চেতনায় বুদ্বুদ

হত্যা দিবসে জিয়াকে নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতি

 বদিউর রহমান 
৩০ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে যে যেভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেন, তাকে ছাড়া আমাদের জাতীয় সত্তা থাকেই না। সময়ের বাঁক ঘুরে ইতিহাস কাউকে বিন্দুমাত্রও ছাড় দেয় না। কোনো কুকর্মের জন্য ক্ষমাও করে না। সময়ের বিবেচনায় ইতিহাস কাউকে অমর করে দেয়, তখন চাঁদের কলঙ্ক চাঁদের আলোকে আর মলিন করতে পারে না, চাঁদ তখন চাঁদই থেকে যায়। বঙ্গবন্ধু ইতিহাসে তেমনই। ক্ষমতায় থাকাবস্থায় তার ব্যর্থতা আছে, বাকশাল করার কড়া সমালোচনা আছে, পত্রিকা সীমিত করে দেওয়ার ক্ষোভ রয়েছে কারও কারও-কিন্তু এ সবকিছু তার চাঁদের কলঙ্ক হিসাবে তাকে সমুজ্জ্বলই রেখে দিয়েছে। সময়ে তিনি আরও প্রোজ্জ্বল হয়েছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তার প্রশংসা করতে করতে তারা লেবুচিপা করে ফেলে তাকে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে তার নাম-নিশানা মুছে ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা করে হয়, এমনকি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউকে বিবি অ্যাভিনিউ করে ফেলে। দুদলের বিপরীতমুখী এতসব কর্মকাণ্ডের পরও বঙ্গবন্ধু সূর্যের তেজস্বিতায় বঙ্গবন্ধুই রয়ে যায়-আর এটাই হলো তার নিজস্বতা। তিনি মানুষ ছিলেন, তার ভুল ছিল, তার খেদ ছিল। কিন্তু তার মুখেই আমরা শুনি-সব চাটার দল খেয়ে ফেলে, তিনিই বলতে পারেন-গাজী আমার কম্বলটা কই? তাই তিনি জাতির পিতা, তাই তিনি বঙ্গবন্ধু, তিনি অমর। তার সঙ্গে জিয়াউর রহমানকে সমান্তরাল করার জন্যই বিএনপি সরকার ২০০৩ সালে দুজনকে একসঙ্গে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়, আর নির্লজ্জ আওয়ামী লীগ তা মেনেও নেয়, এখনো সে পুরস্কার বাতিল করে না। বিএনপি জিয়াকে টেনেটুনে বড় করার জন্য, আর বঙ্গবন্ধুকে চেপেচুপে একটু খাটো করার জন্য একসঙ্গে দুজনকে এ পুরস্কার দিয়েছে। যিনি দেশ দেন, জাতি সৃষ্টি করেন, যিনি জাতির পিতা হন, যিনি নিজেই স্বাধীনতা এনে দেন-তাকে আবার জিয়া-প্রবর্তিত স্বাধীনতা পুরস্কার কীভাবে দেওয়া হয় এবং কীভাবে তা মেনেও নেওয়া হয়-তা আজও বুঝলাম না। লজ্জা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারকে এ জন্য যে, তারা এখনো বঙ্গবন্ধুকে প্রদত্ত স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল করেনি।

চাকরির শুরুতেই আমি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পদায়ন পেয়ে কর্মসূত্রে জিয়াউর রহমানের বঙ্গভবনে যাতায়াত শুরু করি। মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে জিয়াকে দেখি, মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকের কার্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হই, জিয়ার কর্মকাণ্ড দেখি, তাকে বোঝার সুযোগ পাই। হ্যাঁ, রাষ্ট্রপতি হিসাবে জিয়া অবশ্যই দক্ষ ছিলেন, তার প্রশাসন প্রশংসনীয় ছিল। তার মন্ত্রীরা-প্রথমদিকের কয়েকজন ছাড়া-তাকে ভীষণ ভয় পেতেন। আমরা হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে হেডমাস্টারকে যেভাবে ভয় পেতাম প্রথম ছয়/সাতজন ছাড়া বাকি মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী/উপমন্ত্রীরা জিয়াকে তেমনই ভয় পেতেন। মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক তখন শুক্রবার সাড়ে ৭টায় হতো, একটু দেরিতে কেউ এলে জিয়া যেভাবে তাকাতেন, তাতে বিলম্বকারী মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী/উপমন্ত্রী যেন শূলবিদ্ধ হতেন। একদিন একজন মিনিটদশেক পর বৈঠকে ঢুকছিলেন, যেতে তো হয় প্রেসিডেন্টের চেয়ারের একপাশ দিয়ে, জিয়া বললেন-মন্ত্রী আসবেন দশ মিনিট পরে, তাহলে সচিব অফিসে আসবেন বিশ মিনিট পরে, অতিরিক্ত সচিব এক ঘণ্টা পর, যুগ্মসচিব দুই ঘণ্টা পর, উপসচিব চার ঘণ্টা পর, তার পরের কর্মকর্তা তো না এলেও চলবে। সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার সাদেকুর রহমান চৌধুরীর পরামর্শে মন্ত্রীদের বিলম্বের জন্য তাদের রক্ষা করতে আমি কত মিথ্যা বলেছি। সামরিক সচিব আমাকে বলতেন, আপনি পদেও ছোট, বয়সেও ছোট, একটু মিথ্যা বলে মন্ত্রীকে বাঁচিয়ে দিলে গুনাহ হবে না। আপনি প্রেসিডেন্টকে বলবেন, কেবিনেট সেক্রেটারি কেরামত আলী সাহেবকে না পেয়ে মন্ত্রী তার আসতে দেরি হওয়ার কথা, অসুস্থতার কথা, আপনাকে জানিয়ে রেখেছে। এডিসি আউয়াল আর শাহ আলমের কক্ষে আমরা এসব নিয়ে আলোচনা করে মজা করতাম। এখন ভাবি, ব্রিগেডিয়ার, পরে মেজর জেনারেল সাদেকুর রহমান সাহেব কত বড় মনের অধিকারী ছিলেন যে, তিনি মন্ত্রীদের বাঁচিয়ে দেওয়ার কৌশল করে নিজে মিথ্যা না বলেও আমাকে দিয়ে তাদের জিয়ার রোষানল থেকে বাঁচাতেন। জিয়া মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকের সারসংক্ষেপ পড়তেন। তার ফোল্ডার ফেরত এলে দেখতাম তার সারসংক্ষেপের অনেক স্থানে তার কলমের কালিতে দাগ দেওয়া রয়েছে। অনেক মন্ত্রীই কিন্তু সারসংক্ষেপ পড়তেন না। আমি কে কে পড়েন তা পরীক্ষার জন্য সারসংক্ষেপের কোনায় কোনায় একেক দিন একেক মন্ত্রীর ফোল্ডারে, কোনোদিন কয়েক মন্ত্রীর ফোল্ডারে হালকা আঠা লাগিয়ে দিতাম, খুলতে গেলেই তা খুলে যেত। জিয়া সিদ্ধান্ত প্রদানে সিরিয়াস ছিলেন। কার্যবিবরণী অনুমোদনে প্রথমদিকে ‘জিয়া’ পুরো লিখলেও পরে প্রায় শুধু ‘জি’ লিখতেন। প্রথমদিকে আমরা কার্যবিবরণী ইংরেজিতে লিখতাম, ১৯৮০-এর ডিসেম্বরের শেষার্ধে তিনি এক কার্যবিবরণীতে-এখন থেকে বাংলায় লিখুন-লিখে দিলে আমরা বাংলায় লেখা শুরু করি। একবার পেট্রোলিয়াম মূল্যবৃদ্ধির একটি সারসংক্ষেপ বৈঠক শেষে হিসাব মেলাতে গিয়ে কম পাওয়া গেলে তার হিসাব চান জনাব কেরামত আলী। আমি তাকে বললাম, ছুটির দিনে আমাকে এনে অফিস খুলে ওই সারসংক্ষেপ আপনি রাষ্ট্রপতির ক্যান্টনমেন্টের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন, কপি নং.... এত। বড় মেথোডিকেল ছিলেন কেরামত আলী, খুঁজে খুঁজে মাসতিনেক পর তিনি রাষ্ট্রপতির বাসা থেকে ওই কপি এনে আমাকে ফেরত দিয়েছিলেন।

একদিন এক বৈঠকে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের এক সারসংক্ষেপে তাদের ২০ কোটি টাকা লাভের খতিয়ান তুলে ধরা হয়। সবাই বস্ত্র মন্ত্রণালয়কে বাহবা দিল, বস্ত্রমন্ত্রী মনসুর আলী খুশিতে ডগমগ। এমন অবস্থায় সচিব এসএ খায়ের রাষ্ট্রপতিকে বললেন, স্যার আমি যোগ-বিয়োগ করে দেখেছি লাভ ২০ কোটি নয়, ২ কোটি। সারসংক্ষেপে একবার ২-এর সঙ্গে কীভাবে যেন একটা শূন্য বসে যাওয়ার পর থেকে ওটা ২০ কোটি হয়ে গিয়েছে। জিয়া তার ফোল্ডারটা চেপে ধরে বললেন, চারজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট মন্ত্রী থাকার পরও এত বড় ভুল কারও চোখে পড়ল না! ফোল্ডারটা ছুড়ে পাশে ফেলে দিয়ে কেবিনেট সেক্রেটারিকে বললেন, সিদ্ধান্ত লিখবেন-মিনিস্টারস শুড কাম প্রিপেয়ার্ড ইন দ্য মিটিং। এরপর সোজা উঠে চলে গেলেন। আরেকদিন এক মন্ত্রী বৈঠকে একটু ঝিমিয়ে পড়েন। জিয়া বললেন, রাতে ২টা পর্যন্ত তাস খেললে ঘুমানোর সময় কোথায় পাওয়া যায়! বড় কঠোর ছিলেন এসব বিষয়ে-সব মন্ত্রীর খোঁজ থাকত তার কাছে। মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে আপ্যায়নে এক কাপ চা এবং দুটি নোনতা বিস্কুট দেওয়া হতো মাত্র। তবে চাউর ছিল যে, জিয়া নিজে সৎ থাকলেও তিনি মন্ত্রীদের করাপ্ট হতে সুযোগ দিতেন। তার চোখের চাহনিতে নিষ্ঠুরতা ছিল, কালো চশমার ভেতর থেকে ওই নিষ্ঠুরতা হয়তো কেউ টের পেত না। তার আমলে বারবার ক্যু এবং সেনা-নিধনে বোঝা যায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাকে কত নিষ্ঠুর হতে হয়েছে। আমার কাছে একটা বড় মজার বিষয় ছিল-আমার একটা সাদা মোটা বেল্ট রাষ্ট্রপতির পছন্দ হয়ে গিয়েছিল, তার চোখ যে সেদিকে কত তীক্ষ্ন ছিল তা সেদিন বুঝেছিলাম। এডিসি আউয়াল আমাকে ডেকে কোন দোকান থেকে তা কিনেছিলাম, সে খোঁজ নিয়ে পরে ওরকম বেল্ট কিনে আনিয়েছিলেন মর্মে আমাকে জানান। জিয়া বৈঠকে আসার আগে ৫-১০ মিনিট মৃদু একটা ঘণ্টা বাজত, আমি ওটাকে মোগল বাদশাহর আগমনি বার্তা হিসাবে ভাবতাম। জিয়া হাফ শার্ট, সাফারি, পাম্প শু বেশি পরতেন, দেখেছি। রাস্তায় তার গাড়িবহরেও একটা বিশেষ সাইরেনজাতীয় আওয়াজ করত-আমরা বুঝতাম রাজা যাচ্ছেন। একদিন বৈঠকের আগে আমি সচিবদের অপেক্ষায় কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, রাষ্ট্রপতির বৈঠকে যাওয়া দেখার জন্য, তিনি জিজ্ঞেস করে বসলেন-এসবির নাকি? উত্তর দিলাম, স্যার, কেবিনেট ডিভিশনের অফিসার। জীবনে ওই একবারই সরাসরি কথা আমার তার সঙ্গে। সেনাবাহিনীর এডিসি এক মহিলা গেস্টকে বঙ্গভবনের পাস দিয়েছিলেন বলে তাকে জিয়া সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রশাসনে তিনি দক্ষও ছিলেন, কড়াও ছিলেন, তার আমলে সিভিল সার্ভিসে দলবাজি দেখিনি। পদায়নে তিনি যোগ্যতা বিবেচনা করেছেন। ভিন্নমনা যোগ্যকেও যথামূল্যায়ন করেছেন। সাবেক স্বাস্থ্য সচিব মোহাম্মদ আলীকে (নরসিংদী) ইআরডির যুগ্মসচিব পদে বসালে কেউ কেউ জনাব আলীকে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হিসাবে বিরোধিতা করছিলেন। জিয়া জিজ্ঞেস করেছিলেন-দক্ষতা কেমন, উত্তর পেলেন ভালো, সততা সমন্ধে উত্তর পেলেন সৎ। তখন জিয়ার নাকি জবাব ছিল, দক্ষ ও সৎ হলে বঙ্গবন্ধুভক্ত হলে অসুবিধা কোথায়, ইআরডিতে তার পদায়ন হয়। আমরা কখনো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে জিয়াকে দেখিনি। হজে আমার এক রুমমেট মুক্তিযোদ্ধা আমাকে বলেছিলেন, তিনি নাকি একবার জিয়াকে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে বললে জিয়া জবাব দিয়েছিলেন, তাকে মূল্যায়নের ক্ষমতা আমার নেই, ইতিহাস তাকে মূল্যায়ন করবে। সিভিল সার্ভিসে মেধাবী অফিসার আসার জন্য জিয়াই অধ্যাপক শামস উল হককে দিয়ে সুপিরিয়র পদ পরীক্ষায় ১৯৭৬-এর কঠোর সিলেবাস প্রণয়ন করিয়েছিলেন, যাতে মোট ১৩০০ নম্বরের লিখিত, ২০০ নম্বরের মৌখিক এবং ১০০ নম্বরের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা ছিল। তন্মধ্যে বাংলায় তিন ঘণ্টা একটা রচনা এবং ইংরেজিতে তিন ঘণ্টা একটা রচনা লেখার ১০০ নম্বর করে যে প্রথা ছিল, তাতেই পরীক্ষার্থীর পুলসিরাত পার হওয়ার অবস্থা হতো। জিয়ার সঙ্গে ঢাকার বাইরে দুই বৈঠকে গিয়েও আমার ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

কিন্তু জিয়ার মৃত্যু আমাকে আরেকবার এক মজবুত শিক্ষা দিয়ে যায় যে, মারে আল্লাহ রাখে কে। আমরা কার্যবিধিমালা, ১৯৭৫ অনুসারে শুক্রবারের মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকের জন্য চারদিন আগে মঙ্গলবার নোটিশ দিলাম। বুধবার লে. কর্নেল মাহফুজ টেলিফোনে আমাকে বৈঠক বাতিল করতে বললেন, রাষ্ট্রপতি ইরাক-ইরান যুদ্ধের শান্তি কমিটির বৈঠকে যাবেন। আমরা বৈঠক বাতিলের নোটিশ দিলাম। কিন্তু পরদিন সকালে আবার জানালেন, তিনি যাবেন না। বৈঠক হবে। আমরা বৈঠক বাতিলের নোটিশ বাতিল করলাম। আবার ওইদিন বিকালে জানানো হলো যে বৈঠক হবে না, রাষ্ট্রপতি চট্টগ্রাম যাবেন, সেখানে তখন বিএনপির অভ্যন্তরীণ কিছু গন্ডগোলও ছিল। আমরা বৈঠক বাতিলের বাতিল নোটিশ আবার বহাল করলাম। তাহলে ঘটনাটা কী ঘটল? বৈঠক হবে-নোটিশ দিলাম; বৈঠক হবে না-নোটিশ বাতিল করলাম; আবার বৈঠক হবে-বৈঠক বাতিলের নোটিশ বাতিল করলাম; আবার বৈঠক হবে না-আবার বৈঠক বাতিলের নোটিশ বহাল করলাম। মৃত্যু যদি ডেকে তাকে ইরান যাওয়া থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে না যায়, এমন হবে কেন? অতএব, মারে আল্লাহ রাখে কে? আমরা সাধারণত বেশি বলি, রাখে আল্লাহ মারে কে, কিন্তু মারে আল্লাহ রাখে কে-এটা বেশি একটা বলতে চাই না। কোনো এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি কোনো মৃত্যু নিয়ে বলেন যে, আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন-তখন আমরা ফোঁসফাঁস করি। তারপরও আমরা এমন মৃত্যু কখনো চাই না। মহাত্মা গান্ধী হত্যা, লিয়াকত আলী খান হত্যা, বঙ্গবন্ধু হত্যা, ইন্দিরা গান্ধী হত্যা, ভুট্টোর ফাঁসি, জিয়াউল হকের মৃত্যু, বেনজির ভুট্টো হত্যা, জিয়া হত্যা, রাজিব গান্ধীর মৃত্যু-এমন আরও আরও অনেক মৃত্যু/হত্যা আমাদের কী বার্তা দেয়? মারে আল্লাহ রাখে কে? নাকি সবই মানুষেরই কর্মকাণ্ড?

জিয়া যেদিন মারা গেলেন, সেদিন সকালে আমি অফিসে গেলাম রিলাক্স মুডে, সকালে বৈঠক নেই। আমি ৭টা ৪৫ মিনিটে আমার বাসা বরাদ্দের চিঠি আনার জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এস্টেট অফিসে যাচ্ছিলাম। সচিবালয় লাইব্রেরির পশ্চিম পাশ পেরিয়ে স্বাস্থ্য সচিবের কক্ষের একটু আগে থাকতেই পেছন থেকে ‘স্যার স্যার’ করে ওমদা মিয়াকে চিৎকার করতে শুনলাম। ওমদা হাঁপিয়ে গেলেন। বললেন, কেবিনেট সেক্রেটারি আমাকে ডাকছেন। গেলাম, স্যার বললেন-কেবিনেট মিটিং হবে, প্রস্তুতি নেন। অবাক হলাম, বললাম, স্যার রাষ্ট্রপতি তো চট্টগ্রামে, বৈঠক কে করবেন? কেরামত আলী সাহেব আমাকে যুগ্মসচিব নূর উন নবী চৌধুরীর কক্ষে যেতে বলে আর কিছু বললেন না। যুগ্মসচিবের কক্ষে গেলে তিনিই প্রথম আমাকে বললেন, জিয়াকে হত্যা করা হয়েছে, ভাইস প্রেসিডেন্ট সাত্তার বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন। বলে কী, জিয়া খুন হয়েছেন! কিন্তু বড় আমলাদের কোনো আলাদা অভিব্যক্তি দেখলাম না, মনে হলো জিয়া থাকলেই কী, না থাকলেই কী, যেমন জিয়া বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু সংবাদে বলেছিলেন-সো হোয়াট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। কী এক প্রাকৃতিক প্রতিশোধ, কী এক নেচারাল জাস্টিস! ২৮ ফেব্রুয়ারি (সম্ভবত) বঙ্গভবনে সচিবদের কয়েকজনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জিয়া নিজে তার কর্মপরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক বাজে কথা বলে ফেলেছিলেন। তিনি বললেন, স্বয়ং আল্লাহও তার সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেননি, আমরা চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। ৩০ মে তার মৃত্যুসংবাদে আমার মনে হলো, আল্লাহ কী পারেন আর কী পারেন না-তা আমরা বোঝার আর বলার কে? নিয়তির কী এক নির্মম পরিহাস-যিনি দেশ দেন, জাতির পিতা হন, তার জানাজা হয় অনেক কষ্টে, রেড ক্রিসেন্টের কাপড়ে হয় দাফন, ৫৭০ সাবানে হয় গোসল, আর ক্ষমতায় থেকে মৃত্যুতে জিয়া পেয়ে যান এক সর্ববৃহৎ জানাজা, কবর পেয়ে যান চন্দ্রিমার মাঝখানে। সরাবে সরাবে বলেও শেখ হাসিনা আর সে কবর এখনো সরালেন না। না জানি জিয়ার কবরটাও রাজনীতির একটা কৌশল হলো কি না।

আওয়ামী লীগকে যারা পছন্দ করে না, তাদের কেউ কেউ বলে ফেলেন, এভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে দেশ রক্ষা পেত না। আমরা বলি, আওয়ামী লীগ অজনপ্রিয় হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলেও তা ঠেকাতে পারতেন না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের বিকল্প কি বিএনপি কখনো হতে পেরেছে, না পারবে? তবে হালের বিভিন্ন স্লোগান থেকে আমাদের ভাবতে হচ্ছে বাংলাদেশ এখন কার-জনগণের, বঙ্গবন্ধুর, না শেখ হাসিনার। এ নিয়ে আলাদাভাবে লেখার ইচ্ছা রইল।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন