, শ্রীলংকার সরকার করোনা মহামারি এড়াতে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম বৃহৎ খাত পর্যটন বন্ধ করে দেয়। সরকারের দাবি অনুযায়ী, তিন বছর আগে গির্জাগুলোতে সিরিজ বোমা হামলার কারণেও পর্যটকের সংখ্যা কমতে শুরু করেছিল। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, এ সংকটের জন্য দায়ী অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। পণ্য রপ্তানিতেও ভাটা পড়ে তাদের। এর ফলে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ায় কমতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সমালোচকরা বলেছেন, অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে চীনের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া ২০১৯ সালে মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্ষমতায় আসার পর বড় আকারের কর কমানোর প্রস্তাব দেওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা কেনার টাকাও কমে গেছে তাদের। প্রেসিডেন্ট এবং তার অর্থমন্ত্রী আলি সাবরি এখন স্বীকার করছেন, কর কমানো একটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ২০২১ সালের প্রথম থেকে দেশটিতে মুদ্রা ঘাটতিই কাল হয়ে দাঁড়ায়।
শ্রীলংকা সরকারের আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত দেশটিতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবে দেখা দেয়। সেটা হলো কৃষিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে জৈব সার ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত। সরকার বিদেশ থেকে রাসায়নিক সারের আমদানি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়। এর ফলে কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মুখ থুবড়ে পড়ে দেশটির কৃষিব্যবস্থা। এ কারণে খাদ্য ঘাটতি চরম আকার ধারণ করে।
শ্রীলংকার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। পাঁচবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী শ্রীলংকার ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা। তিনি শ্রীলংকার এই মহাদুর্যোগকে মোকাবিলা করে দেশকে কতদূর এগিয়ে নিতে পারবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
৩.
করোনার নেতিবাচক প্রভাব এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। বৈশ্বিক অস্থিতিশীল অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিও অভ্যন্তরীণভাবে চাপে রয়েছে। সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও রয়েছে প্রচণ্ড চাপে। দেশে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। সব মিলে চতুর্মুখী চাপে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। করোনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিনিয়োগে চলছে স্থবিরতা। নানামুখী অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলায় সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেমন চাহিদার বিপরীতে ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে কম প্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সুনির্দিষ্ট কয়েকটি খাতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির দেনা পরিশোধ ছাড়া অন্য কোনো খাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দেশে দেশে এ ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকাতে খুব শিগগির রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি দরকার। কিন্তু আমরা সেরকম কোনো পূর্বাভাস পাচ্ছি না। আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি সেটা হচ্ছে, মাঠ পর্যায়ের আচরণে অনেকটা যুদ্ধ এবং পরস্পরকে মোকাবিলা করার একটা প্রয়াস। অন্যদিকে শান্তি আলোচনা বা এর জন্য কূটনৈতিক আলোচনা যেটা হচ্ছে, তা এক ধরনের আইওয়াশ বলা যায়। ফলে এ পরিস্থিতি হয়তো আরও দীর্ঘদিন থাকবে। তারপরও একটা পর্যায়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে বা যুদ্ধবিরতি হবে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে ধরনের ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে অনেকটা বেগ পেতে হবে বিশ্বকে। যুদ্ধের ক্ষত পূরণ বা সেরকম একটি পরিবেশ তৈরি করতে হলে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে শক্তিশালী নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক দক্ষতা বাড়াতে হবে।
ড. দেলোয়ার হোসেন : সদস্য, সরকারি কর্ম কমিশন; অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়