বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট
jugantor
বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট

  কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.)  

২৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সৃষ্টি হওয়া পূর্ব পাকিস্তানের শেষদিন; রাতটি ছিল ভয়ংকর বিভীষিকাময়। সেদিন দিবাগত রাতে পাক হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইটে’র নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে চালায় বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে এটি একটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন। গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ও অগ্নিসংযোগে বাংলার মানুষ হতচকিত ও জ্ঞানশূন্য হয়ে দিগ্বিদিক দৌড়াতে থাকে। অসংখ্য নারী-পুরুষ, শিশু, দুর্বল, সবল, বৃদ্ধকে নির্মম ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়।

পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিল এক কলঙ্কজনক রাত। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ২৩ বছর ৭ মাস ১২ দিনের অসংখ্য ব্যর্থতা, শাসন, শোষণ, নির্যাতন, শাসক শ্রেণির লোভ, হিংসা ও অবহেলার শত শত কালিমার সঙ্গে শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানের অস্তিত্বের কাঠে শেষ পেরেকটি পুঁতে দেয় ২৫ মার্চ। তারা নৃশংস গণহত্যা চালিয়ে চিরতরে বাঙালির স্বাধিকারের চেতনা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাঙালি জাতির জীবনে এক ভয়াল নিষ্ঠুরতার স্মৃতি হিসাবে চিহ্নিত এ কালরাত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এ দেশবাসীকে হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছিল। চিরতরে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।

ধর্মীয় কারণে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে কার্যত হিন্দুদের জন্য ভারত আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল বটে। ভারতীয় নেতারা আদর্শগতভাবে প্রকৃত হিন্দু ছিলেন; কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চরিত্র ইসলামী আদর্শের ধারেকাছেও ছিল না। ফলে পাকিস্তান সাংবিধানিকভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন ছিল না। ইসলামী আদর্শ যে সাম্য, মৈত্রী, মানবিক মূল্যবোধ, ইনসাফ, ন্যায়বিচার ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সৃষ্টি হয়েছে; পাকিস্তানি শাসকদের চরিত্রে তার ছিটেফোঁটাও ছিল না।

ফলে তারা পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের ওপর চরম জুলুম, অন্যায় ও অবিচার করতে থাকে। এসব কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মানুষের সম্মান-মর্যাদা, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা লাভের জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিকে উজ্জীবিত করে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য।

২৫ মার্চের গুরুত্ব বুঝতে হলে এর ইতিবৃত্ত জানতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল তার ‘ডেডলি এমব্রেস’ বইতে লিখেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই ‘পাকিস্তানের কাছে বাংলার গুরুত্ব ছিল দ্বিতীয়’ এবং বাঙালিদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ হিসাবে দেখা হতো। ‘প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাব প্রদেশের একচ্ছত্র দৌরাত্ম্য ছিল। পাকিস্তানের ওই অংশে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ছিল পাঞ্জাবে। সবচেয়ে বেশি উর্বর কৃষিজমি ছিল সেখানে। সবচেয়ে বড় কথা, সেনাবাহিনীতে বেশি প্রতিনিধিত্ব ছিল পাঞ্জাবের।

অনেক পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তা মনে করতেন, পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে তাদের স্বার্থ রক্ষায়। তাদের অনেকেই বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করতেন, মনে করতেন বাঙালিদের লড়াই করার ক্ষমতা নেই।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রে পাঞ্জাবিদের আধিপত্য কায়েম হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমাংশের উন্নয়নের দিকে প্রধান নজর দিল। পূর্ব পাকিস্তানকে একরকম উপনিবেশ হিসাবে দেখা শুরু হয়’ (সূত্র : বিবিসি)।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান বিধানসভায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে মতামত প্রদান করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার দিনের অনুষ্ঠানে তৎকালীন এরিয়া কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আইয়ুব খান বাঙালি সৈনিকদের উর্দু ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিলে মেজর এমটি হোসেন ও ক্যাপ্টেন এমএ গণি তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ করেন। ১৯ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে ঘোষণা দিলে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়।

১৯৫২ সালে রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এরপর পাকিস্তানিরা শুরু করে নানা ষড়যন্ত্র। গণতন্ত্রের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বৈরতন্ত্র বা সামরিক শাসন। দীর্ঘ নয় বছরে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হলেও সে অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছিল না। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জার মাধ্যমে সামরিক শাসন জারি করে গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করেন। ২০ দিনের মাথায় ইসকান্দার মির্জা অপসারিত হয়ে দেশান্তরিত হন। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন আইয়ুব খান।

যদিও ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে; কিন্তু চতুর এ স্বৈরশাসক নির্বাচনে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে প্রেসিডেন্টের পদটি দখল করেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বাঙালি সৈন্যদের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট অসাধারণ বীরত্ব ও বিস্ময়কর সফলতা প্রদর্শন করে। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসনের জন্য ৬ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু করেন, যা গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং সারা পাকিস্তান উত্তাল হয়ে পড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবির ওপর গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় রাওয়ালপিন্ডিতে এবং তা ব্যর্থ হলে ২৫ মার্চ আবারও সামরিক শাসন জারি করে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন।

জেনারেল ইয়াহিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দেন। ৩০০ আসনের এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে বিজয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। ১৪ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী।’ কিন্তু কুখ্যাত ভুট্টো ও পাকিস্তানি জেনারেলদের কূট চক্রান্তে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতিকে চিরতরে দুর্বল করার গভীর ষড়যন্ত্র চলতে থাকে গোপনে।

সারা পূর্ব পাকিস্তান আন্দোলনে উত্তাল হতে থাকে। এ গভীর ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের সামনে তার ঐতিহাসিক ভাষণে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি তার ভাষণে সর্বশেষ যে আলটিমেটাম দেন, তা ছিল-‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

এরপর ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য ঢাকায় আসেন। ১৬ থেকে ২২ মার্চ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যা ছিল এক প্রতারণা মাত্র। বৈঠকের আড়ালে তারা ব্যাপক গণহত্যা পরিচালনা করার জন্য সৈন্য বৃদ্ধি করতে থাকে। অবশেষে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। এরপর আসে সেই ২৫ মার্চ, বৃহস্পতিবারের কালরাত। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের আসল রূপে আত্মপ্রকাশ করে।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বাঙালি জাতির একটি প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য নারকীয় এক পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য সামনে রেখে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জেনারেল টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না।’ ফলস্বরূপ বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে বিভীষিকাময় এক কালরাত। হানাদার বাহিনী পরিকল্পিত পন্থায় হিংস্র দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালির ওপর।

মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর মঞ্জুর, এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার, এয়ার ভাইস মার্শাল বাশার ও আরও অনেক সিনিয়র বাঙালি সামরিক অফিসার একত্রিত হন তেলিয়াপাড়ায় ৪ ও ১০ এপ্রিল। প্রণয়ন করেন মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয় ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা। অসংখ্য শহিদের রক্ত ও মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং সৃষ্টি হয় একটি লাল-সবুজ পতাকার।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না।

কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব.) : সামরিক ইতিহাসবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

hoque2515@gmail.com

বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট

 কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.) 
২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সৃষ্টি হওয়া পূর্ব পাকিস্তানের শেষদিন; রাতটি ছিল ভয়ংকর বিভীষিকাময়। সেদিন দিবাগত রাতে পাক হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইটে’র নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে চালায় বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে এটি একটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন। গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ও অগ্নিসংযোগে বাংলার মানুষ হতচকিত ও জ্ঞানশূন্য হয়ে দিগ্বিদিক দৌড়াতে থাকে। অসংখ্য নারী-পুরুষ, শিশু, দুর্বল, সবল, বৃদ্ধকে নির্মম ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়।

পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিল এক কলঙ্কজনক রাত। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ২৩ বছর ৭ মাস ১২ দিনের অসংখ্য ব্যর্থতা, শাসন, শোষণ, নির্যাতন, শাসক শ্রেণির লোভ, হিংসা ও অবহেলার শত শত কালিমার সঙ্গে শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানের অস্তিত্বের কাঠে শেষ পেরেকটি পুঁতে দেয় ২৫ মার্চ। তারা নৃশংস গণহত্যা চালিয়ে চিরতরে বাঙালির স্বাধিকারের চেতনা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাঙালি জাতির জীবনে এক ভয়াল নিষ্ঠুরতার স্মৃতি হিসাবে চিহ্নিত এ কালরাত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এ দেশবাসীকে হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছিল। চিরতরে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।

ধর্মীয় কারণে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে কার্যত হিন্দুদের জন্য ভারত আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল বটে। ভারতীয় নেতারা আদর্শগতভাবে প্রকৃত হিন্দু ছিলেন; কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চরিত্র ইসলামী আদর্শের ধারেকাছেও ছিল না। ফলে পাকিস্তান সাংবিধানিকভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন ছিল না। ইসলামী আদর্শ যে সাম্য, মৈত্রী, মানবিক মূল্যবোধ, ইনসাফ, ন্যায়বিচার ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সৃষ্টি হয়েছে; পাকিস্তানি শাসকদের চরিত্রে তার ছিটেফোঁটাও ছিল না।

ফলে তারা পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের ওপর চরম জুলুম, অন্যায় ও অবিচার করতে থাকে। এসব কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মানুষের সম্মান-মর্যাদা, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা লাভের জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিকে উজ্জীবিত করে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য।

২৫ মার্চের গুরুত্ব বুঝতে হলে এর ইতিবৃত্ত জানতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল তার ‘ডেডলি এমব্রেস’ বইতে লিখেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই ‘পাকিস্তানের কাছে বাংলার গুরুত্ব ছিল দ্বিতীয়’ এবং বাঙালিদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ হিসাবে দেখা হতো। ‘প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাব প্রদেশের একচ্ছত্র দৌরাত্ম্য ছিল। পাকিস্তানের ওই অংশে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ছিল পাঞ্জাবে। সবচেয়ে বেশি উর্বর কৃষিজমি ছিল সেখানে। সবচেয়ে বড় কথা, সেনাবাহিনীতে বেশি প্রতিনিধিত্ব ছিল পাঞ্জাবের।

অনেক পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তা মনে করতেন, পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে তাদের স্বার্থ রক্ষায়। তাদের অনেকেই বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করতেন, মনে করতেন বাঙালিদের লড়াই করার ক্ষমতা নেই।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রে পাঞ্জাবিদের আধিপত্য কায়েম হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমাংশের উন্নয়নের দিকে প্রধান নজর দিল। পূর্ব পাকিস্তানকে একরকম উপনিবেশ হিসাবে দেখা শুরু হয়’ (সূত্র : বিবিসি)।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান বিধানসভায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে মতামত প্রদান করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার দিনের অনুষ্ঠানে তৎকালীন এরিয়া কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আইয়ুব খান বাঙালি সৈনিকদের উর্দু ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিলে মেজর এমটি হোসেন ও ক্যাপ্টেন এমএ গণি তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ করেন। ১৯ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে ঘোষণা দিলে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়।

১৯৫২ সালে রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এরপর পাকিস্তানিরা শুরু করে নানা ষড়যন্ত্র। গণতন্ত্রের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বৈরতন্ত্র বা সামরিক শাসন। দীর্ঘ নয় বছরে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হলেও সে অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছিল না। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জার মাধ্যমে সামরিক শাসন জারি করে গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করেন। ২০ দিনের মাথায় ইসকান্দার মির্জা অপসারিত হয়ে দেশান্তরিত হন। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন আইয়ুব খান।

যদিও ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে; কিন্তু চতুর এ স্বৈরশাসক নির্বাচনে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে প্রেসিডেন্টের পদটি দখল করেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বাঙালি সৈন্যদের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট অসাধারণ বীরত্ব ও বিস্ময়কর সফলতা প্রদর্শন করে। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসনের জন্য ৬ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু করেন, যা গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং সারা পাকিস্তান উত্তাল হয়ে পড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবির ওপর গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় রাওয়ালপিন্ডিতে এবং তা ব্যর্থ হলে ২৫ মার্চ আবারও সামরিক শাসন জারি করে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন।

জেনারেল ইয়াহিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দেন। ৩০০ আসনের এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে বিজয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। ১৪ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী।’ কিন্তু কুখ্যাত ভুট্টো ও পাকিস্তানি জেনারেলদের কূট চক্রান্তে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতিকে চিরতরে দুর্বল করার গভীর ষড়যন্ত্র চলতে থাকে গোপনে।

সারা পূর্ব পাকিস্তান আন্দোলনে উত্তাল হতে থাকে। এ গভীর ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের সামনে তার ঐতিহাসিক ভাষণে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি তার ভাষণে সর্বশেষ যে আলটিমেটাম দেন, তা ছিল-‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

এরপর ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য ঢাকায় আসেন। ১৬ থেকে ২২ মার্চ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যা ছিল এক প্রতারণা মাত্র। বৈঠকের আড়ালে তারা ব্যাপক গণহত্যা পরিচালনা করার জন্য সৈন্য বৃদ্ধি করতে থাকে। অবশেষে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। এরপর আসে সেই ২৫ মার্চ, বৃহস্পতিবারের কালরাত। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের আসল রূপে আত্মপ্রকাশ করে।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বাঙালি জাতির একটি প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য নারকীয় এক পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য সামনে রেখে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জেনারেল টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না।’ ফলস্বরূপ বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে বিভীষিকাময় এক কালরাত। হানাদার বাহিনী পরিকল্পিত পন্থায় হিংস্র দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালির ওপর।

মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর মঞ্জুর, এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার, এয়ার ভাইস মার্শাল বাশার ও আরও অনেক সিনিয়র বাঙালি সামরিক অফিসার একত্রিত হন তেলিয়াপাড়ায় ৪ ও ১০ এপ্রিল। প্রণয়ন করেন মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয় ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা। অসংখ্য শহিদের রক্ত ও মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং সৃষ্টি হয় একটি লাল-সবুজ পতাকার।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না।

কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব.) : সামরিক ইতিহাসবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

hoque2515@gmail.com

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন