নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

উগ্র বাজার অর্থনীতির কুফল ভোগ করছি আমরা

 ড. আর এম দেবনাথ 
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

আম গাছে কি জাম ধরে, অথবা জাম গাছে কি আম ফলে? এ প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা। আম গাছে জাম ধরার কোনো কারণ নেই। তাহলেই প্রশ্ন, বাজার অর্থনীতিতে (মার্কেট ইকোনমি) কি গরিবরা সুখে থাকে, বা থাকতে পারে? এর উত্তরও নেতিবাচক। ‘বাজার অর্থনীতি’ একটি গাছ, যাকে বলা যায় ‘মাদার’ গাছ। এ গাছে ফল ধরে না। এটা কাঁটাওয়ালা গাছ। কাঁটাওয়ালা গাছ থেকে ব্যথা পাওয়া ছাড়া গতি নেই। বাজার অর্থনীতি শত কোটি টাকার মালিকই তৈরি করবে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ যে নেই তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে একটি খবর।

খবরটিতে (১১.০৯.২৩) দেখা যাচ্ছে-আমাদের দেশে শত কোটি, হাজার কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কী প্রেক্ষাপটে বৃদ্ধি পাচ্ছে? স্বাভাবিক অর্থনৈতিক অবস্থায় নয়। প্রথমে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা পাক্কা দুই বছর পীড়িত ছিলাম। এরপর এখন চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সারা বিশ্বের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য তছনছ হয়ে গেছে। সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম হয়েছে আকাশচুম্বী। মূল্যস্ফীতি সরকারি হিসাবেই প্রায় ১০ শতাংশ। মানুষের কষ্টের সীমা নেই। শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ-ডিম, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে হাত দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। যাদের সঞ্চয় নেই, তারা তাদের ভোগের পরিমাণ হ্রাস করেছে। ঋণ করছে অনেকে। এনজিওর ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করছে কোনো কোনো অঞ্চলের কৃষক। পাটের দাম নেই। কৃষক ফলিয়েছে অনেক পাট, কিন্তু এর বাজার নেই। ধান, অর্থাৎ আউশ উঠেছে। এর বাজারও মন্দা। আমদানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। ডলারের দাম ১২০ টাকা ছুঁই ছুঁই। বিদেশি ঋণের বোঝা বেড়েছে। কিস্তি পরিশোধের সময় হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ডলারের অভাবে কিস্তি শোধ করা যাচ্ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা। রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে না। রপ্তানির বাজারও মন্দা। আর কত বলব? নেতিবাচক দিকে ভর্তি বাজারব্যবস্থা। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক খবর নেই। বরং উলটো। ক্ষেত্রটি কী? শত কোটি, হাজার কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা।

কথা ছিল, এমন মন্দার দিনে হয়তো শত কোটি টাকার মালিক, হাজার কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা কমবে। না কমুক, অন্তত এক স্থানে স্থির থাকবে। না তা হচ্ছে না। খবরে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে শত কোটি টাকার মালিক, হাজার কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা বাড়ছেই। ২০২২ সালে ৫৫-১১০ কোটি টাকার মালিক বেড়েছে ৩১ জন। এখন শত কোটি টাকার ‘ব্র্যাকেটে’ বাংলাদেশির সংখ্যা ১ হাজার ১৫৬। একইভাবে ১১০ কোটি থেকে ৫৫০ কোটি, ৫৫০ কোটি থেকে ১১০০ কোটি, ১১০০ কোটি থেকে ৫৫০০ কোটি টাকার মালিকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বোচ্চ ‘ব্র্যাকেটে’ অর্থাৎ ৫০ কোটি ডলারের উপর সম্পদ আছে এমন বাংলাদেশির সংখ্যা এখন ২২। বাংলাদেশের টাকায় তারা প্রত্যেকেই এখন ৫৫০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক।

আরও খবর এই যে, সিঙ্গাপুরে ধনীদের তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশি, যা আগে কখনো শুনিনি। অর্থাৎ বাংলাদেশি ‘বিলিয়নিয়ারের’ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আমরা কি এখন এর প্রতিবাদ করব? কীভাবে প্রতিবাদ করব? প্রতিবাদের ভিত্তি কী? তারা কীভাবে এ টাকার মালিক হয়েছেন, তা আমাদের জানা নেই। জানা খবর, তারা এখন ধনী, অতিধনী, হাজার কোটি টাকার মালিক। বলতে হবে এটা ‘বাজার অর্থনীতির’ ফসল। উগ্র বাজার অর্থনীতির ফল। বাজার অর্থনীতি ধনীকে আরও ধনী করে, গরিবকে করে গরিব। বাজার অর্থনীতিতে ছোটদের স্থান নেই। ছোটরা টিকবে সরকারের আনুকূল্যে, ধনীদের আনুকূল্যে। বিষয়টি এমনই। অথচ আমাদের অনেকেরই পছন্দ বাজার অর্থনীতি।

বাজার অর্থনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি সারা বিশ্বেই চালু। এর প্রশংসাই চারদিকে, ব্যতিক্রম দেখি না। বাজার অর্থনীতি দারিদ্র্য হ্রাস করবে, জিডিপি বাড়াবে, মাথাপিছু আয় বাড়াবে। দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করবে। জগৎ সভায় বাংলাদেশ হবে উচ্চ স্থানের অধিকারী। এসবই সত্য কথা। হচ্ছেও তা-ই। বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। গাড়ি-বাড়ি বাড়ছে। তকতকে ঝলমলে দালানকোঠা হচ্ছে। একটা শ্রেণি হচ্ছে পেশাদার। বহু লোক যাচ্ছে বিদেশে কাজ করতে। তারা ডলার পাঠাচ্ছে। গ্রামে তৈরি হচ্ছে নতুন মধ্যবিত্ত। বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হচ্ছে। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল হচ্ছে গ্রামে। মানুষ এখন না খেয়ে নেই। ‘মঙ্গা’ নেই। দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়েছে। অনেকের জীবনধারণের মানের উন্নতি ঘটেছে। এসবই সত্য কথা। কিন্তু পাশাপাশি আরও আছে অনেক সত্য, যার কথা আমরা আলোচনায় আনি না। আমরা সমস্যার সমালোচনা করি। মূল্যস্ফীতির সমালোচনা করি। খেলাপি ঋণের সমালোচনা করি। দুর্নীতির সমালোচনা করি। অপচয়ের সমালোচনা করি। আইনভঙ্গের সমালোচনা করি। সমালোচনা করি আরও অনেক কিছুর। যেমন-বৈষম্য, আঞ্চলিক বৈষম্য, মজুরি বৃদ্ধিতে শ্লথগতি, শ্রমিক শোষণ, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, সিন্ডিকেট ইত্যাদির। সমালোচনা করি সম্পদ পাচারের, সমালোচনা করি কর, রাজস্ব বৃদ্ধি না পাওয়ার। সমালোচনা করি ঘাটতি ফিন্যান্সিংয়ের। মজার ও শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, আমরা যে যে সমস্যার সমালোচনা করি, তার প্রায় সব কয়টিই বাজার অর্থনীতির ফসল। বাজার অর্থনীতির অনুষঙ্গ। বাজার অর্থনীতির বন্ধু।

একটু গভীরভাবে দেখলেই বিষয়টি বোঝা যাবে যে বৈষম্য ছাড়া পুঁজিবাদী উন্নয়ন হয় না। শ্রমিকদের পাওনা থেকে বঞ্চিত না করে বাজার অর্থনীতি হয় না। ধনী লোক সৃষ্টি না করে বাজার অর্থনীতি হয় না। অর্থ পাচার না করলে বাজার অর্থনীতি হয় না। দেখা যাবে, আমরা যেসব সমস্যার সমালোচনা করি, সেই একই সমস্যায় ভুগছে পৃথিবীর প্রায় সব পুঁজিবাদী তথা বাজার অর্থনীতির দেশ। যেমন অর্থ পাচার। অর্থ পাচার করছে দুনিয়ার সব উন্নয়নশীল দেশের ধনীরা। ভিয়েতনাম, চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ভারত, বাংলাদেশ-কোনো দেশের ধনীরা বাদ নেই। পাচারের টাকা রাখার সুন্দর ব্যবস্থা করে রেখেছে বাজার অর্থনীতি। বেশকিছু দেশ আছে, যারা পরিচিত ‘ট্যাক্স হেভেন’ হিসাবে। সেখানে ট্যাক্স নেই। দুনিয়ার ধনীরা, অতি ধনীরা সেখানে অর্থ পাচার করে।

বৈষম্য ও দারিদ্র্যের সমালোচনা করে লাভ নেই। আগে আমরা অনেক খবর রাখতাম না, পেতাম না। এখন সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব ইত্যাদির বদৌলতে দুনিয়ার গরিবরা কেমন আছে. তা জানতে পারি। উন্নত দেশ জাপান, আমেরিকা, ইংল্যান্ডের সাধারণ মধ্যবিত্ত, গরিবরা কেমন আছে, তা মুহূর্তের মধ্যেই জানা যায়। চমকপ্রদ উন্নতি করার দেশ চীনে দারিদ্র্যের অবস্থা কী, তা এখন জানা যায়। বেকারত্বের অবস্থার কথা জানা যায়। আমেরিকার নাগরিকরা এখন নিজ দেশ ছেড়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ‘স্থায়ী বসবাসের’ ব্যবস্থা করছে। সাধারণ আমেরিকানদের গড় আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না-এ খবর এখন আর নতুন নয়। ছেলেমেয়েরা বিয়ে-শাদি করে না সংসার চালাতে পারবে না বলে। কোটি কোটি মানুষ রোজগার নিয়ে ব্যস্ত। আমেরিকায় অগণিত লোকের মাথার উপর কোনো ছাদ নেই। এসব খবর আমরা পাই অহরহ। এসব কেন হচ্ছে? উন্নতির পাশাপাশি এসব কেন হচ্ছে?

উন্নয়ন-উন্নতি যদি ‘ইনক্লুসিভ’ না হয়, তাহলে তা-ই হবে। অথচ এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, মুখে আমরা যতই বলি না কেন ‘বাজার অর্থনীতির’ যুগ, বাস্তবে এ ব্যবস্থায় সবার সমান উন্নতি সম্ভব নয়। এমনকি সম্ভব নয় সবার মান-সম্মান রক্ষা করাও। বাজার অর্থনীতি যখন আগ্রাসী রূপ নেয়, তখন সব সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। যেমন এখন হচ্ছে বাংলাদেশে। ‘সিন্ডিকেট’ আমাদের জীবনকে, সুন্দর জীবনকে তছনছ করে দিচ্ছে। ব্যবসায়ীরা দল বেঁধে জিনিসের দাম বাড়ায়, কোনো প্রতিকার নেই। বলা হতো, চাহিদা ও সরবরাহ সমান সমান হলে জিনিসের দাম বাড়ে না। বাংলাদেশে তা মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। যেমন ধরুন গোল আলুর কথা। গোল আলুতে আমরা বরাবর উদ্বৃত্ত। এর মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী? অনেক কৃষিপণ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ সবের দামবৃদ্ধির কারণ কী? সারা বিশ্বে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পাচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী শ্রীলংকার ৫০-৬০ শতাংশের মূল্যস্ফীতি এখন নিয়ন্ত্রিত। আমাদেরটা নয়।

সিন্ডিকেট আছে, থাকবে-বাজার অর্থনীতি তা-ই বলে। এখানে ছোট ছোট ব্যবসায়ী, উৎপাদক, আমদানিকারক টিকতে পারে না। তবে হ্যাঁ, টিকতে পারে যদি বাজার অর্থনীতি আইন-কানুনের মধ্যে কাজ করে। দেশে চাহিদা-সরবরাহের ব্যালেন্স রক্ষা করার জন্য আইন আছে, অনেক আইন আছে। বস্তুত আইনের কোনো অভাব দেশে নেই। কিন্তু একশ্রেণির ব্যবসায়ী বাজার অর্থনীতিকে উগ্র বাজার অর্থনীতি বানিয়ে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে। এর পরিসমাপ্তি দরকার। ব্যবসায়ীরা টাকা বানাবে-তাতে কার কী আপত্তি? আপত্তি নেই। শত কোটি টাকার মালিক হোক, আপত্তি নেই। তবে তা হওয়া উচিত প্রতিযোগিতা, মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে। আমাদের দেশে এটা হচ্ছে না। এ জন্যই লোকমনে ধারণা এই যে, বাজার অর্থনীতি সাধারণ মানুষের কল্যাণে আসে না।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন