এবারের নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হতে হবে
jugantor
দেশপ্রেমের চশমা
এবারের নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হতে হবে

  মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার  

১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশে নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কোনো রকম নির্বাচনই আর অহিংস ও দুর্নীতিমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনগুলো অবিতর্কিত ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনগুলোতে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। তবে সেনাসমর্থিত এবং অসাংবিধানিক ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীন সরকার আমলে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাহ্যিকভাবে ওই নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাস-সহিংসতা দৃশ্যমান না হলেও নির্বাচনটিতে গৃহীত ভোটের পরিসংখ্যানই ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির সাক্ষ্য দেয়। কারণ, স্বাভাবিক সময়ে কেবল স্থানীয় সরকার নির্বাচন (ইউপি, উপজেলা, সিটি করপোরেশন) প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে ৬৮, ৭০, ৭৫ শতাংশ বা এর কম-বেশি ভোট পড়তে দেখা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চেয়ে কম। অথচ নবম সংসদ নির্বাচনে অফিসিয়াল কাস্টিং রেট হচ্ছে ৮৬.৩৪ শতাংশ, যা অন্যায়ভাবে ‘না’ এবং ‘বাতিল’ ভোট বাদ দিয়ে হিসাব করে দেখানো হয়েছে। ওই দুরকম ভোটসহ কাস্টিং রেট ৮৭.৬০ শতাংশ, যার মধ্যে পাঁচটি আসনে ৯৫ শতাংশ বা তার বেশি, ১৯টি আসনে ৯৪ শতাংশ বা তার বেশি এবং ৯৪টি আসনে ৯০ শতাংশ বা তার বেশি ভোট কাস্ট হয় (বাংলাদেশি নির্বাচন, খুলনা : অধ্যয়ন পরিষদ, ২০২১, পৃষ্ঠা-১৪২)। এ থেকে অনুধাবন করা যায়, ওই নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ হয়েছিল।

পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করে এককভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা চালু করার পর সংসদ নির্বাচন আর স্বচ্ছ হয়নি। এমন নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদলীয় প্রার্থীদের জয়ী হতে অসুবিধা হয়নি। দলীয় ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে দুটি নতুন কলঙ্কের পাতা যোগ করে। দশম নির্বাচনে জনগণ প্রত্যক্ষ করেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ক্ষমতাসীন দলের ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন সুনিশ্চিত করেন। আর একাদশ সংসদ নির্বাচনে তো নির্বাচনের আগের রাতে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা পোশাকধারী বাহিনী ও প্রিসাইডিং অফিসারদের আয়ত্তে নিয়ে ভোটের কাজ এগিয়ে রাখেন। ফলে পরপর এমন দুটি নির্বাচন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করে।

এ হারানো ভাবমূর্তি উদ্ধার করার জন্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দুর্নীতিমুক্ত ও ইনক্লুসিভ করা ছাড়া সরকারের কাছে অন্য কোনো বিকল্প নেই। আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে যে এমন ইনক্লুসিভ নির্বাচন করা যাবে না, সে বিষয়টি একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন হবে একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার। অথচ, সরকার এখন পর্যন্ত এমন একটি স্বল্পায়ুর নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পরিবর্তে, ক্ষমতাসীন দল আরও একটি ফন্দি-ফিকিরের নির্বাচন করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে সচেষ্ট বলে লক্ষণদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে। কোনো কোনো মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে গেছে। ওটা ভুলে যান। আওয়ামী লীগই হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যে সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’

চলমান ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা দেখে অনুধাবন করা যায়, সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হলে কী অবস্থা হবে। কারণ, ইউপি নির্বাচনে অনেক বড় দল অংশগ্রহণ করছে না। কেবল ক্ষমতাসীন দল এবং এর বিদ্রোহী প্রার্থীরা যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, সেখানেই ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় ইতোমধ্যে বিজিবি সদস্যসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রাণহানি ঘটেছে। এ খুনের দায় যেমন কেউ নিচ্ছে না, তেমনি এর বিচারও হচ্ছে না। উল্লেখ্য, ইউপি নির্বাচনে সব আসন জিতলেও কোনো দল সরকার গঠন করতে পারবে না। এ সত্য জানার পরও যেখানে সহিংসতার মাত্রা এমন, সেখানে যে নির্বাচন জিতলে সরকার গঠন করা যাবে, তেমন সংসদ নির্বাচন যদি দলীয় সরকারাধীনে হয়, তাহলে ওই নির্বাচনে সহিংসতা কেমন উচ্চতায় পৌঁছাবে তা অনুমেয়।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়ার দিকে পরাশক্তিধর দেশগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে। এবার ক্ষমতাসীনদের জন্য গত দুবারের মতো ফন্দি-ফিকিরের নির্বাচন করে পার পাওয়া কঠিন হতে পারে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘসহ পরাশক্তিধর কতিপয় রাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ শুরু করেছে। এ লক্ষ্যে মাঠের প্রধান বিরোধী দলও নিজেদের নেতাকর্মীদের চাঙা করে মাঠে নামার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মামলা-হামলায় পর্যুদস্ত বিএনপি অনেকটা দুর্বল। তারপরও দলটি সমাবেশ ডাকলে মানুষের সমাগম হচ্ছে। এটি যে বিএনপির জনপ্রিয়তার লক্ষণ এমন না-ও হতে পারে। আসলে বিবেকবান নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক আচরণ, সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি, গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়া ও দুর্নীতির ব্যাপক প্রসারের কারণে সরকারের ওপর নাখোশ হয়ে উঠেছেন।

একটি দল পরপর তিন মেয়াদ ক্ষমতায়। এ তিন মেয়াদ যে তারা জনগণের প্রকৃত সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় রয়েছেন এমনও নয়। এজন্য গণতন্ত্রপ্রেমী নাগরিকদের অনেকে সরকারের ওপর খুশি নন। তাদের অনেকে ভয়ে কথা না বললেও সরকারি দলের ওপর ক্ষুব্ধ। বিএনপি নিজদলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে এদেরও দলীয় কর্মসূচিতে ভেড়াতে পারছেন বলেই হয়তো দলটির আহূত সমাবেশে লোক সমাগম হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে মনে হয়, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না করলে সরকারকে গণতান্ত্রিক বিশ্বে কোণঠাসা হয়ে পড়তে হবে। বিষয়টি সরকারও বুঝতে পেরেছে। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের সরকারদলীয় জনসভায় বলেছেন, ‘ভোট চুরি করলে জনগণ তাদের ছেড়ে দেয় না। বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে অতীতে যারা ছিনিমিনি খেলেছে, তাদের শাস্তি হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ক্ষমতা থেকে হটিয়েছে।’

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য এবং দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে সরকারকে কতিপয় জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে সবার আগে সরকারকে সমাজে একটি নির্বাচনি পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কারণ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও সহিংসতাময় পরিবেশে ভালো নির্বাচন করা যায় না। সামাজিক অস্থিরতা দূর করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের যে সদিচ্ছা আছে সে বিষয়টি জনগণকে এখনই জানিয়ে দিতে হবে। এ লক্ষ্যে একটি ঘোষণাই জনমনে স্বস্তি আনতে সক্ষম। সরকার যদি বলে, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে এবং এজন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তাহলে তাতে সমাজে স্বস্তি নেমে আসবে। এমন একটি ঘোষণায় বিরোধীদলীয় সব আন্দোলন প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যাবে। জনগণের মনে নির্বাচনের প্রতি আস্থা ফিরে আসবে এবং ভোটাররা আসন্ন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবেন। সবকিছু মিলে এ এক ঘোষণায় সমাজে স্বস্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

সরকারকে একটি সাংবিধানিক আইনি কাঠামো তৈরি করে তার অধীনে দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। নির্বাচনের বেশ আগে থেকে নতুন ভোটার তালিকা তৈরি ও সীমানা পুনঃনির্ধারণের কাজগুলো শুরু করা ভালো। এ কাজগুলো একটু আগে থেকে শুরু হলে জনগণের মনে হবে, নির্বাচন সঠিকভাবে হবে। নির্বাচন কমিশন লোকবলসমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও দলীয়করণকৃত প্রশাসন থেকে আমলা ভাড়া করে নির্বাচনে রিটার্নিং এবং সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা যাবে না। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের অন্যান্য যোগ্য কর্মকর্তাকে এ দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্দলীয় সরকার কোনো নীতিনির্ধারণী কাজ না করে কেবল সুষ্ঠুভাবে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে মনোনিবেশ করবে। নির্বাচনকালীন সরকার সেনাবাহিনীসহ সব পোশাকধারী বাহিনীকে নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করবে। অস্থায়ী সরকারকে স্বাধীনভাবে নির্বাচনি কাজ করতে সরকারি দলসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলকে সহযোগিতা করতে হবে।

নির্বাচনি প্রচারণাকালে সব অংশগ্রহণকারী দলের সমান সুযোগ-সুবিধা নির্বাচনকালীন সরকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাসীন দল যেন সরকারি সভায় দলীয় প্রচারণা না করতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন ইসিকে সব অংশগ্রহণকারী দলকে নির্বাচীি আচরণবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। কমিশনকে নির্বাচন নস্যাৎকারী যে কোনো প্রচেষ্টা দমনে কঠোর হতে হবে এবং নির্বাচনি আইন প্রয়োগে দ্বিধা করলে হবে না। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের চেষ্টা করা হলে এসবের কিছুই হবে না। তখন ক্ষমতাসীন সরকারের অঘোষিত ডিকটেশন অনুযায়ী ইসি, প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনী কাজ করবে। অতীত সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তেমন ইঙ্গিত দেয়।

মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনে নির্বাচিত একটি সরকার গঠিত হলে ওই সরকারকে যুগপৎ জনগণ এবং আন্তর্জাতিক মহল সব রকম সহযোগিতা প্রদান করবে। ত্রুটিমুক্ত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভূলুণ্ঠিত গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্দলীয় সরকারের অধীনেই ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকদের বাদ দিলে সাধারণ বিবেকসম্পন্ন নাগরিক সমাজও নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন চান। কারণ, তাদের প্রায় সবাই বিশ্বাস করেন, বিরাজিত বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ওই নির্বাচন কিছুতেই স্বচ্ছ হবে না।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

দেশপ্রেমের চশমা

এবারের নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হতে হবে

 মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার 
১৭ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশে নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কোনো রকম নির্বাচনই আর অহিংস ও দুর্নীতিমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনগুলো অবিতর্কিত ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনগুলোতে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। তবে সেনাসমর্থিত এবং অসাংবিধানিক ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীন সরকার আমলে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাহ্যিকভাবে ওই নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাস-সহিংসতা দৃশ্যমান না হলেও নির্বাচনটিতে গৃহীত ভোটের পরিসংখ্যানই ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির সাক্ষ্য দেয়। কারণ, স্বাভাবিক সময়ে কেবল স্থানীয় সরকার নির্বাচন (ইউপি, উপজেলা, সিটি করপোরেশন) প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে ৬৮, ৭০, ৭৫ শতাংশ বা এর কম-বেশি ভোট পড়তে দেখা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চেয়ে কম। অথচ নবম সংসদ নির্বাচনে অফিসিয়াল কাস্টিং রেট হচ্ছে ৮৬.৩৪ শতাংশ, যা অন্যায়ভাবে ‘না’ এবং ‘বাতিল’ ভোট বাদ দিয়ে হিসাব করে দেখানো হয়েছে। ওই দুরকম ভোটসহ কাস্টিং রেট ৮৭.৬০ শতাংশ, যার মধ্যে পাঁচটি আসনে ৯৫ শতাংশ বা তার বেশি, ১৯টি আসনে ৯৪ শতাংশ বা তার বেশি এবং ৯৪টি আসনে ৯০ শতাংশ বা তার বেশি ভোট কাস্ট হয় (বাংলাদেশি নির্বাচন, খুলনা : অধ্যয়ন পরিষদ, ২০২১, পৃষ্ঠা-১৪২)। এ থেকে অনুধাবন করা যায়, ওই নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ হয়েছিল।

পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করে এককভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা চালু করার পর সংসদ নির্বাচন আর স্বচ্ছ হয়নি। এমন নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদলীয় প্রার্থীদের জয়ী হতে অসুবিধা হয়নি। দলীয় ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে দুটি নতুন কলঙ্কের পাতা যোগ করে। দশম নির্বাচনে জনগণ প্রত্যক্ষ করেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ক্ষমতাসীন দলের ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন সুনিশ্চিত করেন। আর একাদশ সংসদ নির্বাচনে তো নির্বাচনের আগের রাতে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা পোশাকধারী বাহিনী ও প্রিসাইডিং অফিসারদের আয়ত্তে নিয়ে ভোটের কাজ এগিয়ে রাখেন। ফলে পরপর এমন দুটি নির্বাচন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করে।

এ হারানো ভাবমূর্তি উদ্ধার করার জন্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দুর্নীতিমুক্ত ও ইনক্লুসিভ করা ছাড়া সরকারের কাছে অন্য কোনো বিকল্প নেই। আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে যে এমন ইনক্লুসিভ নির্বাচন করা যাবে না, সে বিষয়টি একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন হবে একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার। অথচ, সরকার এখন পর্যন্ত এমন একটি স্বল্পায়ুর নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পরিবর্তে, ক্ষমতাসীন দল আরও একটি ফন্দি-ফিকিরের নির্বাচন করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে সচেষ্ট বলে লক্ষণদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে। কোনো কোনো মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে গেছে। ওটা ভুলে যান। আওয়ামী লীগই হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যে সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’

চলমান ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা দেখে অনুধাবন করা যায়, সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হলে কী অবস্থা হবে। কারণ, ইউপি নির্বাচনে অনেক বড় দল অংশগ্রহণ করছে না। কেবল ক্ষমতাসীন দল এবং এর বিদ্রোহী প্রার্থীরা যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, সেখানেই ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় ইতোমধ্যে বিজিবি সদস্যসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রাণহানি ঘটেছে। এ খুনের দায় যেমন কেউ নিচ্ছে না, তেমনি এর বিচারও হচ্ছে না। উল্লেখ্য, ইউপি নির্বাচনে সব আসন জিতলেও কোনো দল সরকার গঠন করতে পারবে না। এ সত্য জানার পরও যেখানে সহিংসতার মাত্রা এমন, সেখানে যে নির্বাচন জিতলে সরকার গঠন করা যাবে, তেমন সংসদ নির্বাচন যদি দলীয় সরকারাধীনে হয়, তাহলে ওই নির্বাচনে সহিংসতা কেমন উচ্চতায় পৌঁছাবে তা অনুমেয়।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়ার দিকে পরাশক্তিধর দেশগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে। এবার ক্ষমতাসীনদের জন্য গত দুবারের মতো ফন্দি-ফিকিরের নির্বাচন করে পার পাওয়া কঠিন হতে পারে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘসহ পরাশক্তিধর কতিপয় রাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ শুরু করেছে। এ লক্ষ্যে মাঠের প্রধান বিরোধী দলও নিজেদের নেতাকর্মীদের চাঙা করে মাঠে নামার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মামলা-হামলায় পর্যুদস্ত বিএনপি অনেকটা দুর্বল। তারপরও দলটি সমাবেশ ডাকলে মানুষের সমাগম হচ্ছে। এটি যে বিএনপির জনপ্রিয়তার লক্ষণ এমন না-ও হতে পারে। আসলে বিবেকবান নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক আচরণ, সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি, গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়া ও দুর্নীতির ব্যাপক প্রসারের কারণে সরকারের ওপর নাখোশ হয়ে উঠেছেন।

একটি দল পরপর তিন মেয়াদ ক্ষমতায়। এ তিন মেয়াদ যে তারা জনগণের প্রকৃত সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় রয়েছেন এমনও নয়। এজন্য গণতন্ত্রপ্রেমী নাগরিকদের অনেকে সরকারের ওপর খুশি নন। তাদের অনেকে ভয়ে কথা না বললেও সরকারি দলের ওপর ক্ষুব্ধ। বিএনপি নিজদলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে এদেরও দলীয় কর্মসূচিতে ভেড়াতে পারছেন বলেই হয়তো দলটির আহূত সমাবেশে লোক সমাগম হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে মনে হয়, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না করলে সরকারকে গণতান্ত্রিক বিশ্বে কোণঠাসা হয়ে পড়তে হবে। বিষয়টি সরকারও বুঝতে পেরেছে। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের সরকারদলীয় জনসভায় বলেছেন, ‘ভোট চুরি করলে জনগণ তাদের ছেড়ে দেয় না। বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে অতীতে যারা ছিনিমিনি খেলেছে, তাদের শাস্তি হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ক্ষমতা থেকে হটিয়েছে।’

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য এবং দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে সরকারকে কতিপয় জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে সবার আগে সরকারকে সমাজে একটি নির্বাচনি পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কারণ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও সহিংসতাময় পরিবেশে ভালো নির্বাচন করা যায় না। সামাজিক অস্থিরতা দূর করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের যে সদিচ্ছা আছে সে বিষয়টি জনগণকে এখনই জানিয়ে দিতে হবে। এ লক্ষ্যে একটি ঘোষণাই জনমনে স্বস্তি আনতে সক্ষম। সরকার যদি বলে, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে এবং এজন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তাহলে তাতে সমাজে স্বস্তি নেমে আসবে। এমন একটি ঘোষণায় বিরোধীদলীয় সব আন্দোলন প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যাবে। জনগণের মনে নির্বাচনের প্রতি আস্থা ফিরে আসবে এবং ভোটাররা আসন্ন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবেন। সবকিছু মিলে এ এক ঘোষণায় সমাজে স্বস্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

সরকারকে একটি সাংবিধানিক আইনি কাঠামো তৈরি করে তার অধীনে দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। নির্বাচনের বেশ আগে থেকে নতুন ভোটার তালিকা তৈরি ও সীমানা পুনঃনির্ধারণের কাজগুলো শুরু করা ভালো। এ কাজগুলো একটু আগে থেকে শুরু হলে জনগণের মনে হবে, নির্বাচন সঠিকভাবে হবে। নির্বাচন কমিশন লোকবলসমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও দলীয়করণকৃত প্রশাসন থেকে আমলা ভাড়া করে নির্বাচনে রিটার্নিং এবং সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা যাবে না। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের অন্যান্য যোগ্য কর্মকর্তাকে এ দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্দলীয় সরকার কোনো নীতিনির্ধারণী কাজ না করে কেবল সুষ্ঠুভাবে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে মনোনিবেশ করবে। নির্বাচনকালীন সরকার সেনাবাহিনীসহ সব পোশাকধারী বাহিনীকে নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করবে। অস্থায়ী সরকারকে স্বাধীনভাবে নির্বাচনি কাজ করতে সরকারি দলসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলকে সহযোগিতা করতে হবে।

নির্বাচনি প্রচারণাকালে সব অংশগ্রহণকারী দলের সমান সুযোগ-সুবিধা নির্বাচনকালীন সরকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাসীন দল যেন সরকারি সভায় দলীয় প্রচারণা না করতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন ইসিকে সব অংশগ্রহণকারী দলকে নির্বাচীি আচরণবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। কমিশনকে নির্বাচন নস্যাৎকারী যে কোনো প্রচেষ্টা দমনে কঠোর হতে হবে এবং নির্বাচনি আইন প্রয়োগে দ্বিধা করলে হবে না। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের চেষ্টা করা হলে এসবের কিছুই হবে না। তখন ক্ষমতাসীন সরকারের অঘোষিত ডিকটেশন অনুযায়ী ইসি, প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনী কাজ করবে। অতীত সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তেমন ইঙ্গিত দেয়।

মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনে নির্বাচিত একটি সরকার গঠিত হলে ওই সরকারকে যুগপৎ জনগণ এবং আন্তর্জাতিক মহল সব রকম সহযোগিতা প্রদান করবে। ত্রুটিমুক্ত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভূলুণ্ঠিত গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্দলীয় সরকারের অধীনেই ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকদের বাদ দিলে সাধারণ বিবেকসম্পন্ন নাগরিক সমাজও নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন চান। কারণ, তাদের প্রায় সবাই বিশ্বাস করেন, বিরাজিত বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ওই নির্বাচন কিছুতেই স্বচ্ছ হবে না।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন