চা শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা
চা শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে বাগান মালিক কর্তৃক প্রচারিত কিছু বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচারের জবাব দেওয়া দরকার। চা শ্রমিকরা যখন ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন, ঠিক তখন মালিকরা বলছেন তারা নাকি চা শ্রমিকদের ৪০২ টাকা মজুরি দেয়। তাদের দেওয়া এ তথ্যে ‘এখন টিভি’ একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছে, যা স্পষ্টতই মিথ্যাচার ও আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার কৌশল। মালিকরা বলছেন, তারা দৈনিক ঘর ভাড়া বাবদ ৭৬.৯২ টাকা, চিকিৎসা বাবদ ৭.৫০ টাকা, ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ ০.০২ টাকা এবং বাসাবাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল বাবদ ১৪.০০ টাকা শ্রমিকদের দেয়। মোটের হিসাবে যা দাঁড়ায় ৯৮.৪৪ টাকা। কিন্তু বাস্তবে তা দেওয়া হয় না।
শ্রম আইনের ২(৪৫) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, বাসস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা সুবিধা, অবসর ভাতা বা ভবিষ্যৎ তহবিলে মালিক কর্তৃক দেওয়া অর্থ মজুরির অন্তর্ভুক্ত হবে না। ফলে মালিকরা উপরিউক্ত খাতগুলোয় যে টাকা মজুরি বাবদ প্রদান করছে বলে দেখাচ্ছে, তার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। আবার শ্রম আইনের ৯৬নং ধারায় স্পষ্ট নির্দেশ আছে চা শ্রমিকদের গৃহায়নের সুবিধা নিশ্চিত করবে মালিকরা। এখানে মনে রাখতে হবে, চা শিল্প অন্য শিল্পের মতো নয় যে বাইরে থেকে শ্রমিক এনে কাজ করানো যায়। চা শিল্পের বিশেষ ধরনের কারণেই শ্রমিকদের বাগানেই থাকতে হয়। আর এ বাগানও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চাষ করছেন চা শ্রমিকরা। মালিক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু শ্রমিকরা সেখানেই আছেন। ফলে চা শ্রমিকদের গৃহে উৎপাদিত কাঁঠাল বা পেয়ারা জাতীয় ফলের মূল্য মজুরিতে দেখানো হাস্যকর যুক্তি ছাড়া আর কি হতে পারে?
মালিকরা দেখাচ্ছেন, প্যাকিং বোনাস/ মাঠ/ কারখানায় অধিক কাজের জন্য দৈনিক ৬৫ টাকা দেওয়া হয়। এটা বাস্তবে সাধারণ দৈনিক মজুরি নয়। এটা শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজের টাকা। শ্রম আইনের ১০৮(১) ধারায় অধিক ‘কাজে সাধারণ হারের দ্বিগুণ মজুরি’ প্রদানের কথা আছে। ফলে এগুলোকে দৈনিক মজুরিতে দেখানো মানে শ্রমিককে ঠকানো। এছাড়া মালিকরা বলছেন ১ জন শ্রমিককে সপ্তাহে ১০.৬১৫ কেজি চাল/ আটা দেওয়া হয়। যার মূল্য ধরা হয়েছে ৩০.৭৯ টাকা। কিন্তু বাস্তবতা হলো একজন পুরুষ শ্রমিককে ৩.২৭ কেজি রেশন দেয়, তার পোষ্য নারী শ্রমিককে ২.৪৪ কেজি আর শিশুকে (যদি শিশু থাকে) ১.২২ কেজি দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে যা হয় ৬.৯৩ কেজি। নারীরা পোষ্যের জন্য রেশন পান না। কোনো কারণে কাজে অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়। অন্য সেক্টরে যারা রেশন পান, সেটাকে মজুরি হিসাবে দেখানো হয় না। যেমন, পুলিশ সদস্য রেশন পান; এটা মজুরি বা বেতন হিসাবে গণ্য হয় না। একই সঙ্গে বছরে ২টি উৎসব ভাতা ও কাজে উপস্থিতি অনুযায়ী বার্ষিক উৎসব ভাতা আলাদা দেওয়ার কথা থাকলেও মালিকরা এ ভাতাকে দৈনিক মজুরির সঙ্গে (৪.৬০+১৫.৪৫ টাকা হারে) যুক্ত করে দেখাচ্ছে, যা বাস্তবে অন্যায়। কারণ শ্রম আইনের আওতায় প্রণীত শ্রম বিধিমালায় বলা আছে-‘প্রতিটি উৎসব ভাতা মাসিক মজুরির অধিক হবে না এবং তা অতিরিক্ত মজুরি হিসাবে বিবেচিত হবে না।’ তাহলে মালিকরা এ টাকাকে কেন মজুরিতে যুক্ত করে দেখাচ্ছে?
এভাবে হিসাবের নানা কৌশলে যে মজুরি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা প্রতারণার শামিল। এ লেখার মাধ্যমে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করি। এ সময়ে সমাজের সব স্তরের সচেতন ও বিবেকবান মানুষের চা শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
সংগঠক, চা বাগান শিক্ষা অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ
চা শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা
সঞ্জয় কান্ত দাস
২৪ মে ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
চা শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে বাগান মালিক কর্তৃক প্রচারিত কিছু বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচারের জবাব দেওয়া দরকার। চা শ্রমিকরা যখন ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন, ঠিক তখন মালিকরা বলছেন তারা নাকি চা শ্রমিকদের ৪০২ টাকা মজুরি দেয়। তাদের দেওয়া এ তথ্যে ‘এখন টিভি’ একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছে, যা স্পষ্টতই মিথ্যাচার ও আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার কৌশল। মালিকরা বলছেন, তারা দৈনিক ঘর ভাড়া বাবদ ৭৬.৯২ টাকা, চিকিৎসা বাবদ ৭.৫০ টাকা, ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ ০.০২ টাকা এবং বাসাবাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল বাবদ ১৪.০০ টাকা শ্রমিকদের দেয়। মোটের হিসাবে যা দাঁড়ায় ৯৮.৪৪ টাকা। কিন্তু বাস্তবে তা দেওয়া হয় না।
শ্রম আইনের ২(৪৫) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, বাসস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা সুবিধা, অবসর ভাতা বা ভবিষ্যৎ তহবিলে মালিক কর্তৃক দেওয়া অর্থ মজুরির অন্তর্ভুক্ত হবে না। ফলে মালিকরা উপরিউক্ত খাতগুলোয় যে টাকা মজুরি বাবদ প্রদান করছে বলে দেখাচ্ছে, তার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। আবার শ্রম আইনের ৯৬নং ধারায় স্পষ্ট নির্দেশ আছে চা শ্রমিকদের গৃহায়নের সুবিধা নিশ্চিত করবে মালিকরা। এখানে মনে রাখতে হবে, চা শিল্প অন্য শিল্পের মতো নয় যে বাইরে থেকে শ্রমিক এনে কাজ করানো যায়। চা শিল্পের বিশেষ ধরনের কারণেই শ্রমিকদের বাগানেই থাকতে হয়। আর এ বাগানও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চাষ করছেন চা শ্রমিকরা। মালিক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু শ্রমিকরা সেখানেই আছেন। ফলে চা শ্রমিকদের গৃহে উৎপাদিত কাঁঠাল বা পেয়ারা জাতীয় ফলের মূল্য মজুরিতে দেখানো হাস্যকর যুক্তি ছাড়া আর কি হতে পারে?
মালিকরা দেখাচ্ছেন, প্যাকিং বোনাস/ মাঠ/ কারখানায় অধিক কাজের জন্য দৈনিক ৬৫ টাকা দেওয়া হয়। এটা বাস্তবে সাধারণ দৈনিক মজুরি নয়। এটা শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজের টাকা। শ্রম আইনের ১০৮(১) ধারায় অধিক ‘কাজে সাধারণ হারের দ্বিগুণ মজুরি’ প্রদানের কথা আছে। ফলে এগুলোকে দৈনিক মজুরিতে দেখানো মানে শ্রমিককে ঠকানো। এছাড়া মালিকরা বলছেন ১ জন শ্রমিককে সপ্তাহে ১০.৬১৫ কেজি চাল/ আটা দেওয়া হয়। যার মূল্য ধরা হয়েছে ৩০.৭৯ টাকা। কিন্তু বাস্তবতা হলো একজন পুরুষ শ্রমিককে ৩.২৭ কেজি রেশন দেয়, তার পোষ্য নারী শ্রমিককে ২.৪৪ কেজি আর শিশুকে (যদি শিশু থাকে) ১.২২ কেজি দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে যা হয় ৬.৯৩ কেজি। নারীরা পোষ্যের জন্য রেশন পান না। কোনো কারণে কাজে অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়। অন্য সেক্টরে যারা রেশন পান, সেটাকে মজুরি হিসাবে দেখানো হয় না। যেমন, পুলিশ সদস্য রেশন পান; এটা মজুরি বা বেতন হিসাবে গণ্য হয় না। একই সঙ্গে বছরে ২টি উৎসব ভাতা ও কাজে উপস্থিতি অনুযায়ী বার্ষিক উৎসব ভাতা আলাদা দেওয়ার কথা থাকলেও মালিকরা এ ভাতাকে দৈনিক মজুরির সঙ্গে (৪.৬০+১৫.৪৫ টাকা হারে) যুক্ত করে দেখাচ্ছে, যা বাস্তবে অন্যায়। কারণ শ্রম আইনের আওতায় প্রণীত শ্রম বিধিমালায় বলা আছে-‘প্রতিটি উৎসব ভাতা মাসিক মজুরির অধিক হবে না এবং তা অতিরিক্ত মজুরি হিসাবে বিবেচিত হবে না।’ তাহলে মালিকরা এ টাকাকে কেন মজুরিতে যুক্ত করে দেখাচ্ছে?
এভাবে হিসাবের নানা কৌশলে যে মজুরি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা প্রতারণার শামিল। এ লেখার মাধ্যমে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করি। এ সময়ে সমাজের সব স্তরের সচেতন ও বিবেকবান মানুষের চা শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
সংগঠক, চা বাগান শিক্ষা অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023