শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
একজন শিক্ষাক্রম গবেষক হিসাবে আমি ২০১৯ সাল থেকেই লিখে আসছি, শিক্ষাক্রমের নেতৃত্বে সমস্যা রয়েছে; তাই শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়াও সঠিক পথে এগোচ্ছে না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেসব আমলে না নিয়ে অবিরত ‘নতুন শিক্ষাক্রমের’ ডঙ্কা বাজিয়ে চলেছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন পাঠ্যপুস্তকে কিছু শুদ্ধ তথ্য চৌর্যবৃত্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং কিছু ভুল তথ্য ধরা পড়ায় মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসেছে। সামাজিকমাধ্যমে তোলপাড় চলছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী মহোদয় জাতির কাছে সুপরামর্শ ও সহযোগিতা চেয়েছেন, প্রধানত পাঠ্যপুস্তকের ভুল সংশোধন কাজে।
মূলত শিক্ষাক্রমের লোক হলেও আমি শিক্ষাক্রম পরিমার্জন এবং শুদ্ধ পাঠ্যপুস্তক রচনা সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিতে পারি। তবে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে সমস্যা ও ত্রুটির আসল কারণ শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিহিত বলে শিক্ষাক্রম প্রক্রিয়া নিয়েই বেশি কথা বলতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় বর্তমান করণীয় এবং পাঠ্যপুস্তক শুদ্ধ ও স্তর-উপযোগী করে রচনা নিয়ে কিছু বলতে চাই।
পূর্ণ জাতীয় শিক্ষাক্রম-পরিকল্পনা করতে হয় একসঙ্গে। শিক্ষাক্রম-পরিকল্পনা একসঙ্গে এবং সার্বিক না হলে শিক্ষাক্রমের সমকেন্দ্র (Concentric) বা সর্পিল (Spiral) পদ্ধতি অনুসরণে নিচের শ্রেণি থেকে ওপর দিকে ক্রমেই বিস্তৃত করা হয়েছে কিনা (Vertical Alignment) এবং একই শ্রেণির বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষাক্রমে পুনরাবৃত্তি বর্জন করা হয়েছে কিনা (Horizontal Alignment) তা পর্যালোচনা করে শিক্ষাক্রমের ভেটিং সম্পন্ন করা যায় না। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হয় নিচের শ্রেণি থেকে ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে।
দুঃখের বিষয়, এবার প্রাথমিক শিক্ষাক্রম প্রাক-প্রাথমিকের আগে পরিমার্জন করা হয়েছে এবং পরিকল্পিত দুই শ্রেণির প্রাক-প্রাথমিক বাদ দিয়ে প্রথম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন শুরু করা হয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও বাস্তবায়নক্রম ঠিক আছে; কিন্তু শুধু নিুমাধ্যমিকের প্রথম দুই শ্রেণির শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক রচনা করে বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। অথচ অষ্টম শ্রেণির শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়া সবে চলমান, নবম-দশম শিক্ষাক্রম নিয়ে ভাবনা থাকলেও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রম নিয়ে এখনো কোনো বাস্তব চিন্তাই রূপ পায়নি। প্রাক-প্রাথমিক এবং মধ্য (নবম-দশম শ্রেণি) ও উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি) শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা জরুরি। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১৪ শ্রেণির পূর্ণ শিক্ষাক্রম পরিমার্জন শেষ হলে সব স্তর ও শ্রেণির শিক্ষাক্রমের ভেটিং করে বিষয়ের ব্যাপ্তি ও কাঠিন্য নিচ থেকে উপর দিকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন বিষয়ে পুনরাবৃত্তি এড়ানো নিশ্চিত করতে হবে।
এবার শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়া চলছে জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ মুরুব্বির পরামর্শ ছাড়া। শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে যথার্থ পরিবর্তন না এলে সমস্যা সমাধান হওয়ার নয়। মূলত শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে অভিজ্ঞ কেউ না থাকার কারণেই এবারের শিক্ষাক্রমে পুরোনো উপাদানগুলোকে নতুন বলে দাবি করে শিক্ষাক্রমে আমূল পরিবর্তন আনয়নের অমূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে (২০২১ সাল থেকে জাশিপাবো গ্রন্থাগারে দেশের সব আবর্তনের শিক্ষাক্রম আছে, যে কেউ বিষয়টি যাচাই করতে পারেন)। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন (Experiential Learning) নামে একটি নতুন ধারণার আওতায় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করার দাবি। বাস্তবে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মূল বিষয় ‘করে শেখার’ (Learning by doing) কথা আড়াই হাজার বছর আগে অ্যারিস্টটল বলে গেছেন। ডেভিড কোব ১৯৮৪ সালে ধারণাটিকে একটু বিস্তৃত করে চার স্তরের (বাস্তব অভিজ্ঞতা, চিন্তাশীল পর্যবেক্ষণ, বিমূর্ত ধারণায়ন ও সক্রিয় পরীক্ষণ) শিখন-মডেল তৈরি করেছিলেন বয়স্কশিক্ষা (Andragogy) তথা প্রশিক্ষণ কোর্সের জন্য; শিশু-কিশোরদের শিক্ষার (Pedagogy) জন্য নয়। উল্লেখ্য, পরীক্ষা-নিরীক্ষানির্ভর প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষায় অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের জন্য শিখনের কিছু অংশ ব্যবহারিক কাজ, অনুসন্ধান, নির্ধারিত কাজ (Assignment) ইত্যাদি হিসাবে বহুকাল ধরে প্রচলিত আছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২তে প্রকৃতি বিজ্ঞানের গণ্ডি ছাড়িয়ে অধিকাংশ বিষয়ে অনুসন্ধানমূলক কাজের ব্যবস্থা রাখা আছে।
প্রশিক্ষণ কোর্সের জন্য প্রযোজ্য অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন প্রক্রিয়া শিশু-কিশোরদের পুরো কোর্সের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়; বাস্তবায়নযোগ্যও হবে না। কারণ দ্বিবিধ-১. জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পূর্বে সৃষ্ট ও প্রকাশিত বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের আস্বাদ নেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য জরুরি। সব কিছু ‘করে শেখানোর’ চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীরা বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে বঞ্চিত থাকবে। ২. ৬০-৯০ জন শিক্ষার্থীর ক্লাসে কোনো শিক্ষকের পক্ষে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনপ্রক্রিয়া বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না; পরিণামে নতুন লেখা পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলোও শিক্ষার্থীরা পড়ে-বুঝে শেষ করার সময় পাবে না। সব বিষয়ের প্রত্যেক অধ্যায়ে একটি অনুসন্ধানমূলক কাজ আবশ্যিকভাবে করানোর মাধ্যমে এক প্রকার সমঝোতায় পৌঁছা যেতে পারে।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের ঢেউকে ধারণ করে, প্রাথমিক স্তরে ১৯৯২ সাল থেকে বাস্তবায়িত যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের সঙ্গে মিলিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমকেও যোগ্যতাভিত্তিক আদলে সাজানো হচ্ছে। কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইং বিশ্বজোড়া ছয় দশক ধরে প্রচলিত ফলাফলভিত্তিক (Outcome-based) শিক্ষাক্রমে ব্যবহৃত সহজে মূল্যায়নযোগ্য সূক্ষ্ম ‘শিখনফল’ (Learning Outcome) ব্যবহার না করায় লেখকদের বই লিখতে, শিক্ষকদের শিক্ষণ-পরিকল্পনা করতে সমস্যা হচ্ছে। কাজেই এ ক্ষেত্রে মূল্যায়নকারীরা বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করতেই পারবেন না। সুতরাং শিক্ষাক্রমে বেশি নতুনত্ব আনয়নের ভুয়া দাবি ছেড়ে দিয়ে শিখনফল আবশ্যিকভাবে লেখার নির্দেশনা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
দেশে যৌক্তিকভাবে তিনটি প্রধান শিক্ষাধারা (সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি) প্রচলিত আছে। সাধারণ শিক্ষাধারায় ঠুনকো একটি কারিগরি বিষয় কোনো কাজে আসবে না; এতে বরং উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিমূলক সাধারণ শিক্ষায় স্কলাস্টিক বিষয়ের (ভাষা, গণিত, প্রকৃতি ও সামাজিক বিজ্ঞান) শিক্ষা চাপের মুখে পড়বে। কার্যকর কারিগরি শিক্ষার জন্য যে মানের ব্যবহারিক জ্ঞান দরকার হয়, তার ব্যবস্থা করা হয় সে মানের পরীক্ষাগারে এবং শিল্প-সংযোগের (Industrial Attachment) মাধ্যমে। ওসব খরচবহুল ব্যবস্থা সাধারণ বিদ্যালয়ের আওতার বাইরে। কারিগরি শিক্ষার অগ্রগতি চাইলে তা ১৯৬৭ সাল থেকে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত কারিগরি ধারায়ই করতে হবে। প্রতি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এখন প্রতি উপজেলায় কারিগরি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করে কারিগরি শিক্ষায় বিপ্লবের সূচনা করা যেতে পারে।
শিক্ষাক্রম রূপরেখায় সবচেয়ে দুর্বল ও অসাধ্য পরিকল্পনা করা হয়েছে মূল্যায়ন পদ্ধতি বিষয়ে। শ্রেণিশিক্ষক/অভিভাবক/বন্ধুদের দিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার অত্যধিক হার এ দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। ২০০৩-০৮ সালে সেসিপের আওতায় ২০-৩০ শতাংশ শিখনকালীন স্কুলভিত্তিক মূল্যায়নও বাস্তবায়ন করা যায়নি। কারণ, শ্রেণিশিক্ষকের হাতে নম্বর থাকায় প্রাইভেট পড়া শুধু উৎসাহিত নয়, আবশ্যিক করে তোলে। আর স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও কলেজ গভর্নিং বডির হস্তক্ষেপে শিখনকালীন মূল্যায়ন নম্বর প্রদানের হিড়িকে পরিণত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। সহপাঠী বন্ধুদের মূল্যায়নের ক্ষেত্র সংকীর্ণ এবং এর বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা শূন্যের কোঠায়। এটি প্রধানত দলীয় কাজের উপস্থাপন; অর্থাৎ শুধু যোগাযোগ দক্ষতার মূল্যায়নে সীমিত থাকবে আর বিভিন্ন দল নিজেদের মধ্যে আঁতাত করে নির্বিচারে সর্বোচ্চ গ্রেড দিয়ে দিতে পারে, কোনো ক্ষেত্রে উলটোটাও ঘটতে পারে।
পাঠ্যপুস্তক শুদ্ধ ও স্তর-উপযোগী করে রচনা
পাঠ্যপুস্তক স্তর-উপযোগী বিষয়বস্তু নিয়ে ও শুদ্ধভাবে রচনা করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, যোগ্য ও অভিজ্ঞ সদস্য নিয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি গঠন করা। উল্লেখ্য, দেশ এখন ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকে’ ভরপুর; কিন্তু বাস্তবে তার আদর্শ কতটা অনুসরণ করা হয়, তাতে সন্দেহের অবকাশ আছে। বঙ্গবন্ধু যে শিক্ষা কমিশন, পরিকল্পনা কমিশন ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছিলেন, সেগুলোতে দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী-গুণী ও যোগ্য লোকের সমাহার ঘটেছিল। এখন কেন জানি জাতীয় কমিশন/কমিটি, বিভিন্ন একাডেমি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে প্রকৃত যোগ্যদের পরিবর্তে স্তাবক ও তালিয়াবাজদের নিয়োগ করা হয়!
জাশিপাবোর সদস্যের (মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম) বিরুদ্ধে প্রকাশিত অভিযোগে দেখা যায়, তিনি কাউকে না জানিয়ে ব্যক্তিগত পছন্দের লোক নিয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছেন। স্পষ্টই বোঝা যায়, এতেই সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে চৌর্যবৃত্তির ঘটনা ঘটেছে। আমি ২০১৮-১৯ সালেই লক্ষ করেছি, এ বোর্ড সদস্য ‘যত বেশি জানে, তত কম মানে’ নীতিতে চলেন। সুতরাং, এখন থেকে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি যাতে দেশের সবচেয়ে যোগ্য ও অভিজ্ঞ সদস্যদের নিয়ে এবং বিধিমোতাবেক গঠন করা হয়, মন্ত্রণালয়কে তা নিশ্চিত করতে হবে।
কয়েকটি শিখনক্ষেত্র ও পাঠ্যপুস্তকের নাম অযৌক্তিভাবে দীর্ঘ করা হয়েছে। যেমন-সামাজিকবিজ্ঞানের নামের শুরুতে অহেতুক ‘ইতিহাস’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এটি ঘটেছে, ইতিহাস যে সামাজিকবিজ্ঞানেরই অন্তর্ভুক্ত, তা না বোঝার কারণে। আর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পাঠ্যপুস্তকের নাম প্রথমে লেখা হয়েছিল ‘ভালো থাকা’; সমালোচনার মুখে তাকে করা হয়েছে ‘শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা’। নামকরণ বিদ্যা (Nomenclature) অনুসারে কোনো কিছুর নাম অর্থবোধক, শ্রুতিমধুর ও যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত হতে হয়। সেই সূত্রে বলা যায়, বইটির নাম স্বাস্থ্যবিধি/বিজ্ঞান লেখাই যথেষ্ট; ভেতরে শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার স্বাস্থ্য সম্পর্কে পড়ে-বুঝে সুরক্ষা নিশ্চিত করলেই চলবে।
দেশে অভিব্যক্তি ও বিবর্তনবাদ নিয়ে এক অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক শুরু হয়েছে। জৈবিক ও সামাজিক উভয় প্রকার বিবর্তন প্রাকৃতিক সত্য। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ সৃষ্টি (Special Creation) মতবাদ বিশ্বাস করলেও অন্যসব জীবের সৃষ্টি ধীরলয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে ঘটেছে বলেই ধারণা করা হয়। এর অনেক প্রমাণের মধ্যে একটি হচ্ছে, প্রকৃতিতে এখনো মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন ধরনের জীব সৃষ্টি হচ্ছে। তবে বিবর্তনের ধারণাটি প্রাথমিক ও নিুমাধ্যমিকের কচিকাঁচাদের না দিয়ে মাধ্যমিক স্তরের কিশোর-কিশোরীদের দিয়ে শুরু করা যায়।
সবশেষে বলতে হয়, পাঠ্যপুস্তক রচনা ও সম্পাদনার জন্য অত্যন্ত কম সময় দেওয়ায় তাড়াহুড়ো করে রচিত পাঠ্যপুস্তকে ভুল থেকে যায়; সময়ের অভাবে কেউ কেউ চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নেয়। পরবর্তী পর্যালোচনা সাধারণত রচনাকালের মতো ডিটেইল হয় না। সুতরাং প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক শুদ্ধভাবে রচনা-সম্পাদনার জন্য দুই-তিন মাস নয়, প্রয়োজনে ছয় মাস সময় ধার্য করা দরকার।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষাক্রম গবেষক এবং প্রাণিবিদ্যার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
asmolla@ymail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন
একজন শিক্ষাক্রম গবেষক হিসাবে আমি ২০১৯ সাল থেকেই লিখে আসছি, শিক্ষাক্রমের নেতৃত্বে সমস্যা রয়েছে; তাই শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়াও সঠিক পথে এগোচ্ছে না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেসব আমলে না নিয়ে অবিরত ‘নতুন শিক্ষাক্রমের’ ডঙ্কা বাজিয়ে চলেছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন পাঠ্যপুস্তকে কিছু শুদ্ধ তথ্য চৌর্যবৃত্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং কিছু ভুল তথ্য ধরা পড়ায় মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসেছে। সামাজিকমাধ্যমে তোলপাড় চলছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী মহোদয় জাতির কাছে সুপরামর্শ ও সহযোগিতা চেয়েছেন, প্রধানত পাঠ্যপুস্তকের ভুল সংশোধন কাজে।
মূলত শিক্ষাক্রমের লোক হলেও আমি শিক্ষাক্রম পরিমার্জন এবং শুদ্ধ পাঠ্যপুস্তক রচনা সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিতে পারি। তবে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে সমস্যা ও ত্রুটির আসল কারণ শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিহিত বলে শিক্ষাক্রম প্রক্রিয়া নিয়েই বেশি কথা বলতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় বর্তমান করণীয় এবং পাঠ্যপুস্তক শুদ্ধ ও স্তর-উপযোগী করে রচনা নিয়ে কিছু বলতে চাই।
পূর্ণ জাতীয় শিক্ষাক্রম-পরিকল্পনা করতে হয় একসঙ্গে। শিক্ষাক্রম-পরিকল্পনা একসঙ্গে এবং সার্বিক না হলে শিক্ষাক্রমের সমকেন্দ্র (Concentric) বা সর্পিল (Spiral) পদ্ধতি অনুসরণে নিচের শ্রেণি থেকে ওপর দিকে ক্রমেই বিস্তৃত করা হয়েছে কিনা (Vertical Alignment) এবং একই শ্রেণির বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষাক্রমে পুনরাবৃত্তি বর্জন করা হয়েছে কিনা (Horizontal Alignment) তা পর্যালোচনা করে শিক্ষাক্রমের ভেটিং সম্পন্ন করা যায় না। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হয় নিচের শ্রেণি থেকে ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে।
দুঃখের বিষয়, এবার প্রাথমিক শিক্ষাক্রম প্রাক-প্রাথমিকের আগে পরিমার্জন করা হয়েছে এবং পরিকল্পিত দুই শ্রেণির প্রাক-প্রাথমিক বাদ দিয়ে প্রথম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন শুরু করা হয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও বাস্তবায়নক্রম ঠিক আছে; কিন্তু শুধু নিুমাধ্যমিকের প্রথম দুই শ্রেণির শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক রচনা করে বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। অথচ অষ্টম শ্রেণির শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়া সবে চলমান, নবম-দশম শিক্ষাক্রম নিয়ে ভাবনা থাকলেও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রম নিয়ে এখনো কোনো বাস্তব চিন্তাই রূপ পায়নি। প্রাক-প্রাথমিক এবং মধ্য (নবম-দশম শ্রেণি) ও উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি) শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা জরুরি। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১৪ শ্রেণির পূর্ণ শিক্ষাক্রম পরিমার্জন শেষ হলে সব স্তর ও শ্রেণির শিক্ষাক্রমের ভেটিং করে বিষয়ের ব্যাপ্তি ও কাঠিন্য নিচ থেকে উপর দিকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন বিষয়ে পুনরাবৃত্তি এড়ানো নিশ্চিত করতে হবে।
এবার শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়া চলছে জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ মুরুব্বির পরামর্শ ছাড়া। শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে যথার্থ পরিবর্তন না এলে সমস্যা সমাধান হওয়ার নয়। মূলত শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে অভিজ্ঞ কেউ না থাকার কারণেই এবারের শিক্ষাক্রমে পুরোনো উপাদানগুলোকে নতুন বলে দাবি করে শিক্ষাক্রমে আমূল পরিবর্তন আনয়নের অমূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে (২০২১ সাল থেকে জাশিপাবো গ্রন্থাগারে দেশের সব আবর্তনের শিক্ষাক্রম আছে, যে কেউ বিষয়টি যাচাই করতে পারেন)। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন (Experiential Learning) নামে একটি নতুন ধারণার আওতায় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করার দাবি। বাস্তবে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মূল বিষয় ‘করে শেখার’ (Learning by doing) কথা আড়াই হাজার বছর আগে অ্যারিস্টটল বলে গেছেন। ডেভিড কোব ১৯৮৪ সালে ধারণাটিকে একটু বিস্তৃত করে চার স্তরের (বাস্তব অভিজ্ঞতা, চিন্তাশীল পর্যবেক্ষণ, বিমূর্ত ধারণায়ন ও সক্রিয় পরীক্ষণ) শিখন-মডেল তৈরি করেছিলেন বয়স্কশিক্ষা (Andragogy) তথা প্রশিক্ষণ কোর্সের জন্য; শিশু-কিশোরদের শিক্ষার (Pedagogy) জন্য নয়। উল্লেখ্য, পরীক্ষা-নিরীক্ষানির্ভর প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষায় অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের জন্য শিখনের কিছু অংশ ব্যবহারিক কাজ, অনুসন্ধান, নির্ধারিত কাজ (Assignment) ইত্যাদি হিসাবে বহুকাল ধরে প্রচলিত আছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২তে প্রকৃতি বিজ্ঞানের গণ্ডি ছাড়িয়ে অধিকাংশ বিষয়ে অনুসন্ধানমূলক কাজের ব্যবস্থা রাখা আছে।
প্রশিক্ষণ কোর্সের জন্য প্রযোজ্য অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন প্রক্রিয়া শিশু-কিশোরদের পুরো কোর্সের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়; বাস্তবায়নযোগ্যও হবে না। কারণ দ্বিবিধ-১. জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পূর্বে সৃষ্ট ও প্রকাশিত বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের আস্বাদ নেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য জরুরি। সব কিছু ‘করে শেখানোর’ চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীরা বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে বঞ্চিত থাকবে। ২. ৬০-৯০ জন শিক্ষার্থীর ক্লাসে কোনো শিক্ষকের পক্ষে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনপ্রক্রিয়া বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না; পরিণামে নতুন লেখা পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলোও শিক্ষার্থীরা পড়ে-বুঝে শেষ করার সময় পাবে না। সব বিষয়ের প্রত্যেক অধ্যায়ে একটি অনুসন্ধানমূলক কাজ আবশ্যিকভাবে করানোর মাধ্যমে এক প্রকার সমঝোতায় পৌঁছা যেতে পারে।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের ঢেউকে ধারণ করে, প্রাথমিক স্তরে ১৯৯২ সাল থেকে বাস্তবায়িত যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের সঙ্গে মিলিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমকেও যোগ্যতাভিত্তিক আদলে সাজানো হচ্ছে। কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইং বিশ্বজোড়া ছয় দশক ধরে প্রচলিত ফলাফলভিত্তিক (Outcome-based) শিক্ষাক্রমে ব্যবহৃত সহজে মূল্যায়নযোগ্য সূক্ষ্ম ‘শিখনফল’ (Learning Outcome) ব্যবহার না করায় লেখকদের বই লিখতে, শিক্ষকদের শিক্ষণ-পরিকল্পনা করতে সমস্যা হচ্ছে। কাজেই এ ক্ষেত্রে মূল্যায়নকারীরা বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করতেই পারবেন না। সুতরাং শিক্ষাক্রমে বেশি নতুনত্ব আনয়নের ভুয়া দাবি ছেড়ে দিয়ে শিখনফল আবশ্যিকভাবে লেখার নির্দেশনা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
দেশে যৌক্তিকভাবে তিনটি প্রধান শিক্ষাধারা (সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি) প্রচলিত আছে। সাধারণ শিক্ষাধারায় ঠুনকো একটি কারিগরি বিষয় কোনো কাজে আসবে না; এতে বরং উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিমূলক সাধারণ শিক্ষায় স্কলাস্টিক বিষয়ের (ভাষা, গণিত, প্রকৃতি ও সামাজিক বিজ্ঞান) শিক্ষা চাপের মুখে পড়বে। কার্যকর কারিগরি শিক্ষার জন্য যে মানের ব্যবহারিক জ্ঞান দরকার হয়, তার ব্যবস্থা করা হয় সে মানের পরীক্ষাগারে এবং শিল্প-সংযোগের (Industrial Attachment) মাধ্যমে। ওসব খরচবহুল ব্যবস্থা সাধারণ বিদ্যালয়ের আওতার বাইরে। কারিগরি শিক্ষার অগ্রগতি চাইলে তা ১৯৬৭ সাল থেকে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত কারিগরি ধারায়ই করতে হবে। প্রতি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এখন প্রতি উপজেলায় কারিগরি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করে কারিগরি শিক্ষায় বিপ্লবের সূচনা করা যেতে পারে।
শিক্ষাক্রম রূপরেখায় সবচেয়ে দুর্বল ও অসাধ্য পরিকল্পনা করা হয়েছে মূল্যায়ন পদ্ধতি বিষয়ে। শ্রেণিশিক্ষক/অভিভাবক/বন্ধুদের দিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার অত্যধিক হার এ দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। ২০০৩-০৮ সালে সেসিপের আওতায় ২০-৩০ শতাংশ শিখনকালীন স্কুলভিত্তিক মূল্যায়নও বাস্তবায়ন করা যায়নি। কারণ, শ্রেণিশিক্ষকের হাতে নম্বর থাকায় প্রাইভেট পড়া শুধু উৎসাহিত নয়, আবশ্যিক করে তোলে। আর স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও কলেজ গভর্নিং বডির হস্তক্ষেপে শিখনকালীন মূল্যায়ন নম্বর প্রদানের হিড়িকে পরিণত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। সহপাঠী বন্ধুদের মূল্যায়নের ক্ষেত্র সংকীর্ণ এবং এর বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা শূন্যের কোঠায়। এটি প্রধানত দলীয় কাজের উপস্থাপন; অর্থাৎ শুধু যোগাযোগ দক্ষতার মূল্যায়নে সীমিত থাকবে আর বিভিন্ন দল নিজেদের মধ্যে আঁতাত করে নির্বিচারে সর্বোচ্চ গ্রেড দিয়ে দিতে পারে, কোনো ক্ষেত্রে উলটোটাও ঘটতে পারে।
পাঠ্যপুস্তক শুদ্ধ ও স্তর-উপযোগী করে রচনা
পাঠ্যপুস্তক স্তর-উপযোগী বিষয়বস্তু নিয়ে ও শুদ্ধভাবে রচনা করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, যোগ্য ও অভিজ্ঞ সদস্য নিয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি গঠন করা। উল্লেখ্য, দেশ এখন ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকে’ ভরপুর; কিন্তু বাস্তবে তার আদর্শ কতটা অনুসরণ করা হয়, তাতে সন্দেহের অবকাশ আছে। বঙ্গবন্ধু যে শিক্ষা কমিশন, পরিকল্পনা কমিশন ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছিলেন, সেগুলোতে দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী-গুণী ও যোগ্য লোকের সমাহার ঘটেছিল। এখন কেন জানি জাতীয় কমিশন/কমিটি, বিভিন্ন একাডেমি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে প্রকৃত যোগ্যদের পরিবর্তে স্তাবক ও তালিয়াবাজদের নিয়োগ করা হয়!
জাশিপাবোর সদস্যের (মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম) বিরুদ্ধে প্রকাশিত অভিযোগে দেখা যায়, তিনি কাউকে না জানিয়ে ব্যক্তিগত পছন্দের লোক নিয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছেন। স্পষ্টই বোঝা যায়, এতেই সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে চৌর্যবৃত্তির ঘটনা ঘটেছে। আমি ২০১৮-১৯ সালেই লক্ষ করেছি, এ বোর্ড সদস্য ‘যত বেশি জানে, তত কম মানে’ নীতিতে চলেন। সুতরাং, এখন থেকে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি যাতে দেশের সবচেয়ে যোগ্য ও অভিজ্ঞ সদস্যদের নিয়ে এবং বিধিমোতাবেক গঠন করা হয়, মন্ত্রণালয়কে তা নিশ্চিত করতে হবে।
কয়েকটি শিখনক্ষেত্র ও পাঠ্যপুস্তকের নাম অযৌক্তিভাবে দীর্ঘ করা হয়েছে। যেমন-সামাজিকবিজ্ঞানের নামের শুরুতে অহেতুক ‘ইতিহাস’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এটি ঘটেছে, ইতিহাস যে সামাজিকবিজ্ঞানেরই অন্তর্ভুক্ত, তা না বোঝার কারণে। আর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পাঠ্যপুস্তকের নাম প্রথমে লেখা হয়েছিল ‘ভালো থাকা’; সমালোচনার মুখে তাকে করা হয়েছে ‘শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা’। নামকরণ বিদ্যা (Nomenclature) অনুসারে কোনো কিছুর নাম অর্থবোধক, শ্রুতিমধুর ও যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত হতে হয়। সেই সূত্রে বলা যায়, বইটির নাম স্বাস্থ্যবিধি/বিজ্ঞান লেখাই যথেষ্ট; ভেতরে শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার স্বাস্থ্য সম্পর্কে পড়ে-বুঝে সুরক্ষা নিশ্চিত করলেই চলবে।
দেশে অভিব্যক্তি ও বিবর্তনবাদ নিয়ে এক অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক শুরু হয়েছে। জৈবিক ও সামাজিক উভয় প্রকার বিবর্তন প্রাকৃতিক সত্য। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ সৃষ্টি (Special Creation) মতবাদ বিশ্বাস করলেও অন্যসব জীবের সৃষ্টি ধীরলয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে ঘটেছে বলেই ধারণা করা হয়। এর অনেক প্রমাণের মধ্যে একটি হচ্ছে, প্রকৃতিতে এখনো মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন ধরনের জীব সৃষ্টি হচ্ছে। তবে বিবর্তনের ধারণাটি প্রাথমিক ও নিুমাধ্যমিকের কচিকাঁচাদের না দিয়ে মাধ্যমিক স্তরের কিশোর-কিশোরীদের দিয়ে শুরু করা যায়।
সবশেষে বলতে হয়, পাঠ্যপুস্তক রচনা ও সম্পাদনার জন্য অত্যন্ত কম সময় দেওয়ায় তাড়াহুড়ো করে রচিত পাঠ্যপুস্তকে ভুল থেকে যায়; সময়ের অভাবে কেউ কেউ চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নেয়। পরবর্তী পর্যালোচনা সাধারণত রচনাকালের মতো ডিটেইল হয় না। সুতরাং প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক শুদ্ধভাবে রচনা-সম্পাদনার জন্য দুই-তিন মাস নয়, প্রয়োজনে ছয় মাস সময় ধার্য করা দরকার।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষাক্রম গবেষক এবং প্রাণিবিদ্যার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
asmolla@ymail.com