একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ
গত ৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের বিচারক (ছুটি, পেনশন ও বিশেষ অধিকার) বিলের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টি ও গণফোরামের তিনজন সংসদ-সদস্য উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের দাবি জানালে উপর্যুক্ত বিলটি পাশের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদ-সদস্যদের দাবির জবাবে জানান যে, ‘উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন করার কাজ চলছে।
কিছু দিনের মধ্যে এ আইন জাতীয় সংসদে তোলা হবে।’ এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো খবর এবং এ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকার প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। আইনটি প্রণয়ন কেন জরুরি, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের (অতঃপর মূল সংবিধান নামে অভিহিত) ৯৪[(১) ও (২)] অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট’ নামে বাংলাদেশের একটি সর্বোচ্চ আদালত থাকবে এবং আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে তা গঠিত হবে। প্রধান বিচারপতি এবং প্রত্যেক বিভাগে আসন গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি যেরূপসংখ্যক বিচারক নিয়োগের প্রয়োজন বোধ করবেন, সেরূপসংখ্যক অন্যান্য বিচারক নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট গঠিত হবে।’ মূল সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে এবং (ক) সুপ্রিমকোর্টে অন্যূন ১০ বছরকাল অ্যাডভোকেট না থেকে থাকলে, অথবা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন ১০ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে, কিংবা অন্যূন দশ বছরকাল অ্যাডভোকেট না থেকে থাকলে এবং অন্যূন তিন বছর জেলা-বিচারকের ক্ষমতা নির্বাহ না করে থাকলে তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।
পরবর্তী সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৯৫(২) অনুচ্ছেদে সংশোধন আনা হয়। সংশোধিত অনুচ্ছেদটি হলো-কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে এবং (ক) সুপ্রিমকোর্টে অন্যূন ১০ বছরকাল অ্যাডভোকেট না থেকে থাকলে; অথবা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন ১০ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে; অথবা (গ) সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থেকে থাকলে তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে মূল সংবিধানের দুটি শর্ত বাদ দেওয়া হয়। এ দুটি শর্তের একটি হলো অন্যূন ১০ বছরকাল অ্যাডভোকেট হিসাবে কর্মরত থাকা। উল্লেখ্য, অন্যূন ১০ বছরকাল অ্যাডভোকেট হিসাবে অবস্থান উচ্চ আদালত নাকি অধস্তন আদালতে হবে, তা মূল সংবিধানে স্পষ্ট করা হয়নি।
এর ফলে অধস্তন আদালতে ১০ বছর কর্মরত থাকা একজন অ্যাডভোকেট উচ্চ আদালতে বিচারক পদে নিয়োগ লাভে যোগ্য বিবেচিত হওয়ার দাবিদার ছিলেন। দ্বিতীয় যে বিষয়টি পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাদ দেওয়া হয় সেটি হলো, কমপক্ষে তিন বছর জেলা-বিচারকের ক্ষমতা নির্বাহ করা। যে বিষয়টি অনুচ্ছেদে সংযোজন করা হয় সেটি হলো, সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে কোনো ব্যক্তি উচ্চ আদালতে বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য না হওয়া। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও অন্যসব বিরোধী দল সংসদে উপস্থিত না থাকায় এবং একমাত্র স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য নোয়াখালী-৬ আসন থেকে নির্বাচিত ফজলুল আজিম অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করায় বাস্তবে কোনো বিতর্ক ছাড়াই ৯৫(২) অনুচ্ছেদের সংশোধনীসহ পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাশ হয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হলেও বিগত এক দশকে সরকার আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়নি। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, আইনজ্ঞ ও আইনজীবী সমিতির প্রস্তাবের প্রতি কোনো গুরুত্বারোপ করা হয়নি। ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে এ বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য জানা যায়। এতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ২ মার্চ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ এক রায়ে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে একটি নীতিমালা করার পক্ষে মত দেন। ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগ উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে সাত দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। বিচারক নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা আনতে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনায় বলা হয়, সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে বিচারক নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করা যেতে পারে। আবেদনকারী ব্যক্তিকে সম্পদের বিবরণ উল্লেখসহ সুপ্রিমকোর্টে সাক্ষাৎকার দিতে হবে।
এটি বিচারক নিয়োগকে অধিকতর স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করার একটি উৎকৃষ্ট পন্থা। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সুপারিশ করা ব্যক্তির শিক্ষাজীবনে দারুণ ফলাফল, সমৃদ্ধ পেশাগত দক্ষতা, আইনগত বিচক্ষণতা ও একাগ্রতা থাকতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনার পর ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকর কমিটির সাধারণ সভায় হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন করে বিচারপতি নিয়োগ করার দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তার বিদায় সংবর্ধনায় বলেছিলেন, সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা বাস্তবতার নিরিখে অপরিহার্য। এতে বিচারপতি নিয়োগের কাজ আরও স্বচ্ছ ও দ্রুততর হবে।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে দেশ শাসনের দায়িত্বে থেকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগকে দলীয়করণ করে। উল্লেখ্য, সুপ্রিমকোর্টের সব পর্যায়ে বিচারক নিয়োগ দলীয়করণ করার সুযোগ থাকলেও এ সুযোগটির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় বিচারক হিসাবে নিয়োগের প্রবেশদ্বার হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগে। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি অনধিক দুই বছরের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করতে পারেন। এভাবে নিযুক্ত কোনো অতিরিক্ত বিচারককে দুই বছর বা বর্ধিত সময়ের মধ্যে স্থায়ী না করা হলে তিনি ওই পদে বহাল থাকেন না।
উদাহরণস্বরূপ, ২০০৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৯ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হয়। তৎকালীন সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন (এসসিবিএ) এ নিয়োগকে দলীয়করণ হিসাবে আখ্যায়িত করে তা বাতিলের জন্য আন্দোলন শুরু করে। কোন বিবেচনায় এ নিয়োগ প্রদান করা হয় তা জানাতে এসসিবিএ তৎকালীন আইনমন্ত্রীকে নোটিশ প্রদানের এবং মন্ত্রীর জবাব সন্তোষজনক না হলে হাইকোর্ট বিভাগে রিট করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনুরূপভাবে ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ১৭ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হয়। এসসিবিএ এ নিয়োগের বিরুদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ আনে।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে নিযুক্তি পাওয়া ১৭ জনের মধ্যে ১৫ জনকে শপথবাক্য পাঠ করালেও দুজনকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এ দুজনের শপথবাক্য পাঠ করান। উচ্চ আদালতের অন্যান্য স্তরে নিয়োগেও দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে।
উচ্চ আদালতে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির ভূমিকা নিয়েও রাজনীতি করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত এবং ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বিধান করা হয়, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করবেন। সংবিধান গৃহীত ও কার্যকর হওয়ার দুই বছর পার হতে না হতেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) মাধ্যমে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করা সংক্রান্ত বিধানটুকু বিলোপ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি এএসএম সায়েম এক আদেশের (Second Proclamation Order No. IV of 1976) মাধ্যমে মূল সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল করেন। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করাসংক্রান্ত বিধান পুনর্বহাল করা হয়। সায়েম পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা গ্রহণকারী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এক আদেশে (Second Proclamation Order No.I of 1977) ৪র্থ সংশোধনীর ফলে ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল, সেটিকে ঠিক ওই অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করাসংক্রান্ত বিধান রহিত করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মূল সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল করা হয়।
এখন দেখা যাক আমাদের পাশের দেশগুলোয় উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে কী পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ভারতের সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশনের সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি দেশটির সুপ্রিমকোর্টে প্রত্যেক বিচারককে নিয়োগদান করেন। সংবিধানের ২১৭ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের গভর্নর এবং হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি কোনো হাইকোর্টে অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দেন।
২০১০ সালের ১৮তম এবং ২০১১ সালের ১৯তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তানের উচ্চ আদালতে অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট এবং ফেডারেল শরিয়াহ কোর্টে বিচারক নিয়োগে আমূল পরিবর্তন আনা হয়। এতে সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট এবং ফেডারেল শরিয়াহ কোর্টে বিচারক নিয়োগে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের বিধান করা হয়। চেয়ারম্যান বাদে এ কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন-সুপ্রিমকোর্টের চারজন জ্যেষ্ঠতম বিচারক (senior most judges), একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অথবা প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিমকোর্টের একজন সাবেক বিচারপতি, ফেডারেল আইন ও বিচারমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বার কাউন্সিল মনোনীত একজন জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট। এ কমিশন প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে একজনের নাম সুপারিশ করে পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে প্রেরণ করে। আট সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টারি কমিটি কমিশন কর্তৃক সুপারিশকৃত নাম গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। গ্রহণের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টারি কমিটি কমিশন কর্তৃক সুপারিশকৃত নাম কনফার্ম করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরণ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী তা অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করেন। সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারককেই (most senior Judge of the Supreme Court) দেশটির প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেন।
২০১৫ সালে গৃহীত নেপালের সংবিধানের ১২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি দেশটির প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগদান করেন। জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করেন। সংবিধানের ১৪০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে দেশটির প্রধান বিচারপতি কোনো হাইকোর্টের প্রধান বিচারক ও অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করেন। সংবিধানের ১৪৯ অনুচ্ছেদ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে দেশটির প্রধান বিচারপতি জেলা আদালতে বিচারকদের নিয়োগদান করেন।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে, বিশেষ করে পাকিস্তান ও নেপালে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা একেবারে সীমিত। ওইসব দেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে সুপারিশ প্রদানের জন্য গঠিত ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন/কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল/ জুডিশিয়াল কাউন্সিল ইত্যাদির সুপারিশে নির্বাহী বিভাগের তথা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রদান রুটিন বিষয় মাত্র। আমাদের দেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ আইন প্রণয়নে ওইসব দেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের বিধানাবলি পর্যালোচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
স্বদেশ ভাবনা
একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ
গত ৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের বিচারক (ছুটি, পেনশন ও বিশেষ অধিকার) বিলের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টি ও গণফোরামের তিনজন সংসদ-সদস্য উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের দাবি জানালে উপর্যুক্ত বিলটি পাশের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদ-সদস্যদের দাবির জবাবে জানান যে, ‘উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন করার কাজ চলছে।
কিছু দিনের মধ্যে এ আইন জাতীয় সংসদে তোলা হবে।’ এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো খবর এবং এ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকার প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। আইনটি প্রণয়ন কেন জরুরি, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের (অতঃপর মূল সংবিধান নামে অভিহিত) ৯৪[(১) ও (২)] অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট’ নামে বাংলাদেশের একটি সর্বোচ্চ আদালত থাকবে এবং আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে তা গঠিত হবে। প্রধান বিচারপতি এবং প্রত্যেক বিভাগে আসন গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি যেরূপসংখ্যক বিচারক নিয়োগের প্রয়োজন বোধ করবেন, সেরূপসংখ্যক অন্যান্য বিচারক নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট গঠিত হবে।’ মূল সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে এবং (ক) সুপ্রিমকোর্টে অন্যূন ১০ বছরকাল অ্যাডভোকেট না থেকে থাকলে, অথবা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন ১০ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে, কিংবা অন্যূন দশ বছরকাল অ্যাডভোকেট না থেকে থাকলে এবং অন্যূন তিন বছর জেলা-বিচারকের ক্ষমতা নির্বাহ না করে থাকলে তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।
পরবর্তী সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৯৫(২) অনুচ্ছেদে সংশোধন আনা হয়। সংশোধিত অনুচ্ছেদটি হলো-কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে এবং (ক) সুপ্রিমকোর্টে অন্যূন ১০ বছরকাল অ্যাডভোকেট না থেকে থাকলে; অথবা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন ১০ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে; অথবা (গ) সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থেকে থাকলে তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে মূল সংবিধানের দুটি শর্ত বাদ দেওয়া হয়। এ দুটি শর্তের একটি হলো অন্যূন ১০ বছরকাল অ্যাডভোকেট হিসাবে কর্মরত থাকা। উল্লেখ্য, অন্যূন ১০ বছরকাল অ্যাডভোকেট হিসাবে অবস্থান উচ্চ আদালত নাকি অধস্তন আদালতে হবে, তা মূল সংবিধানে স্পষ্ট করা হয়নি।
এর ফলে অধস্তন আদালতে ১০ বছর কর্মরত থাকা একজন অ্যাডভোকেট উচ্চ আদালতে বিচারক পদে নিয়োগ লাভে যোগ্য বিবেচিত হওয়ার দাবিদার ছিলেন। দ্বিতীয় যে বিষয়টি পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাদ দেওয়া হয় সেটি হলো, কমপক্ষে তিন বছর জেলা-বিচারকের ক্ষমতা নির্বাহ করা। যে বিষয়টি অনুচ্ছেদে সংযোজন করা হয় সেটি হলো, সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে কোনো ব্যক্তি উচ্চ আদালতে বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য না হওয়া। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও অন্যসব বিরোধী দল সংসদে উপস্থিত না থাকায় এবং একমাত্র স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য নোয়াখালী-৬ আসন থেকে নির্বাচিত ফজলুল আজিম অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করায় বাস্তবে কোনো বিতর্ক ছাড়াই ৯৫(২) অনুচ্ছেদের সংশোধনীসহ পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাশ হয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হলেও বিগত এক দশকে সরকার আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়নি। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, আইনজ্ঞ ও আইনজীবী সমিতির প্রস্তাবের প্রতি কোনো গুরুত্বারোপ করা হয়নি। ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে এ বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য জানা যায়। এতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ২ মার্চ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ এক রায়ে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে একটি নীতিমালা করার পক্ষে মত দেন। ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগ উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে সাত দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। বিচারক নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা আনতে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনায় বলা হয়, সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে বিচারক নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করা যেতে পারে। আবেদনকারী ব্যক্তিকে সম্পদের বিবরণ উল্লেখসহ সুপ্রিমকোর্টে সাক্ষাৎকার দিতে হবে।
এটি বিচারক নিয়োগকে অধিকতর স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করার একটি উৎকৃষ্ট পন্থা। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সুপারিশ করা ব্যক্তির শিক্ষাজীবনে দারুণ ফলাফল, সমৃদ্ধ পেশাগত দক্ষতা, আইনগত বিচক্ষণতা ও একাগ্রতা থাকতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনার পর ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকর কমিটির সাধারণ সভায় হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন করে বিচারপতি নিয়োগ করার দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তার বিদায় সংবর্ধনায় বলেছিলেন, সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা বাস্তবতার নিরিখে অপরিহার্য। এতে বিচারপতি নিয়োগের কাজ আরও স্বচ্ছ ও দ্রুততর হবে।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে দেশ শাসনের দায়িত্বে থেকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগকে দলীয়করণ করে। উল্লেখ্য, সুপ্রিমকোর্টের সব পর্যায়ে বিচারক নিয়োগ দলীয়করণ করার সুযোগ থাকলেও এ সুযোগটির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় বিচারক হিসাবে নিয়োগের প্রবেশদ্বার হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগে। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি অনধিক দুই বছরের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করতে পারেন। এভাবে নিযুক্ত কোনো অতিরিক্ত বিচারককে দুই বছর বা বর্ধিত সময়ের মধ্যে স্থায়ী না করা হলে তিনি ওই পদে বহাল থাকেন না।
উদাহরণস্বরূপ, ২০০৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৯ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হয়। তৎকালীন সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন (এসসিবিএ) এ নিয়োগকে দলীয়করণ হিসাবে আখ্যায়িত করে তা বাতিলের জন্য আন্দোলন শুরু করে। কোন বিবেচনায় এ নিয়োগ প্রদান করা হয় তা জানাতে এসসিবিএ তৎকালীন আইনমন্ত্রীকে নোটিশ প্রদানের এবং মন্ত্রীর জবাব সন্তোষজনক না হলে হাইকোর্ট বিভাগে রিট করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনুরূপভাবে ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ১৭ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হয়। এসসিবিএ এ নিয়োগের বিরুদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ আনে।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে নিযুক্তি পাওয়া ১৭ জনের মধ্যে ১৫ জনকে শপথবাক্য পাঠ করালেও দুজনকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এ দুজনের শপথবাক্য পাঠ করান। উচ্চ আদালতের অন্যান্য স্তরে নিয়োগেও দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে।
উচ্চ আদালতে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির ভূমিকা নিয়েও রাজনীতি করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত এবং ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বিধান করা হয়, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করবেন। সংবিধান গৃহীত ও কার্যকর হওয়ার দুই বছর পার হতে না হতেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) মাধ্যমে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করা সংক্রান্ত বিধানটুকু বিলোপ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি এএসএম সায়েম এক আদেশের (Second Proclamation Order No. IV of 1976) মাধ্যমে মূল সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল করেন। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করাসংক্রান্ত বিধান পুনর্বহাল করা হয়। সায়েম পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা গ্রহণকারী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এক আদেশে (Second Proclamation Order No.I of 1977) ৪র্থ সংশোধনীর ফলে ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল, সেটিকে ঠিক ওই অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করাসংক্রান্ত বিধান রহিত করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মূল সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল করা হয়।
এখন দেখা যাক আমাদের পাশের দেশগুলোয় উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে কী পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ভারতের সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশনের সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি দেশটির সুপ্রিমকোর্টে প্রত্যেক বিচারককে নিয়োগদান করেন। সংবিধানের ২১৭ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের গভর্নর এবং হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি কোনো হাইকোর্টে অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দেন।
২০১০ সালের ১৮তম এবং ২০১১ সালের ১৯তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তানের উচ্চ আদালতে অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট এবং ফেডারেল শরিয়াহ কোর্টে বিচারক নিয়োগে আমূল পরিবর্তন আনা হয়। এতে সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট এবং ফেডারেল শরিয়াহ কোর্টে বিচারক নিয়োগে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের বিধান করা হয়। চেয়ারম্যান বাদে এ কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন-সুপ্রিমকোর্টের চারজন জ্যেষ্ঠতম বিচারক (senior most judges), একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অথবা প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিমকোর্টের একজন সাবেক বিচারপতি, ফেডারেল আইন ও বিচারমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বার কাউন্সিল মনোনীত একজন জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট। এ কমিশন প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে একজনের নাম সুপারিশ করে পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে প্রেরণ করে। আট সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টারি কমিটি কমিশন কর্তৃক সুপারিশকৃত নাম গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। গ্রহণের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টারি কমিটি কমিশন কর্তৃক সুপারিশকৃত নাম কনফার্ম করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরণ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী তা অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করেন। সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারককেই (most senior Judge of the Supreme Court) দেশটির প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেন।
২০১৫ সালে গৃহীত নেপালের সংবিধানের ১২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি দেশটির প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগদান করেন। জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করেন। সংবিধানের ১৪০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে দেশটির প্রধান বিচারপতি কোনো হাইকোর্টের প্রধান বিচারক ও অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করেন। সংবিধানের ১৪৯ অনুচ্ছেদ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে দেশটির প্রধান বিচারপতি জেলা আদালতে বিচারকদের নিয়োগদান করেন।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে, বিশেষ করে পাকিস্তান ও নেপালে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা একেবারে সীমিত। ওইসব দেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে সুপারিশ প্রদানের জন্য গঠিত ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন/কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল/ জুডিশিয়াল কাউন্সিল ইত্যাদির সুপারিশে নির্বাহী বিভাগের তথা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রদান রুটিন বিষয় মাত্র। আমাদের দেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ আইন প্রণয়নে ওইসব দেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের বিধানাবলি পর্যালোচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com