ন্যায়কণ্ঠ

সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা বাস্তবায়নে কেন এ বিলম্ব?

 ইকতেদার আহমেদ 
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

২৬ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হলেও ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ অবধি বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলদারিত্বে ছিল। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে দখলদারিত্বের অবসান ঘটায় এ দিবসটিকে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় জীবনে এককভাবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দলিল হচ্ছে সে দেশের সংবিধান। সংবিধানে ব্যক্ত করা হয় সার্বভৌম জনগণের পরম অভিপ্রায়। তাছাড়া সংবিধানে বিধৃত থাকে রাষ্ট্রের লক্ষ্যসমূহ এবং জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহের নিশ্চয়তার ঘোষণা। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সংবিধানে বর্ণিত হয়ে থাকে রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান কর্তৃপক্ষের নিয়ামক বিধানাবলি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের বিজয় দিবসের এক বছর পূর্তিতে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়। এর পর বিভিন্ন চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ৪৪ বছরের ইতিহাসে সংবিধানে এ যাবৎকাল পর্যন্ত ১৬টি সংশোধনী আনয়ন করা হয়। এসব সংশোধনীর মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় কতিপয় বিষয়ে পরিবর্তন আনয়ন করা হলেও মৌলিক রাষ্ট্রভাষা বিষয়টি পূর্বাপর অক্ষত থাকে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার নগণ্য সংখ্যক বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। দেশের অপর বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা। দেশের এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে বাংলা ভাষাকে সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা উল্লেখ থাকার কারণে সংবিধান কার্যকর হওয়ার অব্যবহিত পর থেকে কোনো সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কার্যাবলি সম্পাদনে বাংলা ব্যতীত অপর কোনো ভাষা ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, সংবিধান কার্যকর হওয়া পরবর্তী প্রায় ১৫ বছর বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনে ইংরেজির ব্যবহার অব্যাহত থাকে।

বাংলা ভাষা বিষয়ে সংবিধানের অভিপ্রায় এবং সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদের বিধানকে পূর্ণরূপে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ৮ মার্চ ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ কার্যকর করা হয়। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনে ইংরেজির ব্যবহার হ্রাস পেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শূন্যে পৌঁছালেও নিম্ন আদালতের বিচারিক কাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ এবং উচ্চ আদালতের বিচারিক কাজের বৃহদাংশ এখনও ইংরেজিতে সম্পাদিত হচ্ছে। এ বাস্তবতায় সংবিধান এবং বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-এর অবস্থান বিবেচনায় নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতের বিচারিক কার্যাবলি সম্পাদনে ইংরেজি ব্যবহারের অবকাশ আছে কিনা, সেটি প্রণিধানযোগ্য।

বাংলা রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে সংবিধানের অবস্থান ইতিমধ্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখন দেখা যাক, সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-এর অবস্থান কি? বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-এর ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জওয়াব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’ ধারা ৩(২)-এ বলা হয়েছে, ‘৩(১)-এ উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।’

সংবিধানের ১৫২নং অনুচ্ছেদে আদালতের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে- আদালত অর্থ সুপ্রিমকোর্টসহ যে কোনো আদালত। দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচার কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের আদালতগুলোয় দেওয়ানি কার্যবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসৃত হয়ে থাকে। এর বাইরে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগ রুল এবং হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ রুল অনুসৃত হয়ে থাকে।

এ বিষয়ে কোনো দ্বিধা নেই যে, সংবিধানের অবস্থান অন্য যে কোনো আইনের ঊর্ধ্বে। বিশেষ আইনের অবস্থান সাধারণ আইনের ঊর্ধ্বে। পরবর্তীকালে প্রবর্তিত আইনের অবস্থান পূর্ববর্তীকালে প্রণীত আইনের ঊর্ধ্বে এবং যে কোনো ধরনের রুল অর্থাৎ বিধির অবস্থান আইনের নি।

আলোচ্য বিতর্ক নিরসনার্থে দেওয়ানি ও ফৌজাদারি কার্যবিধি এবং সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগ রুলে আদালতের কার্যাবলি সম্পাদনে আদালতের ভাষা সম্পর্কে কী বলা হয়েছে, তা আলোচনা করা আবশ্যক।

দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারা অধস্তন আদালতের ভাষা সংক্রান্ত ধারা নং ১৩৭(১)-এ বলা হয়েছে- অত্র বিধি অর্থাৎ কোড বলবৎ হওয়ার সময় হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন কোনো আদালতের যে ভাষা ছিল, সরকার অন্যরূপ নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত তা উক্ত অধস্তন আদালতের ভাষা হিসেবে প্রচলিত থাকবে। ১৩৭(২)-এ বলা হয়েছে- এরূপ আদালতের ভাষা কী হবে এবং কোন রীতিতে সে আদালতসমূহে আবেদনপত্রসমূহ এবং আদালতের কার্যবিবরণী লিখতে হবে, তা ঘোষণা করার অধিকার সরকারের থাকবে।

১৩৭(৩)-এ বলা হয়েছে- যে ক্ষেত্রে এরূপ কোনো আদালতে সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা ব্যতীত অন্য কিছু লিখিতভাবে সম্পাদন করার জন্য অত্র কোর্ট আদেশ বা অনুমোদন করে, তা ইংরেজিতে লেখা যাবে; কিন্তু কোনো পক্ষ বা তার উকিল যদি ইংরেজি ভাষার সহিত পরিচিত না হন, তবে তার অনুরোধক্রমে আদালতের ভাষায় উক্ত ইংরেজির অনুবাদ তাকে সরবরাহ করা হবে এবং এরূপ ক্ষেত্রে আদালত যেরূপ সঙ্গত মনে করেন, অনুবাদের খরচ সম্পর্কে সেরূপ আদেশ দান করবেন।

দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৮ ধারা সাক্ষ্য ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা সংক্রান্ত ১৩৮(১) ধারায় বলা হয়েছে- হাইকোর্ট বিভাগ সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট বিচারক বা তা না হলে বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষিত বিচারককে এ মর্মে নির্দেশ দিতে পারেন, যেসব মোকদ্দমায় আপিল চলে; সেসব মোকদ্দমায় সাক্ষ্য ইংরেজি ভাষায় ও নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসারে লিপিবদ্ধ করতে হবে। ১৩৮(২) ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো বিচারক পর্যাপ্ত কারণে (১) উপধারায় বর্ণিত নির্দেশ পালনে বাধাপ্রাপ্ত হন, তবে তিনি সে কারণ লিপিবদ্ধ করবেন এবং প্রকাশ্য আদালতে শ্রুতলিপির মাধ্যমে সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করাবেন।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৬ ও ৩৬৭ ধারা বিচারিক আদালতের রায় প্রদানের পদ্ধতি ও রায়ের ভাষা সংক্রান্ত উভয় ধারায় যতটুকু ভাষা বিষয়ে প্রাসঙ্গিক, সে বিষয়ে আলোকপাত আবশ্যক। ধারা নং ৩৬৬ (১)-এ বলা হয়েছে- আদি অধিক্ষেত্রের যে কোনো ফৌজদারি আদালতের প্রতিটি বিচারিক রায় আদালতের ভাষায় অথবা অন্য যে কোনো ভাষায় যা আসামি অথবা তার আইনজীবী বুঝতে সক্ষম, সে ভাষায় ঘোষণা অথবা উক্ত রায়ের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করতে হবে। ধারা নং ৩৬৭ (১)-এ বলা হয়েছে- অনুরূপ সব রায় অত্র বিধির অন্য কোথাও আলাদাভাবে বিবৃত না হলে আদালতে বিচার পরিচালনাকারী কর্মকর্তা স্বহস্তে অথবা তার শ্রুতলিপিতে আদালতের ভাষায় অথবা ইংরেজিতে লিখতে হবে।

হাইকোর্ট বিভাগ রুলে সুনির্দিষ্টভাবে কোন ভাষায় হাইকোর্ট বিভাগের রায় ও সিদ্ধান্ত প্রদান করতে হবে, সে বিষয়ে উল্লেখ না থাকলেও ৪র্থ অধ্যায়ের ১নং বিধিতে বলা হয়েছে- হাইকোর্টে দাখিলকৃত দরখাস্তসমূহের ভাষা হবে ইংরেজি এবং হাইকোর্ট রুলের ৫ম অধ্যায়ের ৬৯নং বিধিতে বলা হয়েছে- হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ এবং ডিক্রি আদালতের ভাষায় প্রস্তুত করতে হবে।

সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ রুল বা অন্য কোনো আইনে পৃথকভাবে আপিল বিভাগ রায় প্রদানের ক্ষেত্রে কোন ভাষা ব্যবহার করবে, সে বিষয়ে কোনো উল্লেখ না থাকলেও আপিল বিভাগ রুলে আদেশ নং VII (২)-এ বলা হয়েছে- এ আদালতের সম্মুখে পরিচালিত বিচারকার্যে বাংলা অথবা ইংরেজি ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় কোনো দলিল প্রদর্শিত বা ব্যবহৃত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা এ বিধি অনুযায়ী অনূদিত না হয়।

বাংলাদেশের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগসহ সাংবিধানিক কতিপয় পদ যেমন- উচ্চ আদালতের বিচারক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্ম কমিশনের সভাপতি ও সদস্যদের নিয়োগ বিষয়ে সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের বিধানাবলির কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রচলন বিষয়ে কোনো আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সংবিধানে অনুপস্থিত। আইন ও সংবিধান বিষয়ে গবেষণা, অধ্যাপনা ও চর্চা করেন- এমন অনেকের অভিমত সংবিধানে সুস্পষ্টরূপে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা উল্লেখ থাকায় সংবিধান কার্যকর হওয়ার তারিখ থেকে সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনে বাংলা ভাষার ব্যবহার অপরিহার্য ছিল। সংবিধানের যে কোনো বিধি-বিধানের প্রতিপালন দেশের যে কোনো নাগরিকের জন্য অবশ্য পালনীয় বিধায় এর ব্যত্যয় আইনের দৃষ্টিতে সংবিধানের লঙ্ঘন ও অসদাচরণ হিসেবে বিবেচিত। তাছাড়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নবসন্নিবেশিত ৭ক (১) (খ)-এর বিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায় এ সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা এটা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে- তার এ কার্য রাষ্ট্রদ্রোহ হবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী হবে। উক্ত অনুচ্ছেদের দফা (২)-এ বলা হয়েছে- এরূপ কার্যে সহায়তাকারী ব্যক্তি সমঅপরাধে অপরাধী হবে। সংবিধানের সুস্পষ্ট বিধানের প্রতিপালনকে সর্বাঙ্গীন করার মানসে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ প্রণয়নের আবশ্যকতা দেখা দেয়। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-এর ধারা ৩(১) ও ৩(২)-এর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জওয়াব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলি আবশ্যিকভাবে বাংলায় সম্পাদন করতে বলা হয়েছে। কোনো কর্মস্থল অর্থাৎ সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কোনো ব্যক্তি বাংলা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করলে তা বেআইনি ও অকার্যকর হবে মর্মে উল্লেখ থাকায় এ আইন প্রবর্তনের পর কোনো কর্মস্থলে বাংলা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় কার্যাবলি সম্পাদিত হয়ে থাকলে তাকে আইনানুগ ও কার্যকর বলার অবকাশ আছে কিনা, এ বিতর্কের সুরাহা হওয়া জরুরি।

দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি এবং সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ রুলে ক্ষেত্রবিশেষে ইংরেজি ও আদালতের ভাষা ব্যবহারের উল্লেখ থাকায় অনেকের অনুসন্ধিৎসু প্রশ্ন উপরোক্ত আইন ও রুল সংবিধান এবং বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-কে অতিক্রম (Override) করে কিনা? বাংলা ভাষা প্রচলন আইনে ব্যবহৃত আদালত শব্দটি সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের আলোকে ব্যাখ্যা করলে সুপ্রিমকোর্টসহ দেশের সব আদালত বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-এ উল্লিখিত ‘আদালত’-এর অন্তর্ভুক্ত। আর অতিক্রম বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন হওয়ায় বাংলা ভাষা ব্যবহার বিষয়ে অন্য কোনো আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সে আইন অকার্যকর হবে। অনুরূপভাবে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ কার্যকর হওয়ার পর উক্ত আইনে উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে বাংলা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় কোনো কার্য সম্পাদন হয়ে থাকলে উক্ত কার্য এ আইনের কার্যকারিতায় আপনাআপনিভাবে বেআইনি ও অকার্যকারিতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গেছে। অনেককে এমন প্রশ্ন করতেও শোনা যায়- বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-তে হেফাজতকারী বিধান (Saving clause) না থাকায় এ আইন কার্যকর হওয়ার সময় আইনে উল্লিখিত কর্মস্থলে বাংলা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষা যথা ইংরেজিতে গৃহীত কার্যধারার পরিণতি কী? সংবিধান ও আইনের খসড়া প্রণয়ন বিষয়ে পারদর্শী এমন ব্যক্তিরা অভিমত প্রকাশ করেছেন- সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা উল্লেখ থাকায় পরবর্তীকালে প্রণীত অন্য কোনো আইনে বাংলা ভাষা ব্যবহার বিষয়ে হেফাজতকারী বিধান দেয়া হলে তা প্রচ্ছন্নভাবে সংবিধানের অবমাননা হিসেবে বিবেচিত হতো।

উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট, বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭-এ উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে বাংলা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় কোনো কার্যাবলি গ্রহণ বা পরিচালনা করা হলে তা যে বেআইনি ও অকার্যকর, সে বিষয়ে সব ধরনের বিভ্রান্তি অপনোদনে সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করেছে। এ বাস্তবতায় আমাদের কাম্য হোক- বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-এ উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে বাংলা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষা ব্যবহারের সপক্ষে যেন কোনো যুক্তির অপপ্রয়াসে দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের নির্দেশনা বাস্তবায়ন আর বিলম্বিত না হয়।

ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

iktederahmed@yahoo.com

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন