বিশ্বমন্দার অবসান জরুরি
বিশ্বকবি রবিঠাকুরের ছোটগল্পের পরিধি প্রাসঙ্গিকতায় করোনা মহামারির ক্ষেত্রে বলা যায়, ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’।
কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে যে নির্দয় তাণ্ডব চালিয়েছে, তা বহুলাংশে স্তিমিত হলেও চীনসহ নানা দেশে ভিন্ন প্রকরণে চলমান রয়েছে। অনুন্নত-উন্নয়নশীল দেশগুলো চরম ক্ষতিগ্রস্ত আর্থসামাজিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে ঐকান্তিক প্রয়াসের সূচনাপর্বেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন করে ভয়াবহ সংকট তৈরি করছে।
খাদ্য-জ্বালানিসহ নানামুখী বিপর্যস্ততা একদিকে বিশ্বব্যবস্থাকে লন্ডভন্ড করে চলেছে; অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধের উত্তাপ ভয়ংকর দাবানল সৃষ্টির রূপ পরিগ্রহ করছে।
২৩ জানুয়ারি মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশনস) অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত সংকট কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করতে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকার কারণে তার সরকার বিগত ১৪ বছরে বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়ন করতে পেরেছে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন অনুযায়ী দেশবাসীকে একটি সুন্দর ও উন্নত জীবন দিতে অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারির আগে বাংলাদেশে জিডিপি ক্রমাগত আট শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন অব্যাহত ছিল। কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যসামগ্রী ও পরিবহণ ব্যয় আকাশচুম্বী হওয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলো সমস্যায় পড়েছে; কিন্তু মহামারি থেকে বেরিয়ে আসার পর জিডিপি হ্রাস পেয়েছে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করেছে, যা এখন পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে।’
ধরিত্রীর সমগ্র সচেতন মহলে গভীর আতঙ্ক-আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বিশ্ব কি দ্রুত ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে! পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মতানুসারে, পৃথিবী বসবাসের জন্য ভয়ানক স্থান; খারাপ লোকের জন্য নয়, কিন্তু সেসব লোকের জন্য, যারা এ বিষয়ে কিছু করেন না। নোবেল অর্জনকারী সর্বপ্রথম নারী বিজ্ঞানী ম্যারি কুরির ভাষায়, ‘আপনি আপনার আপন সত্তার বিকাশ না ঘটিয়ে আরও উন্নত কোনো পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে পারেন না। উন্নত পৃথিবীর জন্য আমাদের সর্বাগ্রে নিজেদের সত্তার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।’
বিখ্যাত ব্রিটিশ জ্যোতিঃপদার্থবিদ অধ্যাপক উইলিয়াম স্টিফেন হকিংয়ের মতে, মহাবিশ্ব যেমন একটি বিন্দু থেকে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে, তেমনই এর শেষ পরিণতি হলো বৃহৎ সংকোচনের মাধ্যমে আরেকটি বিন্দু, যা পরম বিন্দু নামে পরিচিত। তবে সমগ্র বিশ্ব একই সঙ্গে বৃহৎ সংকোচনের মাধ্যমে চুপসে না-ও যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কোনো স্থানিক অঞ্চলে অনন্যতা দেখা দেবে, যেটা চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি করবে।
অতিসম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউভুক্ত কয়েকটি দেশের ইউক্রেনকে ট্যাংক-যুদ্ধযান-আকাশ প্রতিরক্ষা-রকেট-ড্রোনসহ অত্যাধুনিক ভারী সমরাস্ত্র সরবরাহের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থার (ওএসসিই) রুশ ডেপুটি রাষ্ট্রদূত ম্যাক্সিম বুয়াকেভিচ সতর্ক করে বলেন-ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
এর ফলে বিশ্বে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আমেরিকার ‘বেপরোয়া নয়া-ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণবাদী নীতি’ ইউরোপ এবং সম্ভবত বিশ্বকে একটি ধ্বংসাত্মক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে ফেলেছে। তার বক্তব্য অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো মিত্র রাষ্ট্রের নেতারা একটি লাল রেখার কাছাকাছি এসেছে। ইউক্রেনে চলমান সংঘাতের ক্রমাগত বৃদ্ধি একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের কঠিন ইঙ্গিত বহন করছে, যেখানে কেউই বিজয়ী হবে না। সামরিক সংঘাত বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের তিনি সরাসরি দায়ী করেন। তারাই ইউক্রেনকে রাশিয়ার জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে উসকানি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন। এ ধরনের যুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপ মহাদেশের জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সতর্ক করেছেন রাশিয়ার এ কূটনীতিক। একই প্রসঙ্গে রুশ শীর্ষ কর্মকর্তারাও হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ‘রাশিয়া তার ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রগুলো এখনো ব্যবহার করেনি। ইউরোপ-আমেরিকা যদি যুদ্ধ আরও বাড়িয়ে তোলে, তাহলে সেসব ব্যবহার করতে বাধ্য হবে ক্রেমলিন, যে বিপর্যয় ঠেকাতে পারবে না কেউ।’ উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরেই ইউক্রেন তার মিত্রদেশগুলোর কাছে ট্যাংক দিয়ে সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়ে আসছিল। এছাড়া রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে রুখতে বেশ আগে থেকেই পশ্চিমা মিত্রদের কাছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র চাইছিল ইউক্রেন।
গত ২৭ জানুয়ারি গণমাধ্যম সূত্রমতে, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ইউক্রেনে ৩১টি এম১এ১ আব্রামস ট্যাংক পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে জার্মানি ১৪টি লেপার্ড-২, যুক্তরাজ্য চ্যালেঞ্জার ট্যাংক ও কানাডা ৪টি লেপার্ড-২ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের তথ্যানুসারে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে এম১এ১ আব্রামস ট্যাংক পাঠানোর পর এম১এ২ ট্যাংকও পাঠাবে। কানাডিয়ান এক টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি জানান, তাদের প্রতিশ্রুত জার্মানির তৈরি লেপার্ড-২ ট্যাংকের পাশাপাশি অতিরিক্ত ৬০টি ট্যাংক পাঠাতে প্রস্তুত রয়েছে পোল্যান্ড। এর মধ্যে ৩০টি পিটি-৯১ মডেলের। বিশ্লেষকদের মতে, চলমান এ যুদ্ধে ইউক্রেনকে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাংক দেওয়ার ঘোষণা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো বিষয়। এর ফলে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন আক্রমণাত্মক যুদ্ধের সময় অত্যাধুনিক লেপার্ড টু ও এমওয়ান অ্যাব্রামস ট্যাংকগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে শক্ত প্রতিরোধ গড়তে সাহায্য করবে বলে মন্তব্য করেছেন সমর বিশেষজ্ঞ এবং মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদ আলী। তিনি আরও বলেন, ‘পশ্চিমা মিত্রের সামরিক সহযোগিতায় ইউক্রেনের হাত অনেক শক্তিশালী হয়েছে। তারা কেবল নিজের দেশেই প্রতিরোধ গড়ছে না, তারা রাশিয়ার ভেতরে গিয়েও হামলা চালাচ্ছে। কাজেই এ যুদ্ধ অত সহসা শেষ হবে বলে আমি মনে কারি না।’ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেনকে শুধু অত্যাধুনিক ট্যাংক ও সমরাস্ত্র নয়, একই সঙ্গে এসব পরিচালনার জন্য দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণও দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩০টির বেশি দেশ ইউক্রেনকে বিভিন্ন অস্ত্রসহ নানা সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে দেশটির পাশে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অস্ত্র-অর্থ সবদিক থেকেই ইউক্রেনকে সাহায্য করছে মার্কিন প্রশাসন। সিএনএনের তথ্যমতে, ইউক্রেন প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র, গোলা, ট্যাংক ও রকেটলঞ্চারসহ সব মিলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১৮৫ কোটি মার্কিন ডলারের সাহায্য পাচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে এ পর্যন্ত ২০০টিরও বেশি টি-৭২ ট্যাংক পেয়েছে ইউক্রেন। ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সাঁজোয়া যানও পেয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আরও ৯০টি স্ট্রাইকার এবং ইরাকে মার্কিন বাহিনীর ব্যবহৃত ৫৯টি ব্র্যাডলি পদাতিক ফাইটিং সাঁজোয়া যান পাঠানোর বিষয়টিও নিশ্চিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ একই ধরনের অস্ত্র পাঠিয়েছে। এর পাশাপাশি এক আঘাতেই ট্যাংক ধ্বংসে সক্ষম অস্ত্রও সরবরাহ করা হয়েছে।
পক্ষান্তরে, ন্যাটো জোট রাশিয়ার বিরুদ্ধে যদি সরাসরি কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তাহলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট স্বল্পপাল্লার কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছে। এতে শুধু ইউক্রেন নয়; পুরো ইউরোপজুড়েই পারমাণবিক ঝুঁকির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স মারফত জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পক্ষ থেকে উন্নত ট্যাংক দেওয়ার ঘোষণার পরপরই ইউক্রেনে তীব্র হামলা শুরু করেছে রুশ বাহিনী। ২৬ জানুয়ারি সকাল থেকেই রুশ সেনারা কিয়েভ ও ওদেসা অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। এর আগে রাতেও ব্যাপক ড্রোন হামলা চালানো হয়। ইউক্রেনের বিমানবাহিনীর মুখপাত্র জানান, ছয়টি টিউ-৯৫ যুদ্ধবিমান থেকে অন্তত ৩০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলায় প্রাণহানিসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত অক্টোবর থেকেই রুশ সেনারা ইউক্রেনের বিদ্যুৎ অবকাঠামোগুলো লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দাবি-অব্যাহত রুশ হামলার জেরে ইউক্রেনের প্রায় ৯০ লাখ মানুষ বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে। জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থাও (আইএইএ) একই দিনে ইউক্রেনে রুশ অধিকৃত জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে শক্তিশালী বিস্ফোরণের বিষয়ে জানানোর পাশাপাশি কেন্দ্রটির চারপাশে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করার আহ্বান জানায়।
২৭ ডিসেম্বর ২০২২ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে ইউক্রেন যুদ্ধে প্রধান সুবিধাভোগী হিসাবে অভিযোগ করে বলেন, ‘ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার মিত্রতা ধ্বংস করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। এটাই যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। তাই দেশটি ইউক্রেন সংকটের প্রধান সুবিধাভোগী। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এ কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণে যে কোনো মূল্যে রাশিয়াকে দুর্বল কিংবা ধ্বংস করতে চাইছে।’ তিনি মনে করেন, ইউক্রেনে চলমান সংঘাত শিগগির থামবে না। এ সংকট জিইয়ে রাখতে ওয়াশিংটন সম্ভাব্য সবকিছু করছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পকে চাঙা করার জন্য এ সংঘাতকে আরও ভয়াবহ রূপ দিতে চাইছে পেন্টাগন।
১০ অক্টোবর ২০২২ বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সাধারণ সভার প্রথম দিনে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিলিনা জর্জিয়েভা বলেন, ‘আগামী বছর বিশ্বব্যাপী মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে। আমরা হিসাব করে দেখেছি, অন্তত দুই অর্থবছর খারাপ সময় যাবে এক-তৃতীয়াংশ বিশ্ব অর্থনীতির। এ মন্দাভাবের কারণে এখন থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ৪ ট্রিলিয়ন ডলার হারাবে, যা জার্মানির জিডিপির সমান। করোনা পরিস্থিতির কারণে বাজারে জোগানের ঘাটতি ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফসল এ মন্দা। এতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। বিপরীতে আর্থিক সংকটে ভুগছে প্রতিটি দেশই। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতকে ‘সেন্সলেস ওয়ার’ আখ্যা দিয়ে সংস্থা দুটি জানায় উন্নয়নশীল অনেক দেশই হয়তো সময়মতো ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারবে না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ক্ষতিকর প্রভাবে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেশি ভুগবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ এমন এক খারাপ সময়ে এলো, যখন বিশ্ব আগে থেকেই মূল্যস্ফীতির সংকটে ছিল। যুদ্ধ শুধু রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এর অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে। বিশেষ করে যারা স্বল্প আয়ের মানুষ, মুদ্রাস্ফীতির ভারে তাদের জীবন জর্জরিত হয়ে যাবে।’
বিশ্বব্যবস্থার সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় নিঃসন্দেহে এটি বলা যায়, সম্ভাব্য দাবানলে উন্নত বিশ্ব পুড়ে মরার চেয়েও বেশি দুর্বিষহ গহ্বরে নিপতিত হবে অনুন্নত-উন্নয়নশীল বিশ্ব। মহামন্দার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় এসব দেশের প্রস্তুতি কোনোভাবেই সুখকর নয়। কথিত উন্নত বিশ্ব হয়তো সৃষ্ট যুদ্ধাবস্থায় অস্ত্র-তেল-খাদ্যকে কেন্দ্র করে অধিকতর লাভবান হবে। এর দীর্ঘসূত্রতা বিশ্বকে কোন পথে নিয়ে যাবে, তা কল্পনায়ও আনা যাচ্ছে না। তবে এটুকু নির্দ্বিধায় প্রাক্কলন করা যায়, বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দেশগুলোয় এর প্রভাব মারাত্মক দুর্ভিক্ষ-মানবিক দুর্যোগ তৈরি করবেই। কথিত উন্নত বিশ্বের কদর্য যুদ্ধংদেহি নেতৃত্ব দানবরূপী মানুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিশ্বকে ধ্বংসের তলানিতে উপনীত করে অধিক মাত্রায় অর্থোপার্জনের হীন উদ্যোগ কার্যকর করার ব্যতিব্যস্ততা বুমেরাং হয়ে তাদেরও যে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেবে না, সময়ের আবর্তনে বিশ্ববাসী তা অবলোকনের অপেক্ষায় রয়েছে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বিশ্বমন্দার অবসান জরুরি
বিশ্বকবি রবিঠাকুরের ছোটগল্পের পরিধি প্রাসঙ্গিকতায় করোনা মহামারির ক্ষেত্রে বলা যায়, ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’।
কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে যে নির্দয় তাণ্ডব চালিয়েছে, তা বহুলাংশে স্তিমিত হলেও চীনসহ নানা দেশে ভিন্ন প্রকরণে চলমান রয়েছে। অনুন্নত-উন্নয়নশীল দেশগুলো চরম ক্ষতিগ্রস্ত আর্থসামাজিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে ঐকান্তিক প্রয়াসের সূচনাপর্বেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন করে ভয়াবহ সংকট তৈরি করছে।
খাদ্য-জ্বালানিসহ নানামুখী বিপর্যস্ততা একদিকে বিশ্বব্যবস্থাকে লন্ডভন্ড করে চলেছে; অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধের উত্তাপ ভয়ংকর দাবানল সৃষ্টির রূপ পরিগ্রহ করছে।
২৩ জানুয়ারি মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশনস) অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত সংকট কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করতে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকার কারণে তার সরকার বিগত ১৪ বছরে বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়ন করতে পেরেছে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন অনুযায়ী দেশবাসীকে একটি সুন্দর ও উন্নত জীবন দিতে অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারির আগে বাংলাদেশে জিডিপি ক্রমাগত আট শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন অব্যাহত ছিল। কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যসামগ্রী ও পরিবহণ ব্যয় আকাশচুম্বী হওয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলো সমস্যায় পড়েছে; কিন্তু মহামারি থেকে বেরিয়ে আসার পর জিডিপি হ্রাস পেয়েছে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করেছে, যা এখন পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে।’
ধরিত্রীর সমগ্র সচেতন মহলে গভীর আতঙ্ক-আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বিশ্ব কি দ্রুত ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে! পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মতানুসারে, পৃথিবী বসবাসের জন্য ভয়ানক স্থান; খারাপ লোকের জন্য নয়, কিন্তু সেসব লোকের জন্য, যারা এ বিষয়ে কিছু করেন না। নোবেল অর্জনকারী সর্বপ্রথম নারী বিজ্ঞানী ম্যারি কুরির ভাষায়, ‘আপনি আপনার আপন সত্তার বিকাশ না ঘটিয়ে আরও উন্নত কোনো পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে পারেন না। উন্নত পৃথিবীর জন্য আমাদের সর্বাগ্রে নিজেদের সত্তার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।’
বিখ্যাত ব্রিটিশ জ্যোতিঃপদার্থবিদ অধ্যাপক উইলিয়াম স্টিফেন হকিংয়ের মতে, মহাবিশ্ব যেমন একটি বিন্দু থেকে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে, তেমনই এর শেষ পরিণতি হলো বৃহৎ সংকোচনের মাধ্যমে আরেকটি বিন্দু, যা পরম বিন্দু নামে পরিচিত। তবে সমগ্র বিশ্ব একই সঙ্গে বৃহৎ সংকোচনের মাধ্যমে চুপসে না-ও যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কোনো স্থানিক অঞ্চলে অনন্যতা দেখা দেবে, যেটা চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি করবে।
অতিসম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউভুক্ত কয়েকটি দেশের ইউক্রেনকে ট্যাংক-যুদ্ধযান-আকাশ প্রতিরক্ষা-রকেট-ড্রোনসহ অত্যাধুনিক ভারী সমরাস্ত্র সরবরাহের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থার (ওএসসিই) রুশ ডেপুটি রাষ্ট্রদূত ম্যাক্সিম বুয়াকেভিচ সতর্ক করে বলেন-ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
এর ফলে বিশ্বে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আমেরিকার ‘বেপরোয়া নয়া-ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণবাদী নীতি’ ইউরোপ এবং সম্ভবত বিশ্বকে একটি ধ্বংসাত্মক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে ফেলেছে। তার বক্তব্য অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো মিত্র রাষ্ট্রের নেতারা একটি লাল রেখার কাছাকাছি এসেছে। ইউক্রেনে চলমান সংঘাতের ক্রমাগত বৃদ্ধি একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের কঠিন ইঙ্গিত বহন করছে, যেখানে কেউই বিজয়ী হবে না। সামরিক সংঘাত বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের তিনি সরাসরি দায়ী করেন। তারাই ইউক্রেনকে রাশিয়ার জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে উসকানি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন। এ ধরনের যুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপ মহাদেশের জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সতর্ক করেছেন রাশিয়ার এ কূটনীতিক। একই প্রসঙ্গে রুশ শীর্ষ কর্মকর্তারাও হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ‘রাশিয়া তার ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রগুলো এখনো ব্যবহার করেনি। ইউরোপ-আমেরিকা যদি যুদ্ধ আরও বাড়িয়ে তোলে, তাহলে সেসব ব্যবহার করতে বাধ্য হবে ক্রেমলিন, যে বিপর্যয় ঠেকাতে পারবে না কেউ।’ উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরেই ইউক্রেন তার মিত্রদেশগুলোর কাছে ট্যাংক দিয়ে সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়ে আসছিল। এছাড়া রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে রুখতে বেশ আগে থেকেই পশ্চিমা মিত্রদের কাছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র চাইছিল ইউক্রেন।
গত ২৭ জানুয়ারি গণমাধ্যম সূত্রমতে, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ইউক্রেনে ৩১টি এম১এ১ আব্রামস ট্যাংক পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে জার্মানি ১৪টি লেপার্ড-২, যুক্তরাজ্য চ্যালেঞ্জার ট্যাংক ও কানাডা ৪টি লেপার্ড-২ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের তথ্যানুসারে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে এম১এ১ আব্রামস ট্যাংক পাঠানোর পর এম১এ২ ট্যাংকও পাঠাবে। কানাডিয়ান এক টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি জানান, তাদের প্রতিশ্রুত জার্মানির তৈরি লেপার্ড-২ ট্যাংকের পাশাপাশি অতিরিক্ত ৬০টি ট্যাংক পাঠাতে প্রস্তুত রয়েছে পোল্যান্ড। এর মধ্যে ৩০টি পিটি-৯১ মডেলের। বিশ্লেষকদের মতে, চলমান এ যুদ্ধে ইউক্রেনকে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাংক দেওয়ার ঘোষণা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো বিষয়। এর ফলে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন আক্রমণাত্মক যুদ্ধের সময় অত্যাধুনিক লেপার্ড টু ও এমওয়ান অ্যাব্রামস ট্যাংকগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে শক্ত প্রতিরোধ গড়তে সাহায্য করবে বলে মন্তব্য করেছেন সমর বিশেষজ্ঞ এবং মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদ আলী। তিনি আরও বলেন, ‘পশ্চিমা মিত্রের সামরিক সহযোগিতায় ইউক্রেনের হাত অনেক শক্তিশালী হয়েছে। তারা কেবল নিজের দেশেই প্রতিরোধ গড়ছে না, তারা রাশিয়ার ভেতরে গিয়েও হামলা চালাচ্ছে। কাজেই এ যুদ্ধ অত সহসা শেষ হবে বলে আমি মনে কারি না।’ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেনকে শুধু অত্যাধুনিক ট্যাংক ও সমরাস্ত্র নয়, একই সঙ্গে এসব পরিচালনার জন্য দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণও দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩০টির বেশি দেশ ইউক্রেনকে বিভিন্ন অস্ত্রসহ নানা সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে দেশটির পাশে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অস্ত্র-অর্থ সবদিক থেকেই ইউক্রেনকে সাহায্য করছে মার্কিন প্রশাসন। সিএনএনের তথ্যমতে, ইউক্রেন প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র, গোলা, ট্যাংক ও রকেটলঞ্চারসহ সব মিলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১৮৫ কোটি মার্কিন ডলারের সাহায্য পাচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে এ পর্যন্ত ২০০টিরও বেশি টি-৭২ ট্যাংক পেয়েছে ইউক্রেন। ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সাঁজোয়া যানও পেয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আরও ৯০টি স্ট্রাইকার এবং ইরাকে মার্কিন বাহিনীর ব্যবহৃত ৫৯টি ব্র্যাডলি পদাতিক ফাইটিং সাঁজোয়া যান পাঠানোর বিষয়টিও নিশ্চিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ একই ধরনের অস্ত্র পাঠিয়েছে। এর পাশাপাশি এক আঘাতেই ট্যাংক ধ্বংসে সক্ষম অস্ত্রও সরবরাহ করা হয়েছে।
পক্ষান্তরে, ন্যাটো জোট রাশিয়ার বিরুদ্ধে যদি সরাসরি কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তাহলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট স্বল্পপাল্লার কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছে। এতে শুধু ইউক্রেন নয়; পুরো ইউরোপজুড়েই পারমাণবিক ঝুঁকির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স মারফত জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পক্ষ থেকে উন্নত ট্যাংক দেওয়ার ঘোষণার পরপরই ইউক্রেনে তীব্র হামলা শুরু করেছে রুশ বাহিনী। ২৬ জানুয়ারি সকাল থেকেই রুশ সেনারা কিয়েভ ও ওদেসা অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। এর আগে রাতেও ব্যাপক ড্রোন হামলা চালানো হয়। ইউক্রেনের বিমানবাহিনীর মুখপাত্র জানান, ছয়টি টিউ-৯৫ যুদ্ধবিমান থেকে অন্তত ৩০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলায় প্রাণহানিসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত অক্টোবর থেকেই রুশ সেনারা ইউক্রেনের বিদ্যুৎ অবকাঠামোগুলো লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দাবি-অব্যাহত রুশ হামলার জেরে ইউক্রেনের প্রায় ৯০ লাখ মানুষ বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে। জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থাও (আইএইএ) একই দিনে ইউক্রেনে রুশ অধিকৃত জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে শক্তিশালী বিস্ফোরণের বিষয়ে জানানোর পাশাপাশি কেন্দ্রটির চারপাশে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করার আহ্বান জানায়।
২৭ ডিসেম্বর ২০২২ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে ইউক্রেন যুদ্ধে প্রধান সুবিধাভোগী হিসাবে অভিযোগ করে বলেন, ‘ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার মিত্রতা ধ্বংস করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। এটাই যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। তাই দেশটি ইউক্রেন সংকটের প্রধান সুবিধাভোগী। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এ কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণে যে কোনো মূল্যে রাশিয়াকে দুর্বল কিংবা ধ্বংস করতে চাইছে।’ তিনি মনে করেন, ইউক্রেনে চলমান সংঘাত শিগগির থামবে না। এ সংকট জিইয়ে রাখতে ওয়াশিংটন সম্ভাব্য সবকিছু করছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পকে চাঙা করার জন্য এ সংঘাতকে আরও ভয়াবহ রূপ দিতে চাইছে পেন্টাগন।
১০ অক্টোবর ২০২২ বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সাধারণ সভার প্রথম দিনে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিলিনা জর্জিয়েভা বলেন, ‘আগামী বছর বিশ্বব্যাপী মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে। আমরা হিসাব করে দেখেছি, অন্তত দুই অর্থবছর খারাপ সময় যাবে এক-তৃতীয়াংশ বিশ্ব অর্থনীতির। এ মন্দাভাবের কারণে এখন থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ৪ ট্রিলিয়ন ডলার হারাবে, যা জার্মানির জিডিপির সমান। করোনা পরিস্থিতির কারণে বাজারে জোগানের ঘাটতি ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফসল এ মন্দা। এতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। বিপরীতে আর্থিক সংকটে ভুগছে প্রতিটি দেশই। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতকে ‘সেন্সলেস ওয়ার’ আখ্যা দিয়ে সংস্থা দুটি জানায় উন্নয়নশীল অনেক দেশই হয়তো সময়মতো ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারবে না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ক্ষতিকর প্রভাবে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেশি ভুগবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ এমন এক খারাপ সময়ে এলো, যখন বিশ্ব আগে থেকেই মূল্যস্ফীতির সংকটে ছিল। যুদ্ধ শুধু রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এর অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে। বিশেষ করে যারা স্বল্প আয়ের মানুষ, মুদ্রাস্ফীতির ভারে তাদের জীবন জর্জরিত হয়ে যাবে।’
বিশ্বব্যবস্থার সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় নিঃসন্দেহে এটি বলা যায়, সম্ভাব্য দাবানলে উন্নত বিশ্ব পুড়ে মরার চেয়েও বেশি দুর্বিষহ গহ্বরে নিপতিত হবে অনুন্নত-উন্নয়নশীল বিশ্ব। মহামন্দার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় এসব দেশের প্রস্তুতি কোনোভাবেই সুখকর নয়। কথিত উন্নত বিশ্ব হয়তো সৃষ্ট যুদ্ধাবস্থায় অস্ত্র-তেল-খাদ্যকে কেন্দ্র করে অধিকতর লাভবান হবে। এর দীর্ঘসূত্রতা বিশ্বকে কোন পথে নিয়ে যাবে, তা কল্পনায়ও আনা যাচ্ছে না। তবে এটুকু নির্দ্বিধায় প্রাক্কলন করা যায়, বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দেশগুলোয় এর প্রভাব মারাত্মক দুর্ভিক্ষ-মানবিক দুর্যোগ তৈরি করবেই। কথিত উন্নত বিশ্বের কদর্য যুদ্ধংদেহি নেতৃত্ব দানবরূপী মানুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিশ্বকে ধ্বংসের তলানিতে উপনীত করে অধিক মাত্রায় অর্থোপার্জনের হীন উদ্যোগ কার্যকর করার ব্যতিব্যস্ততা বুমেরাং হয়ে তাদেরও যে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেবে না, সময়ের আবর্তনে বিশ্ববাসী তা অবলোকনের অপেক্ষায় রয়েছে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়