রাজনীতিতে নীতি থাকুক ‘বাজনীতি’ না হোক
jugantor
চেতনায় বুদ্বুদ
রাজনীতিতে নীতি থাকুক ‘বাজনীতি’ না হোক

  সম্পাদকীয়  

২৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনীতিই আমাদের শেষ ভরসা-এটা অস্বীকার করা যাবে না। আমরা তো পৃথিবীতে রাজনৈতিক সরকার ছাড়া আরও হরেক কিসিমের সরকার দেখলাম, আমাদের দেশেও দেখলাম। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার ছাড়া জনকল্যাণে, সঠিক জনপ্রশাসনে, মানব উন্নয়নে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অন্য কোনো কিসিমের সরকারের তেমন উল্লেখযোগ্য অবদান লক্ষ করলাম না।

সাময়িকভাবে ওসব সরকার কিছু চমক সৃষ্টি করতে পারে, মানুষের মনে আশার সুড়সুড়ি দিতে পারে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তারা আর সফল হতে পারে না। তারাও আবার রাজনীতিতেই ফিরে আসে, রাজনীতিতেই সমাধান খোঁজে। আমাদের বাংলাদেশের কথাই বলি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সরকার, অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে এগিয়ে গেল, স্বল্প সময়ে দেশকে একটা গণমুখী সংবিধান উপহার দিল, আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বেশ সফল হলো।

কিন্তু রাজনীতির নীতিচ্যুত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সরকার অপ্রিয় হয়ে গেল, গাদ্দাররা সুযোগ নিল। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, জীবনের মূল সময় জেলে কাটিয়েছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসাবে তিনি স্বীকৃত হয়েছেন। তার নেতৃত্বে আমরা একটা স্বাধীন দেশও পেলাম, তিনি হলেন জাতির পিতা। কিন্তু তার সরকার রাজনীতির নীতিচ্যুত হলো, গণতন্ত্র ভিন্নরূপে রূপায়িত করে একদলীয় বাকশাল হলো, বঙ্গবন্ধু নিজে রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেন। পরিণতিতে গাদ্দাররা আওয়ামী সরকারকে উৎখাতই শুধু করেনি, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এলেন মোশতাক। এই মোশতাক কে? বঙ্গবন্ধুরই খুব ঘনিষ্ঠজন। তিনি অর্থাৎ মোশতাক কেন এলেন? এলেন তিনি রাজনীতির নীতিচ্যুত হয়ে। তিনি বিশ্বাসঘাতক হলেন।

সামরিক আইন এলো, জিয়া এলেন একই পথ ধরে। তার তো বঙ্গবন্ধুকে মেনে চলার কথা, রক্ষা করার কথা। কিন্তু তিনি ক্ষমতালোভী হলেন, রাজনীতির নীতি তিনি মানলেন না। তিনি সামরিক শাসক হয়ে গেলেন। অবাক করা কাণ্ড যে, যে প্রধান বিচারপতির সংবিধান সংরক্ষণের কথা, সেই প্রধান বিচারপতি সায়েমও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে গেলেন। কিছু বুঝলেন? কিন্তু সমাধান কি হলো? হলো না। কেন হলো না? হলো না এজন্য যে, তারা রাজনীতির নীতিচ্যুত হয়েছেন।

রাজনীতির নীতিটা কী ছিল? নীতিটা ছিল-একটা রাজনৈতিক সরকার ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার, ভোটের সমালোচনা থেকে থাকতে পারে, কিন্তু তার সরকার তো ভোটে নির্বাচিত ছিল। অতএব, রাজনৈতিক নীতিটা হলো যে, একটি সরকার জনগণের অপছন্দে চলে গেলে জনগণ তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করবে, আন্দোলন হবে, রাজনৈতিক নীতিতে সরকারের পতন ঘটবে। কিন্তু হত্যা-ক্যু এসব তো রাজনীতির নীতির বাইরে। তাহলে হলো কেন? হলো এজন্য যে, বঙ্গবন্ধুর নিজের দলের রাজনীতিকই রাজনীতির নীতির বাইরে গিয়ে বিশ্বাসঘাতকতায় সহযোগিতা করেছেন। নীতিতে থাকলে, রাজনীতির নীতিতে থাকলে মোশতাক তো প্রেসিডেন্ট হতে যেতে পারতেন না। জিয়াও তো সামরিক আইন প্রশাসক হতে আসতে পারতেন না, সায়েমের কথা তো উঠতেই পারে না। তারা সবাই রাজনীতির নীতিচ্যুত হলেন।

পরে জিয়া টের পেলেন, রাজনীতির নীতিচ্যুত হয়ে আর টিকে থাকা যায় না। অতএব, তিনি নিজেই এবার রাজনীতিতে এসে গেলেন, রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলেন তিনি, রাজনীতির নীতিতে ফিরে এসে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিলেন। আওয়ামী লীগ নিজেদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য বাকশালকে যতই একটা নতুন দর্শন বা আদর্শ বলে থাকুক না কেন, জনগণ যে বাকশাল গ্রহণ করেনি, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাকশাল যদি প্রকৃতই একটা বিপ্লব বা আদর্শের নাম হয়ে থাকে, তাহলে সংবিধান সংশোধনের মেজরিটি তো আওয়ামী লীগের রয়েছে, আবার বাকশাল করছে না কেন? রাজ্জাক-মহিউদ্দিন তো অনেক সময় বাকশাল ধরে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন, পারলেন না কেন? পারেননি এজন্য যে, বাকশাল রাজনীতির নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল।

আমরা লক্ষ করলাম, রাজনীতিতে নীতি যখন হারিয়ে যায়, তখনই নীতিচ্যুতদের পতন হয়। তারা নীতিচ্যুত হয়ে সাময়িক সুবিধা পেয়ে থাকেন, ভোগ করেন; কিন্তু পরিণামে টিকে থাকতে পারেন না। ফলে দেখা গেল, বঙ্গবন্ধু সরকার রাজনীতিতে নীতিচ্যুত হওয়ায় তার মতো বিশাল মহিরুহও টিকে থাকতে পারলেন না, একই পরিণতিতে পড়ে বিদায় হলেন জিয়াও। প্রাকৃতিক বিচারে জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি জিয়াও পেয়ে গেলেন, মোশতাকরা ইতিহাসে মীরজাফর হয়ে ঘৃণিত হয়ে গেলেন। এলেন এরশাদ, তিনিও রাজনীতির নীতিচ্যুত হয়ে জোর করে সাত্তারকে হটিয়ে সামরিক শাসক হয়ে গেলেন। তিনিও আবার রাজনীতির নীতিতে এসে দল গঠন করে টিকে থাকতে সচেষ্ট হলেন। তিনিও রাজনীতির নীতিচ্যুতদের নিয়ে দল এবং সরকার চালাতে থাকলেন।

কিন্তু তিনিও টিকে থাকতে পারলেন না। আওয়ামী লীগ রাজনীতির নীতিচ্যুত হয়ে ১৯৮৬-এর নির্বাচনে তাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনে গেল। এরশাদ যেহেতু বিএনপিকে হটিয়েছেন, সেহেতু তিনি আওয়ামী-দোস্ত হলেন। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র-এ নীতিতে আওয়ামী লীগ সামরিক আইন জারি করলেও এরশাদকে সমর্থন দিয়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগও রাজনীতির নীতিতে ফিরে এলো, এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে একাট্টা হলো। এরশাদের পতন হলো। আবার রাজনীতি নীতিতে এলো, নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসা শুরু করল।

এরশাদের আমলে রাজনীতি বাজনীতিতে অর্থাৎ বাজপাখির নীতিতে পড়ে গিয়েছিল, মওদুদ এরশাদের প্রধানমন্ত্রী হলেন, পরে উপরাষ্ট্রপতি; আওয়ামী নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী এরশাদের প্রধানমন্ত্রী হলেন; আ স ম রব এরশাদের ‘গৃহপালিত’ বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে গেলেন। রাজনীতি নীতিচ্যুত হলে যা হয় আর কী! অথচ এ মিজানুর রহমান চৌধুরী, রবরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। কিন্তু নীতিচ্যুতরা কি আর টিকে থাকতে পারেন? পারেন না। মিজান চৌধুরী জাপার একাংশ হয়েও হারিয়ে গেলেন, রব এখন কার খালু-তা-ই বোঝা যায় না। অবশ্য রাজনীতিতে নীতিচ্যুত এ রবকে শেখ হাসিনাও তার ঐকমত্যের সরকারে মন্ত্রী করেছিলেন। কোরবান আলীর মতো আওয়ামী নেতাও এরশাদের হয়ে গিয়েছিলেন। মূলত জিয়া ও এরশাদের দলে যারা গেলেন, তাদের বেশিরভাগই তো মূলে আওয়ামী লীগের ছিলেন। রাজনীতির নীতিচ্যুত হয়ে তারা দলচ্যুত হলেন, নীতিচ্যুত তো হলেনই। ফলে রাজনীতি আমাদের কাছে একটা নীতিচ্যুত আদর্শের নাম হতেও দেরি হলো না।

হালে আমরা আবার রাজনৈতিক দলের ছড়াছড়ি দেখছি। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনকৃতও নাকি অনেক দল। এত দল যে তারা এখন জোট, মহাজোট, মঞ্চ, মহামঞ্চ-কত কী নিয়ে ভাবছে। এত এত দল, মোর্চা, কী কী যেন নাম, কে জানে? ড. হাছান মাহমুদ যদি মির্জা ফখরুলকে এগুলোর নাম জানেন কিনা জিজ্ঞেস করেন, তা অপ্রাসঙ্গিক হবে না নিশ্চয়। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতি কি নীতিতে থাকবে, না নীতিচ্যুত হয়ে বাজনীতিতে যাবে? বাজনীতি হচ্ছে বাজপাখির নীতি। বাজপাখি বহু উপর থেকে শিকার লক্ষ্য করে ছোঁ মারবে, শিকার না পেলে খড়কুটো হলেও নিয়ে যাবে। এত এত দল কি এমনতরো ছোঁ মারার জন্য তৈরি হচ্ছে? তা না হলে এত এত দল কেন? আমি তো দেখি এদের গ্রামেগঞ্জে কেউ চেনে না। ঢাকার কিছু কিছু পত্রিকা ও টেলিভিশন এদের নামটা অন্তত বাঁচিয়ে রেখেছে।

আরেকটা বড় প্রশ্ন হালে সামনে এসেছে যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে নীতিচ্যুত কিছু রাজনীতিক কি বড় বড় দলের আশ্রয়ে পুনর্বাসিত হয়ে যাবে? তাদের কেউ কেউ কি আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবে? এই নীতিচ্যুতরা কি নিজেরা-নিজেরা একটা নীতিচ্যুত সমিতি/জোট/মঞ্চ গঠন করবে? এ বিষয়ে আমার পরিষ্কার বক্তব্য এই যে, যেসব রাজনীতিক নিজ দল ত্যাগ করে আলাদা দল করেছেন কিংবা অন্য দলে যোগ দিয়েছেন, তাদের কোনো অবস্থায়ই, যত বড় নেতা কিংবা বীরই হোন না কেন, আবার দলে নেওয়া ঠিক হবে না। রাজনীতিতে নীতিটা অন্তত থাকুক। তবে যেসব রাজনীতিক মতপার্থক্যের কারণে নিজ দল ত্যাগ করলেও অন্য দল গঠন করেননি, কিংবা ভিন্ন দলে যোগ দেননি-কেবল তাদের দলে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। আমরা অবশ্যই চাইব, রাজনীতিতে নীতি থাকুক, রাজনীতি বাজনীতি না হোক। আওয়ামী লীগ যেন এ ব্যাপারে সজাগ থাকে, কেননা আওয়ামী লীগই তো, অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও, এখনো ভরসা।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

চেতনায় বুদ্বুদ

রাজনীতিতে নীতি থাকুক ‘বাজনীতি’ না হোক

 সম্পাদকীয় 
২৮ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনীতিই আমাদের শেষ ভরসা-এটা অস্বীকার করা যাবে না। আমরা তো পৃথিবীতে রাজনৈতিক সরকার ছাড়া আরও হরেক কিসিমের সরকার দেখলাম, আমাদের দেশেও দেখলাম। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার ছাড়া জনকল্যাণে, সঠিক জনপ্রশাসনে, মানব উন্নয়নে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অন্য কোনো কিসিমের সরকারের তেমন উল্লেখযোগ্য অবদান লক্ষ করলাম না।

সাময়িকভাবে ওসব সরকার কিছু চমক সৃষ্টি করতে পারে, মানুষের মনে আশার সুড়সুড়ি দিতে পারে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তারা আর সফল হতে পারে না। তারাও আবার রাজনীতিতেই ফিরে আসে, রাজনীতিতেই সমাধান খোঁজে। আমাদের বাংলাদেশের কথাই বলি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সরকার, অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে এগিয়ে গেল, স্বল্প সময়ে দেশকে একটা গণমুখী সংবিধান উপহার দিল, আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বেশ সফল হলো।

কিন্তু রাজনীতির নীতিচ্যুত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সরকার অপ্রিয় হয়ে গেল, গাদ্দাররা সুযোগ নিল। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, জীবনের মূল সময় জেলে কাটিয়েছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসাবে তিনি স্বীকৃত হয়েছেন। তার নেতৃত্বে আমরা একটা স্বাধীন দেশও পেলাম, তিনি হলেন জাতির পিতা। কিন্তু তার সরকার রাজনীতির নীতিচ্যুত হলো, গণতন্ত্র ভিন্নরূপে রূপায়িত করে একদলীয় বাকশাল হলো, বঙ্গবন্ধু নিজে রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেন। পরিণতিতে গাদ্দাররা আওয়ামী সরকারকে উৎখাতই শুধু করেনি, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এলেন মোশতাক। এই মোশতাক কে? বঙ্গবন্ধুরই খুব ঘনিষ্ঠজন। তিনি অর্থাৎ মোশতাক কেন এলেন? এলেন তিনি রাজনীতির নীতিচ্যুত হয়ে। তিনি বিশ্বাসঘাতক হলেন।

সামরিক আইন এলো, জিয়া এলেন একই পথ ধরে। তার তো বঙ্গবন্ধুকে মেনে চলার কথা, রক্ষা করার কথা। কিন্তু তিনি ক্ষমতালোভী হলেন, রাজনীতির নীতি তিনি মানলেন না। তিনি সামরিক শাসক হয়ে গেলেন। অবাক করা কাণ্ড যে, যে প্রধান বিচারপতির সংবিধান সংরক্ষণের কথা, সেই প্রধান বিচারপতি সায়েমও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে গেলেন। কিছু বুঝলেন? কিন্তু সমাধান কি হলো? হলো না। কেন হলো না? হলো না এজন্য যে, তারা রাজনীতির নীতিচ্যুত হয়েছেন।

রাজনীতির নীতিটা কী ছিল? নীতিটা ছিল-একটা রাজনৈতিক সরকার ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার, ভোটের সমালোচনা থেকে থাকতে পারে, কিন্তু তার সরকার তো ভোটে নির্বাচিত ছিল। অতএব, রাজনৈতিক নীতিটা হলো যে, একটি সরকার জনগণের অপছন্দে চলে গেলে জনগণ তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করবে, আন্দোলন হবে, রাজনৈতিক নীতিতে সরকারের পতন ঘটবে। কিন্তু হত্যা-ক্যু এসব তো রাজনীতির নীতির বাইরে। তাহলে হলো কেন? হলো এজন্য যে, বঙ্গবন্ধুর নিজের দলের রাজনীতিকই রাজনীতির নীতির বাইরে গিয়ে বিশ্বাসঘাতকতায় সহযোগিতা করেছেন। নীতিতে থাকলে, রাজনীতির নীতিতে থাকলে মোশতাক তো প্রেসিডেন্ট হতে যেতে পারতেন না। জিয়াও তো সামরিক আইন প্রশাসক হতে আসতে পারতেন না, সায়েমের কথা তো উঠতেই পারে না। তারা সবাই রাজনীতির নীতিচ্যুত হলেন।

পরে জিয়া টের পেলেন, রাজনীতির নীতিচ্যুত হয়ে আর টিকে থাকা যায় না। অতএব, তিনি নিজেই এবার রাজনীতিতে এসে গেলেন, রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলেন তিনি, রাজনীতির নীতিতে ফিরে এসে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিলেন। আওয়ামী লীগ নিজেদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য বাকশালকে যতই একটা নতুন দর্শন বা আদর্শ বলে থাকুক না কেন, জনগণ যে বাকশাল গ্রহণ করেনি, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাকশাল যদি প্রকৃতই একটা বিপ্লব বা আদর্শের নাম হয়ে থাকে, তাহলে সংবিধান সংশোধনের মেজরিটি তো আওয়ামী লীগের রয়েছে, আবার বাকশাল করছে না কেন? রাজ্জাক-মহিউদ্দিন তো অনেক সময় বাকশাল ধরে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন, পারলেন না কেন? পারেননি এজন্য যে, বাকশাল রাজনীতির নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল।

আমরা লক্ষ করলাম, রাজনীতিতে নীতি যখন হারিয়ে যায়, তখনই নীতিচ্যুতদের পতন হয়। তারা নীতিচ্যুত হয়ে সাময়িক সুবিধা পেয়ে থাকেন, ভোগ করেন; কিন্তু পরিণামে টিকে থাকতে পারেন না। ফলে দেখা গেল, বঙ্গবন্ধু সরকার রাজনীতিতে নীতিচ্যুত হওয়ায় তার মতো বিশাল মহিরুহও টিকে থাকতে পারলেন না, একই পরিণতিতে পড়ে বিদায় হলেন জিয়াও। প্রাকৃতিক বিচারে জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি জিয়াও পেয়ে গেলেন, মোশতাকরা ইতিহাসে মীরজাফর হয়ে ঘৃণিত হয়ে গেলেন। এলেন এরশাদ, তিনিও রাজনীতির নীতিচ্যুত হয়ে জোর করে সাত্তারকে হটিয়ে সামরিক শাসক হয়ে গেলেন। তিনিও আবার রাজনীতির নীতিতে এসে দল গঠন করে টিকে থাকতে সচেষ্ট হলেন। তিনিও রাজনীতির নীতিচ্যুতদের নিয়ে দল এবং সরকার চালাতে থাকলেন।

কিন্তু তিনিও টিকে থাকতে পারলেন না। আওয়ামী লীগ রাজনীতির নীতিচ্যুত হয়ে ১৯৮৬-এর নির্বাচনে তাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনে গেল। এরশাদ যেহেতু বিএনপিকে হটিয়েছেন, সেহেতু তিনি আওয়ামী-দোস্ত হলেন। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র-এ নীতিতে আওয়ামী লীগ সামরিক আইন জারি করলেও এরশাদকে সমর্থন দিয়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগও রাজনীতির নীতিতে ফিরে এলো, এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে একাট্টা হলো। এরশাদের পতন হলো। আবার রাজনীতি নীতিতে এলো, নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসা শুরু করল।

এরশাদের আমলে রাজনীতি বাজনীতিতে অর্থাৎ বাজপাখির নীতিতে পড়ে গিয়েছিল, মওদুদ এরশাদের প্রধানমন্ত্রী হলেন, পরে উপরাষ্ট্রপতি; আওয়ামী নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী এরশাদের প্রধানমন্ত্রী হলেন; আ স ম রব এরশাদের ‘গৃহপালিত’ বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে গেলেন। রাজনীতি নীতিচ্যুত হলে যা হয় আর কী! অথচ এ মিজানুর রহমান চৌধুরী, রবরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। কিন্তু নীতিচ্যুতরা কি আর টিকে থাকতে পারেন? পারেন না। মিজান চৌধুরী জাপার একাংশ হয়েও হারিয়ে গেলেন, রব এখন কার খালু-তা-ই বোঝা যায় না। অবশ্য রাজনীতিতে নীতিচ্যুত এ রবকে শেখ হাসিনাও তার ঐকমত্যের সরকারে মন্ত্রী করেছিলেন। কোরবান আলীর মতো আওয়ামী নেতাও এরশাদের হয়ে গিয়েছিলেন। মূলত জিয়া ও এরশাদের দলে যারা গেলেন, তাদের বেশিরভাগই তো মূলে আওয়ামী লীগের ছিলেন। রাজনীতির নীতিচ্যুত হয়ে তারা দলচ্যুত হলেন, নীতিচ্যুত তো হলেনই। ফলে রাজনীতি আমাদের কাছে একটা নীতিচ্যুত আদর্শের নাম হতেও দেরি হলো না।

হালে আমরা আবার রাজনৈতিক দলের ছড়াছড়ি দেখছি। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনকৃতও নাকি অনেক দল। এত দল যে তারা এখন জোট, মহাজোট, মঞ্চ, মহামঞ্চ-কত কী নিয়ে ভাবছে। এত এত দল, মোর্চা, কী কী যেন নাম, কে জানে? ড. হাছান মাহমুদ যদি মির্জা ফখরুলকে এগুলোর নাম জানেন কিনা জিজ্ঞেস করেন, তা অপ্রাসঙ্গিক হবে না নিশ্চয়। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতি কি নীতিতে থাকবে, না নীতিচ্যুত হয়ে বাজনীতিতে যাবে? বাজনীতি হচ্ছে বাজপাখির নীতি। বাজপাখি বহু উপর থেকে শিকার লক্ষ্য করে ছোঁ মারবে, শিকার না পেলে খড়কুটো হলেও নিয়ে যাবে। এত এত দল কি এমনতরো ছোঁ মারার জন্য তৈরি হচ্ছে? তা না হলে এত এত দল কেন? আমি তো দেখি এদের গ্রামেগঞ্জে কেউ চেনে না। ঢাকার কিছু কিছু পত্রিকা ও টেলিভিশন এদের নামটা অন্তত বাঁচিয়ে রেখেছে।

আরেকটা বড় প্রশ্ন হালে সামনে এসেছে যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে নীতিচ্যুত কিছু রাজনীতিক কি বড় বড় দলের আশ্রয়ে পুনর্বাসিত হয়ে যাবে? তাদের কেউ কেউ কি আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবে? এই নীতিচ্যুতরা কি নিজেরা-নিজেরা একটা নীতিচ্যুত সমিতি/জোট/মঞ্চ গঠন করবে? এ বিষয়ে আমার পরিষ্কার বক্তব্য এই যে, যেসব রাজনীতিক নিজ দল ত্যাগ করে আলাদা দল করেছেন কিংবা অন্য দলে যোগ দিয়েছেন, তাদের কোনো অবস্থায়ই, যত বড় নেতা কিংবা বীরই হোন না কেন, আবার দলে নেওয়া ঠিক হবে না। রাজনীতিতে নীতিটা অন্তত থাকুক। তবে যেসব রাজনীতিক মতপার্থক্যের কারণে নিজ দল ত্যাগ করলেও অন্য দল গঠন করেননি, কিংবা ভিন্ন দলে যোগ দেননি-কেবল তাদের দলে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। আমরা অবশ্যই চাইব, রাজনীতিতে নীতি থাকুক, রাজনীতি বাজনীতি না হোক। আওয়ামী লীগ যেন এ ব্যাপারে সজাগ থাকে, কেননা আওয়ামী লীগই তো, অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও, এখনো ভরসা।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন