জীবনের টানে মৃত্যুর পথে
নিজেরাই জমি থেকে মাইন পরিষ্কারে নেমেছেন ইউক্রেনের কৃষকরা
যুগান্তর ডেস্ক
২৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের এক বছর পার হয়ে গেছে। এখনো থেমে নেই আক্রমণ। একে অপরকে প্রতিহত করতে ব্যবহার করছে নানান ধরনের যুদ্ধাস্ত্র। এর মধ্যে অন্যতম হলো মাটির নিচে পুঁতে রাখা ল্যান্ড মাইন। কোথাও ইউক্রেন সেনাবাহিনী, কোথাও পুঁতে রেখে গেছে রাশিয়া। অবিস্ফোরিত এসব মাইন এখন ইউক্রেনের কৃষদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সামনেই ফসলের মৌসুম। চাষ শুরু করতে হবে। নইলে গত মৌসুমের মতো এবারও পড়ে থাকবে জমি! ধার-দেনা, ত্রাণের ওপর ভরসা করে একবেলা/আধপেটায় কাটবে দিন। পেটের দায়ে তাই নিজেরাই জমি থেকে মাইন পরিষ্কারে নেমেছেন নিরুপায় কৃষকরা। জীবনের টানে পা বাড়াচ্ছেন মৃত্যুর পথে! সিএনএন।
অলেকজেন্ডার হাভরিলুক (৬৯)। ইউক্রেনের খারকিভ অঞ্চলের বাসিন্দা। পেশা কৃষিকাজ। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এখানে এপ্রিলের শুরুতে নতুন ফসল রোপণের মৌসুম শুরু হবে। তাই আমি আমার ফসলের জমি থেকে নিজেই মাইন পরিষ্কার করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। যদিও এটি বিপজ্জনক। এখন পর্যন্ত খারকিভের ইজিয়াম শহরের কাছাকাছি ভ্যালিকা কোমিশুভাহাতে জমি থেকে প্রায় ২০টি মাইন সরিয়েছি। প্রথমে আমি ভয় পেয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আমাকে জমিতে বীজ রোপণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যদি আপনি এটি খুঁজে পান তাহলে একটি লাঠি নিয়ে এর আকার নির্ধারণ করতে আলত চাপুন। এরপর মাটি খনন শুরু করুন। মাইনটি বের হয়ে আসার পর এটিকে সাবধানে তুলে নিন। কাজটি বিপজ্জনক। কিন্তু ফসল উৎপাদন অব্যাহত রাখতে অন্য কোনো বিকল্প নেই। কারণ এটি ব্যতীত কৃষকদের আরও একটি বছর আয়হীন থাকতে হবে। হাভরিলুক একা নন। তার প্রতিবেশী আরও অনেকেই আছেন যারা এই দুঃসাহসী কাজ করছেন। ইউক্রেনের স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন কৃষক তাদের ফসলের মাঠে কাজ করতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে আহত বা নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৫ বছর বয়সি এক বৃদ্ধও রয়েছেন যিনি দক্ষিণ ইউক্রেনের চেরভোন গ্রামের কাছে ভুল করে পা রাখার ফলে মাইন বিস্ফোরিত হয়ে সাথে সাথেই মারা যান। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বারবার কৃষকদের বিষয়টি নিজের হাতে না নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন উত্তোলন অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ প্রায়ই এগুলো মাঝে মাঝে মানুষকে হত্যা এবং আহত করার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করে তৈরি করা হয়। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী অনুমান করে বলেছে, বর্তমানে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জায়গাজুড়ে অবিস্ফোরিত ল্যান্ড মাইন সুপ্তাবস্থায় রয়েছে। এর কারণে উর্বর জমির বিশাল এলাকায় এই বছর ফসল উৎপাদনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
ইউক্রেনের খনি ক্লিয়ারেন্স অপারেশন ইতোমধ্যে এগুলো পরিষ্কারে কাজ করছে। তবে তা ধীর ও ব্যয়বহুল। সেনাবাহিনীর অফিসিয়াল তথ্য অনুযায়ী দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা বছরে ৪৫ হাজার ডিভাইস নিষ্ক্রিয় করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম মাইন ক্লিয়ারেন্স সংস্থা হ্যালো ট্রাস্ট ল্যান্ড মাইন উত্তোলনে ইউক্রেনে ৭০০ কর্মী নিয়োগ করছে, যা বছরের শেষ নাগাদ প্রায় দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ইউক্রেনের হ্যালো ট্রাস্টের ডিমিনিং টাস্ক ফোর্স পরিচালনাকারী মাইরি কানিংহাম সিএনএনকে বলেন, মাইনের কারণে জমিতে দূষণের মাত্রা বিশাল। এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ইউক্রেন যাতে শস্য উৎপাদনে তার পূর্বের অবস্থানে ফিরে যেতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষি জমিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি আমরা। তবে সর্বোচ্চ চ্যালেঞ্জ হলো মাইনের ধরন নির্ধারণের সমস্যা।
তিনি আরও বলেন, আমরা যানবাহনবিরোধী ধাতব এবং প্লাস্টিক উভয় মাইন দেখছি। আমরা কর্মীবিরোধী মাইন দেখছি। এ ছাড়াও ট্রিপওয়্যারে অ্যান্টি-পার্সোনেল বাইন্ডিং এবং ফ্র্যাগমেন্টেশন মাইনসহ ট্রিপওয়্যারে গ্রেনেড দেখছি। যেহেতু মাইন নিষ্ক্রিয়করণের ধ্বংসাত্মক প্রচেষ্টার জন্য কোনো একক ও উপযুক্ত পদ্ধতি নেই।
এর জন্য কার্যকরী পদ্ধতি প্রয়োজন। তাই আমাদের কর্মচারীদের যথাযথভাবে আরও প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। তবুও সব মাইন অপসারণ করতে কয়েক বছর লেগে যাবে। কারণ যুদ্ধে এক দিনের ব্যবহৃত বিস্ফোরক অপসারণ কয়েক মাসের কাজের সমান। এ ছাড়া কর্মীদের নিরাপত্তার দিকেও নজর রাখতে হয়।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
জীবনের টানে মৃত্যুর পথে
নিজেরাই জমি থেকে মাইন পরিষ্কারে নেমেছেন ইউক্রেনের কৃষকরা
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের এক বছর পার হয়ে গেছে। এখনো থেমে নেই আক্রমণ। একে অপরকে প্রতিহত করতে ব্যবহার করছে নানান ধরনের যুদ্ধাস্ত্র। এর মধ্যে অন্যতম হলো মাটির নিচে পুঁতে রাখা ল্যান্ড মাইন। কোথাও ইউক্রেন সেনাবাহিনী, কোথাও পুঁতে রেখে গেছে রাশিয়া। অবিস্ফোরিত এসব মাইন এখন ইউক্রেনের কৃষদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সামনেই ফসলের মৌসুম। চাষ শুরু করতে হবে। নইলে গত মৌসুমের মতো এবারও পড়ে থাকবে জমি! ধার-দেনা, ত্রাণের ওপর ভরসা করে একবেলা/আধপেটায় কাটবে দিন। পেটের দায়ে তাই নিজেরাই জমি থেকে মাইন পরিষ্কারে নেমেছেন নিরুপায় কৃষকরা। জীবনের টানে পা বাড়াচ্ছেন মৃত্যুর পথে! সিএনএন।
অলেকজেন্ডার হাভরিলুক (৬৯)। ইউক্রেনের খারকিভ অঞ্চলের বাসিন্দা। পেশা কৃষিকাজ। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এখানে এপ্রিলের শুরুতে নতুন ফসল রোপণের মৌসুম শুরু হবে। তাই আমি আমার ফসলের জমি থেকে নিজেই মাইন পরিষ্কার করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। যদিও এটি বিপজ্জনক। এখন পর্যন্ত খারকিভের ইজিয়াম শহরের কাছাকাছি ভ্যালিকা কোমিশুভাহাতে জমি থেকে প্রায় ২০টি মাইন সরিয়েছি। প্রথমে আমি ভয় পেয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আমাকে জমিতে বীজ রোপণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যদি আপনি এটি খুঁজে পান তাহলে একটি লাঠি নিয়ে এর আকার নির্ধারণ করতে আলত চাপুন। এরপর মাটি খনন শুরু করুন। মাইনটি বের হয়ে আসার পর এটিকে সাবধানে তুলে নিন। কাজটি বিপজ্জনক। কিন্তু ফসল উৎপাদন অব্যাহত রাখতে অন্য কোনো বিকল্প নেই। কারণ এটি ব্যতীত কৃষকদের আরও একটি বছর আয়হীন থাকতে হবে। হাভরিলুক একা নন। তার প্রতিবেশী আরও অনেকেই আছেন যারা এই দুঃসাহসী কাজ করছেন। ইউক্রেনের স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন কৃষক তাদের ফসলের মাঠে কাজ করতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে আহত বা নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৫ বছর বয়সি এক বৃদ্ধও রয়েছেন যিনি দক্ষিণ ইউক্রেনের চেরভোন গ্রামের কাছে ভুল করে পা রাখার ফলে মাইন বিস্ফোরিত হয়ে সাথে সাথেই মারা যান। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বারবার কৃষকদের বিষয়টি নিজের হাতে না নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন উত্তোলন অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ প্রায়ই এগুলো মাঝে মাঝে মানুষকে হত্যা এবং আহত করার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করে তৈরি করা হয়। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী অনুমান করে বলেছে, বর্তমানে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জায়গাজুড়ে অবিস্ফোরিত ল্যান্ড মাইন সুপ্তাবস্থায় রয়েছে। এর কারণে উর্বর জমির বিশাল এলাকায় এই বছর ফসল উৎপাদনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
ইউক্রেনের খনি ক্লিয়ারেন্স অপারেশন ইতোমধ্যে এগুলো পরিষ্কারে কাজ করছে। তবে তা ধীর ও ব্যয়বহুল। সেনাবাহিনীর অফিসিয়াল তথ্য অনুযায়ী দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা বছরে ৪৫ হাজার ডিভাইস নিষ্ক্রিয় করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম মাইন ক্লিয়ারেন্স সংস্থা হ্যালো ট্রাস্ট ল্যান্ড মাইন উত্তোলনে ইউক্রেনে ৭০০ কর্মী নিয়োগ করছে, যা বছরের শেষ নাগাদ প্রায় দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ইউক্রেনের হ্যালো ট্রাস্টের ডিমিনিং টাস্ক ফোর্স পরিচালনাকারী মাইরি কানিংহাম সিএনএনকে বলেন, মাইনের কারণে জমিতে দূষণের মাত্রা বিশাল। এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ইউক্রেন যাতে শস্য উৎপাদনে তার পূর্বের অবস্থানে ফিরে যেতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষি জমিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি আমরা। তবে সর্বোচ্চ চ্যালেঞ্জ হলো মাইনের ধরন নির্ধারণের সমস্যা।
তিনি আরও বলেন, আমরা যানবাহনবিরোধী ধাতব এবং প্লাস্টিক উভয় মাইন দেখছি। আমরা কর্মীবিরোধী মাইন দেখছি। এ ছাড়াও ট্রিপওয়্যারে অ্যান্টি-পার্সোনেল বাইন্ডিং এবং ফ্র্যাগমেন্টেশন মাইনসহ ট্রিপওয়্যারে গ্রেনেড দেখছি। যেহেতু মাইন নিষ্ক্রিয়করণের ধ্বংসাত্মক প্রচেষ্টার জন্য কোনো একক ও উপযুক্ত পদ্ধতি নেই।
এর জন্য কার্যকরী পদ্ধতি প্রয়োজন। তাই আমাদের কর্মচারীদের যথাযথভাবে আরও প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। তবুও সব মাইন অপসারণ করতে কয়েক বছর লেগে যাবে। কারণ যুদ্ধে এক দিনের ব্যবহৃত বিস্ফোরক অপসারণ কয়েক মাসের কাজের সমান। এ ছাড়া কর্মীদের নিরাপত্তার দিকেও নজর রাখতে হয়।