বায়ুদূষণ নিরসনে দরকার বিজ্ঞানসম্মত উদ্যোগ
jugantor
বায়ুদূষণ নিরসনে দরকার বিজ্ঞানসম্মত উদ্যোগ

  মিফতাহুর রহমান  

১১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বায়ুদূষণ বর্তমান বিশ্বের একটি মারাত্মক পরিবেশসংক্রান্ত হুমকি এবং তা নিরসন করা মানবজাতির সামনে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। বস্তুত এটি ভবিষ্যতে মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একটি বড় লড়াই। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে দরকার সর্বজনীন ঐক্য, নৈতিক শক্তি, সৃজনশীলতা ও বৈশ্বিক অর্থায়ন। বায়ুদূষণের নির্ভরযোগ্য তথ্য নিয়ে বিশ্বের পরিবেশবিদ ও তথ্যবিজ্ঞানীরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিশ্লেষণ এবং তা প্রকাশ করছেন, যাতে আমরা যার যার দেশের বায়ুদূষণের মাত্রা সঠিকভাবে জানতে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি।

বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গৃহীত বায়ুমান নির্দেশক গাইডলাইনের আলোকে আমরা বায়ুবাহিত বস্তুকণা, যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ, তার সঠিক পরিমাপ করতে পারি। ডব্লিউএইচও নির্ধারিত বস্তুকণার গড় বার্ষিক ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের নিচে থাকতে হবে, যদিও এ ঘনত্বের নিচেও অনেক ধরনের দুরারোগ্য শ্বাসজনিত ব্যাধি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। নিবন্ধটি সহজপাঠ্য করার লক্ষ্যে যথাসম্ভব অপ্রযুক্তিগত ও সহজ ভাষায় লেখার চেষ্টা করছি।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) পরিসংখ্যান ব্যবহৃত হয় বায়ুদূষণের মাত্রা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর ও সতর্কীকরণ সংকেত দেওয়ার জন্য, যা জানাটা জনগণের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার গণতান্ত্রিক অধিকার বলে মনে করি। বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ধারণের একককে AQI দিয়ে প্রকাশ করা হয়। বাতাসের বিশুদ্ধতা মাপার কাজে এ এককটি ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সি (EPA)। AQI-এর মান সর্বনিম্ন ০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ে। সাধারণত এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের মান ৫০-এর নিচে হলে তা নিরাপদ বায়ু বোঝায়। অন্যথায় AQI-এর মান ৩০০’র বেশি হলে তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বায়ু হিসাবে পরিগণিত হয়। AQI-এর মান সাধারণত ছয় ভাগে বিভক্ত এবং এর প্রতিটি ভাগের সঙ্গে মানবদেহের বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা সম্পর্কযুক্ত। এ ছয়টি ধাপকে ছয়টি বিভিন্ন রঙে প্রকাশ করা হয়। এ রঙের মাধ্যমে আমরা কোনো অঞ্চলের বায়ুর মান ঝুঁকিপূর্ণ সীমা অতিক্রম করছে কিনা তা সহজেই নির্ণয় করতে পারি।

বিষয়টি সঠিকভাবে বোঝা ও হৃদয়ঙ্গম করার জন্য বাতাসে ভাসমান কিছু রাসায়নিক যৌগ গ্যাস; যেমন-নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ওজোন, কার্বন মনোঅক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইড সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান অর্জন প্রয়োজন বলে মনে করি। নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড হলো নাইট্রোজেন অক্সাইড যৌগ গ্যাসের মধ্যে একটি। বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি প্রাকৃতিক কারণে হয় স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার থেকে আগত অথবা বজ পাত থেকে উদ্ভূত উৎস থেকে।

তবে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি এর উপস্থিতির উৎস হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গাড়ি-বাস-ট্রাক এবং অন্যান্য অফ-রোড সরঞ্জাম যেমন-বুলডোজার, ড্রেজার, ক্রেন, ব্যাকহো লোডার ইত্যাদি যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি। নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড স্বল্প সময়ের জন্য শ্বাসনালিতে গেলে হাঁপানি রোগ বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘ সময়ের জন্য শ্বসন করলে হাঁপানি রোগসহ ফুসফুসের সংক্রামক রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে হাঁপানি রোগী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

মুক্ত বাতাসে ওজোন অণুর উপস্থিতি অত্যন্ত ক্ষতিকর। ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি ওজোন তৈরি হয় নাইট্রোজেন অক্সাইড ও উদ্বায়ী জৈব মিশ্র পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে। অন্যদিকে প্রাকৃতিকভাবে ওজোন স্তর, যা স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরের ১৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত, তা পৃথিবীপৃষ্ঠে সৃষ্ট জীব, জানোয়ার, গাছপালা ও মনুষ্যকুলকে সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করছে। তবে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে অনেক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে, বিশেষ করে সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরোকার্বন), যা অতিমাত্রায় রেফ্রিজারেটর ব্যবহারের ফলে হচ্ছে, ওজোন স্তরে ক্ষয় ও বিশাল ছিদ্র তৈরি হচ্ছে। এটি মানবদেহের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবসহ ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা ও পরিণতিতে গ্রিনহাউজ প্রভাব সৃষ্টির মূল কারণ। ভূপৃষ্ঠের কাছে ওজোনের উপস্থিতি, যা মানবদেহের ওপর অনেক ধরনের রোগ যেমন-বুকব্যথা, কাশি, শ্বাসনালির প্রদাহ বা জ্বালা সৃষ্টির মূল কারণ।

এছাড়া ফুসফুসজনিত রোগ ব্রংকাইটিস ও হাঁপানি বাতাসে ওজোনের উপস্থিতিতে বৃদ্ধি পায়। ওজোন শুধু জীবজন্তু ও মনুষ্যকুলের জন্যই ক্ষতিকর না, এর বিষক্রিয়া বাস্তুসংস্থান (ecosystem) ও গাছপালার পরাগায়নে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ১৯৮৬ সালে নেওয়া জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে গৃহীত কর্মসূচি ইতোমধ্যে ওজোন স্তরের ক্ষয় রোধে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ওজোন স্তরের ছিদ্র মাপা হয় ২৮.৪ বর্গকিলোমিটার, আর ২০২২ সালের নভেম্বরে অ্যান্টার্কটিকায় ওজোন স্তরের ছিদ্র ছিল প্রায় ২৪.৫ বর্গকিলোমিটার।

কার্বন মনোঅক্সাইড একটি রংবিহীন, গন্ধবিহীন গ্যাস, যা গাড়ি, ট্রাক, অন্যান্য যানবাহন, যন্ত্রপাতি থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি (ফসিল ফুয়েল) পোড়ানোর ফলে নির্গত হয়। কেরোসিন ও গ্যাসের চুলা থেকেও কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত হয়। বাতাসে বেশি মাত্রায় কার্বন মনোঅক্সাইডের উপস্থিতিতে শ্বাস নিলে তা হৃদপিণ্ডে প্রবাহিত রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ হ্রাস করে। এখানে বলা বাহুল্য যে, ধূমপায়ীরা এভাবেই হৃদপিণ্ডে ও রক্তে দরকারি অক্সিজেন সরবরাহ হ্রাস করে হৃদরোগ সৃষ্টি করে। কার্বন মনোঅক্সাইডের বিষক্রিয়ার প্রভাবে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি, বুকব্যথা, জ্ঞান হারিয়ে ফেলা, অ্যারিথমিয়া, খিঁচুনি এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

বায়ুদূষণের সবচেয়ে বিপজ্জনক উপাদান হলো বায়ুমণ্ডলীয় বস্তুকণা, যা পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) বা বায়ুমণ্ডলীয় এরোসল কণা নামেও পরিচিত। এ বস্তুকণা ক্ষুদ্র, কঠিন ও তরল পদার্থের জটিল মিশ্রণে তৈরি হয়। বস্তুকণা পিএম২.৫-এর ব্যাস হলো ২.৫ মাইক্রোমিটার অথবা তার ছোট। আর পিএম৫ ও পিএম১০-এর ব্যাস যথাক্রমে ৫ ও ১০ মাইক্রোমিটার ও তার ছোট। এ বস্তুকণা নিশ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করলে ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রে কঠিন ও দুরারোগ্য রোগ হয়। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার এ বস্তুকণাগুলোকে গ্রুপ-১ কার্সিনোজেনিক হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে।

পিএম২.৫ বস্তুকণার স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে হাঁপানি রোগ বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের দুরারোগ্য যেমন ব্রংকাইটিস বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ হয়ে থাকে। এ ছাড়া এ বস্তুকণার সংস্পর্শে হার্ট অ্যাটাক ও অ্যারিথমিয়া (হৃদপিণ্ডের স্পন্দনজনিত রোগ) রোগের জটিলতায় অনেকের অকাল মৃত্যু ঘটে থাকে। বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে, এ বস্তুকণা ইটক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত, যা কয়লা পুড়িয়ে নির্গত হয়।

অনেক ধরনের ছোট ছোট সামাজিক পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা বায়ুদূষণের মাত্রা আমাদের নিজেদের বাড়িঘরে ও আশপাশের এলাকায় কমাতে পারি। বায়ুদূষণের অনেক উৎস আছে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে; এর মধ্যে গাড়ি, ট্রাক, বাস, নির্মাণ সরঞ্জাম, পরিবহণ সরঞ্জাম, গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপ থেকে সমষ্টিগত নির্গমন মোট শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত দূষিত ও বিষাক্ত গ্যাসের চেয়ে বেশি। এ বায়ুদূষণ কমিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় আমাদের পৌর করপোরেশনগুলো ব্যাপক সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্গত প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বায়ুদূষণসংক্রান্ত শিক্ষা, নির্দেশিকা ও প্রণোদনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি।

এক্ষেত্রে সব ব্যবসাকেন্দ্র, শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করা হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। গাড়ির ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস নিষ্কাশন যন্ত্র, যা বায়ুদূষণ সৃষ্টির একটি অন্যতম উৎস, তা মেরামত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া গাড়িতে একসঙ্গে ভ্রমণ, বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার ইত্যাদি বায়ুদূষণ কমানোর সক্রিয় ও কার্যকর পন্থা। মোট কথা, কম জ্বালানি ব্যবহার কম বায়ুদূষণ সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া ছোটখাটো অসচেতনতা যেমন-গাড়ির চাকার হাওয়া কম থাকলে গাড়ির তেল বেশি পুড়বে, থামা অবস্থায় গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকলে বিষাক্ত গ্যাসের হটস্পট তৈরি হয়ে গাড়ি থেকে বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন বাড়বে; যা জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করে। খড় পোড়ানো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর একটি প্রচলিত ধারা, যা বায়ুতে অনেক বিষাক্ত গ্যাস যেমন-নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড, মিথেন, বায়ুমণ্ডলীয় বস্তুকণা পিএম২.৫, পিএম৫ ও পিএম১০ নির্গমন করে, যা মানবদেহ ও আবহাওয়ার ব্যাপক ক্ষতি করে।

এছাড়া ঘরবাড়ির আবর্জনা পোড়ানো মানবদেহ ও আবহাওয়ার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবে শুকনা গাছের লাকরি পোড়ানো ততটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। দেশজুড়ে ফলদ ও মূল্যমান কাঠের বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন করার প্রতিযোগিতা আরও জোরদার করতে হবে; কারণ, গাছপালা দূষণ সৃষ্টিকারী বাতাসকে ছেঁকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে শোষণ করে। অন্যদিকে গাছপালা বাতাসে অক্সিজেন ছাড়ে ও আবহাওয়াকে ঠান্ডা রাখে।

বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত হয় অনেক ধরনের ক্ষতিকর দূষণকারী পদার্থ, যা আরও নানা ধরনের দূষণকারী পদার্থের সৃষ্টি করে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লা, পেট্রোলিয়াম, ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপন্ন ও নির্গত হয় বিষাক্ত গ্যাস যেমন-ওজোন, কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও বায়ুমণ্ডলীয় বস্তুকণা। বলা বাহুল্য, এসব জ্বালানির মধ্যে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সবচেয়ে বেশি দূষণকারী পদার্থ ও গ্যাস নির্গত হয়।

বায়ুদূষণসংক্রান্ত সঠিক পরিসংখ্যান জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সহজলভ্য করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বায়ুদূষণ আইনের সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, কোম্পানি ও শিল্প-কারখানায় জরুরিভিত্তিতে বায়ু পর্যবেক্ষণ সিস্টেম ইনস্টল করা এবং রিয়েল সময়ে ডেটা সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া আরম্ভ করা জরুরি। পরবর্তী পর্যায়ে সংগৃহীত ডেটা সঠিক সংস্থা ও প্রাসঙ্গিক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে, যাতে তথ্যবিজ্ঞানীরা ডেটা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণে সহায়তা করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে ডেটা সংগ্রহ প্রক্রিয়া নির্ভরযোগ্য ও নির্ভুল হওয়া বাঞ্ছনীয়।

মনুষ্যকুল, জীব-জানোয়ার, গাছপালা ইত্যাদি সবাই পৃথিবী থেকে মাটি, বাতাস, পানি গ্রহণ করেই শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠে। কাজেই মানুষ যদি প্রকৃতি, আবহাওয়া ও পরিবেশ ধ্বংস করে, তাহলে এর পরিণতি মনুষ্যকুলকেই দিতে হবে। আমাদের আকাশ, বাতাস, জলাধার, ভূমি, যার ওপর আমরা সবাই নির্ভরশীল, তা মানুষের দ্বারাই কলুষিত ও দূষিত হচ্ছে। অন্যদিকে একমাত্র মানুষের সঠিক নেতৃত্বেই পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।

এ নব উদ্যোগে আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে জীবাশ্ম জ্বালানির (ফসিল ফুয়েল) যথেচ্ছ ব্যবহারকারীদের। সংরক্ষণ করতে হবে জীবজন্তু ও গাছপালার আবাসস্থল এবং নিষ্ক্রিয় করতে হবে বনজঙ্গল নিধনকারীদের। আজকের বিশ্ব বিজ্ঞান ও কারিগরি উন্নয়নের এক অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে উপনীত। সেই সঙ্গে মানুষের সীমাহীন সৃজনশীলতা মানবজাতিকে দিয়েছে অসাধ্য জয়ের এক অসাধারণ ক্ষমতা-যা ব্যবহার করে মানুষ দারিদ্র্য, বেকারত্ব, রোগব্যাধি ও পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা করতে পারে পৃথিবীকে।

মিফতাহুর রহমান : শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিজ্ঞান ও কারিগরি পরামর্শক

miftahur1710@gmail.com

বায়ুদূষণ নিরসনে দরকার বিজ্ঞানসম্মত উদ্যোগ

 মিফতাহুর রহমান 
১১ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বায়ুদূষণ বর্তমান বিশ্বের একটি মারাত্মক পরিবেশসংক্রান্ত হুমকি এবং তা নিরসন করা মানবজাতির সামনে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। বস্তুত এটি ভবিষ্যতে মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একটি বড় লড়াই। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে দরকার সর্বজনীন ঐক্য, নৈতিক শক্তি, সৃজনশীলতা ও বৈশ্বিক অর্থায়ন। বায়ুদূষণের নির্ভরযোগ্য তথ্য নিয়ে বিশ্বের পরিবেশবিদ ও তথ্যবিজ্ঞানীরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিশ্লেষণ এবং তা প্রকাশ করছেন, যাতে আমরা যার যার দেশের বায়ুদূষণের মাত্রা সঠিকভাবে জানতে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি।

বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গৃহীত বায়ুমান নির্দেশক গাইডলাইনের আলোকে আমরা বায়ুবাহিত বস্তুকণা, যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ, তার সঠিক পরিমাপ করতে পারি। ডব্লিউএইচও নির্ধারিত বস্তুকণার গড় বার্ষিক ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের নিচে থাকতে হবে, যদিও এ ঘনত্বের নিচেও অনেক ধরনের দুরারোগ্য শ্বাসজনিত ব্যাধি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। নিবন্ধটি সহজপাঠ্য করার লক্ষ্যে যথাসম্ভব অপ্রযুক্তিগত ও সহজ ভাষায় লেখার চেষ্টা করছি।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) পরিসংখ্যান ব্যবহৃত হয় বায়ুদূষণের মাত্রা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর ও সতর্কীকরণ সংকেত দেওয়ার জন্য, যা জানাটা জনগণের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার গণতান্ত্রিক অধিকার বলে মনে করি। বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ধারণের একককে AQI দিয়ে প্রকাশ করা হয়। বাতাসের বিশুদ্ধতা মাপার কাজে এ এককটি ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সি (EPA)। AQI-এর মান সর্বনিম্ন ০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ে। সাধারণত এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের মান ৫০-এর নিচে হলে তা নিরাপদ বায়ু বোঝায়। অন্যথায় AQI-এর মান ৩০০’র বেশি হলে তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বায়ু হিসাবে পরিগণিত হয়। AQI-এর মান সাধারণত ছয় ভাগে বিভক্ত এবং এর প্রতিটি ভাগের সঙ্গে মানবদেহের বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা সম্পর্কযুক্ত। এ ছয়টি ধাপকে ছয়টি বিভিন্ন রঙে প্রকাশ করা হয়। এ রঙের মাধ্যমে আমরা কোনো অঞ্চলের বায়ুর মান ঝুঁকিপূর্ণ সীমা অতিক্রম করছে কিনা তা সহজেই নির্ণয় করতে পারি।

বিষয়টি সঠিকভাবে বোঝা ও হৃদয়ঙ্গম করার জন্য বাতাসে ভাসমান কিছু রাসায়নিক যৌগ গ্যাস; যেমন-নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ওজোন, কার্বন মনোঅক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইড সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান অর্জন প্রয়োজন বলে মনে করি। নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড হলো নাইট্রোজেন অক্সাইড যৌগ গ্যাসের মধ্যে একটি। বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি প্রাকৃতিক কারণে হয় স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার থেকে আগত অথবা বজ পাত থেকে উদ্ভূত উৎস থেকে।

তবে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি এর উপস্থিতির উৎস হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গাড়ি-বাস-ট্রাক এবং অন্যান্য অফ-রোড সরঞ্জাম যেমন-বুলডোজার, ড্রেজার, ক্রেন, ব্যাকহো লোডার ইত্যাদি যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি। নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড স্বল্প সময়ের জন্য শ্বাসনালিতে গেলে হাঁপানি রোগ বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘ সময়ের জন্য শ্বসন করলে হাঁপানি রোগসহ ফুসফুসের সংক্রামক রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে হাঁপানি রোগী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

মুক্ত বাতাসে ওজোন অণুর উপস্থিতি অত্যন্ত ক্ষতিকর। ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি ওজোন তৈরি হয় নাইট্রোজেন অক্সাইড ও উদ্বায়ী জৈব মিশ্র পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে। অন্যদিকে প্রাকৃতিকভাবে ওজোন স্তর, যা স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরের ১৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত, তা পৃথিবীপৃষ্ঠে সৃষ্ট জীব, জানোয়ার, গাছপালা ও মনুষ্যকুলকে সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করছে। তবে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে অনেক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে, বিশেষ করে সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরোকার্বন), যা অতিমাত্রায় রেফ্রিজারেটর ব্যবহারের ফলে হচ্ছে, ওজোন স্তরে ক্ষয় ও বিশাল ছিদ্র তৈরি হচ্ছে। এটি মানবদেহের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবসহ ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা ও পরিণতিতে গ্রিনহাউজ প্রভাব সৃষ্টির মূল কারণ। ভূপৃষ্ঠের কাছে ওজোনের উপস্থিতি, যা মানবদেহের ওপর অনেক ধরনের রোগ যেমন-বুকব্যথা, কাশি, শ্বাসনালির প্রদাহ বা জ্বালা সৃষ্টির মূল কারণ।

এছাড়া ফুসফুসজনিত রোগ ব্রংকাইটিস ও হাঁপানি বাতাসে ওজোনের উপস্থিতিতে বৃদ্ধি পায়। ওজোন শুধু জীবজন্তু ও মনুষ্যকুলের জন্যই ক্ষতিকর না, এর বিষক্রিয়া বাস্তুসংস্থান (ecosystem) ও গাছপালার পরাগায়নে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ১৯৮৬ সালে নেওয়া জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে গৃহীত কর্মসূচি ইতোমধ্যে ওজোন স্তরের ক্ষয় রোধে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ওজোন স্তরের ছিদ্র মাপা হয় ২৮.৪ বর্গকিলোমিটার, আর ২০২২ সালের নভেম্বরে অ্যান্টার্কটিকায় ওজোন স্তরের ছিদ্র ছিল প্রায় ২৪.৫ বর্গকিলোমিটার।

কার্বন মনোঅক্সাইড একটি রংবিহীন, গন্ধবিহীন গ্যাস, যা গাড়ি, ট্রাক, অন্যান্য যানবাহন, যন্ত্রপাতি থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি (ফসিল ফুয়েল) পোড়ানোর ফলে নির্গত হয়। কেরোসিন ও গ্যাসের চুলা থেকেও কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত হয়। বাতাসে বেশি মাত্রায় কার্বন মনোঅক্সাইডের উপস্থিতিতে শ্বাস নিলে তা হৃদপিণ্ডে প্রবাহিত রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ হ্রাস করে। এখানে বলা বাহুল্য যে, ধূমপায়ীরা এভাবেই হৃদপিণ্ডে ও রক্তে দরকারি অক্সিজেন সরবরাহ হ্রাস করে হৃদরোগ সৃষ্টি করে। কার্বন মনোঅক্সাইডের বিষক্রিয়ার প্রভাবে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি, বুকব্যথা, জ্ঞান হারিয়ে ফেলা, অ্যারিথমিয়া, খিঁচুনি এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

বায়ুদূষণের সবচেয়ে বিপজ্জনক উপাদান হলো বায়ুমণ্ডলীয় বস্তুকণা, যা পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) বা বায়ুমণ্ডলীয় এরোসল কণা নামেও পরিচিত। এ বস্তুকণা ক্ষুদ্র, কঠিন ও তরল পদার্থের জটিল মিশ্রণে তৈরি হয়। বস্তুকণা পিএম২.৫-এর ব্যাস হলো ২.৫ মাইক্রোমিটার অথবা তার ছোট। আর পিএম৫ ও পিএম১০-এর ব্যাস যথাক্রমে ৫ ও ১০ মাইক্রোমিটার ও তার ছোট। এ বস্তুকণা নিশ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করলে ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রে কঠিন ও দুরারোগ্য রোগ হয়। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার এ বস্তুকণাগুলোকে গ্রুপ-১ কার্সিনোজেনিক হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে।

পিএম২.৫ বস্তুকণার স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে হাঁপানি রোগ বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের দুরারোগ্য যেমন ব্রংকাইটিস বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ হয়ে থাকে। এ ছাড়া এ বস্তুকণার সংস্পর্শে হার্ট অ্যাটাক ও অ্যারিথমিয়া (হৃদপিণ্ডের স্পন্দনজনিত রোগ) রোগের জটিলতায় অনেকের অকাল মৃত্যু ঘটে থাকে। বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে, এ বস্তুকণা ইটক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত, যা কয়লা পুড়িয়ে নির্গত হয়।

অনেক ধরনের ছোট ছোট সামাজিক পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা বায়ুদূষণের মাত্রা আমাদের নিজেদের বাড়িঘরে ও আশপাশের এলাকায় কমাতে পারি। বায়ুদূষণের অনেক উৎস আছে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে; এর মধ্যে গাড়ি, ট্রাক, বাস, নির্মাণ সরঞ্জাম, পরিবহণ সরঞ্জাম, গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপ থেকে সমষ্টিগত নির্গমন মোট শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত দূষিত ও বিষাক্ত গ্যাসের চেয়ে বেশি। এ বায়ুদূষণ কমিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় আমাদের পৌর করপোরেশনগুলো ব্যাপক সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্গত প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বায়ুদূষণসংক্রান্ত শিক্ষা, নির্দেশিকা ও প্রণোদনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি।

এক্ষেত্রে সব ব্যবসাকেন্দ্র, শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করা হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। গাড়ির ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস নিষ্কাশন যন্ত্র, যা বায়ুদূষণ সৃষ্টির একটি অন্যতম উৎস, তা মেরামত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া গাড়িতে একসঙ্গে ভ্রমণ, বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার ইত্যাদি বায়ুদূষণ কমানোর সক্রিয় ও কার্যকর পন্থা। মোট কথা, কম জ্বালানি ব্যবহার কম বায়ুদূষণ সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া ছোটখাটো অসচেতনতা যেমন-গাড়ির চাকার হাওয়া কম থাকলে গাড়ির তেল বেশি পুড়বে, থামা অবস্থায় গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকলে বিষাক্ত গ্যাসের হটস্পট তৈরি হয়ে গাড়ি থেকে বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন বাড়বে; যা জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করে। খড় পোড়ানো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর একটি প্রচলিত ধারা, যা বায়ুতে অনেক বিষাক্ত গ্যাস যেমন-নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড, মিথেন, বায়ুমণ্ডলীয় বস্তুকণা পিএম২.৫, পিএম৫ ও পিএম১০ নির্গমন করে, যা মানবদেহ ও আবহাওয়ার ব্যাপক ক্ষতি করে।

এছাড়া ঘরবাড়ির আবর্জনা পোড়ানো মানবদেহ ও আবহাওয়ার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবে শুকনা গাছের লাকরি পোড়ানো ততটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। দেশজুড়ে ফলদ ও মূল্যমান কাঠের বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন করার প্রতিযোগিতা আরও জোরদার করতে হবে; কারণ, গাছপালা দূষণ সৃষ্টিকারী বাতাসকে ছেঁকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে শোষণ করে। অন্যদিকে গাছপালা বাতাসে অক্সিজেন ছাড়ে ও আবহাওয়াকে ঠান্ডা রাখে।

বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত হয় অনেক ধরনের ক্ষতিকর দূষণকারী পদার্থ, যা আরও নানা ধরনের দূষণকারী পদার্থের সৃষ্টি করে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লা, পেট্রোলিয়াম, ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপন্ন ও নির্গত হয় বিষাক্ত গ্যাস যেমন-ওজোন, কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও বায়ুমণ্ডলীয় বস্তুকণা। বলা বাহুল্য, এসব জ্বালানির মধ্যে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সবচেয়ে বেশি দূষণকারী পদার্থ ও গ্যাস নির্গত হয়।

বায়ুদূষণসংক্রান্ত সঠিক পরিসংখ্যান জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সহজলভ্য করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বায়ুদূষণ আইনের সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, কোম্পানি ও শিল্প-কারখানায় জরুরিভিত্তিতে বায়ু পর্যবেক্ষণ সিস্টেম ইনস্টল করা এবং রিয়েল সময়ে ডেটা সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া আরম্ভ করা জরুরি। পরবর্তী পর্যায়ে সংগৃহীত ডেটা সঠিক সংস্থা ও প্রাসঙ্গিক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে, যাতে তথ্যবিজ্ঞানীরা ডেটা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণে সহায়তা করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে ডেটা সংগ্রহ প্রক্রিয়া নির্ভরযোগ্য ও নির্ভুল হওয়া বাঞ্ছনীয়।

মনুষ্যকুল, জীব-জানোয়ার, গাছপালা ইত্যাদি সবাই পৃথিবী থেকে মাটি, বাতাস, পানি গ্রহণ করেই শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠে। কাজেই মানুষ যদি প্রকৃতি, আবহাওয়া ও পরিবেশ ধ্বংস করে, তাহলে এর পরিণতি মনুষ্যকুলকেই দিতে হবে। আমাদের আকাশ, বাতাস, জলাধার, ভূমি, যার ওপর আমরা সবাই নির্ভরশীল, তা মানুষের দ্বারাই কলুষিত ও দূষিত হচ্ছে। অন্যদিকে একমাত্র মানুষের সঠিক নেতৃত্বেই পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।

এ নব উদ্যোগে আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে জীবাশ্ম জ্বালানির (ফসিল ফুয়েল) যথেচ্ছ ব্যবহারকারীদের। সংরক্ষণ করতে হবে জীবজন্তু ও গাছপালার আবাসস্থল এবং নিষ্ক্রিয় করতে হবে বনজঙ্গল নিধনকারীদের। আজকের বিশ্ব বিজ্ঞান ও কারিগরি উন্নয়নের এক অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে উপনীত। সেই সঙ্গে মানুষের সীমাহীন সৃজনশীলতা মানবজাতিকে দিয়েছে অসাধ্য জয়ের এক অসাধারণ ক্ষমতা-যা ব্যবহার করে মানুষ দারিদ্র্য, বেকারত্ব, রোগব্যাধি ও পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা করতে পারে পৃথিবীকে।

মিফতাহুর রহমান : শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিজ্ঞান ও কারিগরি পরামর্শক

miftahur1710@gmail.com

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন