স্মার্ট ভূমিসেবা : ভূমি সংস্কারে নবদিগন্ত
কল্পনা করুন, একটুকরা জমি কেনার আগে অনলাইনেই তাৎক্ষণিক আপনি জমির মালিকানা পরিবর্তনের ইতিহাস, যেমন-জমিটি কতবার ভাগ হয়েছে, কতজন নতুন মালিক যুক্ত হয়েছেন, বর্তমানে কত অংশ অবশিষ্ট আছে, সর্বশেষ জরিপে কত অংশ নতুনভাবে নামজারি হয়েছে প্রভৃতি জানতে পারছেন। একই সঙ্গে এনআইডি নম্বরের মাধ্যমেও জানতে পারছেন জমির প্রকৃত মালিক কে। জমিটি ক্রয়ান্তে নিবন্ধন করার পরই যদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামজারি, হোল্ডিং তৈরি হয়ে ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণ এবং একই সঙ্গে একক মালিকভিত্তিক খতিয়ান ও মৌজাম্যাপও প্রস্তুত হয়ে যায় তাহলে? সেই সঙ্গে ক্রয়কৃত জমির মালিকানার প্রমাণ হিসাবে যদি একধরনের সার্টিফিকেটই যথেষ্ট হয়!
নতুন জমি কিনে হঠাৎ কোনো কারণে আপনার ভূমিবিষয়ক একটি তথ্য জানা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা না করেই আপনি মুহূর্তেই এআই পোর্টাল থেকে চ্যাটবটের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমেই জবাব পেয়ে গেলেন!
একসময় উপর্যুক্ত এসব ঘটনা কষ্টকল্পনা কিংবা স্বপ্নবিলাস মনে হলেও আজ তা বাস্তবতা। ভূমি মন্ত্রণালয় এ স্মার্ট ব্যবস্থা একটি প্ল্যাটফরম (land.gov.bd) থেকেই বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপে আজ প্রধানমন্ত্রী ‘রেজিস্ট্রেশন-মিউটেশন আন্তঃসংযোগ’, ‘স্মার্ট ভূমি নকশা’, ‘স্মার্ট ভূমি রেকর্ড’ এবং ‘স্মার্ট ভূমি-পিডিয়া’ এবং অন্যান্য তিনটি উদ্যোগ উদ্বোধন করবেন, যা ভূমি সংস্কারে আনবে এক নবদিগন্ত।
সারা দেশে স্মার্ট ভূমিব্যবস্থা চালু হলে নাগরিকদের খুব প্রয়োজন ছাড়া ভূমি অফিসে যেতে হবে না। একবার কোথাও ডিজিটাল জরিপ সম্পন্ন হলে সেখানে ভবিষ্যতে আর জরিপ করার প্রয়োজন পড়বে না। ভূমি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা ও সীমানা বিরোধ কমে যাবে বহুলাংশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দক্ষ ও কার্যকর স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হলে নিশ্চিত হবে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি ভূমির ন্যায্য অধিকার।
ন্যায্য অধিকার অনুযায়ী ভূমি ব্যবস্থাপনার স্বপ্ন অবশ্য বঙ্গবন্ধু তার তারুণ্য থেকেই দেখতেন। ১৯৪৮ সালের ১২ আগস্ট তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিলের সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জমিদারি প্রথা বিলোপের প্রতিশ্রুতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন পাকিস্তান সরকার না করায় তৎকালীন জাতীয় মন্ত্রিসভার প্রবল সমালোচনা করেছিলেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতে দৈনিক ইত্তেহাদে দেওয়া বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, নতুন জরিপের নাম করে সরকার জমিদারি প্রথার সম্পূর্ণ বিলোপ আট বছরের জন্য স্থগিত করেছে; যা নিরন্ন জনসাধারণের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে।
পরবর্তীকালে, ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ঘোষিত ২১ দফার দ্বিতীয় দফায় বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও খাজনা আদায়কারীদের স্বত্ব বাতিল করে উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকের মাঝে বিতরণের কর্মসূচি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে দেশের সাধারণ মানুষের ভূমির অধিকারের কথা তুলে ধরেছিলেন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ভূমি সংস্কারে বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন ত্রিমুখী পদক্ষেপ-আইন ও বিধি সংস্কার, নীতিগত সংস্কার এবং প্রশাসনিক সংস্কার। স্বাধীন বাংলার প্রথম ভূমি সংস্কারক জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তনের পরপরই ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সভার প্রথম এজেন্ডায় ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেন। পরিবার পর্যায়ে জমির সর্বোচ্চ মালিকানা ১০০ বিঘা নির্ধারণের আদেশ জারি করেন তিনি। একই সঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক এদেশের গরিব কৃষকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ৬০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা বাতিল করার আদেশ দেন, যা এদেশের গরিব কৃষকদের সেই সময়ের প্রায় ৩৬ কোটি টাকার দেনা থেকে মুক্তি দেয়।
১৯৭২-এর ২০ ফেব্রুয়ারি সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূল পরিদর্শনে তৎকালীন নোয়াখালী আর বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলা সফর করে তিনি মুজিব কিল্লার নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। নির্দেশ দেন সরকারি খাসজমিতে নদীভাঙনের শিকার পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের। এর পরিপ্রেক্ষিতে পোড়াগাছায় গুচ্ছগ্রাম প্রতিষ্ঠা করে ২০০ পরিবারের আবাসন নিশ্চিত করা হয়। এ ঐতিহাসিক ঘটনাকে সম্মান জানাতে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত সেই স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্মৃতিস্তম্ভ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গুচ্ছগ্রাম কমপ্লেক্সও আজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
পিতার মতোই এ দেশের মাটি ও মানুষকে হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখা হাসিনা। ভূমির যথাযথ ও সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নয়নের ব্রত নিয়ে দেশ পরিচালনা করছেন তিনি। ভূমি ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতার মূল ভিত্তি হচ্ছে ২০০১ সালে ২৮টি মৌলিক বিষয় নিয়ে তার প্রণীত জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি। ২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের মহাপরিকল্পনায় যুক্ত করেন ভূমি ব্যবস্থাপনাকেও। ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৩১টি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল জনবান্ধব ভূমি ব্যবস্থাপনার অন্যতম মাইলফলক।
ভূমিসেবাকে সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য করার স্বপ্ন পূরণে ভূমি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে নানামুখী ডিজিটাল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ই-নামজারি, ডিজিটাল ভূমি উন্নয়ন কর, ১৬১২২ কলসেন্টার, সোশ্যাল মিডিয়া ও কিয়স্কের মাধ্যমে ভূমিসেবা, ডিজিটাল সার্ভে, অনলাইনে জলমহালের আবেদন, ল্যান্ড ডাটা ব্যাংক, মর্টগেজ ডাটা ব্যাংক। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ই-নামজারি উদ্যোগের জন্য ইউনাইটেড নেশন্স পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড ২০২০-এ ভূষিত হয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। ডিজিটাল ভূমি উন্নয়ন করের জন্য অর্জন করেছে উইসিস পুরস্কার-২০২২ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার-২০২২। ভূমি তথ্য ব্যাংকের জন্য অর্জন করেছে বঙ্গবন্ধু জনপ্রশাসন পদক-২০২২।
ভূমি মন্ত্রণালয় ডিজিটাল সেবা প্রবর্তনের পাশাপাশি আইন ও বিধিবিধান সংশোধন করে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নতুন আইনের খসড়া তৈরি করে টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা স্থাপনেও জোর দিচ্ছে। ইতোমধ্যে হাট ও বাজার (স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা) আইন, ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। আরও নতুন যেসব আইন নিয়ে কাজ করা হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ভূমি মালিকানা ও ব্যবহার আইন, ভূমি সংস্কার আইন, ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ভূমি ব্যবহারস্বত্ব গ্রহণ ইত্যাদি।
ভূমি ভবন, উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস স্থাপনের মাধ্যমে অবকাঠামোগত সংস্কারের উদ্যোগও গ্রহণ করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। আগে উল্লিখিত পাঁচটি উদ্যোগের সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাল্টি-চ্যানেলভিত্তিক নাগরিক সেবা (কাস্টমার সার্ভিস) ব্যবস্থার অন্যতম অংশ স্মার্ট ভূমিসেবা কেন্দ্র এবং ৪০০ ইউনিয়ন ভূমি অফিসও আজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সার্বিক দিকনির্দেশনায় ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার এবং ভূমিসংক্রান্ত জনবান্ধব সেবা নিশ্চিত করতে ভূমি ব্যবস্থাপনার স্মার্ট কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
প্রচলিত সরকারি ব্যবস্থা থেকে একেবারে ভিন্নভাবে ‘ওপেন স্পেস অফিস’ কনসেপ্টের মাধ্যমে পরিচালিত ‘ডিজিটাইজেশন, নলেজ ম্যানেজমেন্ট ও পারফরম্যান্স’ শাখার মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনা স্মার্ট করার কাজের সমন্বয় করা হচ্ছে। এখানে যে কোনো গণকর্মচারী দিতে পারেন তাদের ‘আইডিয়া’। এমন ‘আইডিয়া জেনারেট’ ও কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতেই আজ থেকে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হচ্ছে জাতীয় ভূমি সম্মেলন।
দক্ষ ভূমি ব্যবস্থাপনা জলবায়ু সংকট মোকাবিলার অন্যতম নিয়ামক। জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ভুক্তভোগী হয়েও ভূমির দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অনন্য উদাহরণ তৈরি করছে বাংলাদেশ। এ অগ্রযাত্রাকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে রূপকল্প ২০৪১, বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রণয়ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমি মন্ত্রণালয় তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা।
সৈয়দ মো. আবদুল্লাহ আল নাহইয়ান : জনসংযোগ কর্মকর্তা, ভূমি মন্ত্রণালয়
স্মার্ট ভূমিসেবা : ভূমি সংস্কারে নবদিগন্ত
সৈয়দ মো. আবদুল্লাহ আল নাহিয়ান
২৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কল্পনা করুন, একটুকরা জমি কেনার আগে অনলাইনেই তাৎক্ষণিক আপনি জমির মালিকানা পরিবর্তনের ইতিহাস, যেমন-জমিটি কতবার ভাগ হয়েছে, কতজন নতুন মালিক যুক্ত হয়েছেন, বর্তমানে কত অংশ অবশিষ্ট আছে, সর্বশেষ জরিপে কত অংশ নতুনভাবে নামজারি হয়েছে প্রভৃতি জানতে পারছেন। একই সঙ্গে এনআইডি নম্বরের মাধ্যমেও জানতে পারছেন জমির প্রকৃত মালিক কে। জমিটি ক্রয়ান্তে নিবন্ধন করার পরই যদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামজারি, হোল্ডিং তৈরি হয়ে ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণ এবং একই সঙ্গে একক মালিকভিত্তিক খতিয়ান ও মৌজাম্যাপও প্রস্তুত হয়ে যায় তাহলে? সেই সঙ্গে ক্রয়কৃত জমির মালিকানার প্রমাণ হিসাবে যদি একধরনের সার্টিফিকেটই যথেষ্ট হয়!
নতুন জমি কিনে হঠাৎ কোনো কারণে আপনার ভূমিবিষয়ক একটি তথ্য জানা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা না করেই আপনি মুহূর্তেই এআই পোর্টাল থেকে চ্যাটবটের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমেই জবাব পেয়ে গেলেন!
একসময় উপর্যুক্ত এসব ঘটনা কষ্টকল্পনা কিংবা স্বপ্নবিলাস মনে হলেও আজ তা বাস্তবতা। ভূমি মন্ত্রণালয় এ স্মার্ট ব্যবস্থা একটি প্ল্যাটফরম (land.gov.bd) থেকেই বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপে আজ প্রধানমন্ত্রী ‘রেজিস্ট্রেশন-মিউটেশন আন্তঃসংযোগ’, ‘স্মার্ট ভূমি নকশা’, ‘স্মার্ট ভূমি রেকর্ড’ এবং ‘স্মার্ট ভূমি-পিডিয়া’ এবং অন্যান্য তিনটি উদ্যোগ উদ্বোধন করবেন, যা ভূমি সংস্কারে আনবে এক নবদিগন্ত।
সারা দেশে স্মার্ট ভূমিব্যবস্থা চালু হলে নাগরিকদের খুব প্রয়োজন ছাড়া ভূমি অফিসে যেতে হবে না। একবার কোথাও ডিজিটাল জরিপ সম্পন্ন হলে সেখানে ভবিষ্যতে আর জরিপ করার প্রয়োজন পড়বে না। ভূমি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা ও সীমানা বিরোধ কমে যাবে বহুলাংশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দক্ষ ও কার্যকর স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হলে নিশ্চিত হবে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি ভূমির ন্যায্য অধিকার।
ন্যায্য অধিকার অনুযায়ী ভূমি ব্যবস্থাপনার স্বপ্ন অবশ্য বঙ্গবন্ধু তার তারুণ্য থেকেই দেখতেন। ১৯৪৮ সালের ১২ আগস্ট তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিলের সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জমিদারি প্রথা বিলোপের প্রতিশ্রুতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন পাকিস্তান সরকার না করায় তৎকালীন জাতীয় মন্ত্রিসভার প্রবল সমালোচনা করেছিলেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতে দৈনিক ইত্তেহাদে দেওয়া বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, নতুন জরিপের নাম করে সরকার জমিদারি প্রথার সম্পূর্ণ বিলোপ আট বছরের জন্য স্থগিত করেছে; যা নিরন্ন জনসাধারণের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে।
পরবর্তীকালে, ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ঘোষিত ২১ দফার দ্বিতীয় দফায় বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও খাজনা আদায়কারীদের স্বত্ব বাতিল করে উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকের মাঝে বিতরণের কর্মসূচি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে দেশের সাধারণ মানুষের ভূমির অধিকারের কথা তুলে ধরেছিলেন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ভূমি সংস্কারে বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন ত্রিমুখী পদক্ষেপ-আইন ও বিধি সংস্কার, নীতিগত সংস্কার এবং প্রশাসনিক সংস্কার। স্বাধীন বাংলার প্রথম ভূমি সংস্কারক জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তনের পরপরই ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সভার প্রথম এজেন্ডায় ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেন। পরিবার পর্যায়ে জমির সর্বোচ্চ মালিকানা ১০০ বিঘা নির্ধারণের আদেশ জারি করেন তিনি। একই সঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক এদেশের গরিব কৃষকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ৬০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা বাতিল করার আদেশ দেন, যা এদেশের গরিব কৃষকদের সেই সময়ের প্রায় ৩৬ কোটি টাকার দেনা থেকে মুক্তি দেয়।
১৯৭২-এর ২০ ফেব্রুয়ারি সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূল পরিদর্শনে তৎকালীন নোয়াখালী আর বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলা সফর করে তিনি মুজিব কিল্লার নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। নির্দেশ দেন সরকারি খাসজমিতে নদীভাঙনের শিকার পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের। এর পরিপ্রেক্ষিতে পোড়াগাছায় গুচ্ছগ্রাম প্রতিষ্ঠা করে ২০০ পরিবারের আবাসন নিশ্চিত করা হয়। এ ঐতিহাসিক ঘটনাকে সম্মান জানাতে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত সেই স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্মৃতিস্তম্ভ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গুচ্ছগ্রাম কমপ্লেক্সও আজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
পিতার মতোই এ দেশের মাটি ও মানুষকে হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখা হাসিনা। ভূমির যথাযথ ও সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নয়নের ব্রত নিয়ে দেশ পরিচালনা করছেন তিনি। ভূমি ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতার মূল ভিত্তি হচ্ছে ২০০১ সালে ২৮টি মৌলিক বিষয় নিয়ে তার প্রণীত জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি। ২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের মহাপরিকল্পনায় যুক্ত করেন ভূমি ব্যবস্থাপনাকেও। ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৩১টি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল জনবান্ধব ভূমি ব্যবস্থাপনার অন্যতম মাইলফলক।
ভূমিসেবাকে সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য করার স্বপ্ন পূরণে ভূমি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে নানামুখী ডিজিটাল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ই-নামজারি, ডিজিটাল ভূমি উন্নয়ন কর, ১৬১২২ কলসেন্টার, সোশ্যাল মিডিয়া ও কিয়স্কের মাধ্যমে ভূমিসেবা, ডিজিটাল সার্ভে, অনলাইনে জলমহালের আবেদন, ল্যান্ড ডাটা ব্যাংক, মর্টগেজ ডাটা ব্যাংক। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ই-নামজারি উদ্যোগের জন্য ইউনাইটেড নেশন্স পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড ২০২০-এ ভূষিত হয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। ডিজিটাল ভূমি উন্নয়ন করের জন্য অর্জন করেছে উইসিস পুরস্কার-২০২২ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার-২০২২। ভূমি তথ্য ব্যাংকের জন্য অর্জন করেছে বঙ্গবন্ধু জনপ্রশাসন পদক-২০২২।
ভূমি মন্ত্রণালয় ডিজিটাল সেবা প্রবর্তনের পাশাপাশি আইন ও বিধিবিধান সংশোধন করে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নতুন আইনের খসড়া তৈরি করে টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা স্থাপনেও জোর দিচ্ছে। ইতোমধ্যে হাট ও বাজার (স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা) আইন, ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। আরও নতুন যেসব আইন নিয়ে কাজ করা হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ভূমি মালিকানা ও ব্যবহার আইন, ভূমি সংস্কার আইন, ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ভূমি ব্যবহারস্বত্ব গ্রহণ ইত্যাদি।
ভূমি ভবন, উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস স্থাপনের মাধ্যমে অবকাঠামোগত সংস্কারের উদ্যোগও গ্রহণ করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। আগে উল্লিখিত পাঁচটি উদ্যোগের সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাল্টি-চ্যানেলভিত্তিক নাগরিক সেবা (কাস্টমার সার্ভিস) ব্যবস্থার অন্যতম অংশ স্মার্ট ভূমিসেবা কেন্দ্র এবং ৪০০ ইউনিয়ন ভূমি অফিসও আজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সার্বিক দিকনির্দেশনায় ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার এবং ভূমিসংক্রান্ত জনবান্ধব সেবা নিশ্চিত করতে ভূমি ব্যবস্থাপনার স্মার্ট কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
প্রচলিত সরকারি ব্যবস্থা থেকে একেবারে ভিন্নভাবে ‘ওপেন স্পেস অফিস’ কনসেপ্টের মাধ্যমে পরিচালিত ‘ডিজিটাইজেশন, নলেজ ম্যানেজমেন্ট ও পারফরম্যান্স’ শাখার মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনা স্মার্ট করার কাজের সমন্বয় করা হচ্ছে। এখানে যে কোনো গণকর্মচারী দিতে পারেন তাদের ‘আইডিয়া’। এমন ‘আইডিয়া জেনারেট’ ও কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতেই আজ থেকে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হচ্ছে জাতীয় ভূমি সম্মেলন।
দক্ষ ভূমি ব্যবস্থাপনা জলবায়ু সংকট মোকাবিলার অন্যতম নিয়ামক। জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ভুক্তভোগী হয়েও ভূমির দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অনন্য উদাহরণ তৈরি করছে বাংলাদেশ। এ অগ্রযাত্রাকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে রূপকল্প ২০৪১, বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রণয়ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমি মন্ত্রণালয় তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা।
সৈয়দ মো. আবদুল্লাহ আল নাহইয়ান : জনসংযোগ কর্মকর্তা, ভূমি মন্ত্রণালয়
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023