নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

 আফিয়া খাতুন 
২৭ নভেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

কন্যাশিশু জন্মগ্রহণ করলে পরিবারের অনেক সদস্যই তা সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। বর্তমান যুগেও অনেক শিক্ষিত পরিবারের মধ্যে এ ধরনের মানসিকতা দেখা যায়। ইসলামপূর্ব আরব দেশে নারীকে এতটাই ঘৃণা ও অপ্রয়োজনীয় মনে করা হতো যে, সে সময় নারীশিশু জন্মগ্রহণ করলে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। বস্তুত নারী ও পুরুষ উভয়ের সমন্বয়েই সমাজ গড়ে উঠেছে। সমাজে নারী ও পুরুষ উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই।

এমন একটা সময় ছিল, যখন সমাজের নানা বাধানিষেধ ও প্রতিবন্ধকতার জন্য নারীদের গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হতো। সন্তান প্রতিপালন ও গৃহস্থালি কাজেই তাদের ব্যস্ত থাকতে হতো। কিছুদিন আগেও কোনো কোনো নারীও চাইত না নারীরা ঘরের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা বা চাকরি করুক। ওই সময়ে অল্পবয়সি নারীদের বিয়ে দেওয়া হতো। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এ যুগের কোনো কোনো বয়স্ক নারী এখনো বলে থাকেন, ঘরের মেয়ে-বৌদের গৃহবন্দি হয়ে থাকাই উত্তম। এ যুগের মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষা ও বিভিন্ন কাজকর্মে কতটা অগ্রসর সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। এ ধরনের মা, শাশুড়ি, নানি, দাদিরা নানাভাবে নারীদের অত্যাচার করে থাকেন। তাদের দেখে হয়তো বলা যায়, নারীরাই নারীর শত্রু। তারা নারীদের উন্নতি চান না। কিন্তু তাদের মতামতে সমাজ চলতে পারে না। এ যুগে শহর ও গ্রামে প্রায় প্রত্যেক পিতামাতাই আশা করেন তার পুত্রসন্তানের মতো কন্যাসন্তানটিও লেখাপড়া করে মানুষ হয়ে সমাজের যোগ্য হয়ে উঠুক।

বর্তমানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নারীশিক্ষার প্রসার ঘটছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও নারীদের আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে এবং শিক্ষাসহ কর্মক্ষেত্রে ও সর্বস্তরে পুরুষের পাশাপাশি মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতায় নারীরাও এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিককালে শহর ও গ্রামাঞ্চলে অপরাধপ্রবণতা ও নারীর ওপর যৌন নির্যাতন এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সব অভিভাবকই নারীশিশুর নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। ৬-৭ বছরে কন্যাশিশুও অপহৃত ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নিরাপত্তার অভাবে অনেক অভিভাবক তাদের কন্যাটির বিদ্যালয়ে শিক্ষা প্রদান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন এবং অনেকে কিশোরী মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। অথচ ১৮ বছরের নিচে মেয়ের বিয়ে দেওয়া বাংলাদেশের আইনে নিষিদ্ধ।

নারীরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও অনেক সময় নির্যাতিত হচ্ছেন। অথচ গার্মেন্ট শিল্পে বাংলাদেশের নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন, যা সমগ্র বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। জীবিকার জন্য সবারই কর্মসংস্থানের প্রয়োজন। অনেক নারী উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে গৃহকর্মীর কাজ করে থাকেন। অথচ সেখানেও অনেক নারী ও কিশোরী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অভিভাবকরা শঙ্কিত ও নিরুপায় হয়ে তাদের কন্যাটির বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ে দিতে চাইলেও সমস্যা-এ ক্ষেত্রে যৌতুক প্রদান করতে হয়। বাংলাদেশে যৌতুক প্রথাটি এসেছে হিন্দু সমাজের সামাজিক প্রথা থেকে। হিন্দুধর্মের কন্যাসন্তান পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না, যে কারণে বিয়ের সময় পাত্রপক্ষ যৌতুক দাবি করে কন্যার পিতার কাছ থেকে কিছু অর্থ বা সম্পদ হাতিয়ে নেয়। এ নিয়মটি বাংলাদেশেও প্রচলিত আছে। এটি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার জন্য এক বিরাট সমস্যা; বিশেষত দরিদ্র, অশিক্ষিত পরিবারে এ নিয়মটি বেশি দেখা যায়। সম্প্রতি ভারতে হিন্দুধর্মের সম্পত্তি সংক্রান্ত এ আইনটি নাকি পরিবর্তিত হয়েছে। এখন মেয়েরাও পুত্রের মতোই পিতার সম্পত্তির সমান অংশীদারি হবে।

মুসলিম পারিবারিক আইনে কোনো ব্যক্তির পুত্রসন্তান না থাকলে তার মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্ররা ওই ব্যক্তির সম্পত্তির কিছুটা অংশের মালিক হয়ে যায়। এ কারণে কোনো ব্যক্তির যদি একাধিক কন্যাসন্তানও থাকে, তবুও সে একটি পুত্রসন্তানের আশায় বারবার সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে। এতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কিছুটা বাধার সৃষ্টি হয়। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু ভূমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো পরিবার সামান্য পরিমাণ ভূমি নিয়ে যেখানে নিজেরাই সংসার ও পরিবারের ব্যয় বহন এবং জীবিকা নির্বাহ করতে পারে না, সেখানে ভ্রাতুষ্পুত্রদের সম্পত্তির অংশ ভাগ করে দিলে তাদের জীবনযাপন আরও কষ্টকর হয়ে যায়। এসব দিক বিবেচনা করে এ আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে উইল প্রথা চালু বা প্রবর্তন করলে পুত্রসন্তান না থাকলে ওই ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় তার পরিবার অথবা অন্য কাউকে ইচ্ছামতো সম্পত্তি দান করে দিতে পারেন। এতে ভূমির মালিক নিজে এবং তার স্ত্রী-কন্যারাও নিশ্চিন্ত হতে পারেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে উইল প্রথা চালু আছে।

বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক অভিভাবক ও পাত্রপক্ষের একটি বিষয়ে দুর্বলতা আছে। তা হলো, সবাই ফর্সা ও সুন্দর পাত্রপাত্রী পছন্দ করেন। পাত্রের বেলায় গায়ের রং শিথিলযোগ্য হলেও পাত্রী বা পুত্রবধূ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ফর্সা ও সুন্দরী পাত্রীই পছন্দনীয় ও যোগ্য বলে প্রাধান্য দিয়ে থাকে প্রায় সব পরিবার। এখনো এ মতামত বা চিন্তাটি প্রায় সবার মধ্যেই বিদ্যমান আছে। কাজেই প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় কালো মেয়ের বা পাত্রীর গ্রহণযোগ্যতা কম থাকায় তাদের পিতামাতাকে বেশি করে যৌতুক প্রদান করতে হচ্ছে।

কিছুদিন আগেও অনেকেই পুত্রবধূ নির্বাচন করতে গিয়ে কিশোরী মেয়ে বা ১২-১৩ বছরের কন্যাকে পছন্দ করত। তারা বলত, মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি। এ ধরনের নিম্নস্তরের মানসিকতা এখনো অশিক্ষিত, দরিদ্র ও অবিবেচক কিছু ব্যক্তি ও পরিবারের মধ্যে দেখা যায়। এ কারণেও অনেক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতা কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজে কন্যাদায়মুক্ত হতে চান। একে অন্যায় বলে মনে করেন না। তবে বর্তমানে এ ধারণায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।

বর্তমান বিশ্বে চলছে কর্মদক্ষতার প্রতিযোগিতা। উন্নত বিশ্বে প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা দেখিয়ে এগিয়ে যেতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, বিজ্ঞান- সব ক্ষেত্রে জ্ঞানী ব্যক্তিরা নতুন কিছু করার জন্য অবিরাম গবেষণা ও চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তারা তাদের গবেষণা দিয়ে মানবজাতিকে আরও নতুন কিছু দিতে চান, যাতে মানবজাতি ও বিশ্বসমাজ আরও উপকৃত হয়। কাজেই গুণ দিয়েই মানুষকে বিচার করতে হবে। বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রপাত্রীর গায়ের রঙ ফর্সা হতে হবে- এমন চিন্তা বদলাতে হবে।

সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব পিতামাতা উভয়ের থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকাই মুখ্য বলা যায়। মায়েরাই সন্তানের আদর-যত্ন করেন বেশি। তবে শুধু আদর-যত্ন করলেই হবে না, কিশোর ও তরুণ বয়সের পুত্রসন্তানকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। সন্তান নারী নির্যাতন, ইভটিজিং, মাদকাসক্তের দিকে যাচ্ছে কিনা, অসৎ বা বখাটে বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করছে কিনা-এসব দিকে খেয়াল রাখতে হবে। পুত্রসন্তান যদি সঠিক পথে পরিচালিত হয়, তবে সমাজে নারীশিশুর চলার পথে কোনো বাধাবিপত্তি থাকবে না। কারণ ছেলেরাই নারীকে যৌন নির্যাতন করে।

জীবিকার তাগিদে নারী-পুরুষ সবাইকে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয় এবং নানা বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হয়। সমাজে সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার জন্য কিশোরী ও তরুণীদের নিজেদের যোগ্য করে তোলার ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। সরকার, সমাজ, অভিভাবক-সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে এগুলো পর্যবেক্ষণ করে নারী নির্যাতন বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখিকা: সাবেক প্রধান শিক্ষক, এলিমেন্টারি স্কুল, ঢাকা

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন