ব্যাংকগুলোর সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে
jugantor
ব্যাংকগুলোর সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে

  ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ  

২৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণপ্রাপ্তির অনুমোদন পেয়েছে। এজন্য বাংলাদেশকে বেশকিছু শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিতকরণ এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনার বিষয়ে। আইএমএফ ব্যাংক খাতের সংস্কারের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বা প্রয়োজনীয়। অনেকদিন আগে থেকেই অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে আসছিল। অর্থাৎ আইএমএফ দেশের ব্যাংক খাত সংস্কারের ব্যাপারে যেসব শর্ত দিয়েছে, তা অবশ্যই যৌক্তিক। এসব শর্ত বাস্তবায়ন করা হলে দেশের ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা ভালো হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

আইএমএফ ঋণদানের ক্ষেত্রে যেসব পূর্বশর্ত দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, ব্যাংক খাতে ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনা, রাজস্ব খাতের সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়ানো, জ্বালানি শক্তির ওপর থেকে ভর্তুকি কমানো, প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রভৃতি। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে অনেকটা অসহনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এ খাতে অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অবস্থাও খুব একটা ভালো পর্যায়ে নেই। সম্প্রতি ব্যক্তি মালিকানাধীন কয়েকটি ব্যাংকে বড় রকমের দুর্নীতির খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এতে আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই তাদের আমানতকৃত অর্থ তুলে নিচ্ছেন। ফলে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।

আইএমএফ রাজস্ব বাড়াতে কিছু সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য শর্ত দিয়েছে। আমাদের রাজস্ব আদায়ের হার অত্যন্ত কম। গত অর্থবছরে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত দাঁড়ায় ৯:৭। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। এমনকি নেপালের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে ২৩:৯। ট্যাক্স আদায়ের পরিমাণ বাড়ানো না গেলে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমস্যা হয়। আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, তার অধিকাংশই বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বার্থেই বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ নীতিগতভাবে শর্তগুলো পরিপালনে সম্মত হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে শর্তগুলো বাস্তবায়ন করে।

আইএমএফ বাংলাদেশের অনুকূলে মঞ্জুরিকৃত ঋণের প্রথম কিস্তি ইতোমধ্যেই ছাড় করেছে। তারা মোট ৪২ মাসে সাত কিস্তিতে পুরো ঋণ ছাড় করবে। তারা অনুমোদিত ঋণের পরবর্তী কিস্তি ছাড় করার আগে পর্যালোচনা করবে আরোপিত শর্ত বাংলাদেশ পরিপালন করছে কিনা বা পরিপালনে কতটা আন্তরিক।

আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাবায়নের পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার পরামর্শ দিয়েছে। বর্তমানে ব্যাংক গ্রস পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাবায়ন করছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে যে অর্থ রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে, তাকে রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত করে দেখাচ্ছে। কিন্তু আইএমএফ বলেছে, যে অর্থ ব্যবহারযোগ্য নয়, তা কখনই রিজার্ভ অর্থ হতে পারে না। তাই বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োজিত রিজার্ভ অর্থ মোট রিজার্ভের পরিমাণ থেকে বাদ দিতে হবে।

আইএমএফ-এর যেসব শর্তের কথা আমরা শুনেছি, এর বাইরেও আরও কিছু শর্ত আছে যেগুলো তেমন একটা আলোচিত হচ্ছে না। যেমন তারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসানের বিষয়গুলো দেখতে চাচ্ছে। বিভিন্ন পণ্যের ওপর সরকার যে ভর্তুকি প্রদান করছে, তা নিয়েও সংস্থাটির আপত্তি আছে। সরকার ভর্তুকি প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে কিছুটা তৎপরতা দেখাচ্ছে। ইতোমধ্যেই বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি পণ্যের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ইত্যাদি পণ্যের ওপর ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হবে। আইএমএফ পুঁজিবাজার সম্পর্কেও কথাবার্তা বলেছে। সরকার আগামী দিনে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি-এসব খাতে যে ভর্তুকি প্রত্যাহার বা হ্রাস করতে যাচ্ছে, এটি মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। তবে কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদানের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে। মূল্যস্ফীতির বিদ্যমান হার আরও বেড়ে যাবে। এতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের জন্য এ খাতের লোকসানের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কী কারণে লোকসান হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। এসব প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব রয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সম্ভাবনার পুরোটা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছে না। তাই ভর্তুকি প্রত্যাহারের আগে প্রতিষ্ঠানগুলোয় অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করাটাই বেশি জরুরি। অন্যথায় শুধু ভর্তুকি প্রত্যাহার করে এসব প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করা যাবে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো যদি সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে, তাহলে আইএমএফের শর্ত পরিপালন করা সহজ হবে এবং আমরা এ সংস্কার কার্যক্রম থেকে সুফল পাব।

আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, এর মধ্যে বেশকিছু শর্ত আছে যা অত্যন্ত কঠিন। যেমন: রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের বিদ্যমান খেলাপি ঋণের হার ৯ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, দুর্নীতি কমানো, রাজস্ব আয় বাড়ানো প্রভৃতি। এছাড়া বর্তমানে ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ ৯ শতাংশ নির্ধারিত রয়েছে। এটি বাজার চাহিদার তুলনায় অনেক কম। যত দ্রুত সম্ভব ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করা প্রয়োজন। আমানতের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো আমানত সংকটে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্ভবত এ বিষয়টি অনুধাবন করেই আমানতের ওপর প্রদেয় সর্বোচ্চ সুদের হার ৬ শতাংশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে; কিন্তু ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ এখনো ৯ শতাংশ রয়ে গেছে। এতে ব্যাংকগুলোর স্প্রেড কমে যাচ্ছে। তারা ৭/৮ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। কিন্তু সেই আমানতকৃত অর্থ ৯ শতাংশে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে।

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অনেকদিন ধরেই ব্যাংকসংশ্লিষ্টদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে রয়েছে। কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আলামত লক্ষ করা যাচ্ছে না। আমি জানি না কর্তৃপক্ষ খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়টি কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আইএমএফ বলুক আর নাই বলুক, আমাদের খেলাপি ঋণ তো কমাতেই হবে। কোনোভাবেই খেলাপি ঋণের এ উচ্চ প্রবণতা মেনে নেওয়া যায় না। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাদের কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতের জন্য খেলাপি ঋণ একটি ‘দুষ্ট ক্ষত’ হিসাবে পরিচিত। খেলাপি ঋণের বর্তমান ধারা অব্যাহত রেখে সুষ্ঠু ব্যাংকব্যবস্থা গড়ে তোলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিষয়টি আমাদের অনুধাবন করতে হবে। ব্যাংক ঋণের একটি বড় অংশ সামান্য কিছু গ্রাহকের কাছে আটকে থাকায় যারা ভালো উদ্যোক্তা তারাও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ঋণ পাচ্ছেন না। এতে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হচ্ছে। যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও নারী উদ্যোক্তা, তাদের জন্য ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তি খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়তো কিছুটা ভালোই হচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি না হলে চূড়ান্ত বিচারে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম ব্যাহত হতে বাধ্য। কিছু মানুষের হাতে ব্যাংক ঋণ আটকে থাকায় ঋণের অর্থের পুনঃচক্রায়ণ বিঘ্নিত হচ্ছে। সমাজে বিত্তবান-বিত্তহীনের মধ্যে সৃষ্ট ও বিদ্যমান বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এ অবস্থা একটি দেশের অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধক। খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে জোরদার প্রচেষ্টার অভাবে সম্পদ কিছু মানুষের কাছে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সম্ভাব্য ও যোগ্য উদ্যোক্তারা ঋণ পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ব্যাংকের ঋণের অর্থ ঠিকই বেরিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তা উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।

ব্যাংক খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরানোর জন্য প্রথমেই ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। সেই উদ্যোগ হতে হবে কার্যকর ও বাস্তবধর্মী। বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এটি খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র নয়। কারণ ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। উন্নয়ন সহযোগীরাও খেলাপি ঋণের এ পরিমাণ মানতে নারাজ। আইএমএফ বিভিন্ন সময় বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে চিত্র প্রদর্শন করছে তা বাস্তবসম্মত নয়। প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। বরং খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করে তা আদায়ের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিনদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো প্রভিশনিং কস্ট বেড়ে যায়। বিনিয়োগযোগ্য তারল্যে সংকট দেখা দেয়। ব্যাংকের আয় কমে যায়। ফলে ব্যাংকের পক্ষে আমানতকারীদের সুদ প্রদানের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। ব্যাংক খাতে যে দুরবস্থা তার জন্য মূলত অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাবই দায়ী। আমরা দেখছি, ব্যাংকের পরিচালকরা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করে। তারা ঋণ অনুমোদন থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই, যেখানে প্রভাব বিস্তার করেন না। পরিচালকদের প্রভাবে ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক ম্যানেজমেন্টও পরিচালকদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে কাজ করে থাকে। তারা একটি ‘কমফোর্ট জোন’ তৈরি করে। যে ঋণ প্রদান করা হয় তা ভালোভাবে যাচাই করা সম্ভব হয় না। কারণ এসব ঋণের ক্ষেত্রে পরিচালকদের প্রভাব থাকে।

একশ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তাও নানাভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। তাই তারা স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন না। যারা ঋণ গ্রহণ করেন, তাদের অনেকেই দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করেন। ব্যাংকে যারা সৎ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, তাদের পক্ষে এসব অনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর কিছু বিধিনিষেধ পরিপালনের কথা রয়েছে। সেগুলো সঠিকভাবে পরিপালিত হচ্ছে না। ব্যাসেল-১, ব্যাসেল-২, ব্যাসেল-৩ প্রভৃতি পরিপালনের কথা থাকলেও বেশির ভাগ ব্যাংকই এগুলো সঠিকভাবে পরিপালন করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব হচ্ছে এসব আইন সঠিকভাবে পরিপালিত হচ্ছে কি না, তা দেখা। সেই কাজটিও সঠিকভাবে হচ্ছে না। যারা এসব আইন পরিপালন করছে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন হলেও তা করা হচ্ছে না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের প্রতি একধরনের সহানুভূতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিম বিভিন্ন ব্যাংকে অডিট করতে যায়। সেই টিমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। আবার যারা অডিট করতে যান, তাদের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রায়ই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অডিট টিমে যারা থাকেন, তারা তাদের কাজটি সঠিকভাবে করছেন কি না, তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। অডিটরদের যোগ্যতা ও সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকা উচিত নয়। অডিট টিমের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যদি কোনো ব্যাংক থেকে অভিযোগ আসে, তাহলে দ্রুত সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ব্যাংকের সমস্যা সমাধানে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যাংকের নাম পরিবর্তন বা লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করলে কোনো লাভ হবে না। (অনুলিখন : এম এ খালেক)

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক; অর্থনীতিবিদ

ব্যাংকগুলোর সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে

 ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ 
২৪ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণপ্রাপ্তির অনুমোদন পেয়েছে। এজন্য বাংলাদেশকে বেশকিছু শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিতকরণ এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনার বিষয়ে। আইএমএফ ব্যাংক খাতের সংস্কারের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বা প্রয়োজনীয়। অনেকদিন আগে থেকেই অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে আসছিল। অর্থাৎ আইএমএফ দেশের ব্যাংক খাত সংস্কারের ব্যাপারে যেসব শর্ত দিয়েছে, তা অবশ্যই যৌক্তিক। এসব শর্ত বাস্তবায়ন করা হলে দেশের ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা ভালো হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

আইএমএফ ঋণদানের ক্ষেত্রে যেসব পূর্বশর্ত দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, ব্যাংক খাতে ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনা, রাজস্ব খাতের সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়ানো, জ্বালানি শক্তির ওপর থেকে ভর্তুকি কমানো, প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রভৃতি। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে অনেকটা অসহনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এ খাতে অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অবস্থাও খুব একটা ভালো পর্যায়ে নেই। সম্প্রতি ব্যক্তি মালিকানাধীন কয়েকটি ব্যাংকে বড় রকমের দুর্নীতির খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এতে আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই তাদের আমানতকৃত অর্থ তুলে নিচ্ছেন। ফলে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।

আইএমএফ রাজস্ব বাড়াতে কিছু সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য শর্ত দিয়েছে। আমাদের রাজস্ব আদায়ের হার অত্যন্ত কম। গত অর্থবছরে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত দাঁড়ায় ৯:৭। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। এমনকি নেপালের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে ২৩:৯। ট্যাক্স আদায়ের পরিমাণ বাড়ানো না গেলে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমস্যা হয়। আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, তার অধিকাংশই বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বার্থেই বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ নীতিগতভাবে শর্তগুলো পরিপালনে সম্মত হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে শর্তগুলো বাস্তবায়ন করে।

আইএমএফ বাংলাদেশের অনুকূলে মঞ্জুরিকৃত ঋণের প্রথম কিস্তি ইতোমধ্যেই ছাড় করেছে। তারা মোট ৪২ মাসে সাত কিস্তিতে পুরো ঋণ ছাড় করবে। তারা অনুমোদিত ঋণের পরবর্তী কিস্তি ছাড় করার আগে পর্যালোচনা করবে আরোপিত শর্ত বাংলাদেশ পরিপালন করছে কিনা বা পরিপালনে কতটা আন্তরিক।

আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাবায়নের পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার পরামর্শ দিয়েছে। বর্তমানে ব্যাংক গ্রস পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাবায়ন করছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে যে অর্থ রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে, তাকে রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত করে দেখাচ্ছে। কিন্তু আইএমএফ বলেছে, যে অর্থ ব্যবহারযোগ্য নয়, তা কখনই রিজার্ভ অর্থ হতে পারে না। তাই বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োজিত রিজার্ভ অর্থ মোট রিজার্ভের পরিমাণ থেকে বাদ দিতে হবে।

আইএমএফ-এর যেসব শর্তের কথা আমরা শুনেছি, এর বাইরেও আরও কিছু শর্ত আছে যেগুলো তেমন একটা আলোচিত হচ্ছে না। যেমন তারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসানের বিষয়গুলো দেখতে চাচ্ছে। বিভিন্ন পণ্যের ওপর সরকার যে ভর্তুকি প্রদান করছে, তা নিয়েও সংস্থাটির আপত্তি আছে। সরকার ভর্তুকি প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে কিছুটা তৎপরতা দেখাচ্ছে। ইতোমধ্যেই বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি পণ্যের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ইত্যাদি পণ্যের ওপর ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হবে। আইএমএফ পুঁজিবাজার সম্পর্কেও কথাবার্তা বলেছে। সরকার আগামী দিনে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি-এসব খাতে যে ভর্তুকি প্রত্যাহার বা হ্রাস করতে যাচ্ছে, এটি মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। তবে কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদানের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে। মূল্যস্ফীতির বিদ্যমান হার আরও বেড়ে যাবে। এতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের জন্য এ খাতের লোকসানের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কী কারণে লোকসান হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। এসব প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব রয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সম্ভাবনার পুরোটা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছে না। তাই ভর্তুকি প্রত্যাহারের আগে প্রতিষ্ঠানগুলোয় অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করাটাই বেশি জরুরি। অন্যথায় শুধু ভর্তুকি প্রত্যাহার করে এসব প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করা যাবে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো যদি সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে, তাহলে আইএমএফের শর্ত পরিপালন করা সহজ হবে এবং আমরা এ সংস্কার কার্যক্রম থেকে সুফল পাব।

আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, এর মধ্যে বেশকিছু শর্ত আছে যা অত্যন্ত কঠিন। যেমন: রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের বিদ্যমান খেলাপি ঋণের হার ৯ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, দুর্নীতি কমানো, রাজস্ব আয় বাড়ানো প্রভৃতি। এছাড়া বর্তমানে ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ ৯ শতাংশ নির্ধারিত রয়েছে। এটি বাজার চাহিদার তুলনায় অনেক কম। যত দ্রুত সম্ভব ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করা প্রয়োজন। আমানতের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো আমানত সংকটে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্ভবত এ বিষয়টি অনুধাবন করেই আমানতের ওপর প্রদেয় সর্বোচ্চ সুদের হার ৬ শতাংশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে; কিন্তু ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ এখনো ৯ শতাংশ রয়ে গেছে। এতে ব্যাংকগুলোর স্প্রেড কমে যাচ্ছে। তারা ৭/৮ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। কিন্তু সেই আমানতকৃত অর্থ ৯ শতাংশে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে।

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অনেকদিন ধরেই ব্যাংকসংশ্লিষ্টদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে রয়েছে। কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আলামত লক্ষ করা যাচ্ছে না। আমি জানি না কর্তৃপক্ষ খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়টি কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আইএমএফ বলুক আর নাই বলুক, আমাদের খেলাপি ঋণ তো কমাতেই হবে। কোনোভাবেই খেলাপি ঋণের এ উচ্চ প্রবণতা মেনে নেওয়া যায় না। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাদের কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতের জন্য খেলাপি ঋণ একটি ‘দুষ্ট ক্ষত’ হিসাবে পরিচিত। খেলাপি ঋণের বর্তমান ধারা অব্যাহত রেখে সুষ্ঠু ব্যাংকব্যবস্থা গড়ে তোলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিষয়টি আমাদের অনুধাবন করতে হবে। ব্যাংক ঋণের একটি বড় অংশ সামান্য কিছু গ্রাহকের কাছে আটকে থাকায় যারা ভালো উদ্যোক্তা তারাও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ঋণ পাচ্ছেন না। এতে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হচ্ছে। যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও নারী উদ্যোক্তা, তাদের জন্য ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তি খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়তো কিছুটা ভালোই হচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি না হলে চূড়ান্ত বিচারে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম ব্যাহত হতে বাধ্য। কিছু মানুষের হাতে ব্যাংক ঋণ আটকে থাকায় ঋণের অর্থের পুনঃচক্রায়ণ বিঘ্নিত হচ্ছে। সমাজে বিত্তবান-বিত্তহীনের মধ্যে সৃষ্ট ও বিদ্যমান বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এ অবস্থা একটি দেশের অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধক। খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে জোরদার প্রচেষ্টার অভাবে সম্পদ কিছু মানুষের কাছে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সম্ভাব্য ও যোগ্য উদ্যোক্তারা ঋণ পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ব্যাংকের ঋণের অর্থ ঠিকই বেরিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তা উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।

ব্যাংক খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরানোর জন্য প্রথমেই ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। সেই উদ্যোগ হতে হবে কার্যকর ও বাস্তবধর্মী। বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এটি খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র নয়। কারণ ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। উন্নয়ন সহযোগীরাও খেলাপি ঋণের এ পরিমাণ মানতে নারাজ। আইএমএফ বিভিন্ন সময় বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে চিত্র প্রদর্শন করছে তা বাস্তবসম্মত নয়। প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। বরং খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করে তা আদায়ের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিনদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো প্রভিশনিং কস্ট বেড়ে যায়। বিনিয়োগযোগ্য তারল্যে সংকট দেখা দেয়। ব্যাংকের আয় কমে যায়। ফলে ব্যাংকের পক্ষে আমানতকারীদের সুদ প্রদানের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। ব্যাংক খাতে যে দুরবস্থা তার জন্য মূলত অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাবই দায়ী। আমরা দেখছি, ব্যাংকের পরিচালকরা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করে। তারা ঋণ অনুমোদন থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই, যেখানে প্রভাব বিস্তার করেন না। পরিচালকদের প্রভাবে ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক ম্যানেজমেন্টও পরিচালকদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে কাজ করে থাকে। তারা একটি ‘কমফোর্ট জোন’ তৈরি করে। যে ঋণ প্রদান করা হয় তা ভালোভাবে যাচাই করা সম্ভব হয় না। কারণ এসব ঋণের ক্ষেত্রে পরিচালকদের প্রভাব থাকে।

একশ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তাও নানাভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। তাই তারা স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন না। যারা ঋণ গ্রহণ করেন, তাদের অনেকেই দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করেন। ব্যাংকে যারা সৎ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, তাদের পক্ষে এসব অনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর কিছু বিধিনিষেধ পরিপালনের কথা রয়েছে। সেগুলো সঠিকভাবে পরিপালিত হচ্ছে না। ব্যাসেল-১, ব্যাসেল-২, ব্যাসেল-৩ প্রভৃতি পরিপালনের কথা থাকলেও বেশির ভাগ ব্যাংকই এগুলো সঠিকভাবে পরিপালন করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব হচ্ছে এসব আইন সঠিকভাবে পরিপালিত হচ্ছে কি না, তা দেখা। সেই কাজটিও সঠিকভাবে হচ্ছে না। যারা এসব আইন পরিপালন করছে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন হলেও তা করা হচ্ছে না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের প্রতি একধরনের সহানুভূতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিম বিভিন্ন ব্যাংকে অডিট করতে যায়। সেই টিমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। আবার যারা অডিট করতে যান, তাদের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রায়ই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অডিট টিমে যারা থাকেন, তারা তাদের কাজটি সঠিকভাবে করছেন কি না, তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। অডিটরদের যোগ্যতা ও সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকা উচিত নয়। অডিট টিমের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যদি কোনো ব্যাংক থেকে অভিযোগ আসে, তাহলে দ্রুত সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ব্যাংকের সমস্যা সমাধানে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যাংকের নাম পরিবর্তন বা লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করলে কোনো লাভ হবে না। (অনুলিখন : এম এ খালেক)

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক; অর্থনীতিবিদ

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন