দেশপ্রেমের পরীক্ষা
চারদিকের নৈরাশ্যজনক খবরের মধ্যে যখন দু-চারটা ভালো খবর শুনি, প্রশংসনীয় উদ্যোগ দেখি, তখন আনন্দে উদ্বেল হই! চোখে পানি এসে যায়। তেমনই একটি খবর চোখে পড়ল। রাজশাহীর চারঘাটের ইউএনও সোহরাব হোসেন ১৭ হাজার ছেলেমেয়েকে দেশপ্রেমের পরীক্ষায় বসিয়েছেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি উপজেলার অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে প্রশ্ন পাঠানো হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে ১৭টি প্রশ্নের একটি প্রশ্নমালা তৈরি করা হয়েছে, যা উন্মুক্ত। অর্থাৎ অন্যের কাছে জেনেশুনে উত্তর লিখতে পারবে তারা। মুখস্থ থাকলে ভালো, না হলে জেনে নেওয়ার এ সুযোগ তাদের দেওয়া হয়েছে। ১ থেকে ১৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তর হবে অল্পকথায়। প্রশ্নগুলো এমন-তোমার এলাকার জীবিত তিনজন মুক্তিযোদ্ধা ও দুজন শহিদের নাম লেখ। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কে ছিলেন? জাতীয় চার নেতার নাম কী? বীরপ্রতীক, বীরবিক্রম, বীর-উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত? দুজন নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম লেখ। এ ধরনের ১৬টি প্রশ্ন। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য নম্বর ৫। ১৭ নম্বর প্রশ্নটি বর্ণনামূলক-‘সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার’ উক্তিটির আলোকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ঘিরে তোমার আবেগ-অনুভূতি-স্বপ্ন-প্রত্যাশা লেখ। এর উত্তরটি দিতে হবে ১০০ শব্দের মধ্যে। এর জন্য নির্ধারিত নম্বর ২০। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে উপজেলার প্রতিটি বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষার্থীকে পুরস্কৃত করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে আমাদের সন্তানদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এ প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার একটি পদক্ষেপও এটি। যেখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা জানে না একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর আর ২৬ মার্চ কী; জানে না আমাদের জাতীয় সংগীত কোনটি, এর রচয়িতা কে, সেখানে রণসংগীত আর তার রচয়িতার নাম জানা তো অনেক দূরের কথা। এদেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল-তা-ও তো একালের অনেক ছেলেমেয়ের অজানা। সে কারণে তাদের মনে এ সম্পর্কে কোনো আবেগ-অনুভূতি কাজ করে না। বয়স্করাও কেউ কেউ কথায় কথায় বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বেঁচে আর কতদিন চলবে। এ বড় আদিখ্যেতা হচ্ছে।’ অনেকে এখনো বলে ‘গন্ডগোলের বছর’। এর কারণও আছে। কতিপয় দিবস পালন ছাড়া ভাষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের মহিমা তুলে ধরার কোনো উদ্যোগ নেই। সবই দিবসকেন্দ্রিক। আর প্রতিদিনই এমন নতুন নতুন দিবসের নাম শুনছি যে, সত্যিকার পালন করার যে দিবস, সেগুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে ভাবি-হাত ধোয়া দিবস, পা ধোয়া দিবস, জল তোলা দিবস, জল ফেলা দিবস করতে করতে তো আসল দিবসগুলো হারিয়ে যাবে। মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা বলেও তো একটা কথা আছে! এ তো দেখছি একটা দিবস ডিকশনারি খুলতে হবে। প্রতিদিন সেটার পাতা উলটে দেখতে হবে আজ কী দিবস!
স্বাধীনতার মহিমা ম্লান হওয়ার আরেক কারণ অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের সময় নিউমোনিয়ায় মারা গেছেন কেউ, পরিবার তাকে বানিয়ে দিয়েছে শহিদ। কঞ্চির খোঁচায় পা রক্তাক্ত হয়ে গেছে, তিনি হয়েছেন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে জন্ম নেয়নি এমন সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধার কথা তো পত্রিকাতেই পড়লাম। চাকরির বয়স হয়নি, তারা নাকি সব মুজিবনগর সরকারের চাকুরে ছিলেন। কলকাতা গেছেন, ঘুরেছেন ফিরেছেন, খেয়েছেন। সীমান্ত পার হওয়ার কারণেই তারা বড় বড় যোদ্ধা। বাতিলের পরও রয়ে গেছে অঢেল। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতেও অনেকে কুণ্ঠিত হন। সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের কৃতিত্বের কথা বলতে পারেন না স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এই বুঝি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তকমা জোটে! আম আর আমড়া এক হয়ে গেছে।
এরকম একটা সময়ে এ ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। পুথিগত বিদ্যায় দেশপ্রেম হয় না। দেশপ্রেম জাগাতে হলে দেশকে জানতে হয়। আগের দিনের ছেলেমেয়েরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে বইপত্র পড়ত। তাই তারা জানতে পারত ক্ষুদিরাম সম্পর্কে, মাস্টার দা সূর্যসেন সম্পর্কে, বীরকন্যা প্রীতিলতা সম্পর্কে, নেতাজি সুভাস বোস সম্পর্কে। জানত তাদের অবিস্মরণীয় কীর্তিগাথা। তাদের শ্রদ্ধা করত। তাদের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখত। আমি নিশ্চিত, এখনকার অধিকাংশ শিক্ষার্থী এ প্রাতঃস্মরণীয়দের নাম জানে না। পরিবার থেকে জানানোর কোনো চেষ্টাও নেওয়া হয় না। ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি/হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী’ শুনেছিলাম কোন ছেলেবেলায়। এ গান শুনে মা কাঁদতেন, সঙ্গে বুঝে না বুঝে আমিও কাঁদতাম। মা শোনাতেন ক্ষুদিরামের গল্প। আজকালকার কয়টা ছেলেমেয়ে এ গান শুনেছে! কজন মা তাদের সন্তানদের বলেছেন এ গল্প! আর জানেনই বা কতজন মা!
অসংখ্য বইয়ের ভারে জর্জরিত আজকের শিক্ষার্থীরা। তার ওপর আছে কোচিং, একটি-দুটি নয়, লাগাতার। কোচিংয়ের চাপে ভারাক্রান্ত শিক্ষার্থীরা বাইরের বই পড়বে কখন, শিখবে কী? অনেক বাবা-মা চানও না তাদের ছেলেমেয়েরা গল্প-উপন্যাস পড়ুক। তারা এগুলোকে বলেন ‘আউট বই’। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছেলেমেয়েকে জিপিএ ৫ নামের ঘোড়ার ডিমটি পেতে হবে; যেটি পেলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অনেক সময় টেকেও না। এমনই জিপিএ-৫-এর গুরুত্ব!
আজকের ছেলেমেয়েদের শৈশব নেই, কৈশোর নেই, খেলার মাঠ নেই। তাদের জীবনে ঘুড়ি নেই, ডাংগুলি নেই, জিওলের আঠা নেই, প্রজাপতি নেই। স্কুলে স্কুলে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আর বিতর্ক নেই। নেই টিফিন ভাগাভাগি, খুনসুটি, মারামারি। এক অবরুদ্ধ জীবনের বাসিন্দা ওরা। ওদের জীবনে আছে বই-খাতা, ব্যাগ, কোচিং, মাস্টার। তারা কী করে জানবে দেশের কথা, দশের কথা। পাশের মানুষের কথা, প্রতিবেশীর কথা। আমরা নিজেরাই সন্তানদের চারপাশে দেওয়াল তুলে দিয়েছি। সেখানে কোনো ঘুলঘুলি নেই, বাইরের বাতাসের প্রবেশাধিকার নেই।
তারপর ছেলেমেয়ে বড় হলে, পাশ করে বেরোলে দেশে চাকরি নেই; এ দেশ বসবাসের অনুপযুক্ত বলে পাঠিয়ে দিচ্ছি বিদেশে। ব্যস নিশ্চিন্ত! কোনো চেষ্টা নেই দেশের ভালো করার, দেশের সমৃদ্ধির। অথচ এ দেশই তাদের প্রফেসর, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানায়। আমরা ধরেই নিই দেশের সবকিছু করবে সরকার। জনগণের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। দেশটাকে নিজেদের মতো করে গড়ব, অন্য কারও অধীনে থাকব না, অন্য কারও দেশে থাকব না বলেই তো মুক্তিযোদ্ধারা রক্ত ঢেলে দেশ স্বাধীন করেছিল। তাহলে এ স্বাধীনতার মানে কী?
এ চরম অসহনশীল আর ভঙ্গুর সময়ে চারঘাটের ইউএনও সোহরাব হোসেন এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন। উন্মুক্ত প্রশ্নাবলির উত্তর সন্ধানে ছেলেমেয়েরা এলাকায় ঘুরবে। বাবা-মা প্রতিবেশী শিক্ষকদের কাছে জানতে চাইবে তাদের এলাকার শহিদ আর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান করবে। বই পড়বে উত্তরের সন্ধানে। মুক্তিযুদ্ধের দু-চারটি উপন্যাস বা গল্পও তাদের পড়া হয়ে যাবে। অন্তত বইগুলো আর তার লেখকদের নাম তো জানবে। এভাবে দেশের আর মুক্তিযুদ্ধের অনেক কথাই তারা জানতে পারবে, যা এতদিন তারা জানতে পারেনি। হয়তো দু-চারজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তারা সরাসরি পরিচিত হবে। শুনবে তাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার কথা। সত্যি, ভাবতেই খুব ভালো লাগছে, একজন মুক্তিযোদ্ধা চোখ বুজে যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করছেন আর একজন শিক্ষার্থী মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে সেই সত্যি গল্প!
অতীতে প্রশাসনের আমলাদের নানা অসংগতি উল্লেখ করে কলাম লিখেছি। লিখেছি তাদের সাফল্যগাথাও। আজ এ লেখাটি লিখতে একজন শহিদ পরিবারের সদস্য হিসাবে আমি নিজেই উদ্বেলিত। সবে আমরা একুশে পার করে এসেছি। মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে, ঐতিহাসিক মার্চে এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেওয়ায় আপ্লুত হচ্ছি।
আসলে দেশকে ভালোবাসলে, দেশের জন্য ভাবলে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব। দেশপ্রেমের পরীক্ষা নেওয়া চারঘাটের ইউএনওর গভীর দেশপ্রেমের নিদর্শন। তাকে সাধুবাদ জানাই!
ড. আফরোজা পারভীন : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্ম সচিব
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
দেশপ্রেমের পরীক্ষা
চারদিকের নৈরাশ্যজনক খবরের মধ্যে যখন দু-চারটা ভালো খবর শুনি, প্রশংসনীয় উদ্যোগ দেখি, তখন আনন্দে উদ্বেল হই! চোখে পানি এসে যায়। তেমনই একটি খবর চোখে পড়ল। রাজশাহীর চারঘাটের ইউএনও সোহরাব হোসেন ১৭ হাজার ছেলেমেয়েকে দেশপ্রেমের পরীক্ষায় বসিয়েছেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি উপজেলার অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে প্রশ্ন পাঠানো হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে ১৭টি প্রশ্নের একটি প্রশ্নমালা তৈরি করা হয়েছে, যা উন্মুক্ত। অর্থাৎ অন্যের কাছে জেনেশুনে উত্তর লিখতে পারবে তারা। মুখস্থ থাকলে ভালো, না হলে জেনে নেওয়ার এ সুযোগ তাদের দেওয়া হয়েছে। ১ থেকে ১৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তর হবে অল্পকথায়। প্রশ্নগুলো এমন-তোমার এলাকার জীবিত তিনজন মুক্তিযোদ্ধা ও দুজন শহিদের নাম লেখ। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কে ছিলেন? জাতীয় চার নেতার নাম কী? বীরপ্রতীক, বীরবিক্রম, বীর-উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত? দুজন নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম লেখ। এ ধরনের ১৬টি প্রশ্ন। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য নম্বর ৫। ১৭ নম্বর প্রশ্নটি বর্ণনামূলক-‘সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার’ উক্তিটির আলোকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ঘিরে তোমার আবেগ-অনুভূতি-স্বপ্ন-প্রত্যাশা লেখ। এর উত্তরটি দিতে হবে ১০০ শব্দের মধ্যে। এর জন্য নির্ধারিত নম্বর ২০। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে উপজেলার প্রতিটি বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষার্থীকে পুরস্কৃত করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে আমাদের সন্তানদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এ প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার একটি পদক্ষেপও এটি। যেখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা জানে না একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর আর ২৬ মার্চ কী; জানে না আমাদের জাতীয় সংগীত কোনটি, এর রচয়িতা কে, সেখানে রণসংগীত আর তার রচয়িতার নাম জানা তো অনেক দূরের কথা। এদেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল-তা-ও তো একালের অনেক ছেলেমেয়ের অজানা। সে কারণে তাদের মনে এ সম্পর্কে কোনো আবেগ-অনুভূতি কাজ করে না। বয়স্করাও কেউ কেউ কথায় কথায় বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বেঁচে আর কতদিন চলবে। এ বড় আদিখ্যেতা হচ্ছে।’ অনেকে এখনো বলে ‘গন্ডগোলের বছর’। এর কারণও আছে। কতিপয় দিবস পালন ছাড়া ভাষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের মহিমা তুলে ধরার কোনো উদ্যোগ নেই। সবই দিবসকেন্দ্রিক। আর প্রতিদিনই এমন নতুন নতুন দিবসের নাম শুনছি যে, সত্যিকার পালন করার যে দিবস, সেগুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে ভাবি-হাত ধোয়া দিবস, পা ধোয়া দিবস, জল তোলা দিবস, জল ফেলা দিবস করতে করতে তো আসল দিবসগুলো হারিয়ে যাবে। মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা বলেও তো একটা কথা আছে! এ তো দেখছি একটা দিবস ডিকশনারি খুলতে হবে। প্রতিদিন সেটার পাতা উলটে দেখতে হবে আজ কী দিবস!
স্বাধীনতার মহিমা ম্লান হওয়ার আরেক কারণ অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের সময় নিউমোনিয়ায় মারা গেছেন কেউ, পরিবার তাকে বানিয়ে দিয়েছে শহিদ। কঞ্চির খোঁচায় পা রক্তাক্ত হয়ে গেছে, তিনি হয়েছেন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে জন্ম নেয়নি এমন সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধার কথা তো পত্রিকাতেই পড়লাম। চাকরির বয়স হয়নি, তারা নাকি সব মুজিবনগর সরকারের চাকুরে ছিলেন। কলকাতা গেছেন, ঘুরেছেন ফিরেছেন, খেয়েছেন। সীমান্ত পার হওয়ার কারণেই তারা বড় বড় যোদ্ধা। বাতিলের পরও রয়ে গেছে অঢেল। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতেও অনেকে কুণ্ঠিত হন। সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের কৃতিত্বের কথা বলতে পারেন না স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এই বুঝি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তকমা জোটে! আম আর আমড়া এক হয়ে গেছে।
এরকম একটা সময়ে এ ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। পুথিগত বিদ্যায় দেশপ্রেম হয় না। দেশপ্রেম জাগাতে হলে দেশকে জানতে হয়। আগের দিনের ছেলেমেয়েরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে বইপত্র পড়ত। তাই তারা জানতে পারত ক্ষুদিরাম সম্পর্কে, মাস্টার দা সূর্যসেন সম্পর্কে, বীরকন্যা প্রীতিলতা সম্পর্কে, নেতাজি সুভাস বোস সম্পর্কে। জানত তাদের অবিস্মরণীয় কীর্তিগাথা। তাদের শ্রদ্ধা করত। তাদের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখত। আমি নিশ্চিত, এখনকার অধিকাংশ শিক্ষার্থী এ প্রাতঃস্মরণীয়দের নাম জানে না। পরিবার থেকে জানানোর কোনো চেষ্টাও নেওয়া হয় না। ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি/হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী’ শুনেছিলাম কোন ছেলেবেলায়। এ গান শুনে মা কাঁদতেন, সঙ্গে বুঝে না বুঝে আমিও কাঁদতাম। মা শোনাতেন ক্ষুদিরামের গল্প। আজকালকার কয়টা ছেলেমেয়ে এ গান শুনেছে! কজন মা তাদের সন্তানদের বলেছেন এ গল্প! আর জানেনই বা কতজন মা!
অসংখ্য বইয়ের ভারে জর্জরিত আজকের শিক্ষার্থীরা। তার ওপর আছে কোচিং, একটি-দুটি নয়, লাগাতার। কোচিংয়ের চাপে ভারাক্রান্ত শিক্ষার্থীরা বাইরের বই পড়বে কখন, শিখবে কী? অনেক বাবা-মা চানও না তাদের ছেলেমেয়েরা গল্প-উপন্যাস পড়ুক। তারা এগুলোকে বলেন ‘আউট বই’। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছেলেমেয়েকে জিপিএ ৫ নামের ঘোড়ার ডিমটি পেতে হবে; যেটি পেলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অনেক সময় টেকেও না। এমনই জিপিএ-৫-এর গুরুত্ব!
আজকের ছেলেমেয়েদের শৈশব নেই, কৈশোর নেই, খেলার মাঠ নেই। তাদের জীবনে ঘুড়ি নেই, ডাংগুলি নেই, জিওলের আঠা নেই, প্রজাপতি নেই। স্কুলে স্কুলে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আর বিতর্ক নেই। নেই টিফিন ভাগাভাগি, খুনসুটি, মারামারি। এক অবরুদ্ধ জীবনের বাসিন্দা ওরা। ওদের জীবনে আছে বই-খাতা, ব্যাগ, কোচিং, মাস্টার। তারা কী করে জানবে দেশের কথা, দশের কথা। পাশের মানুষের কথা, প্রতিবেশীর কথা। আমরা নিজেরাই সন্তানদের চারপাশে দেওয়াল তুলে দিয়েছি। সেখানে কোনো ঘুলঘুলি নেই, বাইরের বাতাসের প্রবেশাধিকার নেই।
তারপর ছেলেমেয়ে বড় হলে, পাশ করে বেরোলে দেশে চাকরি নেই; এ দেশ বসবাসের অনুপযুক্ত বলে পাঠিয়ে দিচ্ছি বিদেশে। ব্যস নিশ্চিন্ত! কোনো চেষ্টা নেই দেশের ভালো করার, দেশের সমৃদ্ধির। অথচ এ দেশই তাদের প্রফেসর, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানায়। আমরা ধরেই নিই দেশের সবকিছু করবে সরকার। জনগণের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। দেশটাকে নিজেদের মতো করে গড়ব, অন্য কারও অধীনে থাকব না, অন্য কারও দেশে থাকব না বলেই তো মুক্তিযোদ্ধারা রক্ত ঢেলে দেশ স্বাধীন করেছিল। তাহলে এ স্বাধীনতার মানে কী?
এ চরম অসহনশীল আর ভঙ্গুর সময়ে চারঘাটের ইউএনও সোহরাব হোসেন এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন। উন্মুক্ত প্রশ্নাবলির উত্তর সন্ধানে ছেলেমেয়েরা এলাকায় ঘুরবে। বাবা-মা প্রতিবেশী শিক্ষকদের কাছে জানতে চাইবে তাদের এলাকার শহিদ আর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান করবে। বই পড়বে উত্তরের সন্ধানে। মুক্তিযুদ্ধের দু-চারটি উপন্যাস বা গল্পও তাদের পড়া হয়ে যাবে। অন্তত বইগুলো আর তার লেখকদের নাম তো জানবে। এভাবে দেশের আর মুক্তিযুদ্ধের অনেক কথাই তারা জানতে পারবে, যা এতদিন তারা জানতে পারেনি। হয়তো দু-চারজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তারা সরাসরি পরিচিত হবে। শুনবে তাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার কথা। সত্যি, ভাবতেই খুব ভালো লাগছে, একজন মুক্তিযোদ্ধা চোখ বুজে যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করছেন আর একজন শিক্ষার্থী মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে সেই সত্যি গল্প!
অতীতে প্রশাসনের আমলাদের নানা অসংগতি উল্লেখ করে কলাম লিখেছি। লিখেছি তাদের সাফল্যগাথাও। আজ এ লেখাটি লিখতে একজন শহিদ পরিবারের সদস্য হিসাবে আমি নিজেই উদ্বেলিত। সবে আমরা একুশে পার করে এসেছি। মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে, ঐতিহাসিক মার্চে এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেওয়ায় আপ্লুত হচ্ছি।
আসলে দেশকে ভালোবাসলে, দেশের জন্য ভাবলে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব। দেশপ্রেমের পরীক্ষা নেওয়া চারঘাটের ইউএনওর গভীর দেশপ্রেমের নিদর্শন। তাকে সাধুবাদ জানাই!
ড. আফরোজা পারভীন : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্ম সচিব