সবার মাঝে সবুজ সম্প্রীতি
প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর আমাদের মহান রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদের জন্মবার্ষিকীর এ দিনটিতে থাইল্যান্ডের জাতীয় দিবস উদ্যাপিত হয়। অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় এ রাজা ২০১৬ সালে পরলোকগমন করেছেন। থাইল্যান্ডের মানুষ দিবসটিকে তাদের পিতা মহাময়ের অনুগ্রহের স্মরণে জাতীয় দিবস এবং বাবা দিবস হিসাবে পালন করে আসছে।
দুই বছর ধরে করোনা মহামারির কারণে আমরা সশরীরে বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করা থেকে বিরত আছি। এমন বাস্তবতায় কোনো গণজমায়েত আয়োজন করার কথা ভাবাই যায় না। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, বিশ্বব্যাপী এ সংকট আমাদের সবাইকে সমানভাবে প্রভাবিত করেছে এবং তা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবে এ গুরুতর ও কঠিন সময়ের পরিবর্তন আসছে, তাতে আমাদের প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে আমাদের স্থিতিস্থাবকতা শক্তিশালী করার মাধ্যমে অন্যান্য সম্ভাব্য বাধা মোকাবিলা করতে হবে, যা বিভিন্ন আকারে আবির্ভূত হতে পারে; যেমন: জলবায়ু পরিবর্তন, সম্পদের স্বল্পতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর মানে একই সময়ে আমাদের উচিত ক্রমবর্ধমান ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের প্রতিটি দিক স্থায়িত্বের দিকে ধাবিত করা।
এ লক্ষ্যে থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারে। থাইল্যান্ড তার বিদ্যমান সম্পদ আরও সুসংগঠিতভাবে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বায়ো-সারকুলার-গ্রিন (বিসিজি) সবুজ জৈবচক্র অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একই সময়ে বাংলাদেশও মুজিব জলবায়ু উন্নয়ন পরিকল্পনা নামে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ গ্রহণ করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা। অধিকন্তু, বাংলাদেশ চিত্তাকর্ষকভাবে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং দৃঢ়কণ্ঠে ঠ২০-তে জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়নে তার উদ্বেগ ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করছে। অতএব উভয় দেশ নিজেদের মধ্যে একটি ‘সবুজ সম্প্রীতি’ গড়ে তোলার পাশাপাশি মানুষ ও পৃথিবীর জন্য ভারসাম্যপূর্ণ টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
যেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে, থাইল্যান্ডও অধীর আগ্রহের সঙ্গে ২০২২-এর দিকে তাকিয়ে আছে, যখন অসংখ্য দ্বিপাক্ষিক বৈঠক এবং সফর আয়োজনের সুযোগ রয়েছে। এ বছরের জুলাই থেকে থাইল্যান্ড পর্যায়ক্রমে বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের জন্য ২০২১ সালের ১ নভেম্বর থেকে সব ধরনের ভিসার নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছে, যাতে দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি এ নতুন স্বাভাবিক অবস্থায় পুনঃস্থাপিত হয়।
করোনার প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং থমকে যাওয়ার আগে থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উভয় পক্ষই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও সক্রিয়ভাবে বাণিজ্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। একটি দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বিবেচনাধীন অবস্থায় থাইল্যান্ডের আন্দামান উপকূল এবং বঙ্গোপসাগরের মধ্যে আরও সাশ্রয়ী সমুদ্র পরিবহণব্যবস্থা চালুর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ নতুন সংযোগ স্থাপনে থাইল্যান্ড ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের মধ্যে জোরালো সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
২০২২ সালে থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ তাদের মাঝে ৫০ বছরের দীর্ঘ কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করবে। দুটি রাষ্ট্রই নিজেদের জনগণের কল্যাণসাধনের লক্ষ্যে বিগত পাঁচ দশক ধরে উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে আসছে। থাইল্যান্ড অন্যতম বন্ধুরাষ্ট্র যে বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ১৯৭২ সালের ৫ অক্টোবর। তখন থেকেই উভয় দেশের মধ্যে বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন মাত্রায় সহযোগিতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে ২০১৩ সালে শুরু করা প্রযুক্তিগত সহযোগিতার মধ্য দিয়ে।
যদিও মহামারি অবস্থায় মানবজাতি অনেক সম্ভাবনা ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তা সত্ত্বেও আমাদের নিরাশ না হয়ে বেঁচে থাকার জন্য এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। নিশ্চয়ই এ কঠিন পরিস্থিতি থেকে স্থায়ী মুক্তির পথ খুঁজে বের করা অত্যন্ত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। তবুও পারস্পরিক ঐক্যের ভিত্তিতে দৃঢ়ভাবে আমাদের জ্ঞান ও সক্ষমতার পুনর্ব্যবহার করতে পারলে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারব। তাই থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের মূলভাব হতে পারে ‘সবার মাঝে সবুজ সম্প্রীতি’।
মাকাওয়াদি সুমিতমোর : বাংলাদেশে নিযুক্ত থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সবার মাঝে সবুজ সম্প্রীতি
প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর আমাদের মহান রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদের জন্মবার্ষিকীর এ দিনটিতে থাইল্যান্ডের জাতীয় দিবস উদ্যাপিত হয়। অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় এ রাজা ২০১৬ সালে পরলোকগমন করেছেন। থাইল্যান্ডের মানুষ দিবসটিকে তাদের পিতা মহাময়ের অনুগ্রহের স্মরণে জাতীয় দিবস এবং বাবা দিবস হিসাবে পালন করে আসছে।
দুই বছর ধরে করোনা মহামারির কারণে আমরা সশরীরে বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করা থেকে বিরত আছি। এমন বাস্তবতায় কোনো গণজমায়েত আয়োজন করার কথা ভাবাই যায় না। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, বিশ্বব্যাপী এ সংকট আমাদের সবাইকে সমানভাবে প্রভাবিত করেছে এবং তা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবে এ গুরুতর ও কঠিন সময়ের পরিবর্তন আসছে, তাতে আমাদের প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে আমাদের স্থিতিস্থাবকতা শক্তিশালী করার মাধ্যমে অন্যান্য সম্ভাব্য বাধা মোকাবিলা করতে হবে, যা বিভিন্ন আকারে আবির্ভূত হতে পারে; যেমন: জলবায়ু পরিবর্তন, সম্পদের স্বল্পতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর মানে একই সময়ে আমাদের উচিত ক্রমবর্ধমান ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের প্রতিটি দিক স্থায়িত্বের দিকে ধাবিত করা।
এ লক্ষ্যে থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারে। থাইল্যান্ড তার বিদ্যমান সম্পদ আরও সুসংগঠিতভাবে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বায়ো-সারকুলার-গ্রিন (বিসিজি) সবুজ জৈবচক্র অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একই সময়ে বাংলাদেশও মুজিব জলবায়ু উন্নয়ন পরিকল্পনা নামে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ গ্রহণ করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা। অধিকন্তু, বাংলাদেশ চিত্তাকর্ষকভাবে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং দৃঢ়কণ্ঠে ঠ২০-তে জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়নে তার উদ্বেগ ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করছে। অতএব উভয় দেশ নিজেদের মধ্যে একটি ‘সবুজ সম্প্রীতি’ গড়ে তোলার পাশাপাশি মানুষ ও পৃথিবীর জন্য ভারসাম্যপূর্ণ টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
যেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে, থাইল্যান্ডও অধীর আগ্রহের সঙ্গে ২০২২-এর দিকে তাকিয়ে আছে, যখন অসংখ্য দ্বিপাক্ষিক বৈঠক এবং সফর আয়োজনের সুযোগ রয়েছে। এ বছরের জুলাই থেকে থাইল্যান্ড পর্যায়ক্রমে বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের জন্য ২০২১ সালের ১ নভেম্বর থেকে সব ধরনের ভিসার নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছে, যাতে দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি এ নতুন স্বাভাবিক অবস্থায় পুনঃস্থাপিত হয়।
করোনার প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং থমকে যাওয়ার আগে থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উভয় পক্ষই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও সক্রিয়ভাবে বাণিজ্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। একটি দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বিবেচনাধীন অবস্থায় থাইল্যান্ডের আন্দামান উপকূল এবং বঙ্গোপসাগরের মধ্যে আরও সাশ্রয়ী সমুদ্র পরিবহণব্যবস্থা চালুর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ নতুন সংযোগ স্থাপনে থাইল্যান্ড ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের মধ্যে জোরালো সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
২০২২ সালে থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ তাদের মাঝে ৫০ বছরের দীর্ঘ কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করবে। দুটি রাষ্ট্রই নিজেদের জনগণের কল্যাণসাধনের লক্ষ্যে বিগত পাঁচ দশক ধরে উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে আসছে। থাইল্যান্ড অন্যতম বন্ধুরাষ্ট্র যে বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ১৯৭২ সালের ৫ অক্টোবর। তখন থেকেই উভয় দেশের মধ্যে বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন মাত্রায় সহযোগিতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে ২০১৩ সালে শুরু করা প্রযুক্তিগত সহযোগিতার মধ্য দিয়ে।
যদিও মহামারি অবস্থায় মানবজাতি অনেক সম্ভাবনা ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তা সত্ত্বেও আমাদের নিরাশ না হয়ে বেঁচে থাকার জন্য এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। নিশ্চয়ই এ কঠিন পরিস্থিতি থেকে স্থায়ী মুক্তির পথ খুঁজে বের করা অত্যন্ত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। তবুও পারস্পরিক ঐক্যের ভিত্তিতে দৃঢ়ভাবে আমাদের জ্ঞান ও সক্ষমতার পুনর্ব্যবহার করতে পারলে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারব। তাই থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের মূলভাব হতে পারে ‘সবার মাঝে সবুজ সম্প্রীতি’।
মাকাওয়াদি সুমিতমোর : বাংলাদেশে নিযুক্ত থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত