শিক্ষার আত্মবিলাপ

 মো. আব্দুন নূর 
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘শিক্ষা হলো তাই, যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না, বিশ্বসভার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।’ গত কয়েক দশকে দেশে সর্বজনীন শিক্ষার বিস্তার ঘটলেও বিশ্বজুড়ে জ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টার কোনো কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। ফলাফলনির্ভর শিক্ষার ব্যাপক হারে চর্চা হচ্ছে; কিন্তু জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার চর্চা নেই বললেই চলে। বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষার চর্চা না হওয়ার ফলে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পরও শিক্ষা কোনো কাজে আসছে না। শিক্ষা যেন জাতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনদিন বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি যাচ্ছে। এ শিক্ষা না দেশের কাজে আসছে, না আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজে লাগছে।

শিক্ষা মনুষ্যত্ব অর্জনের স্তর পেরিয়ে আমাদের দেশে ব্যবসা হিসাবে রূপ নিয়েছে। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক কেবল শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছে বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া করে। শিক্ষার্থীরা পড়া বুঝল কি না, পারল কি না, তা বোঝার আগ্রহ শিক্ষকদের বিন্দুমাত্র নেই। স্কুল, কলেজের এমন অনেক শিক্ষক নিজের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও ক্লাসে ইচ্ছাকৃতভাবে ভালোভাবে পড়ায় না, বোঝায় না। এজন্য যে, শিক্ষার্থীরা মাসিক মাসোহারা দিয়ে যাতে শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে আসে। শহরের বাইরের স্কুল-কলেজের প্রতিটি ক্লাসের ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জন শিক্ষার্থীই হলো মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এ ৯০ শিক্ষার্থী বাড়তি খরচ করে প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য রাখে না। তার মানে এরা যথাযথ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদি প্রাইভেট পড়েই মৌলিক অধিকার শিক্ষা অর্জন করতে হয় তাহলে জনগণের টাকায় পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন কি আদৌ রয়েছে? আমাদের পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, পাঠদানের জন্য শিক্ষকও আছে, তারপরও আমাদের ব্যবসায়িক মানসিকতার জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোয় মাধ্যমিক পর্যায়ে নিজস্ব ভাষার বাইরে অন্য ১-২টা ভাষায় শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়। আর আমরা মাতৃভাষা বাংলাতেই শিক্ষার্থীদের দক্ষ করতে পারছি না, বিদেশি ভাষার দক্ষতা তো বহুদূর। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকের ব্যবসায়িক মানসিকতা ও উদাসীনতার কারণে যথোপযুক্ত শিক্ষা প্রয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। এ অবহেলায় জর্জরিত শিক্ষার বেহালদশা মানুষ, সমাজ, দেশ, রাজনীতি তথা সব স্তরে বাজে প্রভাব ফেলছে। এ কারণে সুশিক্ষায় শিক্ষিত সুশীল জাতি গড়ে উঠছে না। দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না। সুস্থ ধারায় গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন হচ্ছে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে সদিচ্ছা ও আত্মনিয়োগের অভাবে আমরা ভুলেই গেছি যে, এ শিক্ষাই সমাজ, দেশ ও জাতিকে পরিচালনা করে; মুক্তির পথ দেখায়, টেকসই উন্নয়নের পথ সুগম করে দেয়, ঘুস, চাঁদাবাজি, অনিয়ম, দুর্নীতি, সংঘাত প্রতিহত করে। শিক্ষার উন্নতি ছাড়া দেশ ও জাতির উন্নতির চিন্তা আর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার চিন্তা একই কথা।

শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন