পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু আর নয়

 মো. এমদাদুর রহমান উদয় 
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বর্তমানে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বেশকিছু উন্নয়নশীল দেশে মানবমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে পানিতে ডুবে মৃত্যুকে উল্লেখ করা হয়। প্রায়ই আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা লক্ষ করে থাকি। সম্প্রতি জাতিসংঘের অন্যতম অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনিসেফের এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০ জনের মৃত্যু ঘটে পানিতে ডুবে। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, পানিতে যারা ডুবে তাদের প্রায় অর্ধেকই শিশু। সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসাবে এটি চিহ্নিত হয়েছে।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ছোট বড় অসংখ্য নদীনালায় ঘেরা আমাদের এ ছোট্ট সুন্দর দেশ। নদীর অফুরন্ত জলধারা আমাদের কৃষিসহ নানা অর্থনৈতিক অঙ্গনকে করেছে সমৃদ্ধ। তবে এ অবারিত জল মাঝে মাঝে হয়ে ওঠে মৃত্যুর কারণ। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এর প্রধান কারণ হিসাবে বাড়ির আশপাশে পরিত্যক্ত ডোবা, পুকুর, খাল-বিল ইত্যাদি জলাধারের উপস্থিতি, বাড়ির বড় সদস্যের বাচ্চাদের প্রতি উদাসীনতা, শিশুর সাঁতারে পর্যাপ্ত দক্ষতার অভাবকে দায়ী করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, পানিতে ডুবে মারা যাওয়া শিশুর প্রত্যেকের বাড়ির সর্বোচ্চ ২০ মিটারের মধ্যে কোনো না কোনো জলাধার রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে আসা অনেক শিশুও দুর্ঘটনার শিকার হয়। আমাদের দেশে পানিতে ডোবার ঘটনাগুলো প্রায়ই সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ঘটে থাকে। ধারণা করা হয়, এ সময় বাড়ির নারী-পুরুষরা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে শিশুদের খেয়াল রাখতে পারে না। ফলে শিশু এ সময় দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে।

ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, শুধু সাঁতার না জানার কারণেই অধিকাংশ শিশুর মৃত্যু হয়। এছাড়া যাদের খিঁচুনি বা মৃগী রোগজনিত সমস্যা আছে, এদের পানি ও জলাধারের ব্যাপারে সচেতন থাকা জরুরি। শহরাঞ্চলেও পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এছাড়া সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুদের বালতির পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাও প্রায়ই আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়। পানিতে ডোবা প্রতিরোধে সচেতনতাই হতে পারে মুখ্য হাতিয়ার। দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। সাঁতারে পারদর্শিতা না থাকায় পানিতে ডুবে যাওয়া ব্যক্তিকে বাঁচাতে গিয়ে অপরজনও দুর্ঘটনায় শিকার হতে দেখা যায়। তাই সাঁতারে দক্ষ এবং পারদর্শীদেরই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা প্রয়োজন। পানিতে ডোবা মানুষকে প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে আপৎকালীন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সহজ হয়। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, সঠিক উপায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করা না হলে তা রোগীর উপকারের বদলে ক্ষতির কারণ হতে পারে। একই সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থাও করতে হবে।

সাম্প্রতিককালে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। প্রতি বছর ২৫ জুলাই পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস হিসাবে চিহ্নিত ও পালন করা হয়। এ বছর পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘যে কেউই পানিতে ডুবে যেতে পারে, কারও ডুবে যাওয়াই কাম্য নয়।’ আমাদের দেশের অধিকাংশ মা-বাবা শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হলেও জীবন রক্ষাকারী সাঁতার শেখানোর ব্যাপারে তারা বেশ উদাসীন। মূলত পাঁচ বছর বয়স থেকেই শিশুকে সাঁতারে উদ্বুদ্ধ করা উচিত। সাঁতার শরীরের জন্য একটি ভালো ব্যায়ামও। এছাড়া দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে এটি জীবন রক্ষকারী দক্ষতা হিসাবেও বিবেচিত হয়। তাই খেলার ছলে ছোট শিশুদের সাঁতারে আগ্রহী করে তোলা প্রয়োজন। এছাড়া তিন বছর বা এর চেয়ে কম বয়সি শিশুর জন্য পিতা-মাতার অধিক যত্নশীল হওয়া, বাড়ির পাশের জলাধারগুলোয় যথাযথ বেষ্টনী দেওয়ার ব্যবস্থা করা, ঝুঁকিপূর্ণ নৌযাত্রা পরিহার করা দুর্ঘটনা রোধে কিছুটা হলেও কার্যকর হতে পারে। এছাড়া বিশেষ সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, এলাকাভিত্তিক সাঁতার প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার আয়োজনও ফলপ্রসূ হতে পারে।

শিক্ষার্থী, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন