একজন ফুলপরী ও ছাত্ররাজনীতি
jugantor
একজন ফুলপরী ও ছাত্ররাজনীতি

  লাইজু আক্তার  

২২ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

দরিদ্র পিতার মেয়ে ফুলপরী। দেনা আর দৈন্যের জাল উপেক্ষা করে দুচোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে একদিন কড়া নেড়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কপাটে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় আনার জন্য। ভেবেছিল পরিশ্রম করে একদিন দরিদ্র পিতাকে দারিদ্র্যমুক্তির বর দেবে; যেমন করে জলপরী সৎ কাঠুরেকে বর স্বরূপ দিয়েছিল সোনার কুঠার আর রুপোর কুঠার। লালপরি, নীলপরি, সাদাপরির ভিড়ে একজন ফুলপরীর স্বপ্ন যে এমন হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেই ফুলপরী আজ স্বপ্ন দেখে ন্যায়বিচারের। আচ্ছা! ফুলপরীরা ন্যায়বিচার পায় তো?

গত মাস থেকে দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোর শিরোনাম ফুলপরী। ফুলপরীরা পত্রিকার শিরোনাম হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শিরোনামের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ফুলপরীর গল্পটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কেন নয়-সেকথা আজ সবারই জানা। কেন এমন অস্বাভাবিক গল্পগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে আসে বলুন তো? বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরা হয় সফলতার শেষ দেওয়াল। যে দেওয়ালটা পাড়ি দিলেই স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়া যায়। অনেকে আশা নিয়ে ঘুম উপেক্ষা করে স্বপ্ন দেখে-এই তো আর কটা দিন, এরপর আর বাবা-মায়ের কাঁধে নিজের বোঝা রাখবে না। আর থাকবে না অভাব-অনটন, বাবা-মাকে আর ধারদেনা করতে হবে না। এ স্বপ্নগুলোয় যদি ভিলেন হয়ে আসে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতা-নেত্রীরা, তবে কেমন হয় বলুন তো? আমি জানি, অনেকেই আমার মতো বলবেন, মোটেও ঠিক হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে গড়ার জায়গা, নিজের মেধাকে তুলে ধরার জায়গা। দেশ ও দশের কল্যাণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার জায়গা। অথচ সেখানে গত কয়েক বছরের ঘটনা যদি দেখি, তাহলে দেখা যাবে ছাত্র রাজনীতির নামে চলছে অরাজকতা। শিক্ষার্থীরা, যারা কিনা দেশের সম্পদ, দেশ গড়ার হাতিয়ার; যারা দেশকে রক্ষা করবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, আজ তারাই দেশকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে। ম্যানার শেখানোর নামে করছে রাতভর নির্যাতন। ছাত্রনেতা থেকে বড় নেতা হবে-এ আশায় ছাত্ররাজনীতি চলমান থাকলেও ঘটনা কিন্তু সব সময় উলটোই ঘটছে। তারচেয়েও বড় কথা, ছাত্রছাত্রীদের প্রধান কাজ কী? অবশ্যই পড়াশোনা। একজন শিক্ষার্থীর পেশাই হলো পড়াশোনা করা। সে লেখাপড়া করবে, গবেষণা করবে, নিজেকে দক্ষ করে তুলবে। কীভাবে দেশ ও দশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হতে পারবে, তা শিখবে। সে কেন রাজনীতি নিয়ে মেতে থাকবে?

পৃথিবীতে গবেষণা করার মতো এত এত বিষয় আছে, আমাদের শিক্ষার্থীরা সেগুলো করছে না কেন? কেন আমরা পদ্মা সেতু করার জন্য বাইরের দেশ থেকে ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে আসি? আমাদের দেশে কেন একজন ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হচ্ছে না? কেন দেশের বিত্তবান লোকগুলোর একটু বুকের ব্যথা উঠলেই ইউরোপ, আমেরিকা ছুটে যাচ্ছে? আমাদের দেশে কেন উন্নত চিকিৎসা ও চিকিৎসক নেই? এ উত্তরগুলো যদি খুঁজতে যাই, তাহলে যে বিষয়গুলো উঠে আসবে, তা হলো-শিক্ষাক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বাজেট না থাকা, ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতিতে প্রবলভাবে যুক্ত থাকা, মেধা অন্বেষণে যথাযথ প্রতিযোগিতার আয়োজন না করা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া থেকে রক্ষা না করা, যথাযথ গবেষণামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি। অথচ আমাদের দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আছেন শিক্ষক-শিক্ষিকা। কিন্তু সেখানে না তৈরি হচ্ছেন বিশ্বমানের একজন ইঞ্জিনিয়ার; না চিকিৎসক, না বিজ্ঞানী। এ কারণে আমরা সেই বিদেশি চিকিৎসক আর ইঞ্জিনিয়ারদের ওপরই নির্ভরশীল রয়ে গেলাম। এ দায় কাদের?

ছাত্র ও শিক্ষকরা যদি রাজনীতি বাদ দিয়ে গবেষণায় হাত দিতেন, তাহলে আজ আমাদের দেশে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার থাকত, থাকত চিকিৎসক, তৈরি হতো বিজ্ঞানী, যার সুফল দেশবাসী সারা জীবন ভোগ করতে পারতেন। এক্ষত্রে হয়তো কেউ কেউ বলবেন-তাহলে দেশ পরিচালনার জন্য নেতা কিভাবে তৈরি হবে? তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি-প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত একজন শিক্ষার্থী অবশ্যই একজন ভালো নেতা হবেন। সুদক্ষ নেতা হওয়ার জন্য সুশিক্ষা তার পাথেয় হবে।

আদমজী, নারায়ণগঞ্জ

mstlaijua@gmail.com

একজন ফুলপরী ও ছাত্ররাজনীতি

 লাইজু আক্তার 
২২ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

দরিদ্র পিতার মেয়ে ফুলপরী। দেনা আর দৈন্যের জাল উপেক্ষা করে দুচোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে একদিন কড়া নেড়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কপাটে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় আনার জন্য। ভেবেছিল পরিশ্রম করে একদিন দরিদ্র পিতাকে দারিদ্র্যমুক্তির বর দেবে; যেমন করে জলপরী সৎ কাঠুরেকে বর স্বরূপ দিয়েছিল সোনার কুঠার আর রুপোর কুঠার। লালপরি, নীলপরি, সাদাপরির ভিড়ে একজন ফুলপরীর স্বপ্ন যে এমন হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেই ফুলপরী আজ স্বপ্ন দেখে ন্যায়বিচারের। আচ্ছা! ফুলপরীরা ন্যায়বিচার পায় তো?

গত মাস থেকে দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোর শিরোনাম ফুলপরী। ফুলপরীরা পত্রিকার শিরোনাম হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শিরোনামের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ফুলপরীর গল্পটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কেন নয়-সেকথা আজ সবারই জানা। কেন এমন অস্বাভাবিক গল্পগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে আসে বলুন তো? বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরা হয় সফলতার শেষ দেওয়াল। যে দেওয়ালটা পাড়ি দিলেই স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়া যায়। অনেকে আশা নিয়ে ঘুম উপেক্ষা করে স্বপ্ন দেখে-এই তো আর কটা দিন, এরপর আর বাবা-মায়ের কাঁধে নিজের বোঝা রাখবে না। আর থাকবে না অভাব-অনটন, বাবা-মাকে আর ধারদেনা করতে হবে না। এ স্বপ্নগুলোয় যদি ভিলেন হয়ে আসে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতা-নেত্রীরা, তবে কেমন হয় বলুন তো? আমি জানি, অনেকেই আমার মতো বলবেন, মোটেও ঠিক হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে গড়ার জায়গা, নিজের মেধাকে তুলে ধরার জায়গা। দেশ ও দশের কল্যাণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার জায়গা। অথচ সেখানে গত কয়েক বছরের ঘটনা যদি দেখি, তাহলে দেখা যাবে ছাত্র রাজনীতির নামে চলছে অরাজকতা। শিক্ষার্থীরা, যারা কিনা দেশের সম্পদ, দেশ গড়ার হাতিয়ার; যারা দেশকে রক্ষা করবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, আজ তারাই দেশকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে। ম্যানার শেখানোর নামে করছে রাতভর নির্যাতন। ছাত্রনেতা থেকে বড় নেতা হবে-এ আশায় ছাত্ররাজনীতি চলমান থাকলেও ঘটনা কিন্তু সব সময় উলটোই ঘটছে। তারচেয়েও বড় কথা, ছাত্রছাত্রীদের প্রধান কাজ কী? অবশ্যই পড়াশোনা। একজন শিক্ষার্থীর পেশাই হলো পড়াশোনা করা। সে লেখাপড়া করবে, গবেষণা করবে, নিজেকে দক্ষ করে তুলবে। কীভাবে দেশ ও দশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হতে পারবে, তা শিখবে। সে কেন রাজনীতি নিয়ে মেতে থাকবে?

পৃথিবীতে গবেষণা করার মতো এত এত বিষয় আছে, আমাদের শিক্ষার্থীরা সেগুলো করছে না কেন? কেন আমরা পদ্মা সেতু করার জন্য বাইরের দেশ থেকে ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে আসি? আমাদের দেশে কেন একজন ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হচ্ছে না? কেন দেশের বিত্তবান লোকগুলোর একটু বুকের ব্যথা উঠলেই ইউরোপ, আমেরিকা ছুটে যাচ্ছে? আমাদের দেশে কেন উন্নত চিকিৎসা ও চিকিৎসক নেই? এ উত্তরগুলো যদি খুঁজতে যাই, তাহলে যে বিষয়গুলো উঠে আসবে, তা হলো-শিক্ষাক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বাজেট না থাকা, ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতিতে প্রবলভাবে যুক্ত থাকা, মেধা অন্বেষণে যথাযথ প্রতিযোগিতার আয়োজন না করা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া থেকে রক্ষা না করা, যথাযথ গবেষণামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি। অথচ আমাদের দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আছেন শিক্ষক-শিক্ষিকা। কিন্তু সেখানে না তৈরি হচ্ছেন বিশ্বমানের একজন ইঞ্জিনিয়ার; না চিকিৎসক, না বিজ্ঞানী। এ কারণে আমরা সেই বিদেশি চিকিৎসক আর ইঞ্জিনিয়ারদের ওপরই নির্ভরশীল রয়ে গেলাম। এ দায় কাদের?

ছাত্র ও শিক্ষকরা যদি রাজনীতি বাদ দিয়ে গবেষণায় হাত দিতেন, তাহলে আজ আমাদের দেশে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার থাকত, থাকত চিকিৎসক, তৈরি হতো বিজ্ঞানী, যার সুফল দেশবাসী সারা জীবন ভোগ করতে পারতেন। এক্ষত্রে হয়তো কেউ কেউ বলবেন-তাহলে দেশ পরিচালনার জন্য নেতা কিভাবে তৈরি হবে? তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি-প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত একজন শিক্ষার্থী অবশ্যই একজন ভালো নেতা হবেন। সুদক্ষ নেতা হওয়ার জন্য সুশিক্ষা তার পাথেয় হবে।

আদমজী, নারায়ণগঞ্জ

mstlaijua@gmail.com

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন