অনেক কিছুই করার আছে আওয়ামী লীগের
দেশে কাঁপন লেগেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কোনো কোনো কমিশনার মুখর হয়ে উঠেছেন। তারা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন দলের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সব দলকে নির্বাচনি প্রতিযোগিতায় মাঠে নামাতে ইসির প্রচেষ্টা আন্তরিক বলেই মনে হয়। এখানে একটা অলঙ্ঘনীয় ‘কিন্তু’ আছে। ‘সব দল’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? কোনো অবস্থায়ই স্বাধীনতাবিরোধী, তাদের সমর্থক এবং তাদের সমর্থিত কোনো দলকে নামে বা বেনামে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না। রুখতে হবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকেও।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের পর সবার দৃষ্টি সেদিকে-তাদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে, এ প্রশ্নও অনেকের মনে। কুমিল্লা পৌর করপোরেশনের নির্বাচন ছিল তাদের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা। প্রথমদিকে ইসির ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তারা সব দলকে আশ্বস্ত করলেন এবং জনৈক সংসদ-সদস্যের তৎপরতা জনস্বার্থ ও নির্বাচনি নীতিমালার বিরোধী হওয়ায় তাকে নির্বাচনি এলাকার বাইরে থাকার নির্দেশ দিলেন। সেই সংসদ-সদস্য ইসির নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে এলাকাতেই থেকে গেলেন এবং নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়তে লাগলেন আর ওস্তাদের মার শেষ রাতে দেখিয়ে দিলেন। কুমিল্লার একজন আওয়ামীপন্থি অধ্যক্ষ জানিয়েছিলেন সেখানকার মেয়রপ্রার্থী মনোনয়নে আওয়ামী লীগ যোগ্যতর প্রার্থীকে অবহেলা করেছে। দলকে হয়তো এর খেসারত দিতে হবে। তবে আশার কথা, বিএনপির তথাকথিত বহিষ্কৃত দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে নির্বাচনের ফল আওয়ামী লীগের অনুকূলে আসবে। আলোচ্য নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার প্রথম থেকেই দেখছিলাম প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই বিএনপির বহিষ্কৃত প্রার্থী উল্লেখযোগ্য ভোটে এগিয়ে যাচ্ছেন, দ্বিতীয় স্থানে আওয়ামী লীগ এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছেন বিএনপির অপর বিদ্রোহী প্রার্থী। নৌকার ভরাডুবি যখন আসন্ন, শেষ ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ৩৩৭ ভোটের ব্যবধানে জয়ী ঘোষণা করা হলো। প্রাগুক্ত অধ্যক্ষ মহোদয় জানালেন শেষ মুহূর্তে ‘বাহারি খেলের’ মাজেজা। প্রকৃত ফলাফল ঘোষিত হলে আওয়ামী লীগই উপকৃত হতো। প্রথমত ‘দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়’-এ বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য এবং দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল হতো। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ‘মেরুদণ্ড শক্ত রেখে দায়িত্ব পালনের’ প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও আমরা দেখেছি ইসির অসহায়তা। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে তারা প্রমাণ করলেন ‘চাকরে আর কুকুরে কোনোই পার্থক্য নেই, হুকুম করিলেই দৌড়াইতে হয়।’ এ নির্বাচন বিষয়ে কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তমের একাধিক প্রশ্নের সদুত্তর সিইসি দিতে পারেননি।
১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে মতবিনিময়ের জন্য শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমনা স্বল্পসংখ্যক শিক্ষকের সঙ্গে আওয়ামী লীগ অফিসে মিলিত হন। বক্তব্যের সূচনাতেই বলেছিলাম, ‘আমার রক্তে-মাংসে, চিন্তাচেতনায় আওয়ামী লীগ, আমি আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগারদের বিশ্বাস করি না, তাদের ওপর আস্থা নেই।’ একসময় রাজনীতি ছিল সেবা, রাজনীতিকরা ছিলেন জনগণ তথা দেশের সেবক। এখন রাজনীতি পেশা। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঠিকাদারি, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদির মতো রাজনীতি এখন পেশায় পরিণত হয়েছে। মন্ত্রী-এমপিদের বিত্তবৈভরের পরিসংখ্যান নিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ক্ষমতায় আসার আগে ও পরে কে কত সম্পদের মালিক ছিলেন ও হয়েছেন-এ হিসাব নেওয়াটা জটিল নয়। ছাত্রনেতা-যুবনেতা-শ্রমিক নেতাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
দ্বাদশ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের উদ্দেশে আমার কিছু বক্তব্য রয়েছে। কথাগুলো হিজরতকারী এবং শুধু দলীয় জার্সিধারী আওয়ামী লীগারদের মনঃপূত হবে না। বঙ্গবন্ধু যে চার স্তরের ওপর দেশকে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, এর কোনোটিকেই ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করা যাবে না। সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হবে। সংখ্যালঘুরা কেন মাতৃভূমি ত্যাগ করছে? তাদের বাড়িঘরে কেন হামলা-ভাঙচুর হয়? তাদের পরিত্যক্ত বিষয়-সম্পত্তি কারা ভোগ করছে? ২০১২ সালে নেত্রকোনায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্বাধীনতা সপ্তাহের অনুষ্ঠানে নেতাদের উদ্দেশে বলেছিলাম, “শুধু দলীয় জার্সি পরিধান এবং মন জোগানো বুলি আউড়ে কিংবা তৈল মর্দন করে নেতা হওয়া যায় না। যে নেতার দোহাই দিয়ে রাজনীতির ময়দানে নেমেছেন অন্তত তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ করুন, অনুসরণ করুন। তোয়াজ মোহাম্মদ কিংবা তৈল মর্দনবাবু না হয়ে জনতার কাতারে শামিল হোন। নিজেকে নেতা না ভেবে জনতার একজন মনে করুন। আপনারা যে পথে চলছেন তা অব্যাহত থাকলে এমন দিন আসতে পারে যখন দলীয় জার্সিতে পিঠ বাঁচাতে পারবেন না।” সেই সভায় জোরালোভাবেই আওয়ামী লীগের একাধিক ব্যর্থতার উল্লেখ করেছিলাম। ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ছাত্র নেতৃত্ব ও যুব নেতৃত্ব চলে যায় অছাত্র ও দুর্বৃত্তদের হাতে। তারপরও শুধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে আমি সমর্থন করব। তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও দৃঢ়চিত্ততার জন্য বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে। ধৃত খুনিদের যথাযথ বিচারের মাধ্যমে রায় দ্রুততর সময়ে হয়েছে কার্যকর। একইভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে অন্যান্য যুদ্ধাপরাধী এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জড়িত কুশীলবরাও রেহাই পাবে না।
নির্বাচন কমিশন বাহ্যত স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ওপর তাদের নির্ভর করতে হয়। সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে ইসির ব্যর্থতা অনিবার্য। সরকারি কর্মকর্তা ডিসি, এমপিরা যথেষ্ট ক্ষমতাধর। জেলার প্রিসাইডিং ও রিটার্নিং অফিসার হিসাবে তারা মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে নিয়ন্ত্রণ করেন। সরকারের ইঙ্গিতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা, এমনকি নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত করার মতো ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তাদের থাকে।
এরশাদ ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সামরিক সচিব মে. জি. মনজুর রশীদ খান তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন-“১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলেই এমন ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটের একটা প্রহসনমূলক ও কারচুপিপূর্ণ নির্বাচন করা হয়। এ অপকর্মের দায়িত্ব দেওয়া হয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সেনা কমান্ডারদের। এরই পরিণতিতে পরবর্তীকালের প্রতিটি নির্বাচনে প্রশাসনের পরোক্ষ সহায়তায় ভোট চুরি, জালিয়াতি ও বিভিন্ন দুষ্কর্মজনিত প্রবণতা বাড়তে থাকে। সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান এরশাদের শাসনামলে এ প্রবণতা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে।...১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে স্থানীয় সেনা কমান্ডার ও বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় ভোট চুরি ও ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে ভোটের ফলাফল নির্ধারণ ও সমন্বয় করা হয়।” এ প্রসঙ্গে নির্বাচনে জালিয়াতির দুটি ঘটনা তিনি উল্লেখ করেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও ১৯৮৬ সালে তার পরাজিত হওয়ার কারণ স্থানীয় থানার ওসির অসহযোগিতা। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে তিনি বিজয় সুনিশ্চিত করার জন্য প্রথমেই ওসিকে ৩ লাখ টাকা ঘুস দিয়ে সফল হন। দ্বিতীয় ঘটনার প্রার্থী জাতীয় পার্টির না হয়েও সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার ডিসিকে ১ লাখ টাকা দিয়ে ৪০ শতাংশ ব্যালট পেপার নিজের কাছে আগের রাতে নিয়ে যান এবং সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। ওসি-ডিসি অর্থাৎ প্রশাসনকে হাত করে কেল্লা ফতেহ! মে. জে. মনজুর রশীদ আরও উল্লেখ করেন, ‘জাতীয় পার্টির প্রার্থী বাছাই করা, নির্বাচনি প্রচার পরিচালনা, তহবিল সংগ্রহ এবং অবৈধ উপায়ে চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করার মতো কাজগুলোর সঙ্গে দুটি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ ভূমিকার কথা কারও অজানা ছিল না। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রায় সব পর্যায়ের কর্মকর্তাই মুখ্যত সেনা কর্মকর্তাদের ইচ্ছানুযায়ী কাজ পরিচালনা করেছেন।’
আশা করি, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ভোট গণনার শেষ ২০-২৫ মিনিটের ম্যাজিক বুঝতে অসুবিধা হবে না। একইভাবে স্মরণ করছি ২০০১ সালের নির্বাচনে কোন অদৃশ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল। এটা স্পষ্ট যে, সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আমলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ার রশিদ বিপুল ভোটে অগ্রগামী থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তার প্রতিদ্বন্দ্বী খন্দকার মোশতাককে বঙ্গবন্ধুর জ্ঞাতসারে মাত্র কয়েকশ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। কে জানত এ সরীসৃপই জাতির পিতার খুনিদের পুরোধা হয়ে উঠবেন। ’৭৩-এর নির্বাচনে ১০-১৫টি আসনের ফলাফল সরকারের ললাটে কলঙ্ক তিলক হয়ে আছে।
’৭১-এর তাজউদ্দীন আহমদের প্রবাসী সরকারকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল মোশতাক ও তার অনুসারীরা। অলক্ষ্যে তার বিরোধিতায় উচ্চাভিলাষী শেখ মণিও ছিলেন সক্রিয়। স্বাধীনতার পর যখন বঙ্গবন্ধুর হৃদয় ও তাজউদ্দীন আহমদের মস্তিষ্কের যুগলবন্দিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি সাফল্যের মুখে, তখনই কিছু ষড়যন্ত্রী-যারা তীক্ষ্ণধী তাজউদ্দীনের উপস্থিতিতে মতলব হাসিল ও বঙ্গবন্ধুর অতিনৈকট্য লাভে বঞ্চিত ছিলেন-মূলত তাদেরই চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দুঃসময়ের কর্ণধার তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিপরিষদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনাকে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। ভয় ও আতঙ্কের কারণ দলীয় জার্সিসর্বস্ব নবাগত ও হিজরতকারী আওয়ামী লীগারদের। বসন্তের কোকিল ও রং বা ভোল পালটানো আমলাদের দিকেও নজর রাখতে হবে। সর্বোপরি প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে এবং যারা এ অপকর্মে জড়িত-তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আওয়ামী লীগ জনতার দল-গণমানুষের আশ্রয়। এটা মাস্তান বা গডফাদারদের আখড়া নয়। সাধারণ মানুষের ভোটেই তারা নির্বাচিত হন। কোনো প্রাসাদ ষড়যন্ত্র কিংবা ক্যান্টনমেন্টজাত উর্দিওয়ালাদের অনুকম্পায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতার মসনদে আসীন হয় না। আত্মীয়তার অপছায়া যেন দলকে কলুষিত না করে। ইতোমধ্যেই অনেকে অধ্যক্ষ পিটিয়ে, উপাজেলা চেয়ারম্যানকে কিল-ঘুসি মেরে, সরকারি কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করে দুর্বৃত্তদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। বদির বদামি তো কিংবদন্তিতুল্য। এদের ঝেঁটিয়ে দল থেকে বিদায় করা উচিত। অনেক সংসদ সদস্য-মন্ত্রী তো আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। নেত্রকোনার জনৈক প্রতিমন্ত্রী প্রথম নির্বাচন করেছিলেন বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার-কর্জ করে, অনুদান নিয়ে। এখন তিনি বিশাল ছয়তলা ভবনের মালিক, আরও আছে তিনটি অটো-রাইস মিল। তার স্ত্রী পাঁচ-ছয়টি স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি। তার বিরুদ্ধে স্কুলগুলোয় শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ-বাণিজ্যের প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নদানের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে নৌকার আরোহীদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো সম্ভব নাও হতে পারে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও সমর্থনের বিন্দুমাত্র অভাব নেই। শেখ হাসিনা যদি নির্মোহচিত্তে দলীয় তৃণমূল কর্মীদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারেন, তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার তার হাতেই থাকবে। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে বিভিন্ন পেশার ৫০ জনকে মনোনয়ন দেওয়া যায়। যেমন বিশিষ্ট আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, কৃষিবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি। আমরা চাই আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত ১৪ দলের ঐক্য অটুট থাকুক। তাদের ৫০টি আসন ছেড়ে দিয়ে ২৫০টি আসনে আওয়ামী লীগকে যোগ্যতম প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে অন্তত ১৭৫ থেকে ২০০ আসনে বিজয়ী হওয়ার জন্য লড়তে হবে। ৫০-৬০টি আসনে বিরোধী দলের যোগ্য প্রার্থী জয়ী হলে সংসদ প্রাণবন্ত হবে। তাদের বাস্তবধর্মী বস্তুনিষ্ঠ গঠনমূলক সমালোচনায় ক্ষমতাসীন দল সংযত হয়ে সঠিক পথে চলবে। অধিক আসন লাভের প্রত্যাশায় ধর্মীয় লেবাসধারী দল ও হেফাজতিদের কোনোরকম প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। এরা কখনো স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না এবং থাকবেও না।
যেসব নিবেদিতপ্রাণ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও আওয়ামী লীগ কর্মী চরম দুর্দিনেও দল ছেড়ে যাননি-তাদের যথাযথ মূল্যায়ন বাঞ্ছনীয়। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক বাহলুল মজনুন চুন্নু, দুর্বৃত্তদের হাতে প্রহৃত ও মারাত্মকভাবে আহত নেত্রকোনা সরকারি মহাবিদ্যালয়ের ভিপি লিটন, এরা সবাই চল্লিশোর্ধ্ব, কেউবা ষাটের কাছাকাছি-সংসদ নির্বাচনে এদের কথা কখনো বিবেচিত হয়নি। সাবেক নেতাকর্মীদের প্রতি এমন আচরণ সুখকর নয়। অপমানিত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজকে কি সসম্মানে ফিরিয়ে আনা যায় না? সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকীকে প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে আওয়ামী লীগ কি গৌরবান্বিত হতে পারে না? জনগণ জানতে চায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষাকবচ ‘ইনডেমনিটি’ বা দায়মুক্তির আইন কে বা কারা করেছেন? তাদের উচ্চ পদ দিয়ে বিদেশে কে পাঠালেন? খুনিদের প্রত্যাবর্তনে খালেদা জিয়ার বাধা দেওয়ার কারণ কী? ’৭৭-এ জাপান এয়ারলাইন্সের বিমান ছিনতাইয়ের আড়ালে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করার মূল চক্রান্তকারী কে? এ দুর্ঘটনার সুবিধাভোগী কে বা কোন পরিবার? বিমানবাহিনীর অফিসারদের নির্বিচারে কেন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো? শেখ হাসিনার কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা-পরবর্তীকালে এর তদন্ত এবং সন্দেভাজনদের বিচার কেন হলো না?
বাংলাদেশের বিচারালয়ের ওপর সাধারণ মানুষ এখনো আস্থাশীল হলেও তাদের বিশ্বাসে ফাটল দেখা দিয়েছে। আমাদের জানামতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যু পরোয়ানা বছর দুয়েক আগেই জারি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর অ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল সেক্রেটারি আজহারুল ইসলামের দণ্ডাদেশ প্রায় দুবছর যাবৎ আপিল বিভাগে পড়ে আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারকের মামলা সম্ভবত এখনো নিম্ন আদালতে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের দণ্ডাদেশ কার্যকর হয়নি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রধান আসামি নূর হোসেনের ভাই বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকীতে কোটি টাকার বাণিজ্যের ফাঁদ পেতেছিল।
নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়। কর্ণফুলি টানেল সমাপ্তির পথে। ঢাকা মেট্রোরেলের কাজও শেষ পর্যায়ে। শেখ হাসিনার বহুবিধ অর্জনের ফসল কি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ঘরে তুলতে পারবে?
ড. নূরুর রহমান খান : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনেক কিছুই করার আছে আওয়ামী লীগের
ড. নূরুর রহমান খান
২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে কাঁপন লেগেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কোনো কোনো কমিশনার মুখর হয়ে উঠেছেন। তারা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন দলের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সব দলকে নির্বাচনি প্রতিযোগিতায় মাঠে নামাতে ইসির প্রচেষ্টা আন্তরিক বলেই মনে হয়। এখানে একটা অলঙ্ঘনীয় ‘কিন্তু’ আছে। ‘সব দল’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? কোনো অবস্থায়ই স্বাধীনতাবিরোধী, তাদের সমর্থক এবং তাদের সমর্থিত কোনো দলকে নামে বা বেনামে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না। রুখতে হবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকেও।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের পর সবার দৃষ্টি সেদিকে-তাদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে, এ প্রশ্নও অনেকের মনে। কুমিল্লা পৌর করপোরেশনের নির্বাচন ছিল তাদের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা। প্রথমদিকে ইসির ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তারা সব দলকে আশ্বস্ত করলেন এবং জনৈক সংসদ-সদস্যের তৎপরতা জনস্বার্থ ও নির্বাচনি নীতিমালার বিরোধী হওয়ায় তাকে নির্বাচনি এলাকার বাইরে থাকার নির্দেশ দিলেন। সেই সংসদ-সদস্য ইসির নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে এলাকাতেই থেকে গেলেন এবং নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়তে লাগলেন আর ওস্তাদের মার শেষ রাতে দেখিয়ে দিলেন। কুমিল্লার একজন আওয়ামীপন্থি অধ্যক্ষ জানিয়েছিলেন সেখানকার মেয়রপ্রার্থী মনোনয়নে আওয়ামী লীগ যোগ্যতর প্রার্থীকে অবহেলা করেছে। দলকে হয়তো এর খেসারত দিতে হবে। তবে আশার কথা, বিএনপির তথাকথিত বহিষ্কৃত দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে নির্বাচনের ফল আওয়ামী লীগের অনুকূলে আসবে। আলোচ্য নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার প্রথম থেকেই দেখছিলাম প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই বিএনপির বহিষ্কৃত প্রার্থী উল্লেখযোগ্য ভোটে এগিয়ে যাচ্ছেন, দ্বিতীয় স্থানে আওয়ামী লীগ এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছেন বিএনপির অপর বিদ্রোহী প্রার্থী। নৌকার ভরাডুবি যখন আসন্ন, শেষ ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ৩৩৭ ভোটের ব্যবধানে জয়ী ঘোষণা করা হলো। প্রাগুক্ত অধ্যক্ষ মহোদয় জানালেন শেষ মুহূর্তে ‘বাহারি খেলের’ মাজেজা। প্রকৃত ফলাফল ঘোষিত হলে আওয়ামী লীগই উপকৃত হতো। প্রথমত ‘দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়’-এ বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য এবং দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল হতো। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ‘মেরুদণ্ড শক্ত রেখে দায়িত্ব পালনের’ প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও আমরা দেখেছি ইসির অসহায়তা। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে তারা প্রমাণ করলেন ‘চাকরে আর কুকুরে কোনোই পার্থক্য নেই, হুকুম করিলেই দৌড়াইতে হয়।’ এ নির্বাচন বিষয়ে কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তমের একাধিক প্রশ্নের সদুত্তর সিইসি দিতে পারেননি।
১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে মতবিনিময়ের জন্য শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমনা স্বল্পসংখ্যক শিক্ষকের সঙ্গে আওয়ামী লীগ অফিসে মিলিত হন। বক্তব্যের সূচনাতেই বলেছিলাম, ‘আমার রক্তে-মাংসে, চিন্তাচেতনায় আওয়ামী লীগ, আমি আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগারদের বিশ্বাস করি না, তাদের ওপর আস্থা নেই।’ একসময় রাজনীতি ছিল সেবা, রাজনীতিকরা ছিলেন জনগণ তথা দেশের সেবক। এখন রাজনীতি পেশা। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঠিকাদারি, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদির মতো রাজনীতি এখন পেশায় পরিণত হয়েছে। মন্ত্রী-এমপিদের বিত্তবৈভরের পরিসংখ্যান নিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ক্ষমতায় আসার আগে ও পরে কে কত সম্পদের মালিক ছিলেন ও হয়েছেন-এ হিসাব নেওয়াটা জটিল নয়। ছাত্রনেতা-যুবনেতা-শ্রমিক নেতাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
দ্বাদশ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের উদ্দেশে আমার কিছু বক্তব্য রয়েছে। কথাগুলো হিজরতকারী এবং শুধু দলীয় জার্সিধারী আওয়ামী লীগারদের মনঃপূত হবে না। বঙ্গবন্ধু যে চার স্তরের ওপর দেশকে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, এর কোনোটিকেই ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করা যাবে না। সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হবে। সংখ্যালঘুরা কেন মাতৃভূমি ত্যাগ করছে? তাদের বাড়িঘরে কেন হামলা-ভাঙচুর হয়? তাদের পরিত্যক্ত বিষয়-সম্পত্তি কারা ভোগ করছে? ২০১২ সালে নেত্রকোনায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্বাধীনতা সপ্তাহের অনুষ্ঠানে নেতাদের উদ্দেশে বলেছিলাম, “শুধু দলীয় জার্সি পরিধান এবং মন জোগানো বুলি আউড়ে কিংবা তৈল মর্দন করে নেতা হওয়া যায় না। যে নেতার দোহাই দিয়ে রাজনীতির ময়দানে নেমেছেন অন্তত তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ করুন, অনুসরণ করুন। তোয়াজ মোহাম্মদ কিংবা তৈল মর্দনবাবু না হয়ে জনতার কাতারে শামিল হোন। নিজেকে নেতা না ভেবে জনতার একজন মনে করুন। আপনারা যে পথে চলছেন তা অব্যাহত থাকলে এমন দিন আসতে পারে যখন দলীয় জার্সিতে পিঠ বাঁচাতে পারবেন না।” সেই সভায় জোরালোভাবেই আওয়ামী লীগের একাধিক ব্যর্থতার উল্লেখ করেছিলাম। ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ছাত্র নেতৃত্ব ও যুব নেতৃত্ব চলে যায় অছাত্র ও দুর্বৃত্তদের হাতে। তারপরও শুধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে আমি সমর্থন করব। তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও দৃঢ়চিত্ততার জন্য বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে। ধৃত খুনিদের যথাযথ বিচারের মাধ্যমে রায় দ্রুততর সময়ে হয়েছে কার্যকর। একইভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে অন্যান্য যুদ্ধাপরাধী এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জড়িত কুশীলবরাও রেহাই পাবে না।
নির্বাচন কমিশন বাহ্যত স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ওপর তাদের নির্ভর করতে হয়। সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে ইসির ব্যর্থতা অনিবার্য। সরকারি কর্মকর্তা ডিসি, এমপিরা যথেষ্ট ক্ষমতাধর। জেলার প্রিসাইডিং ও রিটার্নিং অফিসার হিসাবে তারা মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে নিয়ন্ত্রণ করেন। সরকারের ইঙ্গিতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা, এমনকি নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত করার মতো ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তাদের থাকে।
এরশাদ ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সামরিক সচিব মে. জি. মনজুর রশীদ খান তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন-“১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলেই এমন ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটের একটা প্রহসনমূলক ও কারচুপিপূর্ণ নির্বাচন করা হয়। এ অপকর্মের দায়িত্ব দেওয়া হয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সেনা কমান্ডারদের। এরই পরিণতিতে পরবর্তীকালের প্রতিটি নির্বাচনে প্রশাসনের পরোক্ষ সহায়তায় ভোট চুরি, জালিয়াতি ও বিভিন্ন দুষ্কর্মজনিত প্রবণতা বাড়তে থাকে। সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান এরশাদের শাসনামলে এ প্রবণতা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে।...১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে স্থানীয় সেনা কমান্ডার ও বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় ভোট চুরি ও ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে ভোটের ফলাফল নির্ধারণ ও সমন্বয় করা হয়।” এ প্রসঙ্গে নির্বাচনে জালিয়াতির দুটি ঘটনা তিনি উল্লেখ করেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও ১৯৮৬ সালে তার পরাজিত হওয়ার কারণ স্থানীয় থানার ওসির অসহযোগিতা। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে তিনি বিজয় সুনিশ্চিত করার জন্য প্রথমেই ওসিকে ৩ লাখ টাকা ঘুস দিয়ে সফল হন। দ্বিতীয় ঘটনার প্রার্থী জাতীয় পার্টির না হয়েও সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার ডিসিকে ১ লাখ টাকা দিয়ে ৪০ শতাংশ ব্যালট পেপার নিজের কাছে আগের রাতে নিয়ে যান এবং সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। ওসি-ডিসি অর্থাৎ প্রশাসনকে হাত করে কেল্লা ফতেহ! মে. জে. মনজুর রশীদ আরও উল্লেখ করেন, ‘জাতীয় পার্টির প্রার্থী বাছাই করা, নির্বাচনি প্রচার পরিচালনা, তহবিল সংগ্রহ এবং অবৈধ উপায়ে চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করার মতো কাজগুলোর সঙ্গে দুটি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ ভূমিকার কথা কারও অজানা ছিল না। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রায় সব পর্যায়ের কর্মকর্তাই মুখ্যত সেনা কর্মকর্তাদের ইচ্ছানুযায়ী কাজ পরিচালনা করেছেন।’
আশা করি, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ভোট গণনার শেষ ২০-২৫ মিনিটের ম্যাজিক বুঝতে অসুবিধা হবে না। একইভাবে স্মরণ করছি ২০০১ সালের নির্বাচনে কোন অদৃশ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল। এটা স্পষ্ট যে, সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আমলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ার রশিদ বিপুল ভোটে অগ্রগামী থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তার প্রতিদ্বন্দ্বী খন্দকার মোশতাককে বঙ্গবন্ধুর জ্ঞাতসারে মাত্র কয়েকশ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। কে জানত এ সরীসৃপই জাতির পিতার খুনিদের পুরোধা হয়ে উঠবেন। ’৭৩-এর নির্বাচনে ১০-১৫টি আসনের ফলাফল সরকারের ললাটে কলঙ্ক তিলক হয়ে আছে।
’৭১-এর তাজউদ্দীন আহমদের প্রবাসী সরকারকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল মোশতাক ও তার অনুসারীরা। অলক্ষ্যে তার বিরোধিতায় উচ্চাভিলাষী শেখ মণিও ছিলেন সক্রিয়। স্বাধীনতার পর যখন বঙ্গবন্ধুর হৃদয় ও তাজউদ্দীন আহমদের মস্তিষ্কের যুগলবন্দিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি সাফল্যের মুখে, তখনই কিছু ষড়যন্ত্রী-যারা তীক্ষ্ণধী তাজউদ্দীনের উপস্থিতিতে মতলব হাসিল ও বঙ্গবন্ধুর অতিনৈকট্য লাভে বঞ্চিত ছিলেন-মূলত তাদেরই চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দুঃসময়ের কর্ণধার তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিপরিষদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনাকে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। ভয় ও আতঙ্কের কারণ দলীয় জার্সিসর্বস্ব নবাগত ও হিজরতকারী আওয়ামী লীগারদের। বসন্তের কোকিল ও রং বা ভোল পালটানো আমলাদের দিকেও নজর রাখতে হবে। সর্বোপরি প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে এবং যারা এ অপকর্মে জড়িত-তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আওয়ামী লীগ জনতার দল-গণমানুষের আশ্রয়। এটা মাস্তান বা গডফাদারদের আখড়া নয়। সাধারণ মানুষের ভোটেই তারা নির্বাচিত হন। কোনো প্রাসাদ ষড়যন্ত্র কিংবা ক্যান্টনমেন্টজাত উর্দিওয়ালাদের অনুকম্পায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতার মসনদে আসীন হয় না। আত্মীয়তার অপছায়া যেন দলকে কলুষিত না করে। ইতোমধ্যেই অনেকে অধ্যক্ষ পিটিয়ে, উপাজেলা চেয়ারম্যানকে কিল-ঘুসি মেরে, সরকারি কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করে দুর্বৃত্তদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। বদির বদামি তো কিংবদন্তিতুল্য। এদের ঝেঁটিয়ে দল থেকে বিদায় করা উচিত। অনেক সংসদ সদস্য-মন্ত্রী তো আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। নেত্রকোনার জনৈক প্রতিমন্ত্রী প্রথম নির্বাচন করেছিলেন বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার-কর্জ করে, অনুদান নিয়ে। এখন তিনি বিশাল ছয়তলা ভবনের মালিক, আরও আছে তিনটি অটো-রাইস মিল। তার স্ত্রী পাঁচ-ছয়টি স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি। তার বিরুদ্ধে স্কুলগুলোয় শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ-বাণিজ্যের প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নদানের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে নৌকার আরোহীদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো সম্ভব নাও হতে পারে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও সমর্থনের বিন্দুমাত্র অভাব নেই। শেখ হাসিনা যদি নির্মোহচিত্তে দলীয় তৃণমূল কর্মীদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারেন, তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার তার হাতেই থাকবে। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে বিভিন্ন পেশার ৫০ জনকে মনোনয়ন দেওয়া যায়। যেমন বিশিষ্ট আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, কৃষিবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি। আমরা চাই আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত ১৪ দলের ঐক্য অটুট থাকুক। তাদের ৫০টি আসন ছেড়ে দিয়ে ২৫০টি আসনে আওয়ামী লীগকে যোগ্যতম প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে অন্তত ১৭৫ থেকে ২০০ আসনে বিজয়ী হওয়ার জন্য লড়তে হবে। ৫০-৬০টি আসনে বিরোধী দলের যোগ্য প্রার্থী জয়ী হলে সংসদ প্রাণবন্ত হবে। তাদের বাস্তবধর্মী বস্তুনিষ্ঠ গঠনমূলক সমালোচনায় ক্ষমতাসীন দল সংযত হয়ে সঠিক পথে চলবে। অধিক আসন লাভের প্রত্যাশায় ধর্মীয় লেবাসধারী দল ও হেফাজতিদের কোনোরকম প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। এরা কখনো স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না এবং থাকবেও না।
যেসব নিবেদিতপ্রাণ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও আওয়ামী লীগ কর্মী চরম দুর্দিনেও দল ছেড়ে যাননি-তাদের যথাযথ মূল্যায়ন বাঞ্ছনীয়। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক বাহলুল মজনুন চুন্নু, দুর্বৃত্তদের হাতে প্রহৃত ও মারাত্মকভাবে আহত নেত্রকোনা সরকারি মহাবিদ্যালয়ের ভিপি লিটন, এরা সবাই চল্লিশোর্ধ্ব, কেউবা ষাটের কাছাকাছি-সংসদ নির্বাচনে এদের কথা কখনো বিবেচিত হয়নি। সাবেক নেতাকর্মীদের প্রতি এমন আচরণ সুখকর নয়। অপমানিত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজকে কি সসম্মানে ফিরিয়ে আনা যায় না? সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকীকে প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে আওয়ামী লীগ কি গৌরবান্বিত হতে পারে না? জনগণ জানতে চায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষাকবচ ‘ইনডেমনিটি’ বা দায়মুক্তির আইন কে বা কারা করেছেন? তাদের উচ্চ পদ দিয়ে বিদেশে কে পাঠালেন? খুনিদের প্রত্যাবর্তনে খালেদা জিয়ার বাধা দেওয়ার কারণ কী? ’৭৭-এ জাপান এয়ারলাইন্সের বিমান ছিনতাইয়ের আড়ালে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করার মূল চক্রান্তকারী কে? এ দুর্ঘটনার সুবিধাভোগী কে বা কোন পরিবার? বিমানবাহিনীর অফিসারদের নির্বিচারে কেন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো? শেখ হাসিনার কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা-পরবর্তীকালে এর তদন্ত এবং সন্দেভাজনদের বিচার কেন হলো না?
বাংলাদেশের বিচারালয়ের ওপর সাধারণ মানুষ এখনো আস্থাশীল হলেও তাদের বিশ্বাসে ফাটল দেখা দিয়েছে। আমাদের জানামতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যু পরোয়ানা বছর দুয়েক আগেই জারি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর অ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল সেক্রেটারি আজহারুল ইসলামের দণ্ডাদেশ প্রায় দুবছর যাবৎ আপিল বিভাগে পড়ে আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারকের মামলা সম্ভবত এখনো নিম্ন আদালতে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের দণ্ডাদেশ কার্যকর হয়নি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রধান আসামি নূর হোসেনের ভাই বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকীতে কোটি টাকার বাণিজ্যের ফাঁদ পেতেছিল।
নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়। কর্ণফুলি টানেল সমাপ্তির পথে। ঢাকা মেট্রোরেলের কাজও শেষ পর্যায়ে। শেখ হাসিনার বহুবিধ অর্জনের ফসল কি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ঘরে তুলতে পারবে?
ড. নূরুর রহমান খান : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023