স্বদেশ ভাবনা

মন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু

 আবদুল লতিফ মণ্ডল 
২৯ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

গত ২১ মার্চ খাদ্য অধিদপ্তরের সম্মেলনকক্ষে পবিত্র মাহে রজমানে চালের বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার খাদ্যপণ্যের, বিশেষ করে প্রধান খাদ্য চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন। খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য মিডিয়ায় গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে।

খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, দেশে খাদ্যের কোনো সংকট নেই। অবৈধ মজুতদারির কারণে সংকট হচ্ছে। তাই বেআইনি মজুত বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যবসায়ী যতটুকু মজুত করতে পারবেন, তার বাইরে মজুত করলে তা বেআইনি। যারা বেআইনিভাবে ধান, চাল ও আটার ব্যবসা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এ সময় তিনি ধান ও চালের অবৈধ মজুতদারি কঠোরভাবে মনিটর করতে খাদ্য বিভাগের মাঠপ্রশাসনে কর্মরতদের নির্দেশ দেন। তিনি আরও বলেছেন, লাইসেন্স ছাড়া দেশে কেউ ধান ও চালের ব্যবসা করতে পারবেন না। ধানচালের ব্যবসা করতে হলে ফুড গ্রেইন লাইসেন্স থাকতেই হবে। আড়তদারদেরও এ লাইসেন্স থাকতে হবে। প্রতি ১৫ দিন পর প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে কতটুকু ধান-চাল ক্রয় করেছেন আর কতটুকু বিক্রি করেছেন, এর রিটার্ন খাদ্য বিভাগে দাখিল করতে হবে। দেশে চাল ও গমসহ অন্যসব নিত্যপণ্যের দাম যখন লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে, তখন খাদ্যপণ্য,

বিশেষ করে প্রধান খাদ্য চালের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য খাদ্যমন্ত্রীর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে এখানে যে প্রশ্নটি উঠে আসে তা হলো, খাদ্যমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক বছরের ব্যবধানে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। এতে দেখা যায়, গত এক বছরে দেশের কমবেশি ৭০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চালের দাম বেড়েছে ১৭.৯৫ শতাংশ। আর নাজিরশাইল ও অন্যান্য সরু চালের দাম বেড়েছে গড়ে ২০.২৯ শতাংশ। গমের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। খাদ্যশস্যের (চাল, গম) মূল্যস্ফীতির জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-এক. জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের তুলনায় খাদ্যশস্যের উৎপাদনশীলতা তথা উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হার কম হওয়া।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) ‘৫০ ইয়ার্স অব রাইস ব্রিডিং ইন বাংলাদেশ : জেনেটিক ইল্ড ট্রেন্ডস’ এবং ‘রাইস ভিশন ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক দুটি গবেষণার বরাত দিয়ে ১১ মার্চ বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চালের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বার্ষিক হার যখন দশমিক ৮২ শতাংশ, তখন প্রতিবছর দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ।

এর ফলে দেশে উৎপাদিত চাল চাহিদা মেটাতে পারছে না। খাদ্যশস্যের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গম উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হার পুরোপুরি নেতিবাচক। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরের উৎপাদন ১৯.৮ লাখ টন, বর্তমানে ১১-১২ লাখ টনে নেমে এসেছে। গমের এ উৎপাদন দেশের চাহিদার (কমবেশি ৭০ লাখ টন) ছয়ভাগের একভাগ।

দুই. চাল ও গমের উৎপাদন দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম না হওয়ার এসব খাদ্যপণ্য আমদানি করা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো বিকল্প উপায় থাকছে না।

এদিকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাব, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয়বৃদ্ধি, ডলার সংকট প্রভৃতি কারণে খাদ্যপণ্য আমদানিতে অনেকটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। যুগান্তরের ২৩ মার্চের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকট ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা ব্যাহত হওয়ায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়কালে চাল, গম, চিনিসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের আমদানি হ্রাস পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উপর্যুক্ত সময়কালে যখন চাল-গমের এলসি খোলা ১৪.৫৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, তখন পণ্য দুটির আমদানি হ্রাস পেয়েছে ১২.১৭ শতাংশ।

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় বেসরকারি খাতে চাল আমদানিতে যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, খাদ্যমন্ত্রীর ২১ মার্চের বক্তৃতায় সেই ইঙ্গিত রয়েছে। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি খাতে ১৯ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব, দেশে ডলার সংকট প্রভৃতি কারণে পণ্যটির আমদানিতে গতি আসেনি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য মোতাবেক, চলতি অর্থবছরের ২২ মার্চ পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি খাত মিলে মাত্র ১০ লাখ ৫২ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। অন্যদিকে দেশের চাহিদা মেটাতে কমবেশি ৬০ লাখ টন গম আমদানির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও ২২ মার্চ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে মাত্র ২১ লাখ ৮১ হাজার টন। দেশে পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় খাদ্যশস্যের দাম বাড়ছে।

তিন. সরকারের দুর্বল খাদ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে ধান-চালের সবচেয়ে বড় মজুতদার চালকল মালিকরা সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন।

ু২০১৯ সালে পরিচালিত এক অনুসন্ধান রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুনে ধানের মজুতে বড় ও মাঝারি কৃষকের অংশ ছিল ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশের মধ্যে ৬০ শতাংশের কিছুটা বেশি মজুত ছিল চালকল মালিকদের কাছে। অবশিষ্ট কমবেশি ২০ শতাংশ মজুত ছিল ব্যবসায়ীদের কাছে। চালকল মালিকরা ধান কাটার মৌসুমে কম দামে ধান কিনে তা চালে রূপান্তর করে মজুত করেন এবং মৌসুম শেষে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে উচ্চমূল্যে বিক্রি করেন। খাদ্যমন্ত্রীও বলেছেন, অবৈধ মজুতদারির কারণে চালের সংকট হচ্ছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো পণ্যের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, দেশে চালের কোনো অভাব নেই। তিনি চালের সংকট নিরসনে তথা উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন। এগুলো হলো-১. বেআইনিভাবে ধানচাল মজুতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ; ২. খাদ্য অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ধান ও চালের অবৈধ মজুতদারি কঠোরভাবে মনিটর করা; ৩. বিনা লাইসেন্সে কাউকে ধানচালের ব্যবসা করতে না দেওয়া।

মন্ত্রী বেআইনিভাবে ধানচাল মজুতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ভালো কথা। তবে এখানে যে প্রশ্ন ওঠে তা হলো, সরকার কি ধানচাল মজুতের পরিমাণ, সময়কাল প্রভৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছে? অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৫৬তে খাদ্যদ্রব্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, সরকার লাইসেন্স, পারমিট বা অন্য কোনোভাবে কোনো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুত, পরিবহণ, বণ্টন, বিহিতকরণ, অধিগ্রহণ, ব্যবহার বা ভোগ নিয়ন্ত্রণে আদেশ দিতে পারবে।

১৯৫৩ সালের ‘পূর্ববঙ্গ খাদ্যশস্যের (ফুডস্টাফ) মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মজুতবিরোধী আদেশে বলা হয়েছে, ১. সরকার বিজ্ঞপ্তি মারফত এ নির্দেশ দিতে পারবে যে, কোনো পরিবার, পাইকারি বা খুচরা ব্যবসায়ী তার নিকটে বা আয়ত্তাধীনে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি খাদ্যশস্য রাখতে পারবেন না;

২. সরকার নির্দেশ দিতে পারবে যে, কোনো ব্যবসায়ী তার নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট করে দেওয়া সময়ের অধিক কোনো খাদ্যদ্রব্য রাখতে পারবেন না। ধানচাল মজুতের পরিমাণ, সময়কাল প্রভৃতি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়ে থাকলে অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন?

খাদ্যমন্ত্রী ধান ও চালের অবৈধ মজুতদারি কঠোরভাবে মনিটর করার জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। মন্ত্রী বলেছেন, প্রতি ১৫ দিন পর প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে কতটুকু ধানচাল ক্রয় করেছেন আর কতটুকু বিক্রি করেছেন,

এর রিটার্ন খাদ্য অধিদপ্তরে দাখিল করতে হবে। তবে ধানচাল ব্যবসায়ীরা এ নির্দেশ কতটা পালন করবেন বা খাদ্য অধিদপ্তর এ ব্যবস্থা মনিটরিংয়ে কতটা সক্ষম হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিনা লাইসেন্সে কাউকে ধানচালের ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না। বিদ্যমান আইনগুলোয় এ ধরনের বিধান রয়েছে। তবে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না কেন, এর ব্যাখ্যা মন্ত্রীর বক্তব্যে নেই।

এসবের পর যা বলা দরকার তা হলো, বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে খাদ্যশস্যের দামে স্থিতিশীল অবস্থা বজায় থাকবে। দেশে এ মুহূর্তে কত ধানচাল মজুত আছে, সরকার কি তা বলতে পারবে? খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত মজুত বলতে সাধারণত সরকারি খাদ্যগুদামে মজুতের কথা বলা হয়। এ মুহূর্তে ১০-১১ লাখ টন চাল মজুত থাকলে তা দেশের দুই সপ্তাহের চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়।

সরকারি গুদামে মজুত খাদ্যশস্য, বিশেষ করে চাল যেসব কারণে ব্যবহার করা হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-বাজারে চালের উচ্চমূল্য বিরাজ করলে হ্রাসকৃত মূল্যে পণ্যটি বিক্রির মাধ্যমে বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রাখা; খ. খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল হ্রাসকৃত মূল্যে নিম্ন-আয়ের মানুষের মধ্যে বিতরণ; গ. খাদ্যমুখী কর্মসূচি

যেমন: দুস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য সরবরাহ (ভিজিএফ) কর্মসূচি এবং দুস্থ জনগোষ্ঠী উন্নয়ন কর্মসূচি (ভিজিডি) বাস্তবায়ন। দেশে কী পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত আছে, তা নিয়মিতভাবে মনিটর করে সরকারকে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে।

খাদ্যশস্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে খাদ্যমন্ত্রী ঘোষিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হবে সে আশাই করছি। তবে অতীতেও এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন খুব একটা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গত মে মাসে খাদ্যমন্ত্রী বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

সেগুলোর তেমন বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। তাই চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে খাদ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঘোষিত পদক্ষেপগুলো কতটা বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন