বিদ্যুৎ খাতে ভুল নীতিই এখন ভোগাচ্ছে

 মুঈদ রহমান 
১১ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

সরকার পরিচালনায় টানা ১৫ বছরের শেষ পর্যায়ে আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সবকিছু অনুকূলে থাকলে এ বছরের শেষ নাগাদ কিংবা আগামী বছরের প্রথমদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

সাধারণত দেখা যায়, নির্বাচনের বছর এলে সরকারি ও বিরোধী দল উভয়েই অনেকটা কৌঁসুলি হওয়ার চেষ্টা করে। বিরোধী দল তৎপর থাকে সরকারি দলের অজনপ্রিয় কর্মকাণ্ডের খতিয়ান জনসমক্ষে তুলে ধরতে এবং সরকারি দলের চেষ্টা থাকে জনদুর্ভোগ প্রশমিত করার। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের এবং চলমান ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে দুই দলেরই কোনো জোরালো ভূমিকা নেই।

নির্বাচনে যে জনগণের ভূমিকাই প্রধান থাকে, তা বোধকরি আজকের সময়টাতে সঠিক বলে ভাবতে পারছি না। কারণ উভয় দলই বাংলাদেশের জনগণের বাইরে অন্য কোনো শক্তিকে সন্তুষ্ট করতে তৎপর। অতএব আমাদের ভোগান্তির শেষ কোথায়, তা বলা মুশকিল।

বর্তমান সময়ে দেশে চরম বিদ্যুৎ সংকট চলছে। শহরাঞ্চলে প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা এবং গ্রামাঞ্চলে গড়ে ১৪ ঘণ্টা করে লোডশেডিং চলছে। এর সঙ্গে তীব্র দাবদাহ পরিস্থিতিকে অনেক বেশি নাজুক করে ফেলেছে। কিন্তু সরকারি মহলের আত্মতুষ্টির যে প্রকাশ আমরা গত কয়েক বছর ধরে দেখে এসেছি, তাতে আমাদের এমন সংকটে নিমজ্জিত হওয়ার কথা নয়। বলা হচ্ছে, আমাদের পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি নয়। এর বিপরীতে ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সক্ষমতা আমাদের আছে। সরকারের পক্ষ থেকে এমন প্রচারণায় আমরা অনেকখানি অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম। কিন্তু এত বড় বিপর্যয়ে নাকাল হওয়ার পর সরকারি প্রচারণার প্রতি সংশয় জাগাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। যে সক্ষমতা আমাদের কাজে আসে না, তাকে সক্ষমতা বলে বাহাদুরি করার কোনো অর্থ হয় না।

বিদ্যুৎ খাতে সংকটের শুরুটা বেশ আগেই। তবে এ সময়ে তা চরমে পৌঁছেছে। আজ থেকে দেড় দশক আগে বাংলাদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল মাত্র ২৭টি। এ ২৭টি কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি ছিল না। ২০২৩ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৩টিতে। এর মধ্যে ১০টি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাদবাকি ১৪৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রায় ৩৬ শতাংশই এখন জ্বালানি সংকটে ভুগছে। জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) গত ৫ জুনের দেওয়া তথ্যমতে, ১৪৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ৬৪টি ব্যবহার করে গ্যাস; এর মধ্যে জ্বালানি সংকটে আছে ১৭টি কেন্দ্র। ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে ৬৫টি কেন্দ্র, যার মধ্যে ২৫টি এখন জ্বালানি সংকটে ভুগছে। ডিজেল দিয়ে উৎপাদন করা হয় ৮টি কেন্দ্রে, যার ৪টি জ্বালানি সংকটে আছে। কয়লাভিত্তিক ৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪টিতেই প্রকট জ্বালানি সংকট। মাত্র একটি কেন্দ্র পানিনির্ভর, সেটিও পড়েছে জ্বালানি সংকটে। যেসব কেন্দ্র জ্বালানি ও কারিগরি সংকটে ভুগছে, তাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৯ হাজার মেগাওয়াট। সংকটের কারণে এসব কেন্দ্র মাত্র সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে।

গড়ে প্রতি ঘণ্টায় সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। দিন-রাতে কোনো তফাত করা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে সমালোচনার জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী জাতীয় সংসদে সাধারণ মানুষকে ১৫-১৬ দিন ‘একটু ধৈর্য’ ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা না হয় একটু ধৈর্য ধরলাম, রাতে নাই বা ঘুমালাম। কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থায় কি ধৈর্য ধরার সুযোগ আছে? বিদ্যুৎ শুধু আবাসিক কাজেই ব্যবহৃত হয় না। মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের ৫৬ শতাংশ ব্যয় হয় আবাসিক খাতে, ২৯ শতাংশ শিল্প খাতে, প্রায় ৩ শতাংশ কৃষি খাতে এবং বাণিজ্য ও অন্যান্য খাতে প্রায় ১২ শতাংশ। চলতি বাজেট অধিবেশনে উপস্থাপিত বাজেটে আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। উৎপাদন ব্যাহত হলে সেই মাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে কি? বিদ্যুতের ভয়াবহ অবস্থায় শিল্পোৎপাদন এরই মধ্যে সংকটে পড়েছে। দু-একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ জানায়, জেলায় প্রায় ২ হাজারের মতো শিল্প-কারখানা থাকলেও এসব কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ৬৫০ মেগাওয়াট, পাওয়া যাচ্ছে অর্ধেকেরও কম। ভালুকা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ছোট-বড় মিলে ২০০টির বেশি কারখানা রয়েছে, যার মধ্যে ৩০টি ডাইং ফ্যাক্টরি। লোডশেডিং ও গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন কমে গেছে ৭০ শতাংশ। সিরাজগঞ্জ জেলার ৯ উপজেলায় তাঁতের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। এর মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ তাঁত বিদ্যুৎচালিত। লোডশেডিংয়ের কারণে একদিকে মালিকরা লোকসান গুনছেন, অন্যদিকে মজুরি কমে যাওয়ায় আর্থিক কষ্টে ভুগছেন শ্রমিকরা। সিরামিক শিল্প পড়েছে মহাসংকটে। কারণ, সিরামিক তৈরিতে একটি চুল্লির তাপমাত্রা নির্দিষ্ট পর্যায়ে নিতে ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগে। লোডশেডিংয়ের কারণে সেই মাত্রায় যাওয়াই যাচ্ছে না। তৈরি পোশাকও আক্রান্ত। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমই) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ব্র্যান্ড ক্রেতারা পোশাকের দরে এক সেন্টকেও গুরুত্ব দেন। অন্য কোথাও কম দাম পেলে রপ্তানি আদেশ সরিয়ে নিতে বিন্দুমাত্র ভাববেন না।’ সুতরাং, সমস্যাটা কেবল স্বাভাবিক জীবনের নয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেরও।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, জ্বালানি খাতে বড় আকারের বকেয়া পড়েছে, যে কারণে সরবরাহে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কয়লায় বাকি পড়েছে ২০ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা; এলএনজি আমদানির শুল্ক-কর বাবদ বকেয়া পড়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি আরও বকেয়ার কথা বলছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তাদের মতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২৭ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল পাবে, যার মধ্যে বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলো পাবে ২০ হাজার কোটি টাকা। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ তো পয়সা দিয়েই বিদ্যুৎ কিনে থাকে। বিল বকেয়া থাকলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করে না কর্তৃপক্ষ। তাহলে কাদের জন্য এ আর্থিক অনটন? অপরিকল্পিতভাবে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। চুক্তি মোতাবেক এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্র-মালিকদের। শুধু কেন্দ্র ভাড়ার ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যয় করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং গত তিন বছরে কোনোরকম বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ৫৮ হাজার কোটি টাকা। জনগণের এ বিশাল অঙ্কের টাকা গুটিকয় মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার অধিকার কোনো সরকার রাখে কি? এ রকম প্রশ্ন আজ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

সরকার ২০১০ ও ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ খাতের জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ মহাপরিকল্পনার পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। যদি এ মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে আমদানি ব্যয় মেটাতে হবে বছরে কমপক্ষে ১২০০ কোটি ডলার। যদি ডলারের দাম বৃদ্ধি পায়, তাহলে এর আকার আরও বড় হবে। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য বলছে, জ্বালানিতে আমদানি ব্যয় বেড়েছে অনেক। শুধু পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য আমদানিতে গত ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩৬৭ কোটি ডলার। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে একই সময়ে খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩৬ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেশি। এ বাড়তি ব্যয় বাংলাদেশ ব্যাংককে বিপদে ফেলেছে।

বিশেষজ্ঞরা এ সংকটের জন্য অতিমাত্রায় আমদানিনির্ভরতাকে দায়ী করছেন। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিমের ভাষ্য হলো, ‘আমদানিনির্ভরতাই ভোগাচ্ছে। আমদানিনির্ভর হলে সাধারণত দুই ধরনের সংকট দেখা দেয়। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া বা পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি। এখন বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কম এবং সরবরাহ আছে। অথচ কেনার জন্য ডলার নেই সরকারের হাতে। এটি একটি ভিন্ন পরিস্থিতি। আর শুধু জ্বালানি নয়, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এখন সব খাতেই।’

সবশেষে বলতে চাই, বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমরা তিনটি উপাদান-উপকরণ বেশি ব্যবহার করি, সেগুলো হলো-গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল। এসব উপাদান-উপকরণের বেশিরভাগই আমাদের আমদানি করতে হয়। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে পরিমাণ জ্বালানি চাহিদা রয়েছে, তার আমদানি ব্যয় বাবদ বছরে খরচ করতে হয় প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। আমরা আলোচনায় দেখেছি যে, বর্তমানে সরকার এ পরিমাণ ডলার ব্যয় করতে গিয়ে পেরে উঠছে না। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৭ সাল নাগাদ দেশের নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সবই প্রস্তুত হয়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বাড়তি উৎপাদন যদি বর্তমানের সঙ্গে যোগ হয়, তাহলে ২০২৭ সাল নাগাদ জ্বালানি আমদানি বাবদ ব্যয় করতে হবে বছরে আজকের ডলার মূল্যে আনুমানিক ১২ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং, প্রত্যাশা ও পরিকল্পনার সঙ্গে আর্থিক সংগতির সামঞ্জস্যের কথা ভাবা হয়েছে কি?

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন