পাঠক এখনো যে পত্রিকা খোঁজে
সংবাদপত্র শুধু তথ্যসেবা নয়, নিঃসন্দেহে একটি পণ্যও বটে। কারণ, এর আধেয় বা সংবাদ বিক্রি হয়। পাঠক তার পছন্দের পত্রিকা কিনে পড়ে। বাজার অর্থনীতির ভাষায় যা বেচাকেনা হয় তা অবশ্যই পণ্য। তবে খবর বাজারজাতকরণে খুবই সম্ভাবনাময় এ শিল্পের ব্যাপারে অনেকে এখন ধরেই নিয়েছে, বেগবান প্রযুক্তির যুগে ছাপানো পত্রিকা আর চলবে না।
ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রতিটি দৈনিকের প্রচারসংখ্যা কমতেও শুরু করেছে। কেননা, মানুষ এখন খবর পড়ার চেয়ে খবরের ভিডিও কনটেইন দেখে দ্রুত সংবাদের পুরোটা জেনে নিতে চায়; যার বেশ খানিকটা চাহিদা মেটাচ্ছে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো। কিন্তু টিভি সেটের সামনে বসে খবর দেখার দর্শকও এখন কমছে।
মানুষ যেন আগের থেকে অনেক বেশি ব্যস্ত। কোনো ফুরসত নেই। তাই হাতে থাকা মুঠোফোনের স্ক্রিনেই খবর পড়া ও দেখার কাজ দ্রুত সেরে নিচ্ছে সবাই। পরিবর্তনের এমন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে প্রথম সারির প্রতিটি জাতীয় দৈনিকের রয়েছে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য অনলাইন পত্রিকা।
এছাড়া গত এক দশকে অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষের কাছে সংবাদ ও সংবাদ বিনোদনের আরও বড় প্ল্যাটফর্ম হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে সার্চ ইঞ্জিন গুগল ছাড়াও ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম প্রভৃতি।
সেখানে বিশ্বের প্রতি মুহূর্তের তরতাজা খবর ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ খবরের ভিডিও কনটেইনও থাকছে। আছে নানা নামের ইউটিউব চ্যানেল। সেখানে খবর আর টকশোর ছড়াছড়ি অবস্থা। গুণগত মান যাই হোক, একশ্রেণির ইউটিউবারদের দর্শক ও সাবস্ক্রাইবার লাখ লাখ। অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, ঘুমের সময় ছাড়া বেশিরভাগ মানুষ এখন ইউটিউব, ফেসবুক-এসব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নানা কনটেইনে রীতিমতো আসক্ত হয়ে পড়েছে।
পরিবার থেকে সমাজের নানা স্তরে এর প্রভাব আকাশছোঁয়া। আবার অপব্যবহারের কারণে এর বিরূপ প্রভাবও কম নয়। কিন্তু তরতাজা সব খবর-বেখবরের নেশায় বিভিন্ন বয়সের মানুষ যার যার পছন্দের কনটেইনে সারাক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকছে। ফলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।
ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে প্রতিমুহূর্তে মানুষ যেসব খবর গিলছে তার বেশিরভাগ গুজব, কিছু সত্য অথবা আংশিক সত্য বলেও জোরালো অভিযোগ রয়েছে। সমালোচকরা আঙুল তুলে বলতে চান, সম্পাদক অথবা সম্পাদনা বিভাগ না থাকায় এখানে শতভাগ সাংবাদিকতা হচ্ছে না।
কেউ বলেন, সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে এখানে কিছুই হয় না। সবাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খবরের নামে শুধু নিজের মতামত তুলে ধরছেন। সাংবাদিকতার জ্ঞান না থাকায় তারা সংবাদ থেকে মতামতকে আলাদা করতে পারছেন না। ফলে ইউটিউব, ফেসবুকসহ কিছু নিউজ পোর্টালে সংবাদের নামে অনেকে শুধু বেখবর প্রকাশ করছেন। কোনো রকম ফিল্টার না করেই সংবাদ উৎসের কাঁচামালকে সংবাদ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার ফেসবুক লাইভে এসে কিংবা ইউটিউব চ্যানেল খুলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন গুজব কিংবা উসকানির নানা উপাদান। অনেকে দায়বদ্ধতার চেয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন বেশি।
তবে এ ধরনের অভিযোগের বিরুদ্ধে জোরালো ভিন্নমতও রয়েছে। যারা এসব খবর-বেখবরের সঙ্গে যুক্ত, তাদের অনেকে জোর গলায় এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করছেন। হতাশ হয়ে নিজেদের গতি থামিয়ে দিচ্ছেন না। বরং কেউ কেউ আরও শক্তি অর্জন করে পালটা আঘাত করছেন। তারা বলছেন, বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের এ উত্থানের জন্য মেইনস্ট্রিম গণমাধ্যমগুলো বেশি দায়ী। তারা নিজেদের সাংবাদিকতার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না বলেই সত্য ও সাহসী খবরগুলো ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে নানাভাবে বেরিয়ে আসছে। এক অর্থে বলা যায়, চেপে রাখা কিংবা সেলফ সেন্সর করা খবরগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিস্ফোরিত হচ্ছে। সেখানে হয়তো শতভাগ সাংবাদিকতা নেই, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য ছাড়াও নানা স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গিও কাজ করছে। এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক সময় মাটির ভেতরে চাপে থাকা গ্যাস যেমন বুদবুদ অবস্থায় নানা ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসে, তেমনি যেসব খবর মেইনস্ট্রিম গণমাধ্যমে মুক্তি পাচ্ছে না, সেগুলো ভিন্নপথে বের হওয়ার পথ খুঁজছে। আবার এসব খবরই বেশিরভাগ মানুষ বিরতিহীন শুনছে, দেখছে, পড়ছে। অর্থাৎ পথিকই পথ তৈরি করছে। বলা যায়, অজানা খবরের বিস্তারিত দেখতে শুনতে মানুষ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের এ মাধ্যমগুলোতে বেশি যুক্ত হচ্ছে বলেই এসব খবরের চাহিদাও বাড়ছে। চাহিদার কারণেই জোগান বাড়ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকগুলো কি সত্যিই পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না? একজন পাঠক হিসাবে উত্তরটা হলো ‘পারছে না’। যেসব পত্রিকা এখনো সম্মানজনক প্রচারসংখ্যা ধরে রাখতে পারছে, সেখানেও নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। কারও রোগ কিছুটা দৃশ্যমান, কারোটা অদৃশ্য। এসব প্রশ্নে সাংবাদিক হিসাবে এ যাবত নানা শ্রেণিপেশার মানুষের কাছ থেকে কঠিন, সুকঠিন মন্তব্যও শুনেছি এবং এখনো শুনছি। আটাশ বছর ধরে গণমাধ্যমে সংবাদ নিয়ে কাজ করছি, শুরু থেকেই রিপোর্টার হিসাবে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে চলছি, কথা বলছি; সেহেতু এ বিষয়ে বিস্তর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অবশ্যই পেয়েছি এবং এখনো পাচ্ছি। কিন্তু এ পর্যন্ত বেশিরভাগ পাঠকের প্রতিক্রিয়া হলো, তারা এখনো তাদের কাঙ্ক্ষিত পত্রিকা ওই অর্থে খুঁজে পায়নি। অনেকে এখনো ভালো মানের পত্রিকার অপেক্ষায় আছেন। কেউ কেউ হতাশ হয়ে পত্রিকা পড়া ছেড়ে দিয়েছেন।
বিদ্যমান বাস্তবতায় পাঠকরাও গণমাধ্যমের নানা সীমাবদ্ধতার কথা জানেন। এ জন্য বিভিন্ন পত্রিকাকে নিজেদের মতো করে পাঠকরা নানা নামে অভিহিত করেন। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ধরে ধরে আলোচনা আড্ডায় কঠোর সমালোচনা করা হয়। দুর্ভাগ্য হলো, বেশিরভাগ পত্রিকাকে সাধারণ পাঠকরা সত্যের সাহসী ধারক-বাহক না বলে বিভিন্ন মতাদর্শ ও এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসাবে আখ্যা দেন। অন্যতম অভিযোগ তুলে ধরে বলা হয়-কোন পত্রিকা কোন দলের, কোন পথের, কোন মতের কিংবা কিসের পাহারাদার ইত্যাদি। আবার কথিত সুশীল শ্রেণির পত্রিকাগুলোর রয়েছে বেশধারী নানা কৌশল। টিভি চ্যানেলগুলোও দর্শকের কাছ থেকে এমন মন্তব্য থেকে মুক্ত নয়। তবে নানা সীমাবদ্ধতা ও নেতিবাচক মন্তব্যের মধ্যেও হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল এখনো তাদের সাহস ও জন্মসূত্রের স্বকীয়তা কিছুটা হলেও ধরে রাখতে পারছে। এ কারণে প্রথম সারির পত্রিকাগুলোর অনলাইনে পাঠকসংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ।
এ প্রেক্ষাপটে স্বভাবতই সবার সামনে বড় একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খায়। সেটি হলো, পাঠক সমাজ এখনো যে পত্রিকা খুঁজছে সেই মানের পত্রিকা আমরা কেন করতে পারছি না। উত্তরটা খুবই সহজ। পেশাদারত্বের অভাব। সমাজে অনেক পেশার মতো সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমজুড়ে বড় ধরনের পেশাগত অবক্ষয় হয়েছে। বিভিন্ন মতাদর্শ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব দিনে দিনে বিভেদের দেওয়াল বড় করেছে। এখন এ দেওয়াল কোথাও মহিরুহ অপশক্তিতে রূপ নিয়েছে, যা দুই-একজনের পক্ষে ভাঙা সম্ভব নয়। পেশাগত অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মতামত বিশ্লেষণ করে পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী ভালো মানের শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল পত্রিকা না হওয়ার পেছনে মোটা দাগে কতগুলো কারণ দায়ী। এর মধ্যে কয়েকটি কারণের জন্য বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তা দায়ী। তবে বেশিরভাগ কারণের দায় আমিসহ আমাদের পেশার অনেক সাংবাদিকের ঘাড়ে বর্তায়।
বর্তমানে প্রথম শ্রেণির শক্তিশালী জাতীয় দৈনিক পত্রিকা করতে হলে বড় ধরনের আর্থিক বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যারা বড় পত্রিকা করার জন্য বিশাল বিনিয়োগ করেন, তাদের অনেকের উদ্দেশ্য থাকে-দেশ ও সমাজের কল্যাণের চেয়ে নিজের কল্যাণ। অর্থাৎ পাঠক ও জনস্বার্থ রক্ষা না করে পত্রিকাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে নিজেকে রক্ষা করায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকা। এর ফলে এ ধরনের পত্রিকার চেহারা যখন পাঠকের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন সে পত্রিকা আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। পাঠকপ্রিয়তার পরিবর্তে সমাজে নিন্দিত হয়। মূলত এ কারণে বহু পত্রিকা অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বাজারে এলেও তা অল্প সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে। এসব পত্রিকার ক্ষেত্রে সাংবাদিক-কর্মচারীদের তেমন কিছু করার থাকে না। আবার অনেকে জেনেশুনে কিছুদিন ভালো থাকার জন্য এ ধরনের পত্রিকা বের করার দায়িত্ব নেন। ফলে এসব পত্রিকায় যত ভালো মানের সাংবাদিক কাজ করুক না কেন, কোনো লাভ হবে না। কারণ ভালো মানের সাংবাদিকের শক্তিশালী রিপোর্ট তো ছাপা হবে না। ভ্রূণ হত্যার মতো জন্মের আগেই মেরে ফেলা হয়। আবার ছাপা হলেও তার ট্রিটমেন্ট দেওয়া হবে ভিন্নভাবে। অথবা কাটছাঁট করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফেলে দেওয়া হবে। মূলত এ ধরনের পত্রিকার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা দায়িত্ব পালন করেন, তারা সাংবাদিকতা বাদ দিয়ে শুধু বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য চাকরি করতে চান, অথবা নিজেকে এক ধরনের ক্রীতদাস হিসাবে আবিষ্কার করেন। ফলে এ ধরনের পত্রিকা তার গুরুত্ব ও আবেদন হারিয়ে ফেলে। এছাড়া কোনো কোনো বিনিয়োগকারী নিজেকে ‘মিডিয়া মোগল’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া; যারা গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়িয়ে শুধু হাজার হাজার সাংবাদিককে পকেটস্থ করা নয়, সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমাজসেবার নামে সবই করতে চান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের নির্বাচনে তাদের ব্যাপক প্রভাব দেখা গেছে; যারা প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করে মনোনয়ন ও ভোটারদের ওপর অনেকটা সফলভাবে তাদের রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে অনেক যোগ্য প্রার্থী জিতে আসা তো দূরের কথা, তারা প্রার্থীও হতে পারেননি। এখন অজ্ঞাত স্থান থেকে এসব মনোনয়নকেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কারা কোথায় প্রার্থী হবেন, কাদের পাশ করিয়ে আনতে হবে-তার জন্য নানা মিশন কাজ করে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, এখন সাংবাদিক সংগঠনের বড় পদে নির্বাচন করতে নাকি অনেক টাকা লাগে। যদি অভিযোগ সত্য হয়, তাহলে এসব অর্থের জোগান কারা দেন, কেন দেন সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। এর ফলে শুধু সাংবাদিকদের সংগঠন নয়, পুরো গণমাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অপরদিকে, পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী দায়িত্বশীল শক্তিশালী পত্রিকা না হওয়ার জন্য বেশিরভাগ দায় সাংবাদিকদের। এর প্রধান কারণ সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার মধ্যে রাজনীতি ঢুকে পড়া। মূলত যেদিন থেকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সাংবাদিক সমাজকে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে, বা বিভক্ত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেদিন থেকে সাংবাদিকরা তাদের পেশাদারত্ব হারাতে বসেছে। এর ফলে সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ বিশাল ইস্পাতকঠিন শক্তি এখন নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। মহলবিশেষের ‘ভাগ করো শাসন করো’ ফাঁদে পা দিয়ে বেশিরভাগ সাংবাদিক তাদের স্বাধীন সত্তা হারিয়ে ফেলেছেন। যে কারণে সাংবাদিকরা তাদের ন্যায়সংগত কোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যুক্ত হলে সেখানেও বিভক্তির বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে। সাংবাদিক সমাজ ও সাংবাদিক নেতাদের ঐক্যবদ্ধ একক শক্তি ভেঙে চুরমার হয়ে এখন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। ভঙ্গুর শক্তিগুলো সমাজের বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থে নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পেশাদারত্ব নষ্ট হওয়ায় অতিমাত্রায় দলবাজিসহ সমাজের নানা রকম বাজিগররা আজ জাতির চতুর্থ স্তম্ভের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকতা পেশা দখল করে নিয়েছে। কোনো বিচারে যাদের সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা নেই, তারাও এখন হরহামেশা এ পেশায় ঢুকে পড়ছে। সংবাদের সংজ্ঞা জানা তো দূরের কথা, সংবাদ লিখতে পারে না, এমন বাহাদুররা এখন দোর্দণ্ড প্রতাপে এ পেশার কার্ড হাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ যারা এদের হাতে সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র তুলে দিচ্ছেন, তারা কিন্তু এ পেশার দায়িত্বশীল হিসাবে পরিচিত। ক্ষেত্রবিশেষে বড় পদের সাংবাদিকও বটে। ফলে স্বার্থের জন্য চারদিকে এখন নীতিহীনতার ছড়াছড়ি এবং অন্যায়ের সঙ্গে আপসকামিতা, যা এ পেশাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
এছাড়া এ পেশায় আরেক শ্রেণির কথিত কিছু দায়িত্বশীল তৈরি হয়েছে, যারা সারাদিন মুখে নীতিকথা বলে বেড়ান, কিন্তু সেগুলো কখনো নিজে করেন না। এরা সাংবাদিকতার চেয়ে সারাদিন ব্যক্তিস্বার্থের চর্চায় অভ্যস্ত। এজন্য সব সময় চারদিকে নিজস্ব বলয় গড়ে তুলতে সব শক্তি ব্যয় করেন। এ দুষ্টচক্র অনেক হাউজে বিশৃঙ্খল পরিবেশের জনক। কিন্তু তাদের লাগাম টানার যেন কেউ নেই। বরং তাদের আহলাদ করে লালন করেন। এছাড়া এসব প্রভাবশালী তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য সব প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য আগেভাগে পদে পদে খাল কেটে কুমির ছেড়ে দেয়। এরা সব সময় নিজস্ব বলয় তৈরি করে রাখতে চায়। তাদের কাছে প্রয়োজন কিছু চাটুকার ও দালাল শ্রেণির সহকর্মী, যারা সারাক্ষণ তার স্তুতি বন্দনায় ব্যস্ত থাকবে। কেউ আবার সাংবাদিকতা পেশার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে ব্যস্ত ভিন্ন কাজ বা অন্য পেশায়। কেউ কেউ আবার সাংবাদিকতা পেশায় কোনো বিটে সফল সাংবাদিক না হলেও নেতা হিসাবে বেশ সফল। নেতা হওয়া দোষের কিছু নয়, কারণ নেতা হতেও অনেক যোগ্যতা লাগে। কিন্তু সাংবাদিক যখন সারাদিন নিজের আসল কাজ না করে নেতাগিরি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তখন তো প্রশ্ন আসবেই। কেউ কেউ বারো মাস সাংবাদিক কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠনের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। জনপ্রিয়তা থাকুক বা না থাকুক, তাকে ভোটে দাঁড়াতেই হবে। প্রশ্ন হলো, একজন সাংবাদিক যদি সারাদিন সংগঠন আর ভোট নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে পেশাগত কাজে কখন সময় দেবেন? কিন্তু তাতে কী। কোনো সমস্যা নেই। তাদের চাকরি নিয়ে টানাটানি করার সাহস কার(!)
কোনো কোনো সাংবাদিক শুধু পেশাগত সংগঠনের নেতা হওয়া নয়, আরও বড় কোনো নির্বাচনে নেতা হওয়ার খায়েশও দেখেন। ফলে কাঙ্ক্ষিত সব পদ-পদবি ও পদক পেতে এ পেশার অনেকে শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে দিয়ে সাংবাদিকতা করছেন। ফলে সে পত্রিকা দিয়ে পাঠকের স্বার্থ আদায় করার পরিবর্তে তিনি সুকৌশলে মহলবিশেষের স্বার্থ সুরক্ষা করে চলেছেন। ব্যক্তিস্বার্থের জন্য কেউ কেউ পেশাগত স্বার্থ এতটাই বিসর্জন দিয়েছেন যে, তাকে দিয়ে বড়জোর কোনো দলের বক্তৃতা লেখা ও পোস্টার বানানো ছাড়া পত্রিকা প্রকাশ করার সুযোগ নেই।
মূলত মহান পেশা হিসাবে সাংবাদিকতা আগের অবস্থানে নেই। কারণ সাম্প্রতিককালে এ পেশায় যারা যুক্ত হচ্ছেন, তাদের অনেকে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও মান উন্নয়নে সচেষ্ট না হয়ে কীভাবে দ্রুত ধনী হওয়া যায় সে পথে হাঁটতে চান। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আমার পরিচিত বিএনপি বিটের একজন সিনিয়র সাংবাদিক কিছুদিন আগে কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলছিলেন, ১৬-১৭ বছর বিএনপি ক্ষমতায় নেই, তাহলে বুঝতেই তো পারছেন কেমন আছি। এ বিষয়টি সামনে এনে আমি বিএনপি বিটের সব সাংবাদিককে খাটো করছি না। অবশ্যই প্রতিটি বিটে এখনো অনেক পেশাদার ভালো সাংবাদিক আছে। সে সংখ্যাটাও একেবারে কম নয়। কিন্তু এ বাস্তব চিত্র অনেক কিছু জানান দেয়।
আবার নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার কথা বললে একশ্রেণির গায়ে খুব জ্বালা ধরে। কয়েক মাস আগে এক মিটিংয়ে একজন সিনিয়র সাংবাদিক তো বলেই ফেললেন, ‘নিরপেক্ষ বলে কিছু নেই। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহও নিরপেক্ষ নন। কারণ আল্লাহ ন্যায়ের পক্ষে। তাহলে সাংবাদিকদেরও কোনো একটা পক্ষ বেছে নিতে হবে। এখানে নিরপেক্ষতার ভান করার প্রয়োজন নেই।’ তখন তাকে বলা হয়, আপনিও সত্যের পক্ষে থাকেন। সাহসের সঙ্গে সত্য রিপোর্ট করেন। তখন তিনি বলেন, ‘এটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। আমার কাছে যা সত্য, তা অন্যের কাছে সত্য নাও হতে পারে।’ অতএব, বুঝতেই পারছেন, আমরা সাংবাদিকতা কীভাবে করছি।
গেল সপ্তাহে একজন সিনিয়র মন্ত্রীকে বলতে শুনলাম, ‘একমাত্র পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন।’ ফলে আমরা সাংবাদিকরা সমাজে প্রতিনিয়ত এ রকম নানা বিষয় ফেস করছি। তবে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমাদের দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে নিজের দায়বদ্ধতা চিন্তা করি না। উন্নত দেশে গণমাধ্যম স্বাধীনতার পাশাপাশি নিজের দায়বদ্ধতা নিয়েও সচেতন থাকে। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে সেটির অভাব আছে।’ মন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে অনেকে হয়তো দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে তথ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত। কেননা, এখনো চীন, রাশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর অনেক দেশে সাংবাদিকতা একরকম শৃঙ্খলিত। আমরা অনেক কিছু বলতে ও লিখতে পারছি। যেমন-এই যে আমি আমার মতপ্রকাশ করছি। আশা করছি এ লেখাও ছাপা হবে। কিন্তু সমস্যা হলো অন্যখানে। সেখানে আমরা সাংবাদিকরা স্বেচ্ছায় অনেকে ব্যক্তিস্বার্থে চাটুকারিতা ও দাসত্বের পথ বেছে নিয়েছি। বরং আমি এও মনে করি, একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী সাংবাদিকের কারণে সরকারের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সরকারকে যদি সমাজের আর কোনো শ্রেণিপেশার মানুষ ভুল পথে নিয়ে থাকে, তার মধ্যে আমাদের পেশার কিছু লোকের দায় আছে। সব সরকারের আমলে এরা সক্রিয় থাকে। বিএনপি সরকারকেও আরেকটি পক্ষ ভুল পথে নিয়েছিল।
এদিকে ভূরাজনীতি শুধু দেশের রাজনীতিতে নয়, গণমাধ্যমেও ভর করেছে। এটা নতুন খবর নয়। অনেক পুরোনো। তবে কয়েক বছর থেকে মাত্রাটা বেড়েছে। রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতির পাশাপাশি গণমাধ্যমও এখন এ দুষ্টচক্রের কাছে জিম্মি। তাদের প্রস্তুত করা সফট পাওয়ারগুলো ধীরে ধীরে গণমাধ্যমকে গ্রাস করছে। আরেকটা ভয়াবহ খারাপ সংস্কৃতি চালু হয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। সেটি হলো, কোনো সাংবাদিককে নিজের পক্ষের মনে না হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষ দল বা গ্রুপের ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়। বিএনপি সরকারের আমলে আমার পরিচিত একজন সাংবাদিক সচিবালয়ে সরকারবিরোধী লিফলেট নিয়ে আলোচিত রিপোর্ট করায় তাকে আওয়ামী লীগের এজেন্ট বলে ট্যাগ লাগানো হয়। শুধু তাই নয়, তদন্তের নামে একটি সংস্থা দিয়ে তাকে দুবছর হেনস্তা করা হয়। আবার ওই একই সাংবাদিককে সচিবালয়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভিত্তিক রিপোর্টের কারণে বর্তমান সরকারের আমলে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। রাতারাতি তাকে বিএনপি-জামায়াতের দোসর বলে ট্যাগ দেওয়া হয়। যদিও তা শেষ পর্যন্ত তদন্তে ভুল প্রমাণিত হয়। তবে বাস্তবতা হলো, এ পেশায় কাকের মাংস কাকে খায় বেশি। কোনো রাজনৈতিক দলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
শেষ কথা, প্রতিটি সরকারের আমলে গণমাধ্যমের কাছে সরকারি দলের তরফ থেকে যা প্রত্যাশা করা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি চাটুকারিতার আশ্রয় নেয় একশ্রেণির গণমাধ্যমসংশ্লিষ্টরা। এই শ্রেণির সাংবাদিকদের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সম্মেলনের প্রকৃত চরিত্রও একেবারে পালটে গেছে। প্রশ্ন করার নামে সাংবাদিকদের নজিরবিহীন তোষামোদি বক্তব্য শুনে অনেক সময় মন্ত্রী-এমপিরাও বিব্রতবোধ করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যক্তিস্বার্থের জন্য ওই শ্রেণির এ তোষণনীতি কোনোদিন বন্ধ হবে না। চলতেই থাকবে। অতএব, গোল্লায় যাক ভালো মানের পত্রিকা বের করার সাংবাদিকতা। বরং টিকে থাকুক, বেঁচে থাকুক একশ্রেণির সাংবাদিকের অপসাংবাদিকতা। পাঠকরাও অনন্তকাল খুঁজতে থাকুক তাদের কাঙ্ক্ষিত পত্রিকা।
বিএম জাহাঙ্গীর : উপসম্পাদক, যুগান্তর
bmjahangir69@gmail.com
পাঠক এখনো যে পত্রিকা খোঁজে
বিএম জাহাঙ্গীর
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সংবাদপত্র শুধু তথ্যসেবা নয়, নিঃসন্দেহে একটি পণ্যও বটে। কারণ, এর আধেয় বা সংবাদ বিক্রি হয়। পাঠক তার পছন্দের পত্রিকা কিনে পড়ে। বাজার অর্থনীতির ভাষায় যা বেচাকেনা হয় তা অবশ্যই পণ্য। তবে খবর বাজারজাতকরণে খুবই সম্ভাবনাময় এ শিল্পের ব্যাপারে অনেকে এখন ধরেই নিয়েছে, বেগবান প্রযুক্তির যুগে ছাপানো পত্রিকা আর চলবে না।
ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রতিটি দৈনিকের প্রচারসংখ্যা কমতেও শুরু করেছে। কেননা, মানুষ এখন খবর পড়ার চেয়ে খবরের ভিডিও কনটেইন দেখে দ্রুত সংবাদের পুরোটা জেনে নিতে চায়; যার বেশ খানিকটা চাহিদা মেটাচ্ছে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো। কিন্তু টিভি সেটের সামনে বসে খবর দেখার দর্শকও এখন কমছে।
মানুষ যেন আগের থেকে অনেক বেশি ব্যস্ত। কোনো ফুরসত নেই। তাই হাতে থাকা মুঠোফোনের স্ক্রিনেই খবর পড়া ও দেখার কাজ দ্রুত সেরে নিচ্ছে সবাই। পরিবর্তনের এমন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে প্রথম সারির প্রতিটি জাতীয় দৈনিকের রয়েছে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য অনলাইন পত্রিকা।
এছাড়া গত এক দশকে অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষের কাছে সংবাদ ও সংবাদ বিনোদনের আরও বড় প্ল্যাটফর্ম হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে সার্চ ইঞ্জিন গুগল ছাড়াও ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম প্রভৃতি।
সেখানে বিশ্বের প্রতি মুহূর্তের তরতাজা খবর ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ খবরের ভিডিও কনটেইনও থাকছে। আছে নানা নামের ইউটিউব চ্যানেল। সেখানে খবর আর টকশোর ছড়াছড়ি অবস্থা। গুণগত মান যাই হোক, একশ্রেণির ইউটিউবারদের দর্শক ও সাবস্ক্রাইবার লাখ লাখ। অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, ঘুমের সময় ছাড়া বেশিরভাগ মানুষ এখন ইউটিউব, ফেসবুক-এসব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নানা কনটেইনে রীতিমতো আসক্ত হয়ে পড়েছে।
পরিবার থেকে সমাজের নানা স্তরে এর প্রভাব আকাশছোঁয়া। আবার অপব্যবহারের কারণে এর বিরূপ প্রভাবও কম নয়। কিন্তু তরতাজা সব খবর-বেখবরের নেশায় বিভিন্ন বয়সের মানুষ যার যার পছন্দের কনটেইনে সারাক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকছে। ফলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।
ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে প্রতিমুহূর্তে মানুষ যেসব খবর গিলছে তার বেশিরভাগ গুজব, কিছু সত্য অথবা আংশিক সত্য বলেও জোরালো অভিযোগ রয়েছে। সমালোচকরা আঙুল তুলে বলতে চান, সম্পাদক অথবা সম্পাদনা বিভাগ না থাকায় এখানে শতভাগ সাংবাদিকতা হচ্ছে না।
কেউ বলেন, সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে এখানে কিছুই হয় না। সবাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খবরের নামে শুধু নিজের মতামত তুলে ধরছেন। সাংবাদিকতার জ্ঞান না থাকায় তারা সংবাদ থেকে মতামতকে আলাদা করতে পারছেন না। ফলে ইউটিউব, ফেসবুকসহ কিছু নিউজ পোর্টালে সংবাদের নামে অনেকে শুধু বেখবর প্রকাশ করছেন। কোনো রকম ফিল্টার না করেই সংবাদ উৎসের কাঁচামালকে সংবাদ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার ফেসবুক লাইভে এসে কিংবা ইউটিউব চ্যানেল খুলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন গুজব কিংবা উসকানির নানা উপাদান। অনেকে দায়বদ্ধতার চেয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন বেশি।
তবে এ ধরনের অভিযোগের বিরুদ্ধে জোরালো ভিন্নমতও রয়েছে। যারা এসব খবর-বেখবরের সঙ্গে যুক্ত, তাদের অনেকে জোর গলায় এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করছেন। হতাশ হয়ে নিজেদের গতি থামিয়ে দিচ্ছেন না। বরং কেউ কেউ আরও শক্তি অর্জন করে পালটা আঘাত করছেন। তারা বলছেন, বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের এ উত্থানের জন্য মেইনস্ট্রিম গণমাধ্যমগুলো বেশি দায়ী। তারা নিজেদের সাংবাদিকতার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না বলেই সত্য ও সাহসী খবরগুলো ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে নানাভাবে বেরিয়ে আসছে। এক অর্থে বলা যায়, চেপে রাখা কিংবা সেলফ সেন্সর করা খবরগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিস্ফোরিত হচ্ছে। সেখানে হয়তো শতভাগ সাংবাদিকতা নেই, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য ছাড়াও নানা স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গিও কাজ করছে। এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক সময় মাটির ভেতরে চাপে থাকা গ্যাস যেমন বুদবুদ অবস্থায় নানা ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসে, তেমনি যেসব খবর মেইনস্ট্রিম গণমাধ্যমে মুক্তি পাচ্ছে না, সেগুলো ভিন্নপথে বের হওয়ার পথ খুঁজছে। আবার এসব খবরই বেশিরভাগ মানুষ বিরতিহীন শুনছে, দেখছে, পড়ছে। অর্থাৎ পথিকই পথ তৈরি করছে। বলা যায়, অজানা খবরের বিস্তারিত দেখতে শুনতে মানুষ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের এ মাধ্যমগুলোতে বেশি যুক্ত হচ্ছে বলেই এসব খবরের চাহিদাও বাড়ছে। চাহিদার কারণেই জোগান বাড়ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকগুলো কি সত্যিই পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না? একজন পাঠক হিসাবে উত্তরটা হলো ‘পারছে না’। যেসব পত্রিকা এখনো সম্মানজনক প্রচারসংখ্যা ধরে রাখতে পারছে, সেখানেও নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। কারও রোগ কিছুটা দৃশ্যমান, কারোটা অদৃশ্য। এসব প্রশ্নে সাংবাদিক হিসাবে এ যাবত নানা শ্রেণিপেশার মানুষের কাছ থেকে কঠিন, সুকঠিন মন্তব্যও শুনেছি এবং এখনো শুনছি। আটাশ বছর ধরে গণমাধ্যমে সংবাদ নিয়ে কাজ করছি, শুরু থেকেই রিপোর্টার হিসাবে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে চলছি, কথা বলছি; সেহেতু এ বিষয়ে বিস্তর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অবশ্যই পেয়েছি এবং এখনো পাচ্ছি। কিন্তু এ পর্যন্ত বেশিরভাগ পাঠকের প্রতিক্রিয়া হলো, তারা এখনো তাদের কাঙ্ক্ষিত পত্রিকা ওই অর্থে খুঁজে পায়নি। অনেকে এখনো ভালো মানের পত্রিকার অপেক্ষায় আছেন। কেউ কেউ হতাশ হয়ে পত্রিকা পড়া ছেড়ে দিয়েছেন।
বিদ্যমান বাস্তবতায় পাঠকরাও গণমাধ্যমের নানা সীমাবদ্ধতার কথা জানেন। এ জন্য বিভিন্ন পত্রিকাকে নিজেদের মতো করে পাঠকরা নানা নামে অভিহিত করেন। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ধরে ধরে আলোচনা আড্ডায় কঠোর সমালোচনা করা হয়। দুর্ভাগ্য হলো, বেশিরভাগ পত্রিকাকে সাধারণ পাঠকরা সত্যের সাহসী ধারক-বাহক না বলে বিভিন্ন মতাদর্শ ও এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসাবে আখ্যা দেন। অন্যতম অভিযোগ তুলে ধরে বলা হয়-কোন পত্রিকা কোন দলের, কোন পথের, কোন মতের কিংবা কিসের পাহারাদার ইত্যাদি। আবার কথিত সুশীল শ্রেণির পত্রিকাগুলোর রয়েছে বেশধারী নানা কৌশল। টিভি চ্যানেলগুলোও দর্শকের কাছ থেকে এমন মন্তব্য থেকে মুক্ত নয়। তবে নানা সীমাবদ্ধতা ও নেতিবাচক মন্তব্যের মধ্যেও হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল এখনো তাদের সাহস ও জন্মসূত্রের স্বকীয়তা কিছুটা হলেও ধরে রাখতে পারছে। এ কারণে প্রথম সারির পত্রিকাগুলোর অনলাইনে পাঠকসংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ।
এ প্রেক্ষাপটে স্বভাবতই সবার সামনে বড় একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খায়। সেটি হলো, পাঠক সমাজ এখনো যে পত্রিকা খুঁজছে সেই মানের পত্রিকা আমরা কেন করতে পারছি না। উত্তরটা খুবই সহজ। পেশাদারত্বের অভাব। সমাজে অনেক পেশার মতো সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমজুড়ে বড় ধরনের পেশাগত অবক্ষয় হয়েছে। বিভিন্ন মতাদর্শ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব দিনে দিনে বিভেদের দেওয়াল বড় করেছে। এখন এ দেওয়াল কোথাও মহিরুহ অপশক্তিতে রূপ নিয়েছে, যা দুই-একজনের পক্ষে ভাঙা সম্ভব নয়। পেশাগত অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মতামত বিশ্লেষণ করে পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী ভালো মানের শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল পত্রিকা না হওয়ার পেছনে মোটা দাগে কতগুলো কারণ দায়ী। এর মধ্যে কয়েকটি কারণের জন্য বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তা দায়ী। তবে বেশিরভাগ কারণের দায় আমিসহ আমাদের পেশার অনেক সাংবাদিকের ঘাড়ে বর্তায়।
বর্তমানে প্রথম শ্রেণির শক্তিশালী জাতীয় দৈনিক পত্রিকা করতে হলে বড় ধরনের আর্থিক বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যারা বড় পত্রিকা করার জন্য বিশাল বিনিয়োগ করেন, তাদের অনেকের উদ্দেশ্য থাকে-দেশ ও সমাজের কল্যাণের চেয়ে নিজের কল্যাণ। অর্থাৎ পাঠক ও জনস্বার্থ রক্ষা না করে পত্রিকাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে নিজেকে রক্ষা করায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকা। এর ফলে এ ধরনের পত্রিকার চেহারা যখন পাঠকের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন সে পত্রিকা আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। পাঠকপ্রিয়তার পরিবর্তে সমাজে নিন্দিত হয়। মূলত এ কারণে বহু পত্রিকা অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বাজারে এলেও তা অল্প সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে। এসব পত্রিকার ক্ষেত্রে সাংবাদিক-কর্মচারীদের তেমন কিছু করার থাকে না। আবার অনেকে জেনেশুনে কিছুদিন ভালো থাকার জন্য এ ধরনের পত্রিকা বের করার দায়িত্ব নেন। ফলে এসব পত্রিকায় যত ভালো মানের সাংবাদিক কাজ করুক না কেন, কোনো লাভ হবে না। কারণ ভালো মানের সাংবাদিকের শক্তিশালী রিপোর্ট তো ছাপা হবে না। ভ্রূণ হত্যার মতো জন্মের আগেই মেরে ফেলা হয়। আবার ছাপা হলেও তার ট্রিটমেন্ট দেওয়া হবে ভিন্নভাবে। অথবা কাটছাঁট করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফেলে দেওয়া হবে। মূলত এ ধরনের পত্রিকার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা দায়িত্ব পালন করেন, তারা সাংবাদিকতা বাদ দিয়ে শুধু বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য চাকরি করতে চান, অথবা নিজেকে এক ধরনের ক্রীতদাস হিসাবে আবিষ্কার করেন। ফলে এ ধরনের পত্রিকা তার গুরুত্ব ও আবেদন হারিয়ে ফেলে। এছাড়া কোনো কোনো বিনিয়োগকারী নিজেকে ‘মিডিয়া মোগল’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া; যারা গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়িয়ে শুধু হাজার হাজার সাংবাদিককে পকেটস্থ করা নয়, সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমাজসেবার নামে সবই করতে চান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের নির্বাচনে তাদের ব্যাপক প্রভাব দেখা গেছে; যারা প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করে মনোনয়ন ও ভোটারদের ওপর অনেকটা সফলভাবে তাদের রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে অনেক যোগ্য প্রার্থী জিতে আসা তো দূরের কথা, তারা প্রার্থীও হতে পারেননি। এখন অজ্ঞাত স্থান থেকে এসব মনোনয়নকেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কারা কোথায় প্রার্থী হবেন, কাদের পাশ করিয়ে আনতে হবে-তার জন্য নানা মিশন কাজ করে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, এখন সাংবাদিক সংগঠনের বড় পদে নির্বাচন করতে নাকি অনেক টাকা লাগে। যদি অভিযোগ সত্য হয়, তাহলে এসব অর্থের জোগান কারা দেন, কেন দেন সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। এর ফলে শুধু সাংবাদিকদের সংগঠন নয়, পুরো গণমাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অপরদিকে, পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী দায়িত্বশীল শক্তিশালী পত্রিকা না হওয়ার জন্য বেশিরভাগ দায় সাংবাদিকদের। এর প্রধান কারণ সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার মধ্যে রাজনীতি ঢুকে পড়া। মূলত যেদিন থেকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সাংবাদিক সমাজকে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে, বা বিভক্ত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেদিন থেকে সাংবাদিকরা তাদের পেশাদারত্ব হারাতে বসেছে। এর ফলে সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ বিশাল ইস্পাতকঠিন শক্তি এখন নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। মহলবিশেষের ‘ভাগ করো শাসন করো’ ফাঁদে পা দিয়ে বেশিরভাগ সাংবাদিক তাদের স্বাধীন সত্তা হারিয়ে ফেলেছেন। যে কারণে সাংবাদিকরা তাদের ন্যায়সংগত কোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যুক্ত হলে সেখানেও বিভক্তির বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে। সাংবাদিক সমাজ ও সাংবাদিক নেতাদের ঐক্যবদ্ধ একক শক্তি ভেঙে চুরমার হয়ে এখন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। ভঙ্গুর শক্তিগুলো সমাজের বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থে নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পেশাদারত্ব নষ্ট হওয়ায় অতিমাত্রায় দলবাজিসহ সমাজের নানা রকম বাজিগররা আজ জাতির চতুর্থ স্তম্ভের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকতা পেশা দখল করে নিয়েছে। কোনো বিচারে যাদের সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা নেই, তারাও এখন হরহামেশা এ পেশায় ঢুকে পড়ছে। সংবাদের সংজ্ঞা জানা তো দূরের কথা, সংবাদ লিখতে পারে না, এমন বাহাদুররা এখন দোর্দণ্ড প্রতাপে এ পেশার কার্ড হাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ যারা এদের হাতে সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র তুলে দিচ্ছেন, তারা কিন্তু এ পেশার দায়িত্বশীল হিসাবে পরিচিত। ক্ষেত্রবিশেষে বড় পদের সাংবাদিকও বটে। ফলে স্বার্থের জন্য চারদিকে এখন নীতিহীনতার ছড়াছড়ি এবং অন্যায়ের সঙ্গে আপসকামিতা, যা এ পেশাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
এছাড়া এ পেশায় আরেক শ্রেণির কথিত কিছু দায়িত্বশীল তৈরি হয়েছে, যারা সারাদিন মুখে নীতিকথা বলে বেড়ান, কিন্তু সেগুলো কখনো নিজে করেন না। এরা সাংবাদিকতার চেয়ে সারাদিন ব্যক্তিস্বার্থের চর্চায় অভ্যস্ত। এজন্য সব সময় চারদিকে নিজস্ব বলয় গড়ে তুলতে সব শক্তি ব্যয় করেন। এ দুষ্টচক্র অনেক হাউজে বিশৃঙ্খল পরিবেশের জনক। কিন্তু তাদের লাগাম টানার যেন কেউ নেই। বরং তাদের আহলাদ করে লালন করেন। এছাড়া এসব প্রভাবশালী তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য সব প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য আগেভাগে পদে পদে খাল কেটে কুমির ছেড়ে দেয়। এরা সব সময় নিজস্ব বলয় তৈরি করে রাখতে চায়। তাদের কাছে প্রয়োজন কিছু চাটুকার ও দালাল শ্রেণির সহকর্মী, যারা সারাক্ষণ তার স্তুতি বন্দনায় ব্যস্ত থাকবে। কেউ আবার সাংবাদিকতা পেশার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে ব্যস্ত ভিন্ন কাজ বা অন্য পেশায়। কেউ কেউ আবার সাংবাদিকতা পেশায় কোনো বিটে সফল সাংবাদিক না হলেও নেতা হিসাবে বেশ সফল। নেতা হওয়া দোষের কিছু নয়, কারণ নেতা হতেও অনেক যোগ্যতা লাগে। কিন্তু সাংবাদিক যখন সারাদিন নিজের আসল কাজ না করে নেতাগিরি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তখন তো প্রশ্ন আসবেই। কেউ কেউ বারো মাস সাংবাদিক কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠনের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। জনপ্রিয়তা থাকুক বা না থাকুক, তাকে ভোটে দাঁড়াতেই হবে। প্রশ্ন হলো, একজন সাংবাদিক যদি সারাদিন সংগঠন আর ভোট নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে পেশাগত কাজে কখন সময় দেবেন? কিন্তু তাতে কী। কোনো সমস্যা নেই। তাদের চাকরি নিয়ে টানাটানি করার সাহস কার(!)
কোনো কোনো সাংবাদিক শুধু পেশাগত সংগঠনের নেতা হওয়া নয়, আরও বড় কোনো নির্বাচনে নেতা হওয়ার খায়েশও দেখেন। ফলে কাঙ্ক্ষিত সব পদ-পদবি ও পদক পেতে এ পেশার অনেকে শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে দিয়ে সাংবাদিকতা করছেন। ফলে সে পত্রিকা দিয়ে পাঠকের স্বার্থ আদায় করার পরিবর্তে তিনি সুকৌশলে মহলবিশেষের স্বার্থ সুরক্ষা করে চলেছেন। ব্যক্তিস্বার্থের জন্য কেউ কেউ পেশাগত স্বার্থ এতটাই বিসর্জন দিয়েছেন যে, তাকে দিয়ে বড়জোর কোনো দলের বক্তৃতা লেখা ও পোস্টার বানানো ছাড়া পত্রিকা প্রকাশ করার সুযোগ নেই।
মূলত মহান পেশা হিসাবে সাংবাদিকতা আগের অবস্থানে নেই। কারণ সাম্প্রতিককালে এ পেশায় যারা যুক্ত হচ্ছেন, তাদের অনেকে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও মান উন্নয়নে সচেষ্ট না হয়ে কীভাবে দ্রুত ধনী হওয়া যায় সে পথে হাঁটতে চান। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আমার পরিচিত বিএনপি বিটের একজন সিনিয়র সাংবাদিক কিছুদিন আগে কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলছিলেন, ১৬-১৭ বছর বিএনপি ক্ষমতায় নেই, তাহলে বুঝতেই তো পারছেন কেমন আছি। এ বিষয়টি সামনে এনে আমি বিএনপি বিটের সব সাংবাদিককে খাটো করছি না। অবশ্যই প্রতিটি বিটে এখনো অনেক পেশাদার ভালো সাংবাদিক আছে। সে সংখ্যাটাও একেবারে কম নয়। কিন্তু এ বাস্তব চিত্র অনেক কিছু জানান দেয়।
আবার নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার কথা বললে একশ্রেণির গায়ে খুব জ্বালা ধরে। কয়েক মাস আগে এক মিটিংয়ে একজন সিনিয়র সাংবাদিক তো বলেই ফেললেন, ‘নিরপেক্ষ বলে কিছু নেই। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহও নিরপেক্ষ নন। কারণ আল্লাহ ন্যায়ের পক্ষে। তাহলে সাংবাদিকদেরও কোনো একটা পক্ষ বেছে নিতে হবে। এখানে নিরপেক্ষতার ভান করার প্রয়োজন নেই।’ তখন তাকে বলা হয়, আপনিও সত্যের পক্ষে থাকেন। সাহসের সঙ্গে সত্য রিপোর্ট করেন। তখন তিনি বলেন, ‘এটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। আমার কাছে যা সত্য, তা অন্যের কাছে সত্য নাও হতে পারে।’ অতএব, বুঝতেই পারছেন, আমরা সাংবাদিকতা কীভাবে করছি।
গেল সপ্তাহে একজন সিনিয়র মন্ত্রীকে বলতে শুনলাম, ‘একমাত্র পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন।’ ফলে আমরা সাংবাদিকরা সমাজে প্রতিনিয়ত এ রকম নানা বিষয় ফেস করছি। তবে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমাদের দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে নিজের দায়বদ্ধতা চিন্তা করি না। উন্নত দেশে গণমাধ্যম স্বাধীনতার পাশাপাশি নিজের দায়বদ্ধতা নিয়েও সচেতন থাকে। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে সেটির অভাব আছে।’ মন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে অনেকে হয়তো দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে তথ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত। কেননা, এখনো চীন, রাশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর অনেক দেশে সাংবাদিকতা একরকম শৃঙ্খলিত। আমরা অনেক কিছু বলতে ও লিখতে পারছি। যেমন-এই যে আমি আমার মতপ্রকাশ করছি। আশা করছি এ লেখাও ছাপা হবে। কিন্তু সমস্যা হলো অন্যখানে। সেখানে আমরা সাংবাদিকরা স্বেচ্ছায় অনেকে ব্যক্তিস্বার্থে চাটুকারিতা ও দাসত্বের পথ বেছে নিয়েছি। বরং আমি এও মনে করি, একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী সাংবাদিকের কারণে সরকারের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সরকারকে যদি সমাজের আর কোনো শ্রেণিপেশার মানুষ ভুল পথে নিয়ে থাকে, তার মধ্যে আমাদের পেশার কিছু লোকের দায় আছে। সব সরকারের আমলে এরা সক্রিয় থাকে। বিএনপি সরকারকেও আরেকটি পক্ষ ভুল পথে নিয়েছিল।
এদিকে ভূরাজনীতি শুধু দেশের রাজনীতিতে নয়, গণমাধ্যমেও ভর করেছে। এটা নতুন খবর নয়। অনেক পুরোনো। তবে কয়েক বছর থেকে মাত্রাটা বেড়েছে। রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতির পাশাপাশি গণমাধ্যমও এখন এ দুষ্টচক্রের কাছে জিম্মি। তাদের প্রস্তুত করা সফট পাওয়ারগুলো ধীরে ধীরে গণমাধ্যমকে গ্রাস করছে। আরেকটা ভয়াবহ খারাপ সংস্কৃতি চালু হয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। সেটি হলো, কোনো সাংবাদিককে নিজের পক্ষের মনে না হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষ দল বা গ্রুপের ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়। বিএনপি সরকারের আমলে আমার পরিচিত একজন সাংবাদিক সচিবালয়ে সরকারবিরোধী লিফলেট নিয়ে আলোচিত রিপোর্ট করায় তাকে আওয়ামী লীগের এজেন্ট বলে ট্যাগ লাগানো হয়। শুধু তাই নয়, তদন্তের নামে একটি সংস্থা দিয়ে তাকে দুবছর হেনস্তা করা হয়। আবার ওই একই সাংবাদিককে সচিবালয়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভিত্তিক রিপোর্টের কারণে বর্তমান সরকারের আমলে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। রাতারাতি তাকে বিএনপি-জামায়াতের দোসর বলে ট্যাগ দেওয়া হয়। যদিও তা শেষ পর্যন্ত তদন্তে ভুল প্রমাণিত হয়। তবে বাস্তবতা হলো, এ পেশায় কাকের মাংস কাকে খায় বেশি। কোনো রাজনৈতিক দলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
শেষ কথা, প্রতিটি সরকারের আমলে গণমাধ্যমের কাছে সরকারি দলের তরফ থেকে যা প্রত্যাশা করা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি চাটুকারিতার আশ্রয় নেয় একশ্রেণির গণমাধ্যমসংশ্লিষ্টরা। এই শ্রেণির সাংবাদিকদের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সম্মেলনের প্রকৃত চরিত্রও একেবারে পালটে গেছে। প্রশ্ন করার নামে সাংবাদিকদের নজিরবিহীন তোষামোদি বক্তব্য শুনে অনেক সময় মন্ত্রী-এমপিরাও বিব্রতবোধ করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যক্তিস্বার্থের জন্য ওই শ্রেণির এ তোষণনীতি কোনোদিন বন্ধ হবে না। চলতেই থাকবে। অতএব, গোল্লায় যাক ভালো মানের পত্রিকা বের করার সাংবাদিকতা। বরং টিকে থাকুক, বেঁচে থাকুক একশ্রেণির সাংবাদিকের অপসাংবাদিকতা। পাঠকরাও অনন্তকাল খুঁজতে থাকুক তাদের কাঙ্ক্ষিত পত্রিকা।
বিএম জাহাঙ্গীর : উপসম্পাদক, যুগান্তর
bmjahangir69@gmail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023