জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যথাযথ মূল্যায়ন হোক
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে সম্প্রতি নরসিংদী গিয়েছিলাম গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটার লিখতে। সেখানে তৃণমূল পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপচারিতায় অদ্ভুত কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মফিজুদ্দিন নামের এক মুক্তিযোদ্ধা বলেছিলেন, ভাতা ভোগ করে আমাদের চেতনা বিনষ্ট হয়েছে। তার কথার মর্মার্থ সাধারণ অনেক মুক্তিযোদ্ধাই বুঝতে সক্ষম হবেন না বলে আন্দাজ করি। আসলে কি মুক্তিযোদ্ধারা কোনো ভাতা প্রাপ্তির জন্য যুদ্ধ করেছিলেন? তবু জনগণের পক্ষ থেকে সরকার তাদের সম্মান দিয়েছে, এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
কারা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা? তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই এ দেশের সাধারণ মানুষ। যুদ্ধের সময় তারা ছিলেন যুবা ও তরুণ। জন্ম-অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরোধে এক সময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ঘন ঘন যাতায়াত করতে হতো। সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাগজপত্র ঠিকঠাক করার জন্য প্রতিদিনই আসতেন বিপুল সংখ্যায়, আর আমি বেদনার্ত চোখে তাকিয়ে দেখতাম তাদের মুখগুলো। প্রত্যেকের অতি সাধারণ বেশভূষা, গলায় মাফলার, পায়ে স্যান্ডেল বা নাগরা।
মন্ত্রণালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর, সে সময় সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিএনপি সরকারের ১ মাসও পূর্ণ হয়নি। ১৯৭১ সালে এ সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদেরই নিজের ১১ বছর বয়সে যেভাবে জলে কাদায় লুটোপুটি করতে দেখেছি, তা ছিল এক বিস্ময়। এরাই ছিলেন এমআর আখতার মুকুলের চরমপত্রে বিধৃত ‘বিচ্ছু’। নিজের ভাই-ভগ্নিপতিরা দেশের সীমান্ত পার হয়ে প্রতিবেশী দেশে যেতে পারেননি, তারা দেশেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
অথচ আমার মাত্র দু-তিন বছরের বড় বন্ধুদের অনেকেই ভারতে যেতে সক্ষম হয়েছিল। তাদেরই একজন এমএম খালেদ হোসেনের উক্তি প্রণিধানযোগ্য : ‘সাহেব-জোতদারের সন্তানরা কি এত কষ্ট করতে সক্ষম? আমরা দরিদ্র কৃষকের ছেলেরাই মরণপণ করে সেটা করতে সক্ষম হয়েছিলাম।’ আসলেই, বিচ্ছুরাই পেরেছিল সর্বকর্ম সাধন করতে।
মুক্তিযুদ্ধের নিরিখে এ দেশকে আমরা চিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দিয়ে, আর চিনি হাসান হাফিজুর রহমানের মাধ্যমে। হাসান হাফিজুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (১৬ খণ্ড) সম্পাদনা করেছিলেন। ২০০১ সালে জাতীয়তাবাদী সরকার এসে বহু খণ্ডের আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়ন করেছিল। তবে বিতর্কের শুরু এখানে নয়, স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে যে ব্যাপক দুর্নীতির কথা শোনা যাচ্ছিল, তখন থেকেই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নামের গায়ে কলঙ্ক লেপন শুরু হয়। কিছুদিন আগেও বিদায়ি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। যে কোনো দুর্নীতিই বিতর্কের জন্ম দেয়। বিচার না হলে বিতর্ক আরও প্রলম্বিত হয়।
১৯৭২ সালের ৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নির্ধারণপূর্বক যে গেজেট প্রকাশ করেছিল তাতে উদ্ধৃত ছিল, ‘Freedom Fighters mean any person who had served as a member of any force engaged in the war of liberation but shall not include members of the Defence Services or any police or the Civil Armed Forces.’ এ সংজ্ঞা বর্তমান সরকারের অধীনস্থ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মাধ্যমে নিম্নরূপভাবে পালটে যায় :
‘The people who were involved in the liberation war in response to the call of the Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman in between March 26 and December 16, 1971.’ এ সংজ্ঞা অনুসারে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা। সেই হিসাবে বাংলার মা-বোনদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তারা অভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের খেতে দিয়েছেন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা।
যুদ্ধের পর নিবন্ধনের সময় বীরাঙ্গনা নারীরা যখন আইডেনটিটি ক্রাইসিস অথবা হীনমন্যতায় ভুগছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু সস্নেহে বলেছিলেন, ওদের পিতার জায়গায় তোরা আমার নাম লিখে দিস। সেই বঙ্গবন্ধুর দেশে সবচেয়ে বড় বিতর্কের ঢেউটা আমরা তুলেছি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অশান্ত দেশে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রত্যক্ষভাবে আর কিছু করার সময়ই পাননি।
মুক্তিযোদ্ধা ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ সাধনে হাত লাগিয়েছিলেন জোরেশোরেই। তিনি নিহত হওয়ার পর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ সময়। ক্ষমতারোহণের পরপর তিনি বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। তবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারায় তার মধ্যে এক ধরনের আক্ষেপ ছিল এবং সেই আক্ষেপ থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে অনেক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছিলেন।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় সরকারই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নে নতুন নতুন নীতিমালা নির্ধারণ করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। লাল মুক্তিবার্তায় নামের অস্তিত্ব থাকা কিংবা যে কোনো দুটি উৎসের একটিতে নাম থাকা থেকে শুরু করে নানা ধরনের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। তালিকাবহির্ভূত মুক্তিযোদ্ধারা অবশেষে আপিলের সুযোগ লাভ করেন। সরকার বর্তমানে এসব আপিল নিষ্পত্তি এবং অতঃপর নতুন গেজেট প্রণয়নের কাজে ব্যস্ত রয়েছে।
সেই ব্যস্ততা যেন মুক্তিযোদ্ধা-বিএলএফ (যুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনী) দ্বন্দ্ব নিরসনসহ সব মানসিক সংঘাত দূরীকরণে সহায়ক হয়। তবে চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা পদ্ধতি যুগ যুগ ধরে চালু রাখলে প্রকৃত মেধাবীদের সেবা থেকে দেশ বঞ্চিত হবে। সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ সুবিধা সবাইকে দেওয়া যুক্তিযুক্তও নয়। শুধু দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এটি উন্মুক্ত রেখে ধীরে ধীরে এ প্রথা বিলুপ্ত করা যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতেই আবার ফিরে আসি। সব সরকারের আমলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নানাভাবে বিনষ্ট হয়েছে। যখন রাজাকার-আল বদররা শহিদের রক্তে রাঙা পতাকাশোভিত গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন আমাদের মনোকষ্টের সীমা ছিল না। প্রশ্ন তো একটাই-কোন দেশে জন্মেছি আমরা? পুনঃপুনঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা এবং অতি সূক্ষ্মভাবে জাতিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে কারণে পোষ্য হিসাবে মুক্তিযোদ্ধার সুবিধাভোগীদের মধ্যে ছিল আমাদের অনেক পাকিস্তানপন্থি সন্তান। তাছাড়া বহু সচ্ছল ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ফলভোগীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নিজের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় দুটি ঘটনার বয়ান দিয়ে যৌক্তিক ভিতের ওপর এ রচনাটি দাঁড় করানোর চেষ্টা করব। একবার (১৯৮৭) মোহাম্মদপুরে জমি প্রদানের উদ্দেশ্যে হেমায়েতপুরের (সাভার) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আলীর জমিজমা সরেজমিন পরিদর্শন করতে হয়েছিল। তখন এলাকাবাসীর অনেকেই বলেছিলেন-কয়টা দেখবেন স্যার, তার তো জমি-জিরাতের অভাব নেই। অর্থাৎ তিনি একজন সচ্ছল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।
সে সময় সরকারের উচিত ছিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে গরিব মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা। যুদ্ধের অব্যবহিত পর মানুষকে ঢালাওভাবে বলতে শুনেছি, ওরা তো ডাকাত। এসব বলে তাদের চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বহু মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন অনাহারেও ছিলেন। কেউ রাজপথে রিকশা চালিয়েছেন, চাকরি না পেয়ে ছাদ থেকে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বলতে শুনেছি, আমাদের মেরে ফেল বাবারা।
কেউ কেউ বলেছেন, যুদ্ধের সময় কেন যে মরলাম না! সে সময় রাষ্ট্রীয় গান স্যালুটই ছিল তাদের একমাত্র প্রাপ্তি, তাও মৃত্যুর পর, জীবদ্দশায় তারা কিছুই পাননি। এর বিপরীতে বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি সম্মানজনক ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে। তাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। অমুক্তিযোদ্ধারা তালিকাভুক্তির সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল, যদিও কেউ কেউ মন্ত্রীর (একেএম মোজাম্মেল হক) দৃঢ়তার কারণে তালিকা থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল। ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় সরকার সচিবদেরও তালিকা থেকে বাদ দিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বিদেশি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করতে যে স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়েছিল, সেখানে ব্যাপক খাদ প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল, তা জাতি আজও জানতে পারেনি।
আরেকটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চাকরিকালীন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মুজিবনগর কর্মচারী সংক্রান্ত একটি নথি প্রক্রিয়াকরণ করতে হয়েছিল (২০১০)। দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধের সময় কারও বয়স দুই, কারও তিন। এমন পরিস্থিতিতে তো আমরা বিস্মিত হতেও ভুলে যাই। এখন শুনি অনেক মুক্তিযোদ্ধার বয়সই বাংলাদেশের সমান, অর্থাৎ যুদ্ধের সময় তারা জন্ম নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন(!)। আমাদের নষ্টামি, বিকারগ্রস্ততার সীমা-পরিসীমা নেই।
আবার নরসিংদীর কথা দিয়েই শেষ করি। ওই জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই তাদের ঘর দেওয়ার বিষয়ে বর্তমান সরকারি উদ্যোগের ঘোর বিরোধী। কারণ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘর তৈরি হতে হতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করবেন। তার চেয়ে নগদ অর্থ দেওয়া উত্তম, তারা নিজেদের মতো করে ঘর তুলে নেবেন। তাছাড়া সরকারি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির কারণে বাজে মেটেরিয়াল দিয়ে আবাস নির্মিত হলে সেসব বেশিদিন টিকবে না বলেও তাদের আশঙ্কা। এতদ্ব্যতীত, এসব নিয়ে ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ ও অন্যদের মধ্যে ব্যাপক পারিবারিক দ্বন্দ্বও রয়েছে। কাজেই সাবধান না থাকলে আবার নয়া বিতর্কের অবতারণা হতে পারে।
সুবিধাদি প্রদান করলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজীবন ধমনিতে প্রবহমান থাকবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। রাষ্ট্রকে তাই একটি নির্মোহ, দল-মতের ঊর্ধ্বে নীতিমালা প্রণয়ন, কর্মসূচি হাতে নিয়ে সেই শাশ্বত চেতনা অটুট রাখার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কামনা করি, আমাদের সুবর্ণজয়ন্তীর আবেগ বিবেকে রূপান্তরিত হোক।
ড. গোলাম শকিক : কবি ও প্রাবন্ধিক
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যথাযথ মূল্যায়ন হোক
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে সম্প্রতি নরসিংদী গিয়েছিলাম গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটার লিখতে। সেখানে তৃণমূল পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপচারিতায় অদ্ভুত কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মফিজুদ্দিন নামের এক মুক্তিযোদ্ধা বলেছিলেন, ভাতা ভোগ করে আমাদের চেতনা বিনষ্ট হয়েছে। তার কথার মর্মার্থ সাধারণ অনেক মুক্তিযোদ্ধাই বুঝতে সক্ষম হবেন না বলে আন্দাজ করি। আসলে কি মুক্তিযোদ্ধারা কোনো ভাতা প্রাপ্তির জন্য যুদ্ধ করেছিলেন? তবু জনগণের পক্ষ থেকে সরকার তাদের সম্মান দিয়েছে, এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
কারা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা? তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই এ দেশের সাধারণ মানুষ। যুদ্ধের সময় তারা ছিলেন যুবা ও তরুণ। জন্ম-অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরোধে এক সময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ঘন ঘন যাতায়াত করতে হতো। সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাগজপত্র ঠিকঠাক করার জন্য প্রতিদিনই আসতেন বিপুল সংখ্যায়, আর আমি বেদনার্ত চোখে তাকিয়ে দেখতাম তাদের মুখগুলো। প্রত্যেকের অতি সাধারণ বেশভূষা, গলায় মাফলার, পায়ে স্যান্ডেল বা নাগরা।
মন্ত্রণালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর, সে সময় সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিএনপি সরকারের ১ মাসও পূর্ণ হয়নি। ১৯৭১ সালে এ সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদেরই নিজের ১১ বছর বয়সে যেভাবে জলে কাদায় লুটোপুটি করতে দেখেছি, তা ছিল এক বিস্ময়। এরাই ছিলেন এমআর আখতার মুকুলের চরমপত্রে বিধৃত ‘বিচ্ছু’। নিজের ভাই-ভগ্নিপতিরা দেশের সীমান্ত পার হয়ে প্রতিবেশী দেশে যেতে পারেননি, তারা দেশেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
অথচ আমার মাত্র দু-তিন বছরের বড় বন্ধুদের অনেকেই ভারতে যেতে সক্ষম হয়েছিল। তাদেরই একজন এমএম খালেদ হোসেনের উক্তি প্রণিধানযোগ্য : ‘সাহেব-জোতদারের সন্তানরা কি এত কষ্ট করতে সক্ষম? আমরা দরিদ্র কৃষকের ছেলেরাই মরণপণ করে সেটা করতে সক্ষম হয়েছিলাম।’ আসলেই, বিচ্ছুরাই পেরেছিল সর্বকর্ম সাধন করতে।
মুক্তিযুদ্ধের নিরিখে এ দেশকে আমরা চিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দিয়ে, আর চিনি হাসান হাফিজুর রহমানের মাধ্যমে। হাসান হাফিজুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (১৬ খণ্ড) সম্পাদনা করেছিলেন। ২০০১ সালে জাতীয়তাবাদী সরকার এসে বহু খণ্ডের আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়ন করেছিল। তবে বিতর্কের শুরু এখানে নয়, স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে যে ব্যাপক দুর্নীতির কথা শোনা যাচ্ছিল, তখন থেকেই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নামের গায়ে কলঙ্ক লেপন শুরু হয়। কিছুদিন আগেও বিদায়ি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। যে কোনো দুর্নীতিই বিতর্কের জন্ম দেয়। বিচার না হলে বিতর্ক আরও প্রলম্বিত হয়।
১৯৭২ সালের ৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নির্ধারণপূর্বক যে গেজেট প্রকাশ করেছিল তাতে উদ্ধৃত ছিল, ‘Freedom Fighters mean any person who had served as a member of any force engaged in the war of liberation but shall not include members of the Defence Services or any police or the Civil Armed Forces.’ এ সংজ্ঞা বর্তমান সরকারের অধীনস্থ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মাধ্যমে নিম্নরূপভাবে পালটে যায় :
‘The people who were involved in the liberation war in response to the call of the Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman in between March 26 and December 16, 1971.’ এ সংজ্ঞা অনুসারে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা। সেই হিসাবে বাংলার মা-বোনদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তারা অভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের খেতে দিয়েছেন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা।
যুদ্ধের পর নিবন্ধনের সময় বীরাঙ্গনা নারীরা যখন আইডেনটিটি ক্রাইসিস অথবা হীনমন্যতায় ভুগছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু সস্নেহে বলেছিলেন, ওদের পিতার জায়গায় তোরা আমার নাম লিখে দিস। সেই বঙ্গবন্ধুর দেশে সবচেয়ে বড় বিতর্কের ঢেউটা আমরা তুলেছি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অশান্ত দেশে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রত্যক্ষভাবে আর কিছু করার সময়ই পাননি।
মুক্তিযোদ্ধা ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ সাধনে হাত লাগিয়েছিলেন জোরেশোরেই। তিনি নিহত হওয়ার পর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ সময়। ক্ষমতারোহণের পরপর তিনি বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। তবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারায় তার মধ্যে এক ধরনের আক্ষেপ ছিল এবং সেই আক্ষেপ থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে অনেক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছিলেন।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় সরকারই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নে নতুন নতুন নীতিমালা নির্ধারণ করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। লাল মুক্তিবার্তায় নামের অস্তিত্ব থাকা কিংবা যে কোনো দুটি উৎসের একটিতে নাম থাকা থেকে শুরু করে নানা ধরনের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। তালিকাবহির্ভূত মুক্তিযোদ্ধারা অবশেষে আপিলের সুযোগ লাভ করেন। সরকার বর্তমানে এসব আপিল নিষ্পত্তি এবং অতঃপর নতুন গেজেট প্রণয়নের কাজে ব্যস্ত রয়েছে।
সেই ব্যস্ততা যেন মুক্তিযোদ্ধা-বিএলএফ (যুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনী) দ্বন্দ্ব নিরসনসহ সব মানসিক সংঘাত দূরীকরণে সহায়ক হয়। তবে চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা পদ্ধতি যুগ যুগ ধরে চালু রাখলে প্রকৃত মেধাবীদের সেবা থেকে দেশ বঞ্চিত হবে। সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ সুবিধা সবাইকে দেওয়া যুক্তিযুক্তও নয়। শুধু দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এটি উন্মুক্ত রেখে ধীরে ধীরে এ প্রথা বিলুপ্ত করা যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতেই আবার ফিরে আসি। সব সরকারের আমলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নানাভাবে বিনষ্ট হয়েছে। যখন রাজাকার-আল বদররা শহিদের রক্তে রাঙা পতাকাশোভিত গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন আমাদের মনোকষ্টের সীমা ছিল না। প্রশ্ন তো একটাই-কোন দেশে জন্মেছি আমরা? পুনঃপুনঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা এবং অতি সূক্ষ্মভাবে জাতিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে কারণে পোষ্য হিসাবে মুক্তিযোদ্ধার সুবিধাভোগীদের মধ্যে ছিল আমাদের অনেক পাকিস্তানপন্থি সন্তান। তাছাড়া বহু সচ্ছল ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ফলভোগীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নিজের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় দুটি ঘটনার বয়ান দিয়ে যৌক্তিক ভিতের ওপর এ রচনাটি দাঁড় করানোর চেষ্টা করব। একবার (১৯৮৭) মোহাম্মদপুরে জমি প্রদানের উদ্দেশ্যে হেমায়েতপুরের (সাভার) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আলীর জমিজমা সরেজমিন পরিদর্শন করতে হয়েছিল। তখন এলাকাবাসীর অনেকেই বলেছিলেন-কয়টা দেখবেন স্যার, তার তো জমি-জিরাতের অভাব নেই। অর্থাৎ তিনি একজন সচ্ছল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।
সে সময় সরকারের উচিত ছিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে গরিব মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা। যুদ্ধের অব্যবহিত পর মানুষকে ঢালাওভাবে বলতে শুনেছি, ওরা তো ডাকাত। এসব বলে তাদের চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বহু মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন অনাহারেও ছিলেন। কেউ রাজপথে রিকশা চালিয়েছেন, চাকরি না পেয়ে ছাদ থেকে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বলতে শুনেছি, আমাদের মেরে ফেল বাবারা।
কেউ কেউ বলেছেন, যুদ্ধের সময় কেন যে মরলাম না! সে সময় রাষ্ট্রীয় গান স্যালুটই ছিল তাদের একমাত্র প্রাপ্তি, তাও মৃত্যুর পর, জীবদ্দশায় তারা কিছুই পাননি। এর বিপরীতে বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি সম্মানজনক ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে। তাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। অমুক্তিযোদ্ধারা তালিকাভুক্তির সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল, যদিও কেউ কেউ মন্ত্রীর (একেএম মোজাম্মেল হক) দৃঢ়তার কারণে তালিকা থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল। ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় সরকার সচিবদেরও তালিকা থেকে বাদ দিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বিদেশি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করতে যে স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়েছিল, সেখানে ব্যাপক খাদ প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল, তা জাতি আজও জানতে পারেনি।
আরেকটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চাকরিকালীন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মুজিবনগর কর্মচারী সংক্রান্ত একটি নথি প্রক্রিয়াকরণ করতে হয়েছিল (২০১০)। দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধের সময় কারও বয়স দুই, কারও তিন। এমন পরিস্থিতিতে তো আমরা বিস্মিত হতেও ভুলে যাই। এখন শুনি অনেক মুক্তিযোদ্ধার বয়সই বাংলাদেশের সমান, অর্থাৎ যুদ্ধের সময় তারা জন্ম নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন(!)। আমাদের নষ্টামি, বিকারগ্রস্ততার সীমা-পরিসীমা নেই।
আবার নরসিংদীর কথা দিয়েই শেষ করি। ওই জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই তাদের ঘর দেওয়ার বিষয়ে বর্তমান সরকারি উদ্যোগের ঘোর বিরোধী। কারণ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘর তৈরি হতে হতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করবেন। তার চেয়ে নগদ অর্থ দেওয়া উত্তম, তারা নিজেদের মতো করে ঘর তুলে নেবেন। তাছাড়া সরকারি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির কারণে বাজে মেটেরিয়াল দিয়ে আবাস নির্মিত হলে সেসব বেশিদিন টিকবে না বলেও তাদের আশঙ্কা। এতদ্ব্যতীত, এসব নিয়ে ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ ও অন্যদের মধ্যে ব্যাপক পারিবারিক দ্বন্দ্বও রয়েছে। কাজেই সাবধান না থাকলে আবার নয়া বিতর্কের অবতারণা হতে পারে।
সুবিধাদি প্রদান করলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজীবন ধমনিতে প্রবহমান থাকবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। রাষ্ট্রকে তাই একটি নির্মোহ, দল-মতের ঊর্ধ্বে নীতিমালা প্রণয়ন, কর্মসূচি হাতে নিয়ে সেই শাশ্বত চেতনা অটুট রাখার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কামনা করি, আমাদের সুবর্ণজয়ন্তীর আবেগ বিবেকে রূপান্তরিত হোক।
ড. গোলাম শকিক : কবি ও প্রাবন্ধিক