Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

প্রকৃত গণতন্ত্র আসতে পারে যেভাবে

Icon

গোলাম শফিক

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রকৃত গণতন্ত্র আসতে পারে যেভাবে

রাজতন্ত্রে রাজার উত্তরাধিকারী ছেলে বা মেয়ে রাজা হয়। সিংহাসনে আরোহণ করলে জ্যেষ্ঠ রাজ-তনয়াকে ‘রানী’ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে মনে করা হয় রাজা। রাজদণ্ড যার হাতে থাকে, তিনি হয়ে যান শৌর্যবীর্য ও পৌরুষের প্রতীক। এ সংস্কৃতিতে বংশই প্রধান বিষয়। রাজার বংশ মানেই কৌলীন্যের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। না হলে সম্রাট আকবর ১৪ বছর বয়সে সম্রাট হতেন না, যাকে সম্রাট হতে সহায়তা করেছিলেন উজির বৈরাম খাঁ।

এশিয়ার বিপ্লবের সূতিকাগার চীনের তথ্যটি পিলে চমকে দেওয়ার মতো। সেখানকার শেষ সম্রাট পুয়ি রাজা হয়েছিলেন দুই বছর বয়সে (১৯০৮ সালে); কারণ, সে ছিল রাজার ছেলে। কিন্তু এশিয়ার বিপ্লব যে উত্তরাধিকারের রাজনীতি বা নয়া রাজতন্ত্র ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে তা নয়। উত্তর কোরিয়াতেও বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। রাষ্ট্রটি ক্রমান্বয়ে এক সন্ন্যাসী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সেখানে কিম ইল সুং-এর তৃতীয় প্রজন্মের রাজত্ব চলছে এখন। বর্তমান শাসক কিম জং উন-এর পিতা কিম জং ইলও উত্তর কোরিয়ার ‘রাজা’ ছিলেন পার্টি সচিব পদবির আড়ালে। তাকে বলা হতো প্রথম ‘সুপ্রিম লিডার’। উত্তর কোরিয়ার রাজনীতিতে এ সুপ্রিমেসি এখনো অব্যাহত আছে। সুপ্রিম লিডারের পুত্র উন ৩০ বছর বয়সে পার্টিপ্রধান হয়ে বাদশাহ আকবরের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। এখন তার মৃত্যু হলে হামেশাই তার সঙ্গে কিম জু-এ নামের যে কন্যাটিকে হাঁটতে দেখা যায়, সে-ই হবে উত্তর কোরিয়ার ‘রাজা’। কারণ, রাজতন্ত্রে (!) সবই সম্ভব। এটি সম্ভব হয় পরিবারের বাইরে কাউকে বিশ্বাস না করার কারণে এবং ভোগের অভিপ্রায় থেকে। তাছাড়া অতীত কৃতকর্মের বিচারের ভয় তো থেকেই যায়। উত্তরাধিকারের রাজতন্ত্রে রাজ-পরিবারবহির্ভূত কাউকে শত যোগ্যতার পরও রাজা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিধান বা সংস্কৃতি আগেও ছিল না, আজও নেই। ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা রাজ-পরিবারে সীমাবদ্ধ।

এ রকমই অলিখিত রাজতন্ত্রের ছায়া দেখা যায় এশিয়ায়, বিশেষত উপমহাদেশে। সার্কভুক্ত ৮টি স্বাধীন দেশের মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান রাজতন্ত্রমুক্ত। ভুটান ও নেপালে বিদ্যমান ছিল প্রকৃত রাজতন্ত্র। এর বাইরে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা-এ চারটি দেশে গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকলেও রাজনৈতিক আচার-আচরণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অভ্যাস, চর্চা ও মনস্তত্ত্ব রাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। পপুলিজম বা জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির উর্বরভূমি এসব দেশে স্বজনের লাশ কাঁধে নিয়ে সহজেই জনপ্রিয়তা ও সহানুভূতি অর্জন সম্ভব হয়। রাজনীতিতে এ প্রবণতা প্রকৃত সম্ভাবনাময় নেতৃত্বকে প্রস্ফুটিত হতে দেয় না। এভাবে জাতিসমূহ নতুন নতুন, ভিন্নমাত্রিক, মেধাবী ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।

ভারতের উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে এক নম্বর স্থানটি দখল করে আছে কংগ্রেস। দলটির ছয় নেতার মধ্যে তিনজন প্রধানমন্ত্রীই ছিলেন নেহরু পরিবারের সদস্য-জওহর লাল নেহরু, তদীয় কন্যা ইন্দিরা গান্ধী ও দৌহিত্র রাজীব গান্ধী। এ পরিবার দেশ শাসন করেছে ৩৯ বছর। তবে মতিলাল নেহরু থেকে রাহুল গান্ধী ও তদীয় মাতা সোনিয়া গান্ধীর রাজনীতিতে সচল থাকার সময় যুক্ত করলে তাদের সংশ্লিষ্টতার প্রকৃত পরিধি আরও বিস্তৃত।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভুট্টো পরিবারের আধিপত্য দীর্ঘদিন অব্যাহত ছিল। জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুর পর তার কন্যা বেনজীর ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর স্বামী আসিফ আলী জারদারি হয়েছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। এখন তাদের পুত্র বিলাওয়াল ভুট্টো দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বেনজীরের শাসনামলে তার মাতা নুসরাত ভুট্টোকে উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। এ পদের জন্য মা ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করা যায়নি। বেনজীরের ভ্রাতা গোলাম মর্তুজা ভুট্টোও পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।

শ্রীলংকার ৪র্থ প্রধানমন্ত্রী সোলোমন বন্দরনায়েকের মৃত্যুর পর তার কন্যা চন্দ্রিকা বন্দরনায়েক কুমারাতুঙ্গা হয়েছিলেন দেশটির ৫ম রাষ্ট্রপতি ও ১১তম প্রধানমন্ত্রী। চন্দ্রিকার শাসনামলে (রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন) বন্দরনায়েক পরিবারের শ্রীমাভো বন্দরনায়েক প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন। চন্দ্রিকারই অধীনে মাহিন্দো রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর উত্তরাধিকারের রাজনীতির মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে শ্রীলংকাকে বানানো হয়েছিল দুর্নীতির আখড়া ও দেউলিয়ানার রাজত্ব, সে সংক্রান্ত বিতর্ক এখনো অব্যাহত আছে। তবে তার মতো এত পদ এ দেশের শেরেবাংলাও অলংকৃত করতে পারেননি। ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট, ত্রয়োদশ প্রধানমন্ত্রী, দ্বাদশ বিরোধীদলীয় প্রধান, অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী, হাইওয়েজ, ক্রীড়া ও নৌমন্ত্রী, আইন ও শৃঙ্খলা মন্ত্রী, মৎস্য ও জলজসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী, শ্রম ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ মন্ত্রী-কী ছিলেন না তিনি? তার ভাই চমল রাজাপাকসে হয়েছিলেন পার্লামেন্টের স্পিকার, অন্য দুভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে রাষ্ট্রপতি ও বাসিল রাজাপাকসে অর্থমন্ত্রী। এজন্য শ্রীলংকার একটি জনপ্রিয় কৌতুক হচ্ছে ‘রাজাপাকসে কি তোমাদের দেশের মানুষের একমাত্র শেষ নাম?’

শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ষষ্ঠবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাকে ছাড়া শ্রীলংকা প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য আর কাউকে খুঁজে পায়নি। তিনিও এক উত্তরাধিকারের লেজুড়, ইতঃপূর্বে এক দশকেরও বেশি সময় রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকা জুনিস জয়বর্ধনের তিনি ভাইপো। যে উত্তরাধিকারীদের দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে শ্রীলংকা নামের সচ্ছল একটি দেশ হয়েছে সর্বস্বান্ত, সেখানে রনিলকেই তাদের জাতীয় সংসদ রাষ্ট্রপতি হিসাবে বেছে নিল। গণ-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে এমনই হয়। আর রনিল সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বেছে নিলেন ছেলেবেলার বন্ধু দীনেশ গুণবর্ধনকে। শ্রীলংকার ক্ষেত্রেই বোধহয় জিওভানি জেনটাইল (ইতালীয় দার্শনিক ও ফ্যাসিবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক স্থপতি) প্রদত্ত ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞাটি প্রযোজ্য, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সবকিছুকে লাকড়ির মতো বান্ডিল বানিয়ে প্যাঁচিয়ে কুড়ালের নিচে রেখে দেওয়া। অথচ শ্রীলংকায় জরুরি অবস্থা জারি করে বিক্রমাসিংহে বিক্ষোভকারীদের ‘ফ্যাসিবাদী’ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন।

বাংলাদেশে উত্তরাধিকারের রাজনৈতিক প্রবণতা পুরো মাত্রায় বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তার কন্যা শেখ হাসিনা সংকটময় মুহূর্তে দলীয়প্রধানের পদ গ্রহণ করে পরবর্তীকালে হন প্রধানমন্ত্রী। ক্রমান্বয়ে তার মেয়াদকাল প্রলম্বিত হয়েছে এবং শেখ পরিবারের অনেকেই দলীয় ও সরকারি পদ লাভে সক্ষম হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলে তার স্ত্রী খালেদা জিয়া হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, যার কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাই ছিল না, বলা হয়ে থাকে তিনি ছিলেন রসুইঘরের মানুষ। তদীয় পুত্র তারেক রহমানকে যখন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচন করা হয়, তখন তিনি দলের ‘সিনিয়র’ কেউ ছিলেন না। কিন্তু যেহেতু উত্তরাধিকারের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা হবে, তাই তাকে আগেভাগেই টেনে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যার যৌক্তিক অনুক্রমে তিনি এখন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। কোনো পদবির আগে ‘সিনিয়র’ শব্দটি কখন জুড়ে দেওয়া হয়? যখন সেই ব্যক্তিটি প্রকৃতপক্ষেই দেশের একজন অভিজ্ঞ ও সিনিয়র সিটিজেন, যেমন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদায় ‘সিনিয়র মন্ত্রী’র পদ দান করেছিলেন, যখন যাদু মিয়ার বয়স ছিল ৫৪ বছর। তারেক রহমানের পদবির সঙ্গে ‘সিনিয়র’ তকমা জুড়ে দেওয়া হয়েছিল তার ৩৪ বছর বয়সকালে।

বাংলাদেশে এক দল কর্তৃক আরেক দলকে ‘স্বৈরাচারী’, ‘স্বেচ্ছাচারী’, ‘কর্তৃত্ববাদী’, ‘ফ্যাসিবাদী’, ‘একনায়কতান্ত্রিক’ বলার সুযোগটি তৈরি হয়ে যায় বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে। আর বেশিদিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগটি তৈরি হয় রাজতন্ত্রের খোলসে গণতন্ত্রের অধীনেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে সাধারণত দলীয় প্রধানরাই হন সরকারপ্রধান। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সরকারপ্রধান নির্বাচন করা হয় অনেক ভেবেচিন্তে। রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় সক্ষম সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ব্যক্তিদের মনোনীত করে প্রত্যক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমেরিকায় ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির বর্তমান প্রধান (চেয়ারম্যান) জেইম হেরিসন এবং ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান (চেয়ারম্যান) গ্রেগ হ্যান্ডস। যে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের একসময় আমরা অংশ ছিলাম, সেই ভারতেও ট্রেন্ড পরিবর্তনের কারণে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপির প্রধান (সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডা) রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে আছেন। এ ধরনের চর্চার জন্য তারা কি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছেন? তারা মনে করেন, দলের হাল ধরে রাখা দলীয়প্রধানকে প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ/নির্বাচন করা হলে দলকে সময় দেবে কে, যে দল টিকে না থাকলে রাজনীতিই টিকবে না? উন্নত ও টেকসই গণতন্ত্রের দেশসমূহে এ ধরনের রাজনৈতিক শ্রমবিভাজনের বিষয়টি খুবই পরিষ্কার। এতে ক্ষমতার ভারসাম্যও রক্ষিত হয়, কাউকে আর ফ্যাসিবাদী কিংবা স্বৈরতন্ত্রীতে পরিণত হতে হয় না।

বিরোধী দল হিসাবে বিএনপি কর্তৃক একটি ৩১ দফা সংস্কারের প্রস্তাব ঘোষণা করা হয়েছিল, যার কোথাও হেরিডিটারি পলিটিক্স নিরুৎসাহিত করা হবে, এ ধরনের কোনো ইশারা-ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তাহলে মুক্ত গণতন্ত্রের ততধিক মুক্ত বাতাস আর কীভাবে বইবে? তাদের একটি প্রস্তাবে আছে-পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। প্রশ্ন হলো, যারা ইতোমধ্যেই তিন/চার টার্ম দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে সংস্কারের এ ধারাটি কীভাবে প্রয়োগ করা হবে? যদি সত্যি সত্যিই সংস্কারের এ প্রস্তাবটি অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধান সংশোধিত হয়, তবে বিষয়টি নির্দিষ্ট করা না থাকলে কারও কারও ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনে টার্মের সংখ্যা হয়ে যেতে পারে পাঁচ/ছয়।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব ঘোষিত একটি সংস্কার প্রস্তাবে আছে-আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, এমন বিষয় ছাড়া অন্য সব বিষয়ে সংসদ-সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিতের লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে। ভালো কথা। তবে দলটি এ বিষয়ে জাতিকে পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারত। কারণ, ৭০ অনুচ্ছেদ দীর্ঘ অনুভূত একটি ক্ষতচিহ্ন। অতীতে রাজা-বাদশারাও অমাত্য ও পারিষদবর্গকে মতপ্রকাশের সুযোগ দিতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে এ সুযোগ আদায় করে নিতে হচ্ছে।

প্রকৃত গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে এ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সূচনা থেকেই লক্ষ করা গিয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীদের এ ক্ষমতার কারণে সংসদীয় গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে যায় (অনুচ্ছেদ ৫৫-৫৬)। আর এজন্যই ‘সংসদীয় স্বৈরাচার’ এসব বিশেষণ বিরোধী দলগুলো আরোপ করার সুযোগ পায়, যেহেতু বাংলাদেশের পার্লামেন্ট প্রধানমন্ত্রীনির্ভর।

এদেশে প্রায়ই শোনা যায়-আর নেতা কোথায়, নেতা কোথায়? ধারণাটি সম্পূর্ণই ভ্রান্ত। দেশের বর্তমান শিক্ষিত জনগোষ্ঠীতে অগণন সম্ভাবনাময় নেতা প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজমান, যারা সুযোগের অভাবে তাদের মেধার অবদান রাখতে পারছেন না। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে সৎ-উদীয়মান বহু তরুণ রয়েছে, যারা স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ সভাপতির পদ অলংকৃত করে নিজেদের নেতৃত্ব-প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে জাতীয় ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম। কিন্তু এ দুটি রেজিমের অধীনস্থ দলীয় পরিচয়ধারীদেরই বারংবার এসব পদে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রকৃত গতিশীল ও কার্যকর নেতৃত্ব বিকাশের আকাঙ্ক্ষা চাপাই পড়ে থাকছে। আর রাজনীতি দুর্বৃত্তদের হাতে চলে যাওয়ায় অনেকেই রাজনীতি নামক ক্ষেত্রটিতে আসতে অনাগ্রহী। নেতৃত্বের অনেক ধরন আছে, গতানুগতিক নেতৃত্বের স্টাইলকে পরিহার করে যেগুলোর চর্চা হওয়া জরুরি। আমাদের দেশে উত্তরাধিকারের যে রাজনীতি প্রচলিত আছে সেটিও ছিল খুব একপেশে, এজন্য রাজনীতিতে মাহী বি. চৌধুরী ও সোহেল তাজের মতো ছেলেদের স্থান হয় না। তারাও ছিলেন যোগ্য ব্যক্তিদেরই সন্তান।

প্রত্যেককেই প্রজা বাৎসল্যের স্থলে নাগরিক বৎসল হওয়ার সুযোগ দেওয়া, দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, নেতৃত্বে শুদ্ধতা আনয়ন, বিবেকচালিত সমাজ গড়ে তোলা, ভৌত উন্নয়নের পাশাপাশি নৈতিক উন্নয়ন-এসবই একমাত্র নিশ্চিত করতে পারে প্রকৃত গণতন্ত্র, যেটির জন্য জনগণ এখনো জীবন দিচ্ছেন। জীবনের এ উৎসর্জন বন্ধ হোক।

গোলাম শফিক : প্রাবন্ধিক; অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম