পিলখানা হত্যার পেছনের ঘটনা উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিশন গঠিত হবে কি?
বাইফোকাল লেন্স
একেএম শামসুদ্দিন
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
হাইকোর্ট পিলখানা হত্যা মামলার রায় দিয়েছেন পাঁচ বছর হলো। সময়টা ছিল ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর। সে সময় হাইকোর্ট সংক্ষিপ্ত রায় দিয়েছিল। তার দুই বছর পর মহামান্য আদালত পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছেন। কিন্তু এ সময়ের ভেতর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি বিষয়ে বড় কোনো অগ্রগতি হয়েছে কিনা বা কতদূর অগ্রগতি হয়েছে তা আমাদের জানা নেই।
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর, রাজধানীর বকশী বাজারে স্থাপিত হত্যা মামলার বিশেষ জজ আদালত ১৫২ জন বিডিআর সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ২৭৮ জনকে খালাস দিয়ে রায় দিয়েছিলেন। বিচারিক আদালতের রায়ের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের নভেম্বরে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন। অতঃপর ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন।
হাইকোর্টের রায়ে বিচারিক আদালতে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৩৯ জনের দণ্ড বহাল রাখা হয়। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ৮ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও ৪ জনকে বেকসুর খালাস দেন হাইকোর্ট। ১৮৫ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন ও ১৮৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড। অর্থাৎ ৫৫২ জনকে সাজা ও ২৮৩ জনকে খালাস দেন আদালত। তবে আশ্চর্যের বিষয়, বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার এখনো বিচারিক আদালতেই ঝুলে আছে। এখন বলা হচ্ছে, কোভিডের প্রভাবে আদালতের কার্যক্রম দীর্ঘদিন অনিয়মিত থাকায় হত্যা মামলার আপিল ও বিস্ফোরক মামলার বিচার নিষ্পত্তি পিছিয়ে গেছে।
বর্তমানে কোভিডের সেই পরিস্থিতি আর নেই। এ পর্যন্ত আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ যতগুলো আপিল ও লিভ টু আপিল করে থাকুন না কেন, চূড়ান্ত নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া যত দ্রুত সম্ভব শুরু করা উচিত। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে যা জেনেছি তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। অনেকে এ দীর্ঘ সময়ের পরও চূড়ান্ত নিষ্পত্তির বিচার প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় তাদের হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
অনেকে বলেছেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি ঘনিয়ে এলেই কেবল বিবৃতির মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়ার কিছু খবর প্রচার করা হয়। বছরের বাকি দিনগুলোতে এ বিষয়ে যতটুকু অগ্রগতি হওয়ার কথা তা হতে দেখি না। এমন অবস্থা দেখে মনে হয়, ইতিহাসের এ কলঙ্কময় ঘটনার বিচারের বিষয়ে প্রথম দিকে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো, দিন যতই গড়াচ্ছে, এর গুরুত্ব যেন ততই কমে আসছে। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের দাবি, ‘বিডিআর সদস্যদের কেবল বিচার করলেই চলবে না। এ ঘটনার পেছন থেকে যারা কলকবজা নাড়িয়েছেন, বিডিআর সদস্যদের বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, তদন্ত করে তাদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
হাইকোর্টও তদন্ত করে এসব নেপথ্যচারীর পরিচয় উন্মোচন করার পরামর্শ দিয়েছেন। সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কী পদক্ষেপ নেবে কিংবা আদৌ কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা, আমাদের জানা নেই। পিলখানা নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনার নেপথ্যচারীদের মুখ উন্মোচনের দাবি শুধু ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদেরই নয়, এ প্রত্যাশা এখন এ দেশের প্রতিটি মানুষের।
পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণাকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে হাইকোর্ট তাদের মত জানিয়েছিলেন। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার পেছনের ঘটনা উদ্ঘাটনে একটি কমিশন গঠনের পক্ষে মত জানিয়েছিলেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট সেদিন বলেছিলেন, সরকার প্রয়োজন মনে করলে তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে জাতির সামনে প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের চেহারা উন্মোচনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ রাইফেলসের বিভাগীয় কিছু উচ্চাভিলাষী সদস্য সমন্বয়ে গঠিত একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা ও উসকানিতে সাধারণ ও নবাগত সৈনিকরা বিভ্রান্ত হয়ে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ করেছিল।’ পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে এ দেশের মানুষের মনে যে সংশয় ও সন্দেহ কাজ করছে, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী সেই কথাই যেন বলে দিয়েছেন।
হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার তিন বছর পার হয়ে গেলেও এ তদন্ত কমিশন গঠনের কোনো লক্ষণ আমরা লক্ষ করছি না। তিন বছর কম সময় নয়। সরকার চাইলেই হাইকোর্টের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করতে পারত। এ দেশের প্রতিটি মানুষ বিশ্বাস করে যে, এত বড় একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড কিছু বিডিআর সদস্য দ্বারা সম্ভব নয়। এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যে একটি মহল কাজ করেছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ ঘটনার পেছনে কারও না কারও ইন্ধন থাকতে বাধ্য। যদি তাই হয়, তাহলে ‘এসব ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করতে সমস্যা কোথায়’-এর উত্তর জানা নেই। বেশি সময় পার হয়ে যায়নি। সরকার যেকোনো সময় তা করতে পারে। মানুষের মনের সন্দেহ দূর করার জন্য হলেও একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা যেতেই পারে।
বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী পিলখানা হত্যাকাণ্ডের যে আটটি উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন; তার মধ্যে তিনটি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণী বলে মনে হয়েছে। এগুলো হলো-এক. বিডিআর-এর চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে এ সুশৃঙ্খল বাহিনীকে অকার্যকর করা। দুই. বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করা এবং ৩. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করা।
আমি বেশ কিছু দিন আগে পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমার একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে, যে ঘটনা ঘটেছে, সে ঘটনা থেকে কোন্ স্বার্থান্বেষী মহল সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। কারণ, অতীতে দেখা গেছে, এ ধরনের ঘটনায় লাভবানেরাই নেপথ্যে অনুঘটকের কাজ করেছে। আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা পেশাগতভাবে যেমন দক্ষ, দায়িত্ব পালনেও তারা তেমনই সজাগ।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নে যেসব ক্ষুদ্র ও ভারী অস্ত্র বরাদ্দ আছে, বিডিআরের প্রতিটি ব্যাটালিয়নকেও একই ধরনের অস্ত্রে সজ্জিত করে এর সদস্যদের একই পর্যায়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও পারদর্শী করে গড়ে তোলা হচ্ছিল। অতএব, এ বাহিনীর সদস্যদের বিভ্রান্ত করে যদি পুরো বাহিনীকেই অকার্যকর করে ফেলা যায়, তাহলে কারা বেশি লাভবান হতে পারে, তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
মাননীয় বিচারপতি ওই স্বার্থান্বেষী মহলটিকে চিহ্নিত করতেই তদন্ত কমিশন গঠন করার জন্য মত দিয়েছেন। বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী পিলখানার ঘটনার পেছনে দ্বিতীয় যে উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন, সেটিও প্রণিধানযোগ্য। এটা মনে করা অন্যায় হবে না যে, স্বার্থান্বেষী ওই মহলটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করেছিল। এ কারণেই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাদের ইন্ধন থাকতে পারে তা বের করা জরুরি। জরুরি এ জন্যই যে, ভবিষ্যতে যাতে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা কেউ নষ্ট করতে না পারে।
সন্দেহ নেই, পিলখানা হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা দুটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মামলা। উল্লেখ্য, শুধু হত্যা মামলার রায় লিখতেই ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠা লেগে গেছে। হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কবে হবে তাও নিশ্চিত নয়। তবে এটি নিষ্পত্তি হতে যে আরও অনেক দিন লাগবে, তা বলাই বাহুল্য। আগেই উল্লেখ করেছি, বিস্ফোরক মামলাটি এখন পর্যন্ত বিচারিক আদালতেই ঝুলে আছে। বিস্ফোরক মামলার এক হাজার ৩৪৪ জন সাক্ষীর মধ্যে গত ১৪ বছরে মাত্র দুই শতাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা শেষ হয়েছে। এ মামলার আসামি ৮৩৪ জন। তাদের মধ্যে ৩৩ জন আসামি ইতোমধ্যে মারা গেছেন এবং ২০ আসামি এখনো পলাতক। হত্যা মামলার আসামিরাই এ মামলার আসামি।
বিস্ফোরক মামলাটি এখনো পর্যন্ত যেহেতু বিচারিক আদালতেই ঝুলে আছে, কাজেই এ মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। কারণ, বিচারিক মামলার রায়ের পর সেটি হাইকোর্টে শুনানি হবে। হাইকোর্টের রায়ের পর সেটি আপিল বিভাগে যাবে, আপিল নিষ্পত্তির পর আবার রিভিউ আবেদন হবে। ওদিকে হত্যা মামলার আপিল নিষ্পত্তির পর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে রিভিউ আবেদনের আরও একটি পর্ব বাকি থেকে যাবে। সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে, এ দুটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কবে হবে তা বলা মুশকিল।
সময় যতই লাগুক, একজন অপরাধীও যাতে আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগ নিতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, এরই মধ্যে সময়ের অপচয় যদি হয়েও থাকে, আগামী দিনগুলোতে যেন না হয়। তা নাহলে মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সে সুযোগ সরকার কেন দেবে? তবে এর পরও কথা আছে, বিচারের মাধ্যমে আসামিদের কেবল শাস্তি নিশ্চিত করলেই চলবে না, হাইকোর্টের মতামতের ভিত্তিতে তদন্ত কমিশন গঠন করে এ পাশবিক হত্যাকাণ্ডের পেছনের ঘটনা উদ্ঘাটন করা হোক। এটা ভুক্তোভোগী পরিবার চায়, এ দেশের মানুষও চায়। আমাদের বিশ্বাস, সরকারও চায় ঘটনার পেছনের ঘটনা সবার কাছে আরও উন্মোচিত হোক; চিহ্নিত হোক সেসব নেপথ্যচারীর আসল চেহারা।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বাইফোকাল লেন্স
পিলখানা হত্যার পেছনের ঘটনা উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিশন গঠিত হবে কি?
হাইকোর্ট পিলখানা হত্যা মামলার রায় দিয়েছেন পাঁচ বছর হলো। সময়টা ছিল ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর। সে সময় হাইকোর্ট সংক্ষিপ্ত রায় দিয়েছিল। তার দুই বছর পর মহামান্য আদালত পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছেন। কিন্তু এ সময়ের ভেতর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি বিষয়ে বড় কোনো অগ্রগতি হয়েছে কিনা বা কতদূর অগ্রগতি হয়েছে তা আমাদের জানা নেই।
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর, রাজধানীর বকশী বাজারে স্থাপিত হত্যা মামলার বিশেষ জজ আদালত ১৫২ জন বিডিআর সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ২৭৮ জনকে খালাস দিয়ে রায় দিয়েছিলেন। বিচারিক আদালতের রায়ের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের নভেম্বরে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন। অতঃপর ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন।
হাইকোর্টের রায়ে বিচারিক আদালতে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৩৯ জনের দণ্ড বহাল রাখা হয়। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ৮ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও ৪ জনকে বেকসুর খালাস দেন হাইকোর্ট। ১৮৫ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন ও ১৮৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড। অর্থাৎ ৫৫২ জনকে সাজা ও ২৮৩ জনকে খালাস দেন আদালত। তবে আশ্চর্যের বিষয়, বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার এখনো বিচারিক আদালতেই ঝুলে আছে। এখন বলা হচ্ছে, কোভিডের প্রভাবে আদালতের কার্যক্রম দীর্ঘদিন অনিয়মিত থাকায় হত্যা মামলার আপিল ও বিস্ফোরক মামলার বিচার নিষ্পত্তি পিছিয়ে গেছে।
বর্তমানে কোভিডের সেই পরিস্থিতি আর নেই। এ পর্যন্ত আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ যতগুলো আপিল ও লিভ টু আপিল করে থাকুন না কেন, চূড়ান্ত নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া যত দ্রুত সম্ভব শুরু করা উচিত। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে যা জেনেছি তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। অনেকে এ দীর্ঘ সময়ের পরও চূড়ান্ত নিষ্পত্তির বিচার প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় তাদের হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
অনেকে বলেছেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি ঘনিয়ে এলেই কেবল বিবৃতির মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়ার কিছু খবর প্রচার করা হয়। বছরের বাকি দিনগুলোতে এ বিষয়ে যতটুকু অগ্রগতি হওয়ার কথা তা হতে দেখি না। এমন অবস্থা দেখে মনে হয়, ইতিহাসের এ কলঙ্কময় ঘটনার বিচারের বিষয়ে প্রথম দিকে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো, দিন যতই গড়াচ্ছে, এর গুরুত্ব যেন ততই কমে আসছে। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের দাবি, ‘বিডিআর সদস্যদের কেবল বিচার করলেই চলবে না। এ ঘটনার পেছন থেকে যারা কলকবজা নাড়িয়েছেন, বিডিআর সদস্যদের বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, তদন্ত করে তাদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
হাইকোর্টও তদন্ত করে এসব নেপথ্যচারীর পরিচয় উন্মোচন করার পরামর্শ দিয়েছেন। সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কী পদক্ষেপ নেবে কিংবা আদৌ কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা, আমাদের জানা নেই। পিলখানা নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনার নেপথ্যচারীদের মুখ উন্মোচনের দাবি শুধু ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদেরই নয়, এ প্রত্যাশা এখন এ দেশের প্রতিটি মানুষের।
পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণাকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে হাইকোর্ট তাদের মত জানিয়েছিলেন। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার পেছনের ঘটনা উদ্ঘাটনে একটি কমিশন গঠনের পক্ষে মত জানিয়েছিলেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট সেদিন বলেছিলেন, সরকার প্রয়োজন মনে করলে তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে জাতির সামনে প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের চেহারা উন্মোচনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ রাইফেলসের বিভাগীয় কিছু উচ্চাভিলাষী সদস্য সমন্বয়ে গঠিত একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা ও উসকানিতে সাধারণ ও নবাগত সৈনিকরা বিভ্রান্ত হয়ে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ করেছিল।’ পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে এ দেশের মানুষের মনে যে সংশয় ও সন্দেহ কাজ করছে, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী সেই কথাই যেন বলে দিয়েছেন।
হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার তিন বছর পার হয়ে গেলেও এ তদন্ত কমিশন গঠনের কোনো লক্ষণ আমরা লক্ষ করছি না। তিন বছর কম সময় নয়। সরকার চাইলেই হাইকোর্টের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করতে পারত। এ দেশের প্রতিটি মানুষ বিশ্বাস করে যে, এত বড় একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড কিছু বিডিআর সদস্য দ্বারা সম্ভব নয়। এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যে একটি মহল কাজ করেছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ ঘটনার পেছনে কারও না কারও ইন্ধন থাকতে বাধ্য। যদি তাই হয়, তাহলে ‘এসব ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করতে সমস্যা কোথায়’-এর উত্তর জানা নেই। বেশি সময় পার হয়ে যায়নি। সরকার যেকোনো সময় তা করতে পারে। মানুষের মনের সন্দেহ দূর করার জন্য হলেও একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা যেতেই পারে।
বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী পিলখানা হত্যাকাণ্ডের যে আটটি উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন; তার মধ্যে তিনটি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণী বলে মনে হয়েছে। এগুলো হলো-এক. বিডিআর-এর চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে এ সুশৃঙ্খল বাহিনীকে অকার্যকর করা। দুই. বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করা এবং ৩. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করা।
আমি বেশ কিছু দিন আগে পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমার একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে, যে ঘটনা ঘটেছে, সে ঘটনা থেকে কোন্ স্বার্থান্বেষী মহল সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। কারণ, অতীতে দেখা গেছে, এ ধরনের ঘটনায় লাভবানেরাই নেপথ্যে অনুঘটকের কাজ করেছে। আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা পেশাগতভাবে যেমন দক্ষ, দায়িত্ব পালনেও তারা তেমনই সজাগ।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নে যেসব ক্ষুদ্র ও ভারী অস্ত্র বরাদ্দ আছে, বিডিআরের প্রতিটি ব্যাটালিয়নকেও একই ধরনের অস্ত্রে সজ্জিত করে এর সদস্যদের একই পর্যায়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও পারদর্শী করে গড়ে তোলা হচ্ছিল। অতএব, এ বাহিনীর সদস্যদের বিভ্রান্ত করে যদি পুরো বাহিনীকেই অকার্যকর করে ফেলা যায়, তাহলে কারা বেশি লাভবান হতে পারে, তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
মাননীয় বিচারপতি ওই স্বার্থান্বেষী মহলটিকে চিহ্নিত করতেই তদন্ত কমিশন গঠন করার জন্য মত দিয়েছেন। বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী পিলখানার ঘটনার পেছনে দ্বিতীয় যে উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন, সেটিও প্রণিধানযোগ্য। এটা মনে করা অন্যায় হবে না যে, স্বার্থান্বেষী ওই মহলটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করেছিল। এ কারণেই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাদের ইন্ধন থাকতে পারে তা বের করা জরুরি। জরুরি এ জন্যই যে, ভবিষ্যতে যাতে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা কেউ নষ্ট করতে না পারে।
সন্দেহ নেই, পিলখানা হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা দুটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মামলা। উল্লেখ্য, শুধু হত্যা মামলার রায় লিখতেই ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠা লেগে গেছে। হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কবে হবে তাও নিশ্চিত নয়। তবে এটি নিষ্পত্তি হতে যে আরও অনেক দিন লাগবে, তা বলাই বাহুল্য। আগেই উল্লেখ করেছি, বিস্ফোরক মামলাটি এখন পর্যন্ত বিচারিক আদালতেই ঝুলে আছে। বিস্ফোরক মামলার এক হাজার ৩৪৪ জন সাক্ষীর মধ্যে গত ১৪ বছরে মাত্র দুই শতাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা শেষ হয়েছে। এ মামলার আসামি ৮৩৪ জন। তাদের মধ্যে ৩৩ জন আসামি ইতোমধ্যে মারা গেছেন এবং ২০ আসামি এখনো পলাতক। হত্যা মামলার আসামিরাই এ মামলার আসামি।
বিস্ফোরক মামলাটি এখনো পর্যন্ত যেহেতু বিচারিক আদালতেই ঝুলে আছে, কাজেই এ মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। কারণ, বিচারিক মামলার রায়ের পর সেটি হাইকোর্টে শুনানি হবে। হাইকোর্টের রায়ের পর সেটি আপিল বিভাগে যাবে, আপিল নিষ্পত্তির পর আবার রিভিউ আবেদন হবে। ওদিকে হত্যা মামলার আপিল নিষ্পত্তির পর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে রিভিউ আবেদনের আরও একটি পর্ব বাকি থেকে যাবে। সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে, এ দুটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কবে হবে তা বলা মুশকিল।
সময় যতই লাগুক, একজন অপরাধীও যাতে আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগ নিতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, এরই মধ্যে সময়ের অপচয় যদি হয়েও থাকে, আগামী দিনগুলোতে যেন না হয়। তা নাহলে মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সে সুযোগ সরকার কেন দেবে? তবে এর পরও কথা আছে, বিচারের মাধ্যমে আসামিদের কেবল শাস্তি নিশ্চিত করলেই চলবে না, হাইকোর্টের মতামতের ভিত্তিতে তদন্ত কমিশন গঠন করে এ পাশবিক হত্যাকাণ্ডের পেছনের ঘটনা উদ্ঘাটন করা হোক। এটা ভুক্তোভোগী পরিবার চায়, এ দেশের মানুষও চায়। আমাদের বিশ্বাস, সরকারও চায় ঘটনার পেছনের ঘটনা সবার কাছে আরও উন্মোচিত হোক; চিহ্নিত হোক সেসব নেপথ্যচারীর আসল চেহারা।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা