প্রস্তাবিত বাজেট ও ‘বিকল্প বাজেট’
প্রতিবছরের মতো এবারও আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট মহান সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে। মাসব্যাপী আলোচনার পর কিছুটা সংযোজন-বিয়োজনের পর তা চলতি মাসের শেষের দিকে সংসদে অনুমোদিত হবে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১ জুন বাজেটটি প্রস্তাবাকারে সংসদে উপস্থাপন করেন। এবার বাজেটের মূল দর্শন হিসাবে বলা হয়েছে-‘২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এ বাজেট সরকারি হিসাবে জিডিপির ১৫ শতাংশ। এ অর্থের জোগান আসবে কোথা থেকে? সরকারের হিসাব মতে, মোট রাজস্ব আয় হবে ৫ লাখ কোটি টাকা, যার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আহরিত হবে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে আয় হবে ৭০ হাজার কোটি টাকা। আয়-ব্যয়ের হিসাবে দেখা যায়, বাজেটে ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি পূরণ করার উপায় কী? প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। বাদবাকি ঋণ অভ্যন্তরীণভাবে নেওয়া হবে, যার মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন খাতের বরাদ্দ নিয়ে এরই মধ্যে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। আমি তার পুনরাবৃত্তি করতে চাইছি না। সব মিলিয়ে যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে তা হলো, এটি একটি গতানুগতিক বাজেট। এর মধ্যে আশান্বিত হওয়ার মতো কিছু নেই। বাজেটের বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়াও গতানুগতিক এবং পূর্বপ্রস্তুতকৃত। সরকারি দল বলছে, ‘এ বাজেট গণমুখী’, বিরোধী দল বলছে, ‘এ বাজেট গণবিরোধী’। তাই বাজেট প্রস্তাবনায় যেমন নতুন কিছু নেই, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়ায়ও নতুন কিছু নেই।
এ কথা ঠিক যে, বার্ষিক বাজেটের সঙ্গে সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির সম্পর্ক থাকে। তবে বার্ষিক বাজেটের প্রধান লক্ষ্য থাকে চলমান সংকট মোকাবিলা ও তা নিরসন করা। যে সময় আসন্ন অর্থবছরের বাজেটটি উপস্থাপিত হয়েছে, সেসময়ে অর্থনীতিতে নানা রকমের সংকট চলছে। দ্রব্যমূল্য আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, ডলার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে, কালোটাকার পাহাড় জমে গেছে, অর্থ পাচার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না, ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্যে লাগাম টানা যাচ্ছে না, আয়বৈষম্যে ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি। এসব সমস্যা-সংকট সামনে রেখে যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, তা দিয়ে কোনো কার্যকর ফল আসবে না।
আজকের লেখাটি প্রস্তাবিত বাজেটের দুর্বল দিকগুলো আলোচনার উদ্দেশ্যে নয়। বরং একটি বাজেট প্রণয়নে যে দার্শনিক ভিত্তি থাকে, এর অভাবটি তুলে ধরতে চাই। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি কর্তৃক প্রস্তাবিত ‘বিকল্প বাজেট’কে তুলনায় আনতে চাই। সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের দর্শন ভিত্তি হলো প্রচলিত সামাজিক অবস্থাকে বহাল রেখে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা। যে কারণে বাজেটের সুবিধাভোগ করবে ধনিক ও বিত্তশালী শ্রেণি, যারা শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। এবং গত ৫০ বছর ধরে তা-ই হয়ে আসছে। সাধারণ জনগোষ্ঠীর কথা কোনো বাজেটেই ভাবা হয়নি, যদিও বলা হয়েছে এবং তা বলা পর্যন্তই শেষ। দিনকে দিন বৈষম্যের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এদিক থেকে অর্থনীতি সমিতির দর্শনটি অনেকখানি জনমুখী।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি গত ২০১৫ সাল থেকে ‘বিকল্প বাজেট’ উপস্থাপন করে আসছে। এবারও ২৫ মে সমিতি তার বিকল্প বাজেট উপস্থাপন করেছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাজেট ঘোষণার অনুষ্ঠানটিতে অনলাইনে যুক্ত ছিল ৬৪ জেলা, ১৩৫ উপজেলা এবং ৪৫ ইউনিয়ন। ‘বিকল্প বাজেট’ উপস্থাপন করেন সমিতির সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে-বৈষম্য নিরসনে জনগণতান্ত্রিক বাজেট। বিকল্প বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ২০ লাখ ৯৪ হাজার ১১২ কোটি টাকা, যা সরকারি হিসাবের জিডিপির ৫২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। চলমান সরকারি বাজেটের তুলনায় সমিতির বাজেটের আকার ৩ গুণেরও বেশি বড় এবং ১ জুন সংসদে উপস্থাপিত আসন্ন অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ২ দশমিক ৭৫ গুণ বড়। বিকল্প বাজেটের এ প্রায় ২১ লাখ কোটি টাকা আসবে কোথা থেকে? সমিতি মনে করে, রাজস্ব আয় থেকে ১৯ লাখ ২৯ হাজার ১১২ কোটি টাকা আহরণ করা সম্ভব, যা কিনা মোট বরাদ্দের ৯২ দশমিক ১৩ শতাংশ। বাজেটের বাদবাকি ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশের (অর্থাৎ ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতির) জোগান আসবে যথাক্রমে সম্মিলিত বন্ড বাজার থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে বিক্রি বাবদ ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারত্ব থেকে আসবে ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতি সমিতি মনে করে, ঘাটতি পূরণের জন্য বৈদেশিক ঋণের দ্বারস্থ হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, অভ্যন্তরীণভাবেই তা পূরণ করা সম্ভব। বৈদেশিক ঋণের বিষয়ে অর্থনীতি সমিতির অবস্থান খুব স্পষ্ট। তাদের বক্তব্য হলো, আমরা নীতিগতভাবেই ঋণ করে ঘি খাওয়ার বিপক্ষে (এর মধ্যে কোনো জাতীয়তাবাদ নেই, নেই মানবসত্তার মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা)। আমরা জানি, সাম্রাজ্যবাদী আর্থিকীকরণকৃত রেন্টসিকিং লুটেরা পুঁজির ঋণ যে কোনো দেশে তাদেরই অধীনস্থ লুটেরা শ্রেণির শাসনব্যবস্থা জোরদারে সহায়ক হতে বাধ্য। বরাদ্দের ক্ষেত্রে কাঠামোগত ও নীতিগত পরিবর্তন চায় সমিতি। আমাদের সরকারি চলতি বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা আছে ৬২ শতাংশ, আর উন্নয়ন ব্যয় ধরা আছে ৩২ শতাংশ। সমিতি মনে করে, প্রকৃতপক্ষে এর আমূল পরিবর্তন করে পরিচালন ব্যয় হওয়া উচিত ৩৪ শতাংশ, আর উন্নয়ন ব্যয় হওয়া উচিত ৬৬ শতাংশ।
অর্থনীতি সমিতির প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে প্রায় সবার মনে যে প্রশ্নটির উদয় হবে, তা হলো-এত টাকা আহরণের বাস্তবতা কতখানি? কিংবা যে পরিমাণ রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে, তা কোন মানদণ্ড বিচার করে? এ রকম প্রশ্নের মুখোমুখি অর্থনীতি সমিতি বিগত বছরগুলোয়ও হয়েছে। প্রকৃত সত্য হলো, অর্থনীতি সমিতি আয়ের উৎস দেখাতে পারে, কিন্তু সেই উৎস থেকে অর্থ আহরণের উপায়টি রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। সমিতি মনে করে, বর্তমান কর-কাঠামোর আওতায় যে পরিমাণ কর আদায় করা হয়, তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে কালোটাকা ও অর্থ পাচার উদ্ধারের অংশ, সম্পদ কর ও অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর। সরকারের নৈতিক প্রতিশ্রুতি ও সদিচ্ছা থাকলে কতটা আয় করা সম্ভব, তার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কালোটাকার কথাই ধরা যাক। গত বছরে অবৈধ কালোটাকা সৃষ্টি হয়েছে আনুমানিক ৮ লাখ কোটি টাকা। আর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত ৪৮ বছরে কালোটাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৯ লাখ কোটি টাকা। অর্থনীতি সমিতি এ টাকা উদ্ধারে সরকারের ভূমিকা দেখতে চায়। কোনো সরকার যদি দুর্বল ও আপসকামী হয়ে মাত্র ২০ শতাংশ টাকাও উদ্ধার করতে পারে, তাহলেও এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা। একইভাবে আমাদের দেশে সম্পদ করের আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। অর্থনীতি সমিতি মনে করে, সম্পদ কর থেকে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর বসিয়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব। এর সঙ্গে যোগ হবে সরকার প্রাক্কলিত ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং একটি আপসকামী ও দুর্বল চিত্তের সরকার হলেও প্রায় ২৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন সম্ভব। এর বিপরীতে বর্তমান সরকার তো নিজেকে অত্যন্ত সবল ও আপসহীন বলে প্রচার করে। তাহলে তা সম্ভব হচ্ছে না কেন? সুতরাং সমিতির প্রস্তাবনাকে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো সরকার জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে উপেক্ষা করে, এর দায় তো অর্থনীতি সমিতি নেবে না।
আমাদের মধ্যে দ্বৈত-প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। আমরা গতানুগতিক কোনো প্রক্রিয়া বা কর্মে বিরক্ত হই বটে, কিন্তু নতুন কোনো পথ খোঁজার আগ্রহ দেখাই না, আগ্রহ থাকলেও পুরোনোর ভিত্তিমূলে আঘাত করার সাহস রাখি না, এমনকি কোনো আমূল পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেও অভ্যস্ত নই। যে কারণে বিগত ৫০ বছরের গতানুগতিক বাজেটের বাইরে আমরা যাওয়ার চিন্তাও করতে পারছি না। আমাদের পূর্ব প্রজন্ম রক্তের বিনিময়ে নতুন স্বাধীন দেশ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু আমরা সমাজে বিদ্যমান অনিয়ম সামান্য দূর করার সাহস ও ক্ষমতা রাখি না। এটাই আসলে বাস্তবতা। গতানুগতিক বাজেটে তিনটি পর্ব থাকে : প্রথম পর্বে বাজেট প্রণয়ন (স্ক্রিপ্ট রচনা পর্ব); দ্বিতীয় পর্বটি সংসদে উত্থাপন (মঞ্চায়ন পর্ব) এবং তৃতীয় পর্বটি অনুমোদন দিয়ে চূড়ান্তকরণ (প্রাক ভোগ-দুর্ভোগ পর্ব)। এর বাইরে আমরা যেতে পারিনি।
কিন্তু অর্থনীতি সমিতি মনে করে, এর বাইরে আমাদের যেতে হবে। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির ও তা রক্ষার মূল উৎসে যেতে হবে। তাই সমিতি মনে করে, যেহেতু ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান মতে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ [অনুচ্ছেদ ৭ (১)]; যেহেতু ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’ (অনুচ্ছেদ ১১) এবং যেহেতু বৈষম্য-সম্পদবৈষম্য, আয়বৈষম্য, স্বাস্থ্যবৈষম্য, শিক্ষাবৈষম্য, আবাসনবৈষম্য ক্রমবর্ধমান; সেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাজেট হতে হবে বৈষম্য নিরসন-উদ্দিষ্ট জনগণতান্ত্রিক বাজেট। এ নিয়ে কোনো ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয়-সন্দেহ হবে অসাংবিধানিক।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
প্রস্তাবিত বাজেট ও ‘বিকল্প বাজেট’
মুঈদ রহমান
০৪ জুন ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতিবছরের মতো এবারও আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট মহান সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে। মাসব্যাপী আলোচনার পর কিছুটা সংযোজন-বিয়োজনের পর তা চলতি মাসের শেষের দিকে সংসদে অনুমোদিত হবে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১ জুন বাজেটটি প্রস্তাবাকারে সংসদে উপস্থাপন করেন। এবার বাজেটের মূল দর্শন হিসাবে বলা হয়েছে-‘২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এ বাজেট সরকারি হিসাবে জিডিপির ১৫ শতাংশ। এ অর্থের জোগান আসবে কোথা থেকে? সরকারের হিসাব মতে, মোট রাজস্ব আয় হবে ৫ লাখ কোটি টাকা, যার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আহরিত হবে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে আয় হবে ৭০ হাজার কোটি টাকা। আয়-ব্যয়ের হিসাবে দেখা যায়, বাজেটে ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি পূরণ করার উপায় কী? প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। বাদবাকি ঋণ অভ্যন্তরীণভাবে নেওয়া হবে, যার মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন খাতের বরাদ্দ নিয়ে এরই মধ্যে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। আমি তার পুনরাবৃত্তি করতে চাইছি না। সব মিলিয়ে যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে তা হলো, এটি একটি গতানুগতিক বাজেট। এর মধ্যে আশান্বিত হওয়ার মতো কিছু নেই। বাজেটের বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়াও গতানুগতিক এবং পূর্বপ্রস্তুতকৃত। সরকারি দল বলছে, ‘এ বাজেট গণমুখী’, বিরোধী দল বলছে, ‘এ বাজেট গণবিরোধী’। তাই বাজেট প্রস্তাবনায় যেমন নতুন কিছু নেই, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়ায়ও নতুন কিছু নেই।
এ কথা ঠিক যে, বার্ষিক বাজেটের সঙ্গে সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির সম্পর্ক থাকে। তবে বার্ষিক বাজেটের প্রধান লক্ষ্য থাকে চলমান সংকট মোকাবিলা ও তা নিরসন করা। যে সময় আসন্ন অর্থবছরের বাজেটটি উপস্থাপিত হয়েছে, সেসময়ে অর্থনীতিতে নানা রকমের সংকট চলছে। দ্রব্যমূল্য আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, ডলার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে, কালোটাকার পাহাড় জমে গেছে, অর্থ পাচার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না, ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্যে লাগাম টানা যাচ্ছে না, আয়বৈষম্যে ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি। এসব সমস্যা-সংকট সামনে রেখে যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, তা দিয়ে কোনো কার্যকর ফল আসবে না।
আজকের লেখাটি প্রস্তাবিত বাজেটের দুর্বল দিকগুলো আলোচনার উদ্দেশ্যে নয়। বরং একটি বাজেট প্রণয়নে যে দার্শনিক ভিত্তি থাকে, এর অভাবটি তুলে ধরতে চাই। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি কর্তৃক প্রস্তাবিত ‘বিকল্প বাজেট’কে তুলনায় আনতে চাই। সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের দর্শন ভিত্তি হলো প্রচলিত সামাজিক অবস্থাকে বহাল রেখে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা। যে কারণে বাজেটের সুবিধাভোগ করবে ধনিক ও বিত্তশালী শ্রেণি, যারা শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। এবং গত ৫০ বছর ধরে তা-ই হয়ে আসছে। সাধারণ জনগোষ্ঠীর কথা কোনো বাজেটেই ভাবা হয়নি, যদিও বলা হয়েছে এবং তা বলা পর্যন্তই শেষ। দিনকে দিন বৈষম্যের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এদিক থেকে অর্থনীতি সমিতির দর্শনটি অনেকখানি জনমুখী।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি গত ২০১৫ সাল থেকে ‘বিকল্প বাজেট’ উপস্থাপন করে আসছে। এবারও ২৫ মে সমিতি তার বিকল্প বাজেট উপস্থাপন করেছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাজেট ঘোষণার অনুষ্ঠানটিতে অনলাইনে যুক্ত ছিল ৬৪ জেলা, ১৩৫ উপজেলা এবং ৪৫ ইউনিয়ন। ‘বিকল্প বাজেট’ উপস্থাপন করেন সমিতির সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে-বৈষম্য নিরসনে জনগণতান্ত্রিক বাজেট। বিকল্প বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ২০ লাখ ৯৪ হাজার ১১২ কোটি টাকা, যা সরকারি হিসাবের জিডিপির ৫২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। চলমান সরকারি বাজেটের তুলনায় সমিতির বাজেটের আকার ৩ গুণেরও বেশি বড় এবং ১ জুন সংসদে উপস্থাপিত আসন্ন অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ২ দশমিক ৭৫ গুণ বড়। বিকল্প বাজেটের এ প্রায় ২১ লাখ কোটি টাকা আসবে কোথা থেকে? সমিতি মনে করে, রাজস্ব আয় থেকে ১৯ লাখ ২৯ হাজার ১১২ কোটি টাকা আহরণ করা সম্ভব, যা কিনা মোট বরাদ্দের ৯২ দশমিক ১৩ শতাংশ। বাজেটের বাদবাকি ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশের (অর্থাৎ ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতির) জোগান আসবে যথাক্রমে সম্মিলিত বন্ড বাজার থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে বিক্রি বাবদ ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারত্ব থেকে আসবে ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতি সমিতি মনে করে, ঘাটতি পূরণের জন্য বৈদেশিক ঋণের দ্বারস্থ হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, অভ্যন্তরীণভাবেই তা পূরণ করা সম্ভব। বৈদেশিক ঋণের বিষয়ে অর্থনীতি সমিতির অবস্থান খুব স্পষ্ট। তাদের বক্তব্য হলো, আমরা নীতিগতভাবেই ঋণ করে ঘি খাওয়ার বিপক্ষে (এর মধ্যে কোনো জাতীয়তাবাদ নেই, নেই মানবসত্তার মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা)। আমরা জানি, সাম্রাজ্যবাদী আর্থিকীকরণকৃত রেন্টসিকিং লুটেরা পুঁজির ঋণ যে কোনো দেশে তাদেরই অধীনস্থ লুটেরা শ্রেণির শাসনব্যবস্থা জোরদারে সহায়ক হতে বাধ্য। বরাদ্দের ক্ষেত্রে কাঠামোগত ও নীতিগত পরিবর্তন চায় সমিতি। আমাদের সরকারি চলতি বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা আছে ৬২ শতাংশ, আর উন্নয়ন ব্যয় ধরা আছে ৩২ শতাংশ। সমিতি মনে করে, প্রকৃতপক্ষে এর আমূল পরিবর্তন করে পরিচালন ব্যয় হওয়া উচিত ৩৪ শতাংশ, আর উন্নয়ন ব্যয় হওয়া উচিত ৬৬ শতাংশ।
অর্থনীতি সমিতির প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে প্রায় সবার মনে যে প্রশ্নটির উদয় হবে, তা হলো-এত টাকা আহরণের বাস্তবতা কতখানি? কিংবা যে পরিমাণ রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে, তা কোন মানদণ্ড বিচার করে? এ রকম প্রশ্নের মুখোমুখি অর্থনীতি সমিতি বিগত বছরগুলোয়ও হয়েছে। প্রকৃত সত্য হলো, অর্থনীতি সমিতি আয়ের উৎস দেখাতে পারে, কিন্তু সেই উৎস থেকে অর্থ আহরণের উপায়টি রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। সমিতি মনে করে, বর্তমান কর-কাঠামোর আওতায় যে পরিমাণ কর আদায় করা হয়, তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে কালোটাকা ও অর্থ পাচার উদ্ধারের অংশ, সম্পদ কর ও অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর। সরকারের নৈতিক প্রতিশ্রুতি ও সদিচ্ছা থাকলে কতটা আয় করা সম্ভব, তার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কালোটাকার কথাই ধরা যাক। গত বছরে অবৈধ কালোটাকা সৃষ্টি হয়েছে আনুমানিক ৮ লাখ কোটি টাকা। আর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত ৪৮ বছরে কালোটাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৯ লাখ কোটি টাকা। অর্থনীতি সমিতি এ টাকা উদ্ধারে সরকারের ভূমিকা দেখতে চায়। কোনো সরকার যদি দুর্বল ও আপসকামী হয়ে মাত্র ২০ শতাংশ টাকাও উদ্ধার করতে পারে, তাহলেও এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা। একইভাবে আমাদের দেশে সম্পদ করের আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। অর্থনীতি সমিতি মনে করে, সম্পদ কর থেকে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর বসিয়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব। এর সঙ্গে যোগ হবে সরকার প্রাক্কলিত ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং একটি আপসকামী ও দুর্বল চিত্তের সরকার হলেও প্রায় ২৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন সম্ভব। এর বিপরীতে বর্তমান সরকার তো নিজেকে অত্যন্ত সবল ও আপসহীন বলে প্রচার করে। তাহলে তা সম্ভব হচ্ছে না কেন? সুতরাং সমিতির প্রস্তাবনাকে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো সরকার জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে উপেক্ষা করে, এর দায় তো অর্থনীতি সমিতি নেবে না।
আমাদের মধ্যে দ্বৈত-প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। আমরা গতানুগতিক কোনো প্রক্রিয়া বা কর্মে বিরক্ত হই বটে, কিন্তু নতুন কোনো পথ খোঁজার আগ্রহ দেখাই না, আগ্রহ থাকলেও পুরোনোর ভিত্তিমূলে আঘাত করার সাহস রাখি না, এমনকি কোনো আমূল পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেও অভ্যস্ত নই। যে কারণে বিগত ৫০ বছরের গতানুগতিক বাজেটের বাইরে আমরা যাওয়ার চিন্তাও করতে পারছি না। আমাদের পূর্ব প্রজন্ম রক্তের বিনিময়ে নতুন স্বাধীন দেশ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু আমরা সমাজে বিদ্যমান অনিয়ম সামান্য দূর করার সাহস ও ক্ষমতা রাখি না। এটাই আসলে বাস্তবতা। গতানুগতিক বাজেটে তিনটি পর্ব থাকে : প্রথম পর্বে বাজেট প্রণয়ন (স্ক্রিপ্ট রচনা পর্ব); দ্বিতীয় পর্বটি সংসদে উত্থাপন (মঞ্চায়ন পর্ব) এবং তৃতীয় পর্বটি অনুমোদন দিয়ে চূড়ান্তকরণ (প্রাক ভোগ-দুর্ভোগ পর্ব)। এর বাইরে আমরা যেতে পারিনি।
কিন্তু অর্থনীতি সমিতি মনে করে, এর বাইরে আমাদের যেতে হবে। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির ও তা রক্ষার মূল উৎসে যেতে হবে। তাই সমিতি মনে করে, যেহেতু ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান মতে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ [অনুচ্ছেদ ৭ (১)]; যেহেতু ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’ (অনুচ্ছেদ ১১) এবং যেহেতু বৈষম্য-সম্পদবৈষম্য, আয়বৈষম্য, স্বাস্থ্যবৈষম্য, শিক্ষাবৈষম্য, আবাসনবৈষম্য ক্রমবর্ধমান; সেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাজেট হতে হবে বৈষম্য নিরসন-উদ্দিষ্ট জনগণতান্ত্রিক বাজেট। এ নিয়ে কোনো ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয়-সন্দেহ হবে অসাংবিধানিক।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023