পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার বেড়াজালে শিক্ষার্থীরা
ড. মো. শফিকুর রহমান
২২ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ফলে শুধু শিক্ষা কার্যক্রম নয়, ভর্তি কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হলো আরেক দফা অচলাবস্থা।
দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এরপর থেকে করোনা সংক্রমণ সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুমভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ মাসের বেশি সময় বন্ধ ছিল।
দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া চর্চার অভ্যাস ছেড়ে অন্য কাজকর্মে ঢুকে পড়ে; আবার অনেকেই টিভি দেখা ও ইন্টারনেট গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে মানসিক বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়। কাজেই করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে সৃষ্ট অতুলনীয় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়াই ছিল তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং করোনা-পরবর্তী এ চ্যালেঞ্জটি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার অঙ্গীকার আসছিল সরকার ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।
শতভাগ শিক্ষার্থীকে করোনা টিকার আওতায় এনে তারপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন মন্ত্রীগণ। যা হোক, গত অক্টোবরের শেষদিকে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শতভাগ শিক্ষার্থীকে টিকা না দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মিত ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু করে। আর মেডিকেল কলেজগুলো ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের করোনা ভ্যাকসিন দিয়েই সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু করে।
সাধারণত প্রতিবছর এপ্রিল-মে-তে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্য ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু করে দেয়। তবে ২০২০ সালে করোনা মহামারির জন্য সময়মতো এইচএসসি পরীক্ষা না হওয়ার কারণে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ওই এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় পর করোনার প্রকোপ কমে আসায় গত অক্টোবর থেকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি পরীক্ষা বা ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে। তবে এরই মধ্যে মেডিকেল কলেজসহ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস ভর্তি পরীক্ষা শেষ করে ২০২০-২১ সেশনের ক্লাস রীতিমতো শুরু করতে পারলেও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গত অক্টোবরে শুরু হওয়া ভর্তি কার্যক্রম দীর্ঘ প্রায় তিন মাসেও শেষ করতে পারেনি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নতুন করে বন্ধের সিদ্ধান্তে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে আরও বেশকিছু সময় লেগে যেতে পারে এবং ২০২১-২২ সেশনের ১ম বর্ষের ক্লাস শুরু করতে আরও অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে। দেশের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৪৬ হাজার আসনের জন্য প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ এইচএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীর একটি বিরাট অংশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার মতো একটি বড় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে।
অপেক্ষা করেও যে শিক্ষার্থীরা পছন্দ অনুযায়ী বিষয়ে ভর্তি হতে পারবে তারও নিশ্চয়তা নেই। আবার ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গঠিত গুচ্ছ পরীক্ষার কার্যক্রম এগিয়ে থাকলেও গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কয়েকটি মেধা তালিকা পরপর প্রকাশ করার পরও গড়ে ৫০ শতাংশ আসন পূর্ণ করতে পারেনি। ভর্তি পরীক্ষার তিন মাস পরও গুচ্ছভুক্ত কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এখনো ভর্তি কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
তাই করোনাকালীন দীর্ঘ বিরতি, ভর্তি পরীক্ষার দীর্ঘ সময় পর ভর্তি কার্যক্রম এবং পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়ে পড়ার সুযোগের অনিশ্চয়তার ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে হতাশায় ভোগার আশঙ্কা দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক। অনেকেই আবার ঝুঁকি না নিয়ে বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আশায় ঠিকমতো ক্লাস করতে পারছিল না।
করোনার অতি দ্রুত সংক্রমণশীল ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি ইতোমধ্যেই দেশের কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সংক্রমিত করার খবরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে সশরীরে পাঠদান কার্যকর চালিয়ে যাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিক্ষার্থীর মধ্যে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ায় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল ও কলেজের একটি সেকশন আগে থেকেই বন্ধ ছিল।
করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণে ইতোমধ্যেই দেশের পাঁচ-ছয়টি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দুটি (জাহাঙ্গীরনগর এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) শ্রেণিকক্ষে সরাসরি শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া বন্ধ রেখেছে। করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি কম বয়সি শিক্ষার্থীসহ সব বয়সিদের সমভাবে সংক্রমণে সক্ষম। আর এখন যেভাবে প্রতিদিন করোনা সংক্রমণের হার বাড়ছে তাতে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে করোনা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার বন্ধ হয়ে গেলে মহামারির বছরে এমন দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ভর্তি প্রক্রিয়ার বেড়াজালে পড়ে ২০২০-২০২১ সেশনের ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কী হবে, সেটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভেবে দেখা দরকার ছিল।
মহামারির বছরে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর চলমান এ দীর্ঘ ভর্তি প্রক্রিয়ার সময় ৪-৫ মাস থেকে কমিয়ে ১-২ মাসে নিয়ে এসে ডিসেম্বর ২০২১ অথবা ১ জানুয়ারি ২০২২ থেকে ক্লাস শুরু করে অন্তত তিন মাস সময় এগিয়ে আনতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শিক্ষা বিরতির কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যেত এবং এইচএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীরা তাদের বহুল প্রতীক্ষিত ভার্সিটি জীবন অধ্যায়ের শুভ সূচনা অন্তত একটি ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের মাধ্যমেও শুরু করতে পারত।
এ ছাড়াও পাঠদানের বিষয়টি যাতে শিক্ষার্থীরা সহজে বুঝতে পারে ও পাঠদানটি উপভোগ্য হয়, সেজন্য প্রত্যেক শিক্ষক তার পাঠদানের বিষয়টি শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপনায় নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে থাকেন এবং তা একজন শিক্ষক থেকে অন্যজন শিক্ষকের ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়। কাজেই যেসব নবীন শিক্ষার্থী তাদের বিভাগের ক্লাসরুমে সশরীরে উপস্থিত হয়ে কোনো ক্লাস করার সুযোগ পায়নি, করোনার কারণে ভার্সিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষকের লেকচারগুলো বুঝে নেওয়া তাদের পক্ষে কঠিন হবে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়াটা যেমন কারও কাম্য নয়, তেমনি খোলা রাখার কারণে করোনা দ্রুত বিস্তার লাভ করে মানুষের জীবন বিপন্ন করুক, এটিও আমাদের কাম্য নয়। কাজেই করোনা অতিমারিকে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা ধরে নিয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনার কারণে সৃষ্ট সেশনজটের কবল থেকে শিক্ষার্থীদের দ্রুত উত্তরণের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষের কমিটমেন্ট ও তা বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা জরুরি।
করোনা মহামারির বছরে এভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ২০২০-২০২১ সেশনে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত শেষ করার বিশেষ কৌশল গ্রহণ না করে ক্লাস শুরু করতে দীর্ঘ ৪-৫ মাস সময় অতিবাহিত করার ফলে তাদের করোনার কারণে লেখাপড়ার ক্ষতি (বিরতি) এক বছর থেকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া অনেক অভিভাবক মেনে নিতে পারছেন না। যদিও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ভর্তি প্রক্রিয়াটি একটু সময়সাপেক্ষ, তথাপি আমরা আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার খুলে দেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ যত দ্রুত সম্ভব এ ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে দ্রুত ২০২০-২০২১ সেশনের ক্লাস শুরু করবে।
ড. মো. শফিকুর রহমান : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
mrahman7@lakeheadu.ca
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার বেড়াজালে শিক্ষার্থীরা
করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ফলে শুধু শিক্ষা কার্যক্রম নয়, ভর্তি কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হলো আরেক দফা অচলাবস্থা।
দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এরপর থেকে করোনা সংক্রমণ সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুমভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ মাসের বেশি সময় বন্ধ ছিল।
দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া চর্চার অভ্যাস ছেড়ে অন্য কাজকর্মে ঢুকে পড়ে; আবার অনেকেই টিভি দেখা ও ইন্টারনেট গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে মানসিক বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়। কাজেই করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে সৃষ্ট অতুলনীয় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়াই ছিল তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং করোনা-পরবর্তী এ চ্যালেঞ্জটি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার অঙ্গীকার আসছিল সরকার ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।
শতভাগ শিক্ষার্থীকে করোনা টিকার আওতায় এনে তারপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন মন্ত্রীগণ। যা হোক, গত অক্টোবরের শেষদিকে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শতভাগ শিক্ষার্থীকে টিকা না দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মিত ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু করে। আর মেডিকেল কলেজগুলো ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের করোনা ভ্যাকসিন দিয়েই সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু করে।
সাধারণত প্রতিবছর এপ্রিল-মে-তে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্য ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু করে দেয়। তবে ২০২০ সালে করোনা মহামারির জন্য সময়মতো এইচএসসি পরীক্ষা না হওয়ার কারণে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ওই এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় পর করোনার প্রকোপ কমে আসায় গত অক্টোবর থেকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি পরীক্ষা বা ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে। তবে এরই মধ্যে মেডিকেল কলেজসহ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস ভর্তি পরীক্ষা শেষ করে ২০২০-২১ সেশনের ক্লাস রীতিমতো শুরু করতে পারলেও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গত অক্টোবরে শুরু হওয়া ভর্তি কার্যক্রম দীর্ঘ প্রায় তিন মাসেও শেষ করতে পারেনি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নতুন করে বন্ধের সিদ্ধান্তে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে আরও বেশকিছু সময় লেগে যেতে পারে এবং ২০২১-২২ সেশনের ১ম বর্ষের ক্লাস শুরু করতে আরও অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে। দেশের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৪৬ হাজার আসনের জন্য প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ এইচএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীর একটি বিরাট অংশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার মতো একটি বড় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে।
অপেক্ষা করেও যে শিক্ষার্থীরা পছন্দ অনুযায়ী বিষয়ে ভর্তি হতে পারবে তারও নিশ্চয়তা নেই। আবার ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গঠিত গুচ্ছ পরীক্ষার কার্যক্রম এগিয়ে থাকলেও গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কয়েকটি মেধা তালিকা পরপর প্রকাশ করার পরও গড়ে ৫০ শতাংশ আসন পূর্ণ করতে পারেনি। ভর্তি পরীক্ষার তিন মাস পরও গুচ্ছভুক্ত কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এখনো ভর্তি কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
তাই করোনাকালীন দীর্ঘ বিরতি, ভর্তি পরীক্ষার দীর্ঘ সময় পর ভর্তি কার্যক্রম এবং পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়ে পড়ার সুযোগের অনিশ্চয়তার ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে হতাশায় ভোগার আশঙ্কা দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক। অনেকেই আবার ঝুঁকি না নিয়ে বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আশায় ঠিকমতো ক্লাস করতে পারছিল না।
করোনার অতি দ্রুত সংক্রমণশীল ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি ইতোমধ্যেই দেশের কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সংক্রমিত করার খবরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে সশরীরে পাঠদান কার্যকর চালিয়ে যাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিক্ষার্থীর মধ্যে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ায় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল ও কলেজের একটি সেকশন আগে থেকেই বন্ধ ছিল।
করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণে ইতোমধ্যেই দেশের পাঁচ-ছয়টি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দুটি (জাহাঙ্গীরনগর এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) শ্রেণিকক্ষে সরাসরি শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া বন্ধ রেখেছে। করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি কম বয়সি শিক্ষার্থীসহ সব বয়সিদের সমভাবে সংক্রমণে সক্ষম। আর এখন যেভাবে প্রতিদিন করোনা সংক্রমণের হার বাড়ছে তাতে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে করোনা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার বন্ধ হয়ে গেলে মহামারির বছরে এমন দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ভর্তি প্রক্রিয়ার বেড়াজালে পড়ে ২০২০-২০২১ সেশনের ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কী হবে, সেটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভেবে দেখা দরকার ছিল।
মহামারির বছরে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর চলমান এ দীর্ঘ ভর্তি প্রক্রিয়ার সময় ৪-৫ মাস থেকে কমিয়ে ১-২ মাসে নিয়ে এসে ডিসেম্বর ২০২১ অথবা ১ জানুয়ারি ২০২২ থেকে ক্লাস শুরু করে অন্তত তিন মাস সময় এগিয়ে আনতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শিক্ষা বিরতির কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যেত এবং এইচএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীরা তাদের বহুল প্রতীক্ষিত ভার্সিটি জীবন অধ্যায়ের শুভ সূচনা অন্তত একটি ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের মাধ্যমেও শুরু করতে পারত।
এ ছাড়াও পাঠদানের বিষয়টি যাতে শিক্ষার্থীরা সহজে বুঝতে পারে ও পাঠদানটি উপভোগ্য হয়, সেজন্য প্রত্যেক শিক্ষক তার পাঠদানের বিষয়টি শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপনায় নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে থাকেন এবং তা একজন শিক্ষক থেকে অন্যজন শিক্ষকের ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়। কাজেই যেসব নবীন শিক্ষার্থী তাদের বিভাগের ক্লাসরুমে সশরীরে উপস্থিত হয়ে কোনো ক্লাস করার সুযোগ পায়নি, করোনার কারণে ভার্সিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষকের লেকচারগুলো বুঝে নেওয়া তাদের পক্ষে কঠিন হবে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়াটা যেমন কারও কাম্য নয়, তেমনি খোলা রাখার কারণে করোনা দ্রুত বিস্তার লাভ করে মানুষের জীবন বিপন্ন করুক, এটিও আমাদের কাম্য নয়। কাজেই করোনা অতিমারিকে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা ধরে নিয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনার কারণে সৃষ্ট সেশনজটের কবল থেকে শিক্ষার্থীদের দ্রুত উত্তরণের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষের কমিটমেন্ট ও তা বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা জরুরি।
করোনা মহামারির বছরে এভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ২০২০-২০২১ সেশনে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত শেষ করার বিশেষ কৌশল গ্রহণ না করে ক্লাস শুরু করতে দীর্ঘ ৪-৫ মাস সময় অতিবাহিত করার ফলে তাদের করোনার কারণে লেখাপড়ার ক্ষতি (বিরতি) এক বছর থেকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া অনেক অভিভাবক মেনে নিতে পারছেন না। যদিও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ভর্তি প্রক্রিয়াটি একটু সময়সাপেক্ষ, তথাপি আমরা আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার খুলে দেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ যত দ্রুত সম্ভব এ ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে দ্রুত ২০২০-২০২১ সেশনের ক্লাস শুরু করবে।
ড. মো. শফিকুর রহমান : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
mrahman7@lakeheadu.ca