মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ
এম এ খালেক
২০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য জাতীয় বাজেট প্রণয়ন সব সময়ই অত্যন্ত কঠিন ও জটিল। আমাদের মতো দেশের অধিকাংশ মানুষের আয় সীমিত হওয়ার কারণে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং অন্যান্য উপকরণ ক্রয়ে প্রত্যাশিত মাত্রায় অর্থব্যয় করতে পারে না। রাষ্ট্রীয় বাজেটের একটি সুবিধা হলো সেখানে ব্যয় বুঝে আয় সমন্বয় করা যায়। অর্থাৎ যতটা অর্থব্যয়ের প্রয়োজন হয়, ঠিক ততটা অর্থই অভ্যন্তীণ অথবা বাইরের সূত্র থেকে সংগ্রহ করা যায়। তবে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বাজেটের ক্ষেত্রে ঘটে উলটো ঘটনা। সেখানে একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চাইলেই তার আয় বাড়াতে পারে না। ফলে তাকে সীমিত আয় দ্বারা বর্ধিত ব্যয় মেটানোর জন্য চাহিদা কাটছাঁট করতে হয়। এতে মানুষের ভোগপ্রবণতা ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হয়। একজন মানুষ যখন একটি পণ্য ভোগ বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন তিনি সেই পণ্যটি যে কোনো মূল্যেই পেতে চাইবেন। কিন্তু আয় যদি না বাড়ে, তাহলে তার পক্ষে অতিরিক্ত ব্যয় করে সেই কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি ক্রয় করা সম্ভব হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য আমাদের জাতীয় বাজেট হবে অত্যন্ত জটিল ও কঠিন একটি বাজেট। বিশেষ করে সাধারণ দরিদ্র মানুষের জন্য এ বাজেটে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেটাই দেখার বিষয়।
করোনা অতিমারির প্রভাব থেকে দেশের অর্থনীতি যখন উত্তরণের পর্যায়ে ছিল, ঠিক তখনই ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’র মতো শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্ব অর্থনীতি আবারও নতুন করে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এ অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি প্রত্যেক মানুষের ওপরই প্রভাব ফেলেছে। তবে দরিদ্র ও নিু-মধ্যম আয়ের মানুষের ওপর এ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ আকারে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব কতটা উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, তা বাজারে গেলেই টের পাওয়া যায়। প্রতিটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগেও যে গরুর মাংসের কেজি ছিল ৬৫০ টাকা, তা এখন ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও এখন আর গরুর মাংস ক্রয় করতে পারছেন না। কোনো কোনো জেলায় আড়াইশ গ্রাম গরুর মাংস বিক্রি শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতি যে কতটা উদ্বেগজনক, তা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়োজন হয় না।
আমাদের দেশে একশ্রেণির ব্যবসায়ী আছে, যারা কোনো অজুহাত পেলেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে গণদুর্ভোগ সৃষ্টি করে থাকে। স্থানীয়ভাবে যেসব পণ্য উৎপাদিত হয়, তার ওপর তো ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা প্রতিটি পণ্যের মূল্য বাড়িয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। দেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ী কতটা খারাপ, প্রসঙ্গক্রমে তার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ইরাক কুয়েত দখল করে নেয়। সেই সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) তাৎক্ষণিকভাবে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য যাচাই করে এবং ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের কারণে রাজধানী ঢাকার বাজারে শাকসবজির মূল্য বেড়েছিল সবচেয়ে বেশি। অথচ অর্থনীতির কোনো সূত্রই শাকসবজির এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে সমর্থন করে না। কারণ সেই সময় যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশ থেকে শাকসবজি রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এতে স্থানীয় বাজারে শাকসবজির উপস্থিতি বেড়ে যায়। এ সময় শাকসবজির মূল্য স্বাভাবিকভাবেই কমে যাওয়ার কথা ছিল। এ দেশের একশ্রেণির অবিবেচক ব্যবসায়ী কোনো অজুহাত পেলেই পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে গণদুর্ভোগ সৃষ্টিতে তৎপর হয়। কয়েকদিন পরই শুরু হবে পবিত্র রমজান। এ সময় প্রতিটি পরিবারই একটু উন্নত মানের খাবার খেতে চাইবে। এ সুযোগে আমাদের দেশের একশ্রেণির অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ী বাজারে পণ্যমূল্য বাড়িতে দিতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আমদানি কমানোর জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। আগে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ১২টি পণ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন এর সংখ্যা ২৬-এ উন্নীত করা হয়েছে। ১২৩টি পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। কোনো কোনো পণ্যের এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) মার্জিন শতভাগ করা হয়েছে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে আমদানি ব্যয় কিছুটা হলেও কমেছে। কিন্তু এরপরও বলা যাবে না যেসব পণ্য আমদানির জন্য অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, তা সত্যি সত্যি দেশে আসছে কি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে বলেছেন, তারা এমন কিছু আমদানি চালান প্রত্যক্ষ করেছেন, যেখানে কোনো কোনো পণ্যের আমদানি ব্যয় ২০ থেকে ২০০ শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। অবস্থা কতটা ভয়াবহ, তা সহজেই অনুমেয়।
আমদানি ব্যয় কমার একটি বড় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সর্বশেষ হিসাব অনুসারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১০৫ কোটি মার্কিন ডলারে। এটিও প্রকৃত রিজার্ভ নয়। কারণ এর মধ্যে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ দেওয়া হয়েছে। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ২ হাজার ৩০৫ কোটি মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে আমদানিকারকরা পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছেন না। ফলে পণ্য আমদানি ব্যয় কমে যাচ্ছে। এটি আমদানিকৃত পণ্যের ব্যবহার হ্রাসের কারণে হচ্ছে না। এটি হচ্ছে মূলত ডলার সংকটের কারণে। মাসভিত্তিক পণ্য আমদানি খাতে ব্যয়ের পরিসংখ্যান প্রত্যক্ষ করলেই পরিস্থিতি অনুধাবন করা যাবে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের নভেম্বরে আমদানি ব্যয় হয়েছিল ৭৬১ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের নভেম্বরে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৭৭৩ কোটি মার্কিন ডলার। এ দুই অর্থবছরের ডিসেম্বরে আমদানি ব্যয় হয়েছিল যথাক্রমে ৮১৪ কোটি এবং ৬৩২ কোটি মার্কিন ডলার। জানুয়ারিতে এটি ছিল যথাক্রমে ৮০৫ কোটি এবং ৬৩৫ কোটি মার্কিন ডলার। ফেব্রুয়ারিতে এটি ছিল ৮১৮ কোটি এবং ৫০৩ কোটি মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে সর্বোচ্চ ৮১৮ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে তা ৫০৩ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। মানুষের ভোগব্যয় বর্ণিত সময়ে কমেছে তা নয়। মার্কিন ডলারের সংকটের কারণে আমদানিকারকরা পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। পণ্য আমদানি কমে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবেই। সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি প্রভৃতি নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা সংকট এবং অর্থনীতির অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন পেয়েছে। এ ঋণ অনুমোদন পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বেশকিছু শর্ত মেনে নিতে হয়েছে। এসব শর্ত স্থানীয়ভাবে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। আইএমএফ-এর শর্তের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেওয়া ব্যাপক মাত্রার ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশ গত ১২-১৩ বছর ধরে আইএমএফ-এর কাছ থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি। ফলে সংস্থাটি বাংলাদেশকে কোনো শর্ত দিতে পারেনি। আইএমএফ কর্তৃপক্ষ খুব ভালো করেই জানে, কোনো দেশ শখের বশে তাদের কাছ থেকে ঋণ নেয় না। একান্ত বিপদে পড়লেই কেবল একটি দেশ আইএমএফ-এর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। তাই ঋণ গ্রহণকারী দেশের ওপর তারা নানা ধরনের শর্ত চাপিয়ে দেয়। আইএমএফ-এর শর্ত পরিপালনের প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসাবে ইতোমধ্যেই অভ্যন্তরীণ বাজারে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সময় বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পেলে অভ্যন্তরীণ বাজারেও মূল্য সমন্বয় করা হবে। কিন্তু মন্ত্রণালয় তাদের সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি মূল্য ইউক্রেন যুদ্ধের পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়নি।
আগামী জাতীয় বাজেটে আইএমএফকে খুশি করার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমানো হতে পারে। তবে সমস্যা দেখা দেবে কৃষি খাতে ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ অনেকদিন ধরেই উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শ উপেক্ষা করে কৃষি খাতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে। ভর্তুকির কারণে কৃষি খাতে যে অগ্রগতি হচ্ছে, তা চোখে পড়ার মতো। এ অবস্থায় সরকার কি আগামী বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখবে, নাকি কমাবে-এটি একটি বড় প্রশ্ন। বস্তুত আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য জাতীয় বাজেট প্রণয়ন সব সময়ই অত্যন্ত কঠিন ও জটিল। আমাদের মতো দেশের অধিকাংশ মানুষের আয় সীমিত হওয়ার কারণে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং অন্যান্য উপকরণ ক্রয়ে প্রত্যাশিত মাত্রায় অর্থব্যয় করতে পারে না। রাষ্ট্রীয় বাজেটের একটি সুবিধা হলো সেখানে ব্যয় বুঝে আয় সমন্বয় করা যায়। অর্থাৎ যতটা অর্থব্যয়ের প্রয়োজন হয়, ঠিক ততটা অর্থই অভ্যন্তীণ অথবা বাইরের সূত্র থেকে সংগ্রহ করা যায়। তবে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বাজেটের ক্ষেত্রে ঘটে উলটো ঘটনা। সেখানে একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চাইলেই তার আয় বাড়াতে পারে না। ফলে তাকে সীমিত আয় দ্বারা বর্ধিত ব্যয় মেটানোর জন্য চাহিদা কাটছাঁট করতে হয়। এতে মানুষের ভোগপ্রবণতা ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হয়। একজন মানুষ যখন একটি পণ্য ভোগ বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন তিনি সেই পণ্যটি যে কোনো মূল্যেই পেতে চাইবেন। কিন্তু আয় যদি না বাড়ে, তাহলে তার পক্ষে অতিরিক্ত ব্যয় করে সেই কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি ক্রয় করা সম্ভব হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য আমাদের জাতীয় বাজেট হবে অত্যন্ত জটিল ও কঠিন একটি বাজেট। বিশেষ করে সাধারণ দরিদ্র মানুষের জন্য এ বাজেটে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেটাই দেখার বিষয়।
করোনা অতিমারির প্রভাব থেকে দেশের অর্থনীতি যখন উত্তরণের পর্যায়ে ছিল, ঠিক তখনই ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’র মতো শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্ব অর্থনীতি আবারও নতুন করে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এ অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি প্রত্যেক মানুষের ওপরই প্রভাব ফেলেছে। তবে দরিদ্র ও নিু-মধ্যম আয়ের মানুষের ওপর এ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ আকারে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব কতটা উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, তা বাজারে গেলেই টের পাওয়া যায়। প্রতিটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগেও যে গরুর মাংসের কেজি ছিল ৬৫০ টাকা, তা এখন ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও এখন আর গরুর মাংস ক্রয় করতে পারছেন না। কোনো কোনো জেলায় আড়াইশ গ্রাম গরুর মাংস বিক্রি শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতি যে কতটা উদ্বেগজনক, তা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়োজন হয় না।
আমাদের দেশে একশ্রেণির ব্যবসায়ী আছে, যারা কোনো অজুহাত পেলেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে গণদুর্ভোগ সৃষ্টি করে থাকে। স্থানীয়ভাবে যেসব পণ্য উৎপাদিত হয়, তার ওপর তো ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা প্রতিটি পণ্যের মূল্য বাড়িয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। দেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ী কতটা খারাপ, প্রসঙ্গক্রমে তার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ইরাক কুয়েত দখল করে নেয়। সেই সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) তাৎক্ষণিকভাবে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য যাচাই করে এবং ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের কারণে রাজধানী ঢাকার বাজারে শাকসবজির মূল্য বেড়েছিল সবচেয়ে বেশি। অথচ অর্থনীতির কোনো সূত্রই শাকসবজির এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে সমর্থন করে না। কারণ সেই সময় যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশ থেকে শাকসবজি রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এতে স্থানীয় বাজারে শাকসবজির উপস্থিতি বেড়ে যায়। এ সময় শাকসবজির মূল্য স্বাভাবিকভাবেই কমে যাওয়ার কথা ছিল। এ দেশের একশ্রেণির অবিবেচক ব্যবসায়ী কোনো অজুহাত পেলেই পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে গণদুর্ভোগ সৃষ্টিতে তৎপর হয়। কয়েকদিন পরই শুরু হবে পবিত্র রমজান। এ সময় প্রতিটি পরিবারই একটু উন্নত মানের খাবার খেতে চাইবে। এ সুযোগে আমাদের দেশের একশ্রেণির অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ী বাজারে পণ্যমূল্য বাড়িতে দিতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আমদানি কমানোর জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। আগে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ১২টি পণ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন এর সংখ্যা ২৬-এ উন্নীত করা হয়েছে। ১২৩টি পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। কোনো কোনো পণ্যের এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) মার্জিন শতভাগ করা হয়েছে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে আমদানি ব্যয় কিছুটা হলেও কমেছে। কিন্তু এরপরও বলা যাবে না যেসব পণ্য আমদানির জন্য অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, তা সত্যি সত্যি দেশে আসছে কি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে বলেছেন, তারা এমন কিছু আমদানি চালান প্রত্যক্ষ করেছেন, যেখানে কোনো কোনো পণ্যের আমদানি ব্যয় ২০ থেকে ২০০ শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। অবস্থা কতটা ভয়াবহ, তা সহজেই অনুমেয়।
আমদানি ব্যয় কমার একটি বড় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সর্বশেষ হিসাব অনুসারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১০৫ কোটি মার্কিন ডলারে। এটিও প্রকৃত রিজার্ভ নয়। কারণ এর মধ্যে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ দেওয়া হয়েছে। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ২ হাজার ৩০৫ কোটি মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে আমদানিকারকরা পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছেন না। ফলে পণ্য আমদানি ব্যয় কমে যাচ্ছে। এটি আমদানিকৃত পণ্যের ব্যবহার হ্রাসের কারণে হচ্ছে না। এটি হচ্ছে মূলত ডলার সংকটের কারণে। মাসভিত্তিক পণ্য আমদানি খাতে ব্যয়ের পরিসংখ্যান প্রত্যক্ষ করলেই পরিস্থিতি অনুধাবন করা যাবে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের নভেম্বরে আমদানি ব্যয় হয়েছিল ৭৬১ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের নভেম্বরে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৭৭৩ কোটি মার্কিন ডলার। এ দুই অর্থবছরের ডিসেম্বরে আমদানি ব্যয় হয়েছিল যথাক্রমে ৮১৪ কোটি এবং ৬৩২ কোটি মার্কিন ডলার। জানুয়ারিতে এটি ছিল যথাক্রমে ৮০৫ কোটি এবং ৬৩৫ কোটি মার্কিন ডলার। ফেব্রুয়ারিতে এটি ছিল ৮১৮ কোটি এবং ৫০৩ কোটি মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে সর্বোচ্চ ৮১৮ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে তা ৫০৩ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। মানুষের ভোগব্যয় বর্ণিত সময়ে কমেছে তা নয়। মার্কিন ডলারের সংকটের কারণে আমদানিকারকরা পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। পণ্য আমদানি কমে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবেই। সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি প্রভৃতি নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা সংকট এবং অর্থনীতির অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন পেয়েছে। এ ঋণ অনুমোদন পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বেশকিছু শর্ত মেনে নিতে হয়েছে। এসব শর্ত স্থানীয়ভাবে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। আইএমএফ-এর শর্তের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেওয়া ব্যাপক মাত্রার ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশ গত ১২-১৩ বছর ধরে আইএমএফ-এর কাছ থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি। ফলে সংস্থাটি বাংলাদেশকে কোনো শর্ত দিতে পারেনি। আইএমএফ কর্তৃপক্ষ খুব ভালো করেই জানে, কোনো দেশ শখের বশে তাদের কাছ থেকে ঋণ নেয় না। একান্ত বিপদে পড়লেই কেবল একটি দেশ আইএমএফ-এর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। তাই ঋণ গ্রহণকারী দেশের ওপর তারা নানা ধরনের শর্ত চাপিয়ে দেয়। আইএমএফ-এর শর্ত পরিপালনের প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসাবে ইতোমধ্যেই অভ্যন্তরীণ বাজারে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সময় বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পেলে অভ্যন্তরীণ বাজারেও মূল্য সমন্বয় করা হবে। কিন্তু মন্ত্রণালয় তাদের সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি মূল্য ইউক্রেন যুদ্ধের পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়নি।
আগামী জাতীয় বাজেটে আইএমএফকে খুশি করার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমানো হতে পারে। তবে সমস্যা দেখা দেবে কৃষি খাতে ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ অনেকদিন ধরেই উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শ উপেক্ষা করে কৃষি খাতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে। ভর্তুকির কারণে কৃষি খাতে যে অগ্রগতি হচ্ছে, তা চোখে পড়ার মতো। এ অবস্থায় সরকার কি আগামী বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখবে, নাকি কমাবে-এটি একটি বড় প্রশ্ন। বস্তুত আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক