বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাতগুলো গতিশীল করতে হবে
এম এ খালেক
০১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
একজন বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন, ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির না থাকে আত্মমর্যাদা, না থাকে কোনো সম্মান। তাকে পদে পদে লাঞ্ছিত হতে হয়।’ কথাটি ব্যক্তির জীবনে যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্রের জীবনেও। যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত, সমাজে তার কোনো মর্যাদা থাকে না। কথায় বলে, ‘গরিবের বউ সবার ভাবি।’
অর্থাৎ দরিদ্র পরিবারের একজন গৃহবধূর কোনো আত্মসম্মান থাকে না। তাকে পদে পদে লাঞ্ছিত-অপমানিত হতে হয়। কেউই ইচ্ছা করে দরিদ্র থাকতে চায় না। কিন্তু পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা একজন মানুষকে দরিদ্র থাকতে বাধ্য করে। ব্যক্তির সমষ্টিই রাষ্ট্র গঠন করে। তাই ব্যক্তির মতো রাষ্ট্রও চিরদিন দরিদ্র হয়ে থাকতে চায় না। একটি রাষ্ট্রকে উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে হলে এমন নেতৃত্বের প্রয়োজন, যা দেশটিকে সত্যিকার ও কার্যকর উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এ উন্নতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাধিত হলেই চলে না, তাকে সামাজিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের মতো করে নেতৃত্ব দিতে হয়। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতির ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কার্যকর ও সঠিক নেতৃত্বের অভাবে অনেক সময়ই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করা সম্ভব হয় না।
আমাদের দেশে একসময় একটি কূট বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল। বলা হচ্ছিল, আমরা উন্নয়ন চাই নাকি গণতন্ত্র? এ বিতর্কের প্রবক্তারা প্রকারান্তরে এটাই বলতে চেয়েছিলেন যে, আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা। সেই উন্নয়ন অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে গণতন্ত্রকেও বিসর্জন দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যারা এ ধরনের অনাবশ্যক বিতর্ক সৃষ্টি করতে চান, তাদের উদ্দেশ্য যে ভালো নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কারণ উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলে। যে দেশে কার্যকর ও বিশুদ্ধ গণতন্ত্র আছে, সেই দেশের অর্জিত উন্নয়ন অধিকতর কার্যকর ও টেকসই হয়। উন্নয়ন যদি ভঙ্গুর হয়, তাহলে সেই উন্নয়ন নিয়ে গর্ব করার মতো কিছু থাকে না। একটি দেশে কার্যকর গণতন্ত্র থাকলে জবাবদিহিতার কোনো অভাব হয় না। আর দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে জবাবদিহিতা একান্তই আবশ্যক।
উন্নয়ন যদি ভঙ্গুর হয়, তাহলে তার পরিণতি কখনোই সুখকর হতে পারে না। সামান্য আঘাতেই উন্নয়নসৌধ ভেঙে পড়তে পারে। এ প্রসঙ্গে নেপালের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নেপাল কয়েক বছর আগে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকায় স্থান লাভ করেছিল। দেশটি বেশ ভালোভাবেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এ ভূমিকম্পের অভিঘাত নেপালি অর্থনীতি সহ্য করতে পারেনি। ফলে জাতিসংঘ নেপালকে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকা থেকে নামিয়ে দিতে বাধ্য হয়। কারণ নেপালের অর্থনৈতিক উন্নয়ন শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না।
একটি দেশের উন্নয়নের অনেক সূচক থাকে। এর একটি হচ্ছে কর-জিডিপি অনুপাত। একটি দেশের অর্থনীতি কতটা মজবুত এবং নিজস্ব শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা কিছুটা হলেও অনুমান করা যায় দেশটির কর-জিডিপি অনুপাত প্রত্যক্ষ করে। যে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত বেশি, সেদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে নিজস্ব সূত্র থেকে অর্থায়ন সহজতর হয়। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের জিডিপির যে আকার, তার মাত্র ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ কর আদায় হয়। ফলে আমাদের উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য বিদেশি ঋণ ও আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়। আর ঋণ ও আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করতে গিয়ে একটি দেশকে নানা ধরনের আপত্তিকর শর্ত মেনে নিতে হয়।
বাংলাদেশের ঋণ গ্রহণের মাত্রা এখনো বিপৎসীমার অনেক নিচে রয়েছে। কিন্তু তাই বলে আমাদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমাদের ঋণ গ্রহণের মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে বাংলাদেশ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের অনুমোদন পেয়েছে। ইতোমধ্যেই অনুমোদিত ঋণের প্রথম কিস্তি বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ হয়েছে।
আইএমএফ এ ঋণ একবারে দেবে না। তারা সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণের অর্থ বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড় করবে। আইএমএফ ঋণদানের বিপরীতে যেসব কঠিন শর্ত দিয়েছে তা এ সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো কারণে বাংলাদেশ যদি আইএমএফের দেওয়া শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হয় অথবা অনাগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে মাঝপথে ঋণের কিস্তি ছাড়করণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মোট ১২ বার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে।
কোনো দেশ একান্ত বিপদে না পড়লে আইএমএফের শর্তযুক্ত ঋণ গ্রহণ করে না। একটি দেশ ঋণ গ্রহণ করবে, তারা সুদসহ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবে। এর মাঝখানে আর কোনো শর্ত থাকা উচিত নয়। কিন্তু আইএমএফ এ বিষয়টি মানতে নারাজ। কারণ তারা ঋণদানের ক্ষেত্রে একটি দেশের উন্নয়নের ইস্যুটি যত না বিবেচনা করে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় তাদের স্বার্থকে। গত প্রায় ১২ বছর বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি।
ফলে আইএমএফের দেওয়া পরামর্শ বাংলাদেশের জন্য মানার বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু এবার ঋণ গ্রহণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ এমনসব শর্ত মেনে নিতে সম্মত হয়েছে, যা সরকার গৃহীত বিভিন্ন নীতি-কৌশলের পরিপন্থি। ফলে বাংলাদেশকে আগামীতে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের গৃহীত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে। আগামীতে এসব ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় বাংলাদেশ সমস্যায় পড়তে পারে।
প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে এ পর্যন্ত ৭ হাজার ২২৯ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ৭ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশকে ঋণদানকারী শীর্ষ পাঁচটি দেশ ও সংস্থার মধ্যে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহণ করেছে। এ ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৮১৬ কোটি মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে, যার পরিমাণ ১ হাজার ৩২৮ কোটি মার্কিন ডলার।
জাপানের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে ৯২৩ কোটি মার্কিন ডলার। রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে যথাক্রমে ৫০৯ কোটি মার্কিন ডলার ও ৪৭৬ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে গৃহীত ঋণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ বাংলাদেশ যেসব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে, তার ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। একইসঙ্গে খুব কম প্রকল্পই আছে যা সঠিক ও নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হলে সেই প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি পায়, সাধারণ মানুষ প্রকল্পের কাছ থেকে সুবিধা ভোগ করতে পারে না।
এদিকে বাংলাদেশ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার কাছ থেকে যে ঋণ গ্রহণ করেছে, তার কিস্তি পরিশোধের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশকে বিদেশি ঋণের কিস্তি বাবদ ২৭৮ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হবে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৩২৮ কোটি মার্কিন ডলার, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ৪০২ কোটি মার্কিন ডলার, ২০২৯-২০৩০ অর্থবছরে ৫১৫ কোটি মার্কিন ডলার এবং ২০৩৪-২০৩৫ অর্থবছরে ৪৪৫ কোটি মার্কিন ডলার কিস্তি বাবদ পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেভাবে কমছে তাতে আগামীতে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা কিছুটা হলেও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে (২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ৩ হাজার ২৩৩ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ প্রদর্শিত রিজার্ভের চেয়ে ৮০০ কোটি ডলার কম। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ দেওয়া অর্থও মোট রিজার্ভের সঙ্গে যোগ করে প্রদর্শন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ অর্থ থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে যে অর্থ ঋণ দিয়েছে, তার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের অধিকার থাকলেও সেই অর্থের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ নেই। চাইলেই বাংলাদেশ ব্যাংক সেই অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। যে অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহার করা যায় না, তা কোনোভাবেই রিজার্ভ হতে পারে না।
আগামীতে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে নানা সমস্যায় পড়তে পারে। রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স প্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। পণ্য রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স খাতের আয় কমার পাশাপাশি বৈধ চ্যানেলে এগুলোর অর্থ দেশে আসবে না। গত এক বছরে প্রায় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে দেশে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রা ম্যানেজমেন্ট সঠিকভাবে করতে না পারলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাতগুলো যদি সঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে বৈদেশিক ঋণগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে।
এমএ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাতগুলো গতিশীল করতে হবে
একজন বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন, ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির না থাকে আত্মমর্যাদা, না থাকে কোনো সম্মান। তাকে পদে পদে লাঞ্ছিত হতে হয়।’ কথাটি ব্যক্তির জীবনে যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্রের জীবনেও। যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত, সমাজে তার কোনো মর্যাদা থাকে না। কথায় বলে, ‘গরিবের বউ সবার ভাবি।’
অর্থাৎ দরিদ্র পরিবারের একজন গৃহবধূর কোনো আত্মসম্মান থাকে না। তাকে পদে পদে লাঞ্ছিত-অপমানিত হতে হয়। কেউই ইচ্ছা করে দরিদ্র থাকতে চায় না। কিন্তু পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা একজন মানুষকে দরিদ্র থাকতে বাধ্য করে। ব্যক্তির সমষ্টিই রাষ্ট্র গঠন করে। তাই ব্যক্তির মতো রাষ্ট্রও চিরদিন দরিদ্র হয়ে থাকতে চায় না। একটি রাষ্ট্রকে উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে হলে এমন নেতৃত্বের প্রয়োজন, যা দেশটিকে সত্যিকার ও কার্যকর উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এ উন্নতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাধিত হলেই চলে না, তাকে সামাজিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের মতো করে নেতৃত্ব দিতে হয়। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতির ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কার্যকর ও সঠিক নেতৃত্বের অভাবে অনেক সময়ই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করা সম্ভব হয় না।
আমাদের দেশে একসময় একটি কূট বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল। বলা হচ্ছিল, আমরা উন্নয়ন চাই নাকি গণতন্ত্র? এ বিতর্কের প্রবক্তারা প্রকারান্তরে এটাই বলতে চেয়েছিলেন যে, আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা। সেই উন্নয়ন অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে গণতন্ত্রকেও বিসর্জন দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যারা এ ধরনের অনাবশ্যক বিতর্ক সৃষ্টি করতে চান, তাদের উদ্দেশ্য যে ভালো নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কারণ উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলে। যে দেশে কার্যকর ও বিশুদ্ধ গণতন্ত্র আছে, সেই দেশের অর্জিত উন্নয়ন অধিকতর কার্যকর ও টেকসই হয়। উন্নয়ন যদি ভঙ্গুর হয়, তাহলে সেই উন্নয়ন নিয়ে গর্ব করার মতো কিছু থাকে না। একটি দেশে কার্যকর গণতন্ত্র থাকলে জবাবদিহিতার কোনো অভাব হয় না। আর দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে জবাবদিহিতা একান্তই আবশ্যক।
উন্নয়ন যদি ভঙ্গুর হয়, তাহলে তার পরিণতি কখনোই সুখকর হতে পারে না। সামান্য আঘাতেই উন্নয়নসৌধ ভেঙে পড়তে পারে। এ প্রসঙ্গে নেপালের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নেপাল কয়েক বছর আগে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকায় স্থান লাভ করেছিল। দেশটি বেশ ভালোভাবেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এ ভূমিকম্পের অভিঘাত নেপালি অর্থনীতি সহ্য করতে পারেনি। ফলে জাতিসংঘ নেপালকে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকা থেকে নামিয়ে দিতে বাধ্য হয়। কারণ নেপালের অর্থনৈতিক উন্নয়ন শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না।
একটি দেশের উন্নয়নের অনেক সূচক থাকে। এর একটি হচ্ছে কর-জিডিপি অনুপাত। একটি দেশের অর্থনীতি কতটা মজবুত এবং নিজস্ব শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা কিছুটা হলেও অনুমান করা যায় দেশটির কর-জিডিপি অনুপাত প্রত্যক্ষ করে। যে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত বেশি, সেদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে নিজস্ব সূত্র থেকে অর্থায়ন সহজতর হয়। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের জিডিপির যে আকার, তার মাত্র ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ কর আদায় হয়। ফলে আমাদের উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য বিদেশি ঋণ ও আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়। আর ঋণ ও আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করতে গিয়ে একটি দেশকে নানা ধরনের আপত্তিকর শর্ত মেনে নিতে হয়।
বাংলাদেশের ঋণ গ্রহণের মাত্রা এখনো বিপৎসীমার অনেক নিচে রয়েছে। কিন্তু তাই বলে আমাদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমাদের ঋণ গ্রহণের মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে বাংলাদেশ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের অনুমোদন পেয়েছে। ইতোমধ্যেই অনুমোদিত ঋণের প্রথম কিস্তি বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ হয়েছে।
আইএমএফ এ ঋণ একবারে দেবে না। তারা সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণের অর্থ বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড় করবে। আইএমএফ ঋণদানের বিপরীতে যেসব কঠিন শর্ত দিয়েছে তা এ সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো কারণে বাংলাদেশ যদি আইএমএফের দেওয়া শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হয় অথবা অনাগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে মাঝপথে ঋণের কিস্তি ছাড়করণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মোট ১২ বার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে।
কোনো দেশ একান্ত বিপদে না পড়লে আইএমএফের শর্তযুক্ত ঋণ গ্রহণ করে না। একটি দেশ ঋণ গ্রহণ করবে, তারা সুদসহ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবে। এর মাঝখানে আর কোনো শর্ত থাকা উচিত নয়। কিন্তু আইএমএফ এ বিষয়টি মানতে নারাজ। কারণ তারা ঋণদানের ক্ষেত্রে একটি দেশের উন্নয়নের ইস্যুটি যত না বিবেচনা করে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় তাদের স্বার্থকে। গত প্রায় ১২ বছর বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি।
ফলে আইএমএফের দেওয়া পরামর্শ বাংলাদেশের জন্য মানার বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু এবার ঋণ গ্রহণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ এমনসব শর্ত মেনে নিতে সম্মত হয়েছে, যা সরকার গৃহীত বিভিন্ন নীতি-কৌশলের পরিপন্থি। ফলে বাংলাদেশকে আগামীতে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের গৃহীত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে। আগামীতে এসব ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় বাংলাদেশ সমস্যায় পড়তে পারে।
প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে এ পর্যন্ত ৭ হাজার ২২৯ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ৭ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশকে ঋণদানকারী শীর্ষ পাঁচটি দেশ ও সংস্থার মধ্যে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহণ করেছে। এ ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৮১৬ কোটি মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে, যার পরিমাণ ১ হাজার ৩২৮ কোটি মার্কিন ডলার।
জাপানের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে ৯২৩ কোটি মার্কিন ডলার। রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে যথাক্রমে ৫০৯ কোটি মার্কিন ডলার ও ৪৭৬ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে গৃহীত ঋণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ বাংলাদেশ যেসব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে, তার ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। একইসঙ্গে খুব কম প্রকল্পই আছে যা সঠিক ও নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হলে সেই প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি পায়, সাধারণ মানুষ প্রকল্পের কাছ থেকে সুবিধা ভোগ করতে পারে না।
এদিকে বাংলাদেশ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার কাছ থেকে যে ঋণ গ্রহণ করেছে, তার কিস্তি পরিশোধের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশকে বিদেশি ঋণের কিস্তি বাবদ ২৭৮ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হবে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৩২৮ কোটি মার্কিন ডলার, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ৪০২ কোটি মার্কিন ডলার, ২০২৯-২০৩০ অর্থবছরে ৫১৫ কোটি মার্কিন ডলার এবং ২০৩৪-২০৩৫ অর্থবছরে ৪৪৫ কোটি মার্কিন ডলার কিস্তি বাবদ পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেভাবে কমছে তাতে আগামীতে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা কিছুটা হলেও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে (২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ৩ হাজার ২৩৩ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ প্রদর্শিত রিজার্ভের চেয়ে ৮০০ কোটি ডলার কম। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ দেওয়া অর্থও মোট রিজার্ভের সঙ্গে যোগ করে প্রদর্শন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ অর্থ থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে যে অর্থ ঋণ দিয়েছে, তার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের অধিকার থাকলেও সেই অর্থের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ নেই। চাইলেই বাংলাদেশ ব্যাংক সেই অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। যে অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহার করা যায় না, তা কোনোভাবেই রিজার্ভ হতে পারে না।
আগামীতে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে নানা সমস্যায় পড়তে পারে। রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স প্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। পণ্য রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স খাতের আয় কমার পাশাপাশি বৈধ চ্যানেলে এগুলোর অর্থ দেশে আসবে না। গত এক বছরে প্রায় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে দেশে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রা ম্যানেজমেন্ট সঠিকভাবে করতে না পারলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাতগুলো যদি সঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে বৈদেশিক ঋণগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে।
এমএ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক