মেঘালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পুনর্জাগরণ
এ যেন এক বীরত্বে গাথা ইতিহাসের নবজাগরণ। ঠিক যা ঘটল ৯ থেকে ১৪ মে মেঘালয়ের পথে পথে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যখন একদল বীর মুক্তিযোদ্ধা মেঘালয়ের মাটিতে পা রাখলেন, তখন এর মধ্য দিয়ে যেন পুনর্জাগরণ ঘটল ইতিহাসের। স্মৃতিবিজড়িত সেই মাটির স্পর্শে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা বীরত্বগাথা স্মৃতিকথায় মেতে ওঠেন। আর তা ইতিহাসের পাঠ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অংশগ্রহণকারী তরুণ প্রজন্মের প্রত্যেক সদস্যের মাঝে। এ এক অসাধারণ মুহূর্ত!
আর এটা সম্ভব হয়েছে বন্ধুপ্রতীম ভারত সরকারের সহযোগিতায়। ৯ থেকে ১৪ মে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের ২৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী রাজ্য মেঘালয় সফর করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর যৌথভাবে উদযাপন করার লক্ষ্যে ভারত সরকারের এ আয়োজন। এই শুভলগ্নে ভারতও উদযাপন করছে তাদের স্বাধীনতার ৭৫তম বছর। একইসঙ্গে মেঘালয় রাজ্য হয়ে ওঠারও ৫০তম বছর। এ যেন এক ত্রিভুজ মহাযোগ।
২৫ সদস্যের প্রতিনিধিদলের মধ্যে ১৮ জনই ছিলেন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, যারা প্রত্যেকেই মেঘালয় থেকে ট্রেনিং নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। এ ছাড়াও প্রতিনিধিদলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, সাংবাদিকসহ তরুণ প্রজন্মের নেতারা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের এ রাজ্যবাসীর সহযোগিতা ছিল অনস্বীকার্য। সেদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা রাজ্যের মতোই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল মেঘালয় রাজ্য। সেদিন সরকারের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকরাও নির্বিশেষে বাংলাদেশি শরণার্থীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল মেঘালয়ের বালাট ও ডাউকি। এ দুটি কেন্দ্র দিয়ে এপ্রিলের শুরু থেকেই সিলেট, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনার মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে মেঘালয় রাজ্যে আশ্রয় নেয়। মেঘালয়ের আমপাতি গ্রাম হয়ে উঠেছিল সেদিন ছোট্ট একটি বাংলাদেশ। বালাটে ‘ইয়ুথ রিসেপশন ক্যাম্প’ গড়ে তোলেন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (মুজিব বাহিনী) তৎকালীন সাব-সেক্টর কমান্ডার, বর্তমান বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আবদুল হামিদ। এই ক্যাম্প থেকে তিনি তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতেন। মেঘালয়ের তুরা ও ডাউকিতে গড়ে উঠেছিল বড় দুটি প্রশিক্ষণ শিবির। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও গেরিলা ট্রেনিং দেওয়া হতো।
১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসকদের গণহত্যা ও বর্বরতার প্রতিবাদে শিলংয়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী রাজধানীতে শোভাযাত্রা বের করেন। পুরো একাত্তর সালজুড়েই বাংলাদেশের সমর্থনে মিছিল-মিটিংয়ে মুখর ছিল মেঘালয়। বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে শিলং, ডাউকি, বালাটে পালন করা হয়েছে বন্ধ, অবরোধ, অনশন। আর সেই সাহায্যের ধারাবাহিকতায় এবং অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের এমন একটি সুন্দর মুহূর্তে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মেঘালয় সফর মনে করিয়ে দেয় সেই বীরত্বগাথা দিনগুলোর কথা। স্বাধীনতা অর্জনের গৌরব, বন্ধুপ্রতিম দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ-সবকিছু মিলেমিশে যেন তৈরি হয়েছিল অসাধারণ কিছু মুহূর্ত, যা বন্ধুত্বের বন্ধনে এক শক্তিশালী সেতুবন্ধ। নবীন-প্রবীণের সেতুবন্ধ। প্রবীণদের সেই ইতিহাস পাঠ সমৃদ্ধ করেছে নবীনদের, জাগ্রত করেছে তাদের দেশপ্রেম। তারা আরও জেনেছে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান, সবকিছু উজাড় করে বন্ধু হয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর কথা।
ছয়দিনের এ সফরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে মেঘালয় রাজ্য সরকারের ছিল নানা বর্ণাঢ্য আয়োজন। সফরের দ্বিতীয় দিন মেঘালয় সরকারের আর্টস অ্যান্ড কালচার মন্ত্রণালয়ের সচিব ও যুগ্ম সচিব এ প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানান এবং উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করেন। এরপর একে একে ভারতীয় গিবমানবাহিনী, ভারতীয় সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। রাজ্য সরকারের আর্টস অ্যান্ড কালচার মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ থেকে আগত এ প্রতিনিধিদল।
এই সফর চলাকালীন একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে গঠিত এ প্রতিনিধিদলের সম্মানে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ও নৈশভোজের আয়োজন করেন মেঘালয় রাজ্যের রাজ্যপাল। সেদিন অনুষ্ঠান শুরুর আগেই এ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন রাজ্যপাল। বৈঠকের শুরুতেই তিনি আধো আধো বাংলায় গেয়ে ওঠেন জনপ্রিয় বাংলা গান ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’। পরবর্তী সময়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ‘রিয়েল হিরো’ বলে উল্লেখ করেন এবং আরও বলেন, কোনো মুক্তিযোদ্ধা যদি মেঘালয় ভ্রমণে আসে তবে রাজ্যপাল তাদের সর্বোচ্চ সম্মান দেবেন ও রাজ্যপালের অতিথি হিসাবে গ্রহণ করবেন। আলোচনাকালে তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। এর মধ্য দিয়েই পরিলক্ষিত হয় আজকের এই বাংলাদেশকে ভারত সরকার ও সেদেশের রাজনৈতিক নেতারা এবং কর্মকর্তারা কী চোখে দেখেন।
এ সফরকালের দুটি বিষয় তুলে না ধরলেই নয়। একটি হলো-ভারতীয় বিমানবাহিনীর ইস্টার্ন এয়ার কমান্ডের কমান্ডার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে ইস্টার্ন এয়ার কমান্ডের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় সরকার ও বিমানবাহিনীর সাহায্যের ওপর ভিত্তি করে একটি ১০ মিনিটের ভিডিওচিত্র দেখানো হয়। সেই ভিডিওচিত্র দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন এক বীর মুক্তিযোদ্ধা, তিনি ধরে রাখতে পারেননি অশ্রু। তার কান্নার আওয়াজে মুহূর্তে যেন ভারী হয়ে ওঠে সমগ্র মিলনায়তন। অন্যটি হলো-বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের প্রতি ভারতীয় সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফের আন্তরিক আচরণ ও সম্মান প্রদর্শন, যা মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রতিনিধিদলের প্রত্যেক সদস্যের হৃদয়কে আনন্দে রাঙিয়ে দিয়েছে।
একজন সাংবাদিক হিসাবে এবং এই প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের উদ্যোগে ভারত সরকারের এ আয়োজন আগামী দিনে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে। দুদেশের মধ্যে এ ধরনের সফরগুলোর মাধ্যমে শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। এর মধ্য দিয়ে আরও শক্তিশালী হবে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
অনয় মুখার্জী : সাংবাদিক
anoy.mukherjeee@gmail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
মেঘালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পুনর্জাগরণ
এ যেন এক বীরত্বে গাথা ইতিহাসের নবজাগরণ। ঠিক যা ঘটল ৯ থেকে ১৪ মে মেঘালয়ের পথে পথে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যখন একদল বীর মুক্তিযোদ্ধা মেঘালয়ের মাটিতে পা রাখলেন, তখন এর মধ্য দিয়ে যেন পুনর্জাগরণ ঘটল ইতিহাসের। স্মৃতিবিজড়িত সেই মাটির স্পর্শে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা বীরত্বগাথা স্মৃতিকথায় মেতে ওঠেন। আর তা ইতিহাসের পাঠ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অংশগ্রহণকারী তরুণ প্রজন্মের প্রত্যেক সদস্যের মাঝে। এ এক অসাধারণ মুহূর্ত!
আর এটা সম্ভব হয়েছে বন্ধুপ্রতীম ভারত সরকারের সহযোগিতায়। ৯ থেকে ১৪ মে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের ২৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী রাজ্য মেঘালয় সফর করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর যৌথভাবে উদযাপন করার লক্ষ্যে ভারত সরকারের এ আয়োজন। এই শুভলগ্নে ভারতও উদযাপন করছে তাদের স্বাধীনতার ৭৫তম বছর। একইসঙ্গে মেঘালয় রাজ্য হয়ে ওঠারও ৫০তম বছর। এ যেন এক ত্রিভুজ মহাযোগ।
২৫ সদস্যের প্রতিনিধিদলের মধ্যে ১৮ জনই ছিলেন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, যারা প্রত্যেকেই মেঘালয় থেকে ট্রেনিং নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। এ ছাড়াও প্রতিনিধিদলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, সাংবাদিকসহ তরুণ প্রজন্মের নেতারা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের এ রাজ্যবাসীর সহযোগিতা ছিল অনস্বীকার্য। সেদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা রাজ্যের মতোই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল মেঘালয় রাজ্য। সেদিন সরকারের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকরাও নির্বিশেষে বাংলাদেশি শরণার্থীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল মেঘালয়ের বালাট ও ডাউকি। এ দুটি কেন্দ্র দিয়ে এপ্রিলের শুরু থেকেই সিলেট, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনার মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে মেঘালয় রাজ্যে আশ্রয় নেয়। মেঘালয়ের আমপাতি গ্রাম হয়ে উঠেছিল সেদিন ছোট্ট একটি বাংলাদেশ। বালাটে ‘ইয়ুথ রিসেপশন ক্যাম্প’ গড়ে তোলেন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (মুজিব বাহিনী) তৎকালীন সাব-সেক্টর কমান্ডার, বর্তমান বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আবদুল হামিদ। এই ক্যাম্প থেকে তিনি তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতেন। মেঘালয়ের তুরা ও ডাউকিতে গড়ে উঠেছিল বড় দুটি প্রশিক্ষণ শিবির। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও গেরিলা ট্রেনিং দেওয়া হতো।
১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসকদের গণহত্যা ও বর্বরতার প্রতিবাদে শিলংয়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী রাজধানীতে শোভাযাত্রা বের করেন। পুরো একাত্তর সালজুড়েই বাংলাদেশের সমর্থনে মিছিল-মিটিংয়ে মুখর ছিল মেঘালয়। বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে শিলং, ডাউকি, বালাটে পালন করা হয়েছে বন্ধ, অবরোধ, অনশন। আর সেই সাহায্যের ধারাবাহিকতায় এবং অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের এমন একটি সুন্দর মুহূর্তে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মেঘালয় সফর মনে করিয়ে দেয় সেই বীরত্বগাথা দিনগুলোর কথা। স্বাধীনতা অর্জনের গৌরব, বন্ধুপ্রতিম দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ-সবকিছু মিলেমিশে যেন তৈরি হয়েছিল অসাধারণ কিছু মুহূর্ত, যা বন্ধুত্বের বন্ধনে এক শক্তিশালী সেতুবন্ধ। নবীন-প্রবীণের সেতুবন্ধ। প্রবীণদের সেই ইতিহাস পাঠ সমৃদ্ধ করেছে নবীনদের, জাগ্রত করেছে তাদের দেশপ্রেম। তারা আরও জেনেছে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান, সবকিছু উজাড় করে বন্ধু হয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর কথা।
ছয়দিনের এ সফরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে মেঘালয় রাজ্য সরকারের ছিল নানা বর্ণাঢ্য আয়োজন। সফরের দ্বিতীয় দিন মেঘালয় সরকারের আর্টস অ্যান্ড কালচার মন্ত্রণালয়ের সচিব ও যুগ্ম সচিব এ প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানান এবং উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করেন। এরপর একে একে ভারতীয় গিবমানবাহিনী, ভারতীয় সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। রাজ্য সরকারের আর্টস অ্যান্ড কালচার মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ থেকে আগত এ প্রতিনিধিদল।
এই সফর চলাকালীন একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে গঠিত এ প্রতিনিধিদলের সম্মানে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ও নৈশভোজের আয়োজন করেন মেঘালয় রাজ্যের রাজ্যপাল। সেদিন অনুষ্ঠান শুরুর আগেই এ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন রাজ্যপাল। বৈঠকের শুরুতেই তিনি আধো আধো বাংলায় গেয়ে ওঠেন জনপ্রিয় বাংলা গান ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’। পরবর্তী সময়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ‘রিয়েল হিরো’ বলে উল্লেখ করেন এবং আরও বলেন, কোনো মুক্তিযোদ্ধা যদি মেঘালয় ভ্রমণে আসে তবে রাজ্যপাল তাদের সর্বোচ্চ সম্মান দেবেন ও রাজ্যপালের অতিথি হিসাবে গ্রহণ করবেন। আলোচনাকালে তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। এর মধ্য দিয়েই পরিলক্ষিত হয় আজকের এই বাংলাদেশকে ভারত সরকার ও সেদেশের রাজনৈতিক নেতারা এবং কর্মকর্তারা কী চোখে দেখেন।
এ সফরকালের দুটি বিষয় তুলে না ধরলেই নয়। একটি হলো-ভারতীয় বিমানবাহিনীর ইস্টার্ন এয়ার কমান্ডের কমান্ডার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে ইস্টার্ন এয়ার কমান্ডের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় সরকার ও বিমানবাহিনীর সাহায্যের ওপর ভিত্তি করে একটি ১০ মিনিটের ভিডিওচিত্র দেখানো হয়। সেই ভিডিওচিত্র দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন এক বীর মুক্তিযোদ্ধা, তিনি ধরে রাখতে পারেননি অশ্রু। তার কান্নার আওয়াজে মুহূর্তে যেন ভারী হয়ে ওঠে সমগ্র মিলনায়তন। অন্যটি হলো-বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের প্রতি ভারতীয় সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফের আন্তরিক আচরণ ও সম্মান প্রদর্শন, যা মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রতিনিধিদলের প্রত্যেক সদস্যের হৃদয়কে আনন্দে রাঙিয়ে দিয়েছে।
একজন সাংবাদিক হিসাবে এবং এই প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের উদ্যোগে ভারত সরকারের এ আয়োজন আগামী দিনে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে। দুদেশের মধ্যে এ ধরনের সফরগুলোর মাধ্যমে শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। এর মধ্য দিয়ে আরও শক্তিশালী হবে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
অনয় মুখার্জী : সাংবাদিক
anoy.mukherjeee@gmail.com