জ্ঞান ও প্রয়োগ
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ খ্যাতিমান মানবতাবাদী সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘হৃদয়ে এবং মস্তিষ্কের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব জাগে, তখন তুমি হৃদয়কেই গ্রহণ করো। কারণ, বুদ্ধিমান মানুষের চেয়ে হৃদয়বান মানুষ অনেক শ্রেয়। বুদ্ধিমান বুদ্ধি দিয়ে ভালোও করতে পারে, খারাপও করতে পারে; কিন্তু হৃদয়বান কেবল ভালোই করবে।’
প্রাচীনকালে দুনিয়ার প্রসিদ্ধ জ্ঞানী ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস (৪৭০-৩৯৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। শিক্ষা ও তার সত্যানুসন্ধানী দর্শনের জন্য তিনি শাসক এবং একশ্রেণির লোকের কাছে ছিলেন চক্ষুশূলস্বরূপ। তিনি ওইসব প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরাগভাজন হন। তাদের অভিযোগে প্রহসনমূলক এক বিচারে সক্রেটিসের প্রতি প্রাণদণ্ডাদেশ প্রদত্ত হয়। বিচারের রায়কে শিরোধার্য করে হেমলক নামের বিষ পান করে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘নিজেকে জানো’ (Know thyself)-এই ছিল সক্রেটিসের শিক্ষা ও দর্শনের মূলকথা। সমসাময়িককালে দর্শন, গণিত, সংগীতসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়েই ছিল সক্রেটিসের একাধিপত্য। সক্রেটিসের শিষ্যদের মধ্যে প্রধান ছিলেন আরেক বিস্ময়কর প্রতিভা প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। আর প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। জ্ঞানচর্চা-সাধনা-গবেষণা ও বিস্তার-বিস্তৃতির সে কী পরম্পরা! গ্রিক বীর আলেকজান্ডার (৩৫৬-৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) অ্যারিস্টটলেরই শিষ্য ছিলেন।
অ্যারিস্টটল ছিলেন অনন্যসাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তি। সমসাময়িককালে গুরুত্বপূর্ণ এমন কোনো বিষয় ছিল না, যা তিনি আয়ত্ত করেননি। অ্যারিস্টটল যে কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে গবেষণা ও গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তর্কশাস্ত্র, ব্যাকরণ, অলংকারশাস্ত্র, সাহিত্য-সমালোচনা, প্রকৃতি-বিজ্ঞান, মনস্তত্ব, শারীরতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি অসংখ্য বই লিখেছেন। জ্ঞানের আকর তার বইগুলো সব কালে এবং সব দেশের পণ্ডিতদের কাছে অমূল্য ও বিস্ময়ের সামগ্রী। অ্যারিস্টটল রচিত ‘Ethics’, ‘Poetics’, ‘Politics’ ইত্যাদি গ্রন্থ অত্যন্ত সুপ্রসিদ্ধ। অ্যারিস্টটলকে বলা হয় ‘সব জ্ঞানীর গুরু’ (The master of all who know)।
বলা হয়ে থাকে, জ্ঞান ও যোগ্যতা দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। আর সততা-সদিচ্ছা ও কর্মনিষ্ঠা দিয়ে আরও বেশি কিছু, ভালো কিছু করা যায়। গতানুগতিক কিংবা কেবল কাজের জন্যই কাজ নয়, কোনো কিছু করার আগে হৃদয়ের মাঝ থেকেও একটি তাড়না থাকা চাই। অ্যারিস্টটলের মতে, জ্ঞান (নলেজ) দুই প্রকারের। একচুয়েল নলেজ ও রিয়েল নলেজ। আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যায় ‘একচুয়েল’ ও ‘রিয়েল’ শব্দ দুটির একই অর্থ। কিন্তু না, শব্দ দুটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বাংলা করলে হতে পারে প্রথমটি মস্তিষ্কজাত ও দ্বিতীয়টি হৃদয়জাত। মস্তিষ্কজাত বা প্রকৃত জ্ঞান দিয়েই মানুষ সবকিছু করছে; পড়াশোনা, ডিগ্রি লাভ, চাকরি, জীবন-জীবিকা-এমন সবকিছু। তবে সব সময় নাও হতে পারে; মানুষের হৃদয়জাত বা আসল জ্ঞানের পরিচয় কখনো কখনো পাওয়া যায়।
ধরা যাক, বিকাল ৪টায় নির্ধারিত সময় শেষ, আরও ১০ মিনিট পরে জনৈক গ্রাহক চেক লিখে নিয়ে গেলেন ব্যাংক থেকে টাকা ওঠাতে। দুঃসহ যানজটের কবলে পড়ে সময়মতো এসে পৌঁছতে পারেননি, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় জরুরি টাকার দরকার তার। ফলে দেখা দিল বিপত্তি, টাকা ওঠাতে পারছেন না তিনি। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক ম্যানেজারের করণীয় কী? ঘড়ির কাঁটাটি ‘৪টা’ গড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর সবকিছুই স্বাভাবিক রয়েছে। শেষবেলায় ম্যানেজারসহ সব কর্মী যথারীতি যার যার কাজ করে চলেছেন। ৬টায় অফিস বন্ধ করার কথা। ম্যানেজার ইচ্ছা করলে সহজে এবং আইন অনুযায়ী গ্রাহক ভদ্রলোকটিকে টাকা না দিয়ে ফেরত পাঠাতে পারেন। এখানে আইনের বাইরে গ্রাহকের পক্ষে ম্যানেজারকে প্রভাবিত করার কিছু নেই। কিন্তু পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় এক্ষেত্রে ম্যানেজার আইনের বাইরেও ভিন্ন কিছু ভাবতে পারেন, সে সুযোগটি তার সামনে রয়েছে। সব কর্মী উপস্থিত, হিসাব-নিকাশ একেবারে ক্লোজ করে ফেলা হয়নি। তার অফিসে ম্যানেজারই সর্বেসর্বা। অফিসের প্রধান হিসাবে ম্যানেজারের অধীনে বাকি সবাই। কাজটি করে দিতে পারলে ভদ্রলোক বাড়ি যাবেন, টাকা নিয়ে হয়তো রাতের আঁধারেই হাসপাতালের দিকে ছুটতে হবে তাকে।
যার যার শিক্ষাদীক্ষা, কর্ম ও ভাবনা অনুযায়ী সারা দুনিয়ার মানুষকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে-১. বুদ্ধিমান মানুষ ও ২. হৃদয়বান মানুষ। সেনাবাহিনীর এক কর্নেলের হঠাৎ কুয়ার ভেতরে পড়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে উদ্ধার হওয়ার চমকপ্রদ গল্পটি বোধকরি অনেকেরই জানা। যারা জানেন না অথবা ভুলে গেছেন, তাদের উদ্দেশে গল্পটি নতুন করে বলে নিই : এক কর্নেল কুয়ার মধ্যে পড়ে গেছেন। তিন দিন পর সাংবাদিকরা অনেক চেষ্টা করে অসুস্থ অবস্থায় তাকে কুয়া থেকে টেনে তুললেন। সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চাইলেন-‘তিন দিন ধরে আপনি কুয়ার ভেতর পড়ে রইলেন, কেউ আপনাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি?’ সাংবাদিকদের করা এমন প্রশ্নের জবাবে কর্নেল বললেন-‘আমাকে উদ্ধার করতে কেউ এগিয়ে আসেনি সে কথা ঠিক নয়, এসেছিল। প্রথমে এসে আমার সৈনিকরা অনেক চেষ্টা করেছে। তারা দড়ি দিয়ে টেনে আমাকে যখন প্রায় তুলে ফেলে, তখনই ওদের চোখ পড়ে আমার ব্যাজের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে দড়ি ছেড়ে দিয়ে ওরা আমাকে স্যালুট দেয় আর আমি আবার কুয়ার মধ্যে পড়ে যাই। এরপর আমাকে উদ্ধার করার জন্য ব্রিগেড কমান্ডার নিজে এলেন। তিনি দড়ি টেনে আমাকে তোলার জন্য সাধ্যানুসারে চেষ্টা করলেন এবং আমি প্রায় উঠেই গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন আমার সিনিয়র স্যারকে দেখলাম, তক্ষুনি দড়ি ছেড়ে দিয়ে স্যালুট দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি আবারও কুয়ার ভেতর পড়ে গেলাম।’
সবসময় শতভাগ আইন-নিয়ম মেনে চললেই সফলতা আসবে, তা কিন্তু নয়। মনে রাখতে হবে, আইন-নিয়ম মানার পাশাপাশি কখনো কখনো কমন সেন্সের প্রয়োগটাও অতি জরুরি হয়ে পড়ে। হৃদয়জাত জ্ঞানের সঙ্গে কমন সেন্স বা সাধারণজ্ঞানের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। কম আর বেশি এমনটি প্রায় সবখানেই ঘটছে বা ঘটে চলেছে বলে দেখা ও শোনা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত অসংখ্য। বিভিন্ন কলেজে সময় সময় নানা কোর্স ও বিভাগ খোলা হয়। এমন একটি উপলক্ষ্যে একবার কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটি টিম এলো। টিমের অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন বিভিন্ন বিভাগের বেশ কজন অভিজ্ঞ শিক্ষক ও কর্মকর্তা। কলেজজুড়ে উৎসবের আমেজ। আছে খানাপিনার ভালো বন্দোবস্ত। সবাই খেলেন, মোট দশ-বারোজন অতিথির মধ্যে একজন খেলেন না। পরিদর্শন ও অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করে ফিরে যাওয়ার সময় আসা-যাওয়ার খরচ ছাড়াও কলেজের পক্ষ থেকে প্রত্যেকের হাতে সম্মানি হিসাবে তুলে দেওয়া হলো একটি করে ‘হলুদ খাম’। ওই কর্মকর্তা তা-ও নিলেন না। তার ভাষ্য : ‘দায়িত্বপূর্ণ পদে আছি। কলেজ ও এলাকাবাসীর স্বার্থে যতটুকু করা যায় করব। নিয়ম অনুযায়ী আমার টিএ-ডিএ বিল হয়। এর বাইরে আমার পক্ষে কিছু করা বা গ্রহণ করা অনুচিত বলে মনে করি।’
অতিসাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত অথচ অনেক উন্নত ভাবনার অধিকারী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ ও কথা বলার সুযোগ এ নিবন্ধকারেরও হয়েছে। বিচিত্র ও বিশাল জগৎ এবং নানা বৈশিষ্ট্যের মানুষ সম্বন্ধে কতটুকুই বা সাধারণের জানা। একশ্রেণির লোক আছে, যারা বাইরে বেশ ফিটফাট, ভেতরে জঞ্জাল। আবার এমনও আছে, যারা ঠিক বাইরের মতোই ভেতরের দিক থেকেও বেশ পরিপাটি ও গোছাল। এখানেই অ্যারিস্টটলের মস্তিষ্কজাত জ্ঞান ও হৃদয়জাত জ্ঞানের মধ্যকার মূল পার্থক্য।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
জ্ঞান ও প্রয়োগ
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ খ্যাতিমান মানবতাবাদী সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘হৃদয়ে এবং মস্তিষ্কের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব জাগে, তখন তুমি হৃদয়কেই গ্রহণ করো। কারণ, বুদ্ধিমান মানুষের চেয়ে হৃদয়বান মানুষ অনেক শ্রেয়। বুদ্ধিমান বুদ্ধি দিয়ে ভালোও করতে পারে, খারাপও করতে পারে; কিন্তু হৃদয়বান কেবল ভালোই করবে।’
প্রাচীনকালে দুনিয়ার প্রসিদ্ধ জ্ঞানী ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস (৪৭০-৩৯৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। শিক্ষা ও তার সত্যানুসন্ধানী দর্শনের জন্য তিনি শাসক এবং একশ্রেণির লোকের কাছে ছিলেন চক্ষুশূলস্বরূপ। তিনি ওইসব প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরাগভাজন হন। তাদের অভিযোগে প্রহসনমূলক এক বিচারে সক্রেটিসের প্রতি প্রাণদণ্ডাদেশ প্রদত্ত হয়। বিচারের রায়কে শিরোধার্য করে হেমলক নামের বিষ পান করে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘নিজেকে জানো’ (Know thyself)-এই ছিল সক্রেটিসের শিক্ষা ও দর্শনের মূলকথা। সমসাময়িককালে দর্শন, গণিত, সংগীতসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়েই ছিল সক্রেটিসের একাধিপত্য। সক্রেটিসের শিষ্যদের মধ্যে প্রধান ছিলেন আরেক বিস্ময়কর প্রতিভা প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। আর প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। জ্ঞানচর্চা-সাধনা-গবেষণা ও বিস্তার-বিস্তৃতির সে কী পরম্পরা! গ্রিক বীর আলেকজান্ডার (৩৫৬-৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) অ্যারিস্টটলেরই শিষ্য ছিলেন।
অ্যারিস্টটল ছিলেন অনন্যসাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তি। সমসাময়িককালে গুরুত্বপূর্ণ এমন কোনো বিষয় ছিল না, যা তিনি আয়ত্ত করেননি। অ্যারিস্টটল যে কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে গবেষণা ও গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তর্কশাস্ত্র, ব্যাকরণ, অলংকারশাস্ত্র, সাহিত্য-সমালোচনা, প্রকৃতি-বিজ্ঞান, মনস্তত্ব, শারীরতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি অসংখ্য বই লিখেছেন। জ্ঞানের আকর তার বইগুলো সব কালে এবং সব দেশের পণ্ডিতদের কাছে অমূল্য ও বিস্ময়ের সামগ্রী। অ্যারিস্টটল রচিত ‘Ethics’, ‘Poetics’, ‘Politics’ ইত্যাদি গ্রন্থ অত্যন্ত সুপ্রসিদ্ধ। অ্যারিস্টটলকে বলা হয় ‘সব জ্ঞানীর গুরু’ (The master of all who know)।
বলা হয়ে থাকে, জ্ঞান ও যোগ্যতা দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। আর সততা-সদিচ্ছা ও কর্মনিষ্ঠা দিয়ে আরও বেশি কিছু, ভালো কিছু করা যায়। গতানুগতিক কিংবা কেবল কাজের জন্যই কাজ নয়, কোনো কিছু করার আগে হৃদয়ের মাঝ থেকেও একটি তাড়না থাকা চাই। অ্যারিস্টটলের মতে, জ্ঞান (নলেজ) দুই প্রকারের। একচুয়েল নলেজ ও রিয়েল নলেজ। আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যায় ‘একচুয়েল’ ও ‘রিয়েল’ শব্দ দুটির একই অর্থ। কিন্তু না, শব্দ দুটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বাংলা করলে হতে পারে প্রথমটি মস্তিষ্কজাত ও দ্বিতীয়টি হৃদয়জাত। মস্তিষ্কজাত বা প্রকৃত জ্ঞান দিয়েই মানুষ সবকিছু করছে; পড়াশোনা, ডিগ্রি লাভ, চাকরি, জীবন-জীবিকা-এমন সবকিছু। তবে সব সময় নাও হতে পারে; মানুষের হৃদয়জাত বা আসল জ্ঞানের পরিচয় কখনো কখনো পাওয়া যায়।
ধরা যাক, বিকাল ৪টায় নির্ধারিত সময় শেষ, আরও ১০ মিনিট পরে জনৈক গ্রাহক চেক লিখে নিয়ে গেলেন ব্যাংক থেকে টাকা ওঠাতে। দুঃসহ যানজটের কবলে পড়ে সময়মতো এসে পৌঁছতে পারেননি, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় জরুরি টাকার দরকার তার। ফলে দেখা দিল বিপত্তি, টাকা ওঠাতে পারছেন না তিনি। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক ম্যানেজারের করণীয় কী? ঘড়ির কাঁটাটি ‘৪টা’ গড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর সবকিছুই স্বাভাবিক রয়েছে। শেষবেলায় ম্যানেজারসহ সব কর্মী যথারীতি যার যার কাজ করে চলেছেন। ৬টায় অফিস বন্ধ করার কথা। ম্যানেজার ইচ্ছা করলে সহজে এবং আইন অনুযায়ী গ্রাহক ভদ্রলোকটিকে টাকা না দিয়ে ফেরত পাঠাতে পারেন। এখানে আইনের বাইরে গ্রাহকের পক্ষে ম্যানেজারকে প্রভাবিত করার কিছু নেই। কিন্তু পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় এক্ষেত্রে ম্যানেজার আইনের বাইরেও ভিন্ন কিছু ভাবতে পারেন, সে সুযোগটি তার সামনে রয়েছে। সব কর্মী উপস্থিত, হিসাব-নিকাশ একেবারে ক্লোজ করে ফেলা হয়নি। তার অফিসে ম্যানেজারই সর্বেসর্বা। অফিসের প্রধান হিসাবে ম্যানেজারের অধীনে বাকি সবাই। কাজটি করে দিতে পারলে ভদ্রলোক বাড়ি যাবেন, টাকা নিয়ে হয়তো রাতের আঁধারেই হাসপাতালের দিকে ছুটতে হবে তাকে।
যার যার শিক্ষাদীক্ষা, কর্ম ও ভাবনা অনুযায়ী সারা দুনিয়ার মানুষকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে-১. বুদ্ধিমান মানুষ ও ২. হৃদয়বান মানুষ। সেনাবাহিনীর এক কর্নেলের হঠাৎ কুয়ার ভেতরে পড়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে উদ্ধার হওয়ার চমকপ্রদ গল্পটি বোধকরি অনেকেরই জানা। যারা জানেন না অথবা ভুলে গেছেন, তাদের উদ্দেশে গল্পটি নতুন করে বলে নিই : এক কর্নেল কুয়ার মধ্যে পড়ে গেছেন। তিন দিন পর সাংবাদিকরা অনেক চেষ্টা করে অসুস্থ অবস্থায় তাকে কুয়া থেকে টেনে তুললেন। সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চাইলেন-‘তিন দিন ধরে আপনি কুয়ার ভেতর পড়ে রইলেন, কেউ আপনাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি?’ সাংবাদিকদের করা এমন প্রশ্নের জবাবে কর্নেল বললেন-‘আমাকে উদ্ধার করতে কেউ এগিয়ে আসেনি সে কথা ঠিক নয়, এসেছিল। প্রথমে এসে আমার সৈনিকরা অনেক চেষ্টা করেছে। তারা দড়ি দিয়ে টেনে আমাকে যখন প্রায় তুলে ফেলে, তখনই ওদের চোখ পড়ে আমার ব্যাজের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে দড়ি ছেড়ে দিয়ে ওরা আমাকে স্যালুট দেয় আর আমি আবার কুয়ার মধ্যে পড়ে যাই। এরপর আমাকে উদ্ধার করার জন্য ব্রিগেড কমান্ডার নিজে এলেন। তিনি দড়ি টেনে আমাকে তোলার জন্য সাধ্যানুসারে চেষ্টা করলেন এবং আমি প্রায় উঠেই গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন আমার সিনিয়র স্যারকে দেখলাম, তক্ষুনি দড়ি ছেড়ে দিয়ে স্যালুট দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি আবারও কুয়ার ভেতর পড়ে গেলাম।’
সবসময় শতভাগ আইন-নিয়ম মেনে চললেই সফলতা আসবে, তা কিন্তু নয়। মনে রাখতে হবে, আইন-নিয়ম মানার পাশাপাশি কখনো কখনো কমন সেন্সের প্রয়োগটাও অতি জরুরি হয়ে পড়ে। হৃদয়জাত জ্ঞানের সঙ্গে কমন সেন্স বা সাধারণজ্ঞানের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। কম আর বেশি এমনটি প্রায় সবখানেই ঘটছে বা ঘটে চলেছে বলে দেখা ও শোনা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত অসংখ্য। বিভিন্ন কলেজে সময় সময় নানা কোর্স ও বিভাগ খোলা হয়। এমন একটি উপলক্ষ্যে একবার কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটি টিম এলো। টিমের অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন বিভিন্ন বিভাগের বেশ কজন অভিজ্ঞ শিক্ষক ও কর্মকর্তা। কলেজজুড়ে উৎসবের আমেজ। আছে খানাপিনার ভালো বন্দোবস্ত। সবাই খেলেন, মোট দশ-বারোজন অতিথির মধ্যে একজন খেলেন না। পরিদর্শন ও অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করে ফিরে যাওয়ার সময় আসা-যাওয়ার খরচ ছাড়াও কলেজের পক্ষ থেকে প্রত্যেকের হাতে সম্মানি হিসাবে তুলে দেওয়া হলো একটি করে ‘হলুদ খাম’। ওই কর্মকর্তা তা-ও নিলেন না। তার ভাষ্য : ‘দায়িত্বপূর্ণ পদে আছি। কলেজ ও এলাকাবাসীর স্বার্থে যতটুকু করা যায় করব। নিয়ম অনুযায়ী আমার টিএ-ডিএ বিল হয়। এর বাইরে আমার পক্ষে কিছু করা বা গ্রহণ করা অনুচিত বলে মনে করি।’
অতিসাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত অথচ অনেক উন্নত ভাবনার অধিকারী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ ও কথা বলার সুযোগ এ নিবন্ধকারেরও হয়েছে। বিচিত্র ও বিশাল জগৎ এবং নানা বৈশিষ্ট্যের মানুষ সম্বন্ধে কতটুকুই বা সাধারণের জানা। একশ্রেণির লোক আছে, যারা বাইরে বেশ ফিটফাট, ভেতরে জঞ্জাল। আবার এমনও আছে, যারা ঠিক বাইরের মতোই ভেতরের দিক থেকেও বেশ পরিপাটি ও গোছাল। এখানেই অ্যারিস্টটলের মস্তিষ্কজাত জ্ঞান ও হৃদয়জাত জ্ঞানের মধ্যকার মূল পার্থক্য।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক