অনলাইনে উচ্চশিক্ষা ও বাস্তবতা
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২০, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনা মহামারীর কারণে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সীমিত আকারে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বৈশ্বিক মহামারীর সময় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
যদিও সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অনলাইনে পুরোপুরি একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। নতুন এ সংকট শুরু হওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কিছুসংখ্যক কোর্স অনলাইনভিত্তিক থাকা উচিত ছিল।
যা হোক, করোনা মহামারীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার ওপর করোনার প্রভাব কম। মহামারী ছাড়াও সাধারণত আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ক্লাসরুম শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাও চালু রয়েছে।
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তিনটি সেমিস্টারে- স্প্রিং(জানুয়ারি থেকে এপ্রিল), সামার (মে থেকে জুলাই) এবং ফল (আগস্ট থেকে ডিসেম্বর) একটি বছর সম্পন্ন হয়। ছাত্র ভর্তি, কোর্স অফার, কোর্স এনরোলমেন্ট, ছাত্রদের ডরমেটরি বরাদ্দ ও লাইব্রেরি থেকে বই সংগ্রহসহ সব কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইনে সম্পাদিত হয়।
যদি কোনো ইনস্ট্রাকটর অব ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিনের জন্য গবেষণার উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেন, তাহলে ওই ইনস্ট্রাকটর অনলাইনে কোর্স অফার করে থাকেন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা ওই কোর্সটি এনরোলমেন্ট করবে, তারা অন ক্যাম্পাসে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভার্চুয়াল ক্লাসরুম ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে কোর্সটিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
অপরদিকে অনেক গ্রাজুয়েট ছাত্রছাত্রী মেজর প্রফেসরের নির্দেশে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা স্টেশনে দীর্ঘদিন অবস্থান করে। ওই গ্রাজুয়েট ছাত্রছাত্রীরা গবেষণা স্টেশনের ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের মাধ্যমে অনলাইনে কোর্স সম্পন্ন করে থাকে। এই সিস্টেমে দেখা যাচ্ছে, অন ক্যাম্পাস ও অব ক্যাম্পাস উভয় জায়গায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটের সংযোগসহ বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে।
ফলে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মহামারীর প্রভাবে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা খুবই কম। উল্লেখ্য, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স ক্রেডিট ঘণ্টা চালু রয়েছে। মোটা দাগে বলা যায়, ফ্লেক্সিবল কোর্স ক্রেডিট ঘণ্টা পদ্ধতিতে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ও গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, চার বছরের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে ছাত্রছাত্রীদের সর্বনিম্ন ১২০ ক্রেডিট ঘণ্টা সম্পন্ন করতে হয়। ছাত্রছাত্রীদের দুই সেমিস্টারে মোট ৩০ ক্রেডিট ঘণ্টা এনরোলমেন্ট করতে হয়। প্রতিটি কোর্স রেঞ্জ ১-৫ ক্রেডিট ঘণ্টা পর্যন্ত (ব্যবহারিকসহ) থাকতে পারে। প্রতি সপ্তাহে ১-৩ ক্রেডিট ঘণ্টা- একটি কোর্সের কমপক্ষে ১-৩ ঘণ্টার ক্লাস থাকতে হবে।
আবার ৩-৪ ক্রেডিট ঘণ্টার একটি কোর্সের ক্লাসের বাইরে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ৬-১২ ঘণ্টা বিষয়ভিত্তিক অতিরিক্ত কাজ থাকতে পারে। উল্লেখ্য ৩ ক্রেডিট ঘণ্টার একটি কোর্সের প্রতি সেমিস্টারে প্রায় ৪০টি ১ ঘণ্টার ক্লাস সম্পন্ন করতে হয়।
ওই সেমিস্টারের মধ্যে পরীক্ষা গ্রহণসহ মূল্যায়ন সম্পন্ন করে ইনস্ট্রাকটরকে গ্রেড রিপোর্ট জমা দিতে হয়। আবার গ্রেড রিপোর্ট অনলাইনের ট্রান্সক্রিপ্টে দৃশ্যমান হয় না, যদি ছাত্রছাত্রী কর্তৃক ইনস্ট্রাকটরদের কোর্স মূল্যায়নের রিপোর্ট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা না হয়।
করোনা মহামারীর কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, দেরিতে হলেও সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে নজর দেয়া উচিত।
বিষয়গুলো হল- অনলাইনে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি কার্যক্রম, ছাত্রছাত্রীদের নির্দিষ্ট আইডি ও পাসওয়ার্ড, অনলাইনে কোর্স অফার, পরীক্ষাগ্রহণ ও মূল্যায়ন, অনলাইনে গ্রেড রিপোর্ট জমাসহ ছাত্রছাত্রীদেরও ইনস্ট্রাকটরদের ক্লাস মূল্যায়নের রিপোর্টটিও অনলাইনে জমা দিতে হবে। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করার জন্য দরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট, সার্ভার সিকিউরিটি ও ভার্চুয়াল ক্লাসরুম।
আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ক্যাম্পাসটি হতে হবে শতভাগ আবাসিক। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি কোর্স অফারিং প্ল্যানটি হতে হবে ফ্লেক্সিবল মোডে। এখানে মোটা দাগে বলা যেতে পারে, কোর্স সংখ্যা যা-ই অফার হোক না কেন, ছাত্রছাত্রীরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মধ্যে থেকে আবশ্যক ও অনাবশ্যক কোর্সগুলো এনরোল করে প্রতি সেমিস্টারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ক্রেডিট ঘণ্টা সম্পন্ন করতে পারবে।
বর্তমানে আধুনিক ইন্টারনেটের যুগে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট রয়েছে। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বারদেরও রয়েছে ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় ব্যক্তিগত ডাটা আপডেট কম। এর মূল কারণ হল শিক্ষকদের ক্লাসরুমে শিক্ষাদান ও পার্টটাইম অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার চাপ। এসব বিষয়ের যুক্তিসঙ্গত সমাধান হওয়া উচিত।
আবার বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সংখ্যাও দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এগুলোর অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান সীমাবদ্ধতা হল প্রাইভেসির জন্য হুমকি।
অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সব শিক্ষা উপকরণ একটি নির্দিষ্ট সিকিউর্ড ওয়েবসাইটে ডকুমেন্ট আকারে থাকতে হবে। ওই ডকুমেন্টগুলোয় কেবল ফ্যাকাল্টি মেম্বার ও ছাত্রছাত্রীরাই আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে। করোনা মহামারী শিক্ষা খাতের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। বর্তমানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম বলা যায় স্থবির হয়ে আছে। এমতাবস্থায় বিশ্বের উন্নত দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফ্রন্টলাইনে আসতে হবে।
বিশ্বের উন্নত দেশের মতো স্বীকৃত অনলাইন পদ্ধতিতে বাংলাদেশেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম, ফ্লেক্সিবল মোডে কোর্স অফার, এনরোলমেন্ট, পরীক্ষার মূল্যায়ন ও গ্রেড রিপোর্ট জমা প্রদানসহ অন্য সব কার্যক্রম পরিচালনা করা অতি জরুরি। এক্ষেত্রে কোভিড-১৯ মহামারী শেষ হয়ে গেলেও কমপক্ষে ২০ শতাংশ কোর্স বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে অফার হওয়া উচিত।
পাশাপাশি নেটওয়ার্ক বেস্ড কোলাবোরেটিভ গবেষণা, শিক্ষক নিয়োগ ও গবেষণার জন্য উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কমিশন গঠনসহ প্রতিটি শিক্ষকের বছরভিত্তিক গবেষণার কমিটমেন্ট থাকতে হবে। ওই বিষয়গুলোর সঠিক বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের প্রণোদনাসহ গবেষণা ও শিক্ষা সহায়ক ফান্ড দরকার। শিক্ষকদের বিশেষ গবেষণার জন্য গবেষণা ভাতাসহ প্রকাশনার ফি ও বরাদ্দ থাকতে হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন ও শিক্ষকদের প্রমোশনের ক্ষেত্রে দরকার স্বচ্ছতা। এক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষক জানতে পারবেন সহকর্মীদের যোগ্যতা। প্রকল্পের ক্ষেত্রে গবেষণা শিরোনামের নোবেলিটিসহ চূড়ান্ত ফান্ড প্রদানের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা আনয়ন নিশ্চিত করা জরুরি। কোভিড-১৯ যতই অভিশাপ হোক না কেন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে ভবিষ্যতের মহামারী মোকাবেলাসহ উচ্চশিক্ষায় গুণগত গবেষণার দ্বার উন্মোচনে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও ফ্রন্টলাইনে আসতে হবে।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : সহযোগী অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
mohammad.alam@wsu.edu