স্বার্থপরতার সব বৃত্ত ভাঙার পদক্ষেপ নিতে হবে: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
jugantor
সাক্ষাৎকার
স্বার্থপরতার সব বৃত্ত ভাঙার পদক্ষেপ নিতে হবে: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

  মোহাম্মদ কবীর আহমদ  

১২ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জন্ম ১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি সিলেটে। তিনি সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন; উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন সিলেট এমসি কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর করেন যথাক্রমে ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে। ১৯৮১ সালে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইয়েটসের কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব বিষয়ে পিএইচডি করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ অধ্যাপক কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ মর্যাদাসম্পন্ন আরও বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

শিক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে এই শিক্ষাবিদ খোলামেলা আলোচনা করেছেন যুগান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোহাম্মদ কবীর আহমদ

যুগান্তর: উন্নত দেশগুলো চতুর্থ ও পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ যেভাবে মোকাবিলা করবে, বাস্তব পরিস্থিতির কারণে আমরা সেভাবে মোকাবিলা করতে পারব না। কারণ তাদের চলার গতি আর আমাদের চলার গতি ভিন্ন। আগামীতে একটা পর্যায়ে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সব দেশকে তুমুল প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হবে। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমরাও যাতে এগিয়ে থাকতে পারি সেজন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমাদের দেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জোরালো প্রস্তুতি এখনো বিশেষভাবে দৃশ্যমান নয়; পঞ্চম তো দূরের কথা। ২০৪১ সালে আমাদের উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারের এ ইচ্ছা মূলত জনগণেরই ইচ্ছা। আমরা তো চাই, বাংলাদেশ আরও আগেই উন্নত দেশের লক্ষ্যে পৌঁছাক।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আগামীতে সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব বাড়বে। আমরা দেখেছি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবনের সম্ভাবনা যত উজ্জ্বল হয়, যত দ্রুত নানা রকম প্রাপ্তি ঘটে, নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে তত দ্রুত একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এটি স্পষ্ট যে, আগামীতে সমগ্র বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব আরও বাড়বে। কাজেই এ খাতে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আমরা লক্ষ করেছি, নৈতিকতার অভাবে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলোতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বার্থপরতার দৃষ্টান্ত বাড়ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলা হলেও তারা হয়ে পড়ে বাজারসর্বস্ব। এসব লক্ষণ থেকেও আগামী দিনের বাস্তবতা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। আগামী দিনগুলোতে সামাজিক মূল্যবোধে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। কাজেই আগে থেকে সতর্কতামূলক প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ঐতিহ্য ধরে রাখা কঠিন হতে পারে। নানা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হলে জ্ঞানচর্চার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। একজন বিজ্ঞানীকে বিজ্ঞানের গবেষণায় সফল হওয়ার পাশাপাশি মানবিকতার চর্চায়ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সায়েন্স ও আর্টস যাতে একটি অপরটির পরিপূরক হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। একজন বিজ্ঞানীর গবেষণালব্ধ ফলাফল মানুষের অকল্যাণে যাতে ব্যবহৃত হতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। মানবসম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের কারও কৃপার পাত্র হতে হবে না।

যুগান্তর : লক্ষ করা যায়, প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলোতে প্রান্তিক মানুষের প্রতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা ক্রমেই কমতে থাকে। তেমন সমাজে বৈষম্য প্রকট হয়, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও একটা শূন্যতা বা নৈরাজ্য স্পষ্ট হতে থাকে, যেখানে মানুষের লোভের সঙ্গে যুক্ত হয় প্রযুক্তিগত সমস্যাও। এসব সমস্যার সমাধানে কী করণীয়?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমরা যে সমাজ গড়তে চাই সেখানে নৈতিকতা-মানবিকতাও বিশেষ গুরুত্ব পাওয়া উচিত। আমরা চাই, শিক্ষা ও দেশের সব ধরনের সেবায় প্রান্তিক মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। এটা যেন স্লোগানে সীমিত না থাকে তা নিশ্চিত করা দরকার। নারীর ক্ষমতায়নে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা প্রান্তিক পর্যায়ের পরিবারগুলোয় যাতে পৌঁছায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত সুযোগ না পেলে প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজটি কঠিন। মানুষের প্রতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা যাতে ক্রমে বাড়ে তা নিশ্চিত করা দরকার। সেটাই সবচেয়ে ভদ্রসমাজ, যেখানে নারী-পুরুষের বিভাজন থাকে না। সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের, বিশেষত নারীদের শিক্ষা বিস্তার ও কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আমাদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বিভিন্ন মহলের স্বার্থপরতা। স্বার্থপরতার সব বৃত্ত ভাঙার পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে কঠোর হতে হবে।

যুগান্তর : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবিকভাবে কাজে লাগিয়ে সর্বত্র সুফল পাওয়া নিশ্চিত করতে পঞ্চম শিল্পবিপ্লবে বেশি জোর দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে আমরা যাতে পিছিয়ে না পড়ি, সেজন্য কী করণীয়?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনকে সহজ করে তুলেছে। আবার উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহার কিছু মানুষের জন্য চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয়েছে; কারণ এর ফলে আমাদের মতো দেশে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। আমার তো মনে হয়, কোনো এক সময় যুদ্ধে পদাতিক বাহিনীর কার্যকারিতা খুবই নগণ্য হয়ে পড়বে। মূল যুদ্ধ চালাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ড্রোনের মতো অস্ত্র; যেখানে বিজ্ঞানীদের ভূমিকা সমরপতিদের সমান বা বেশিই হবে। নৈতিকতার স্খলনে সন্ত্রাস বেড়ে যেতে পারে। আমাদের নীতির ঘরে যাতে কোনো রকম শূন্যতা না থাকে, আগামীতে আমাদের যাতে কারও দয়ার ওপর নির্ভর করে চলতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা যাতে অন্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে না পড়ি, তা নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের দেশের মানুষের ব্যতিক্রমী মানবিক মূল্যবোধ সারা বিশ্বে প্রশংসিত। এ মূল্যবোধে হাজার বছরের সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে; যা মানুষকে একই সঙ্গে নিজেকে এবং অপরকে নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের সংস্কৃতির মূল বার্তাটি হলো, অন্যকে বাদ দিয়ে ভালো থাকা যায় না। লালন শাহ কিংবা শাহ আবদুল করিমের মতো একজন ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন তাদের সমৃদ্ধ ভাবনার কারণে। আধুনিক জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি এসব মনীষীর ভাবনার কথাগুলো মনে রেখে আমরা যত সফলভাবে পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব, তা অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় হবে।

যুগান্তর : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিছু মানুষের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই উদ্বেগ কতটা যৌক্তিক?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এ উদ্বেগ যে একেবারে অযৌক্তিক তা নয়। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক উচ্চতর জ্ঞান অদূরভবিষ্যতেও আমরা সেভাবে তৈরি করতে পারব না। ফলে বিদেশ থেকে যখন আমরা এ জ্ঞান সংগ্রহ করব, তখন আমাদের শর্তে তা করতে পারব না। এতে আমাদের বিপদ থেকেই যাবে। তবে দেশে দেশে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে নিরাপত্তার বিষয়টির একটা সুরাহা হয়তো হবে। তাছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না বাড়লে আমাদের সব কর্মকাণ্ডে-শিক্ষা থেকে নিয়ে কৃষি, চিকিৎসা থেকে নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কমে যাবে। অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অনিবার্য ও নির্বিকল্প হয়ে পড়ছে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাজকে স্বাগত জানানোর বিকল্প নেই। কাজেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহারকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা উচিত এবং একই সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সবারই উচিত দক্ষতা বাড়ানোর ওপর মনোনিবেশ করা। নিজেদের দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব হলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোনো সমস্যা তৈরি করবে না।

যুগান্তর : পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের কী কী বিষয় বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের প্রধান অনুষঙ্গ প্রযুক্তি ও মানবিকতার সম্মিলন। কেউ প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনের পরও যখন নৈতিকতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে, তখন নানা বিচ্যুতি দেখা দেয়। আমরা তো সেটা করতে চাই না। আমরা যে সমাজ গড়তে চাই সেখানে নৈতিকতা থাকবে, নীতি থাকবে, মানবিকতা থাকবে। কোনো কোনো দেশে ও সমাজে যন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরতা দেখা যায়। পঞ্চম শিল্পবিপ্লব এ অতিনির্ভরতার প্রতিফলন দেখাতে পারে। তাতে নৈতিকতা ও মানবিকতার ক্ষেত্রে যাতে কোনো রকম শৈথিল্য না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষানীতি, সমাজনীতি, কৃষিনীতি ইত্যাদিতে এসব সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকতে হবে। সব ধরনের সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যাতে কোনো রকম বৈষম্যের সৃষ্টি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা সাম্য ও মানবিকতার সম্মিলন চাই। আমাদের মনে রাখতে হবে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের বিকল্প নেই।

যুগান্তর : প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের তেমন সুখকর নয়। নতুন শিক্ষাক্রমের সাফল্য নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শুধু পাঠ মুখস্থ করা এবং পরীক্ষা দেওয়ার আয়োজন করে যে শিক্ষাব্যবস্থা, তার তুলনায় নতুন শিক্ষাপদ্ধতি একেবারেই আলাদা। এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে শেখায়, তাদের মুখস্থ করার পরিবর্তে বিষয়বস্তুর গভীরে গিয়ে জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করে। এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীর চিন্তাভাবনা প্রকাশের পাশাপাশি আত্মবিকাশের সুযোগও করে দেয়। আধুনিক এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা বাড়ায়, পাঠগ্রহণ আনন্দময় করে এবং সমগ্র শিক্ষাদান পদ্ধতিকে অংশগ্রহণমূলক করে তোলে। নতুন শিক্ষাক্রমের মূল কথা হলো সৃজনশীলতা। শিক্ষায় আমাদের বিনিয়োগ তুলনামূূলক কম। ১৯৭৪ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে বলা হয়েছিল, জিডিপির পাঁচ থেকে সাত শতাংশ শিক্ষায় বিনিয়োগ হওয়া উচিত। সেই লক্ষ্য আজও বাস্তবায়িত হয়নি। লক্ষ করা যাচ্ছে, বাজেট স্বল্পতার কারণে শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের বেতনভাতা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নতুন পাঠক্রম বাস্তবায়নে যত রকম প্রশিক্ষণ দরকার, সেসব প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আয়োজনটা সুসম্পন্ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলে চলবে না। যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া এ পাঠক্রম পড়ানোর মতো দক্ষ শিক্ষক পাওয়া কঠিন। প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা ও সমন্বয়হীনতা-এসব সীমাবদ্ধতা কাটানোর পদক্ষেপও নিতে হবে। পাঠক্রম বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে কোনো রকম ষড়যন্ত্র হয় কিনা সেদিকেও কর্তৃপক্ষকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এ খাতের সবরকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, সতর্ক না থাকলে অতিগুরুত্বপূর্ণ ও অতিসুন্দর আয়োজনও বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গণমাধ্যমের উচিত এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া। অন্য দশটি সেক্টরের সঙ্গে এ সেক্টরকে না মিলিয়ে এ খাতে সবরকম অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

যুগান্তর : বাজেট স্বল্পতা তো একটি বাস্তবতা। কর্তৃপক্ষ চাইলেই কি এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে, দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে হলে, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে চাইলে অবশ্যই তা সম্ভব। বাজেটে কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমানো যেতে পারে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে-প্রতিবছরই জিডিপির এক থেকে দেড় শতাংশ বাড়ানো উচিত। স্বনির্ভর হতে হলে শিক্ষা খাতের বাজেট বাড়ানোর বিকল্প নেই। দেশে অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, আরও হবে। এসব প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় দরকার দক্ষ জনবল। সেই জনবল বিদেশ থেকে না এনে দেশেই তৈরি করতে হবে। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ না বাড়ালে কাঙ্ক্ষিত সময়ে এ দক্ষ জনবল কীভাবে তৈরি হবে? দেশে সুপার ম্যানেজারের পদে যে মানের দক্ষ জনবল দরকার, তার জন্য যাতে বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে না হয়, সেজন্য শিক্ষার মান অনেক বাড়াতে হবে। প্রয়োজনীয় আর্থিক বিনিয়োগ না হলে তা-ও সম্ভব হবে না। আশার কথা, আমাদের দেশে উচ্চ বেতনের জনবলের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। বস্তুত দক্ষ জনবল তৈরি করা সম্ভব হলে দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশেও তাদের কর্মসংস্থান হবে।

যুগান্তর : প্রাথমিকের শিক্ষকতায় মেধাবীদের আগ্রহী করতে আকর্ষণীয় বেতন প্রদানের কথা অতীতে আপনি বারবার উল্লেখ করছেন। এখন তো প্রাথমিকের শিক্ষকরা আগের চেয়ে বলা যায় আকর্ষণীয় বেতন পাচ্ছেন। এটা যথেষ্ট কি?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আগের থেকে ভালো, কিন্তু আকর্ষণীয় নয়। বর্তমান বাজারমূল্যের কথা বিবেচনায় রাখলে প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন যদি ধরুন সত্তর হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলো, স্কুলের পাশে আবাসনের ব্যবস্থা করে শিক্ষকদের স্বল্প বা বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা করা গেল, তাহলে মেধাবীরা এ পেশায় আগ্রহী হবেন, এটা আশা করা যায়। একজন মেধাবী শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থী যে মানের শিক্ষা পাবে, তুলনামূলক কম মেধাবী শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা সেই মানের শিক্ষা পাবে না। প্রতিটি প্রাইমারি স্কুলকে একেকটা সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসাবে তৈরি করা গেলে, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর সমাহার ঘটানো সম্ভব হলে নতুন পাঠক্রম কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাস্তবায়ন সম্ভব। একটি প্রাইমারি স্কুলে ভালো খেলার মাঠ, একটা অডিটোরিয়াম, ডিজিটাল ক্লাসরুম (যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রেজেন্টেশন দেবে, ইংরেজি শিখবে, বাংলা শিখবে, জীবন দক্ষতা শিখবে) ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব হলে, দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া গেলে নতুন পাঠক্রম কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো।

যুগান্তর : দেশে তরুণরা ভালো ভালো কাজ করছে, যা আমাদের আশাবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করে। আবার এটাও লক্ষ করা যায়, তরুণদের অনেকের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। উচ্চ নৈতিকতা ও উন্নত মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত সীমিত হয়ে পড়ার কারণ কী?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষার দুটো বিষয় আছে। শিক্ষার ভেতরে একটা সংস্কৃতি থাকে, নৈতিকতা থাকে, মুখস্থনির্ভর শিক্ষা যা শেখায় না (শিক্ষার সংস্কৃতি হচ্ছে মনকে উদার করা, বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ রাখা; যে কোনো ধরনের অশুভ, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকা, মানবিকতার চর্চা করা)। শিক্ষার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান-প্রযুক্তিসহ সব বিষয়ে বৈশ্বিক মানের কৌশল শিক্ষা দেওয়া, জীবন দক্ষতা শেখানো এবং শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ আকর্ষণীয় করা। মুখস্থনির্ভর শিক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েও অনেকে কর্মক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা দেখাতে পারে না। সে দক্ষ জনবল প্রতিবেশী অন্য দেশের কর্মীদের সঙ্গে দক্ষতার দিক থেকেও পেরে উঠছে না। কারণ, ওই সংস্কৃতির ফোকাসটা সে জানতে পারে না। শিক্ষা মানুষকে নৈতিকতার চর্চা করতে শেখায়; সৌন্দর্যের চর্চা করতে শেখায়। মুখস্থনির্ভর শিক্ষা যে জনবল তৈরি করে, তারা প্রশ্ন করার পরিবর্তে আদেশ পালন করতেই বেশি পছন্দ করে। নীতির প্রশ্নে তারা আপস করে, সেটিই স্বাভাবিক। তাদের এমন জনসম্পদ দেশের কল্যাণে কী ভূমিকা রাখতে পারবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

যুগান্তর : বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থী ভাষা ও গণিতে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এ দুই বিষয়ে একেবারে গোড়া থেকে অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মানোন্নয়নের মূলে থাকা উচিত একীভূত ও একমুখী মানসম্মত শিক্ষা চালু করা। শিক্ষার্থীরা ভাষা ও গণিতে দক্ষতা অর্জনে যেন সক্ষম হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পূর্ণ নাগরিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া নির্ভর করছে শিক্ষার্থী শৈশবে কতটা মানসম্মত শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে তার ওপর।

যুগান্তর : কোনো কোনো শিক্ষকের অর্থের পেছনে ছোটাছুটির বিষয়টি বিভিন্ন আলোচনায় আসে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আত্মত্যাগের মানসিকতা নিয়ে যারা শিক্ষকতায় আসেন, তারা নগদ কী পেলেন সে হিসাব কখনই করেন না। তাদের একমাত্র চিন্তা থাকে কী করে পাঠ্য বিষয় শিক্ষার্থীদের সামনে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা যায়। এমন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের সংখ্যা কী হারে কমছে এ বিতর্কে না গিয়ে সাধারণভাবে বলা যায়, এমন অনেকেই আছেন, যারা এ পেশাকে অন্য আর দশটি পেশায় নিয়োজিত কর্মজীবীদের মতো চাকরি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিও এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী। শিক্ষকদের জন্য বিনিয়োগ বাড়লে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের সংখ্যা যে অনেকগুণ বেড়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

যুগান্তর : মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে শিক্ষক সমাজের কী করণীয়?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পাঠ্যপুস্তককেন্দ্রিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি শিক্ষকদের একটি করণীয় হচ্ছ শিক্ষার্থীদের উন্নত নৈতিকতার চর্চায় উদ্বুদ্ধ করা। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানের বিষয়ে শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত যে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকসমাজের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে উন্নত নৈতিকতার চর্চা যে আরও বাড়বে, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়।

যুগান্তর : যেসব শিশু পরিবার থেকে যথাযথ শিক্ষা পায় না তাদের নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি হবে কীভাবে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : একটি শিশু স্কুলের পাশাপাশি পরিবারে যে শিক্ষা পায় সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে পরিবারের কর্তা অনৈতিক কাজে নিজেকে যুক্ত রাখেন, সন্তানকে পরিপূর্ণ নৈতিকতার শিক্ষা প্রদানে তার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। যে শিশু পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মানসম্মত কিছু শিখতে পারে না, সে যেন সমাজ থেকে শিখতে পারে, সেজন্য পর্যাপ্ত বিকল্প সুযোগ থাকা দরকার। তার জন্য তখন স্কুলই হয়ে যায় একমাত্র জায়গা; যেখানে ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভের পার্থক্য নির্ণয়সহ নৈতিকতার অন্য বিষয়গুলো সে শিখতে পারে। তবে ব্যাপক অর্থে পুরো সমাজটাই একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একটি শিশু যাতে সবসময় স্কুল ও সমাজ থেকে ঠিক শিক্ষা পায় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।

যুগান্তর : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় না। এতে অনেক ক্ষেত্রে মেধার অপচয় হয়। এ সমস্যার সামধানে কী করণীয়?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সারা দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান বাড়ানো সম্ভব হলে, পাবলিক-প্রাইভেট সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নীত করা সম্ভব হলে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নত মানের হলে তখন আর শিক্ষার্থীদের অনেক দূরের জেলা শহর থেকে রাজধানীতে বা দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ভর্তির জন্য ছুটতে হবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বাড়লে, শিক্ষার্থীদের বেতন ইত্যাদি সহনীয় পর্যায়ে নামলে এ খাতটিও মানসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তারে বড় অবদান রাখতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন হার্ভার্ড, বেসরকারি খাতের উজ্জ্বল উদাহরণ।

যুগান্তর : শিক্ষার্থীদের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমাদের লক্ষ্য থাকবে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বিশ্বমানে উন্নীত করা। তবে মনে রাখতে হবে, কোনো শিক্ষার্থী যদি নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ না পায়, সংস্কৃতির অন্তর্গত শিক্ষা ও মূল্যবোধের সঙ্গে সে নিবিড়ভাবে পরিচিত হতে না পারে, তাহলে তার দক্ষতা উন্নত হলেও সে সুনাগরিক হতে পারবে না। একই সঙ্গে এ-ও বলা যায়, সংস্কৃতির অভাব তাকে প্রকৃত বিশ্বমানে পৌঁছাতে দেবে না। কোনো শিক্ষার্থী নিজ সংস্কৃতির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ না পেলে তার দশা হয় শেকড়বিহীন উদ্ভিদের মতো। কেউ কায়মনে বাঙালি না হলে সে বিশ্বমানব হতে পারবে না। জাপানিরা, কোরিয়ানরা এবং আরও বহু দেশের শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্বতা বজায় রেখে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করে। আমাদেরও তা-ই করা উচিত।

যুগান্তর : বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : দেশের অনেক বিদ্যালয়েই বিজ্ঞান শিক্ষার আধুনিক উপকরণের অভাব রয়েছে, যোগ্যতাসম্পন্ন বিজ্ঞানের শিক্ষকের অভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে মেয়েদের তেমন উৎসাহ প্রদান করা হয় না, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে মেয়েদের নিরুৎসাহিত করা হয়। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীকে শৈশব থেকে বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী করতে হবে। স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষার আধুনিক উপকরণ সরবরাহ করা হলে বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়বে। বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ যত বাড়ানো হবে, আমাদের শিক্ষা তত বৈশ্বিক মানের দিকে যাবে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমলে স্বাভাবিকভাবেই দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যাও কমে যাবে। দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা কমলে সামান্য প্রযুক্তির জন্যও বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হবে। বিজ্ঞানীর সংখ্যা কমে গেলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে।

যুগান্তর : দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক কোনো ধরনের শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : দুই ধরনের শিক্ষাই একই সঙ্গে চলার কথা। তত্ত্ব না জানলে তার প্রয়োগ করা যাবে না, প্রয়োগ না থাকলে শুধু তত্ত্ব মূল্যহীন হয়ে যায়। তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক-এ দুই শিক্ষার সমন্বয় সাধন করতে হবে।

যুগান্তর : প্রযুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানচর্চায় গুরুত্ব বাড়ানো উচিত। এ বিষয়ে আপনার মত কী?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমাদের দেশে প্রচুর প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও ডাক্তার প্রয়োজন, প্রচুর নার্সের প্রয়োজন। দেশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে বিএসসি ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ বৈষম্য দূর করা গেলে, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি যে নেতিবাচক ধারণা তা দূর করা গেলে প্রতিটি বিষয়েই বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আগ্রহ বাড়বে। তবে প্রযুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানের গবেষণায় অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।

যুগান্তর : আর্টস কেন জরুরি?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : সারা পৃথিবী এখন বুঝতে পেরেছে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির পাশাপাশি আর্টসের চর্চাও জরুরি। বিজ্ঞানীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। কেবল তাহলেই বিজ্ঞানীরা তাদের আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারবেন।

যুগান্তর : শিশুদের জন্য বইবান্ধব পরিবেশ কতটা জরুরি?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : কোনো পরিবারে বই পড়ার অনুকূল পরিবেশ না থাকলে সেই পরিবারের শিশুরা বই পাঠে আগ্রহী হবে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। দুঃখজনক হলো, আমাদের দেশের বেশির ভাগ পরিবার বইবান্ধব নয়। সচ্ছল পরিবারের ড্রইং রুমে বা অন্য কোথাও বইয়ের আলমারি দৃশ্যমান নয়। এখন শিশু-শিক্ষার্থীদের বই পড়ার পরিবর্তে বই থেকে বিভিন্ন বিষয় মুখস্থ করতে বলা হয়। স্কুল শেষে যেসব শিক্ষার্থীকে কোচিং সেন্টারে দৌড়াতে হয়, তাদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার সময় কোথায়? এসব শিশু পাঠ্যবইয়ের প্রতি কতটা মনোযোগী এটাও এক প্রশ্ন। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় যেসব বইমেলা হয়, সেসব বইমেলায় যেসব শিশু আগ্রহ নিয়ে বই কেনে, তারা সেগুলো পড়ার মতো যথেষ্ট সময় পায় কিনা এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।

যুগান্তর : এখনো দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর বাবা-মা-অভিভাবক মনে করেন, পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়া খুব একটা জরুরি নয়। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শহরের বাইরে বিস্তীর্ণ গ্রামীণ জনপদে কয়টি পরিবারে বই আছে? শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় এখনো বই পড়ার বিষয়ে তুলনামূলক ভালো পরিবেশ বিরাজ করছে। এর বাইরে দেশের বেশির ভাগ পরিবার বইবান্ধব নয়। সেসব পরিবারের শিশু বই পড়াটাকে এক ধরনের শাস্তি হিসাবে বিবেচনা করে। দেশে মানসম্পন্ন বইয়েরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। শিশুর বইগুলো এমন হওয়া উচিত, যাতে সেগুলো দেখার পর শিশুরা তা আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করে।

যুগান্তর : গত কয়েক বছরে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলেও বই কেনায় তাদের আগ্রহ বাড়েনি। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এটা দুঃখজনক। এখন সারা দেশের স্কুলগুলোতেও মানসম্পন্ন গ্রন্থাগার নেই। আমাদের প্রত্যাশা ছিল সারা দেশে বই পড়ার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। বাস্তবে এটি ঘটেনি।

যুগান্তর : শিক্ষার্থীরা যাতে বই নিয়ে আনন্দ অনুভব করে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে কী করা দরকার?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিশুর জন্য আনন্দময় পরিবেশে বই পড়ার ব্যবস্থা করার কাজটি কঠিন। কারণ শিশুর মনস্তত্ত্ব বোঝা সহজ নয়। আমরা যাকে আনন্দময় বলি, তারা তা না-ও ভাবতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয়, পরিবারে বই পড়ার চর্চা থাকলে। আর পুরো সমাজ বইবান্ধব হলে তো কথাই নেই। শিশুরা তখন বই পড়াটাকে একটা চর্চা হিসাবেই নেবে, তাতে আনন্দও খুঁজে নেবে। সমাজটা বইবান্ধব না হলে শিশুদের যতই আনন্দময় পরিবেশে বই হাতে বসিয়ে দেওয়া হোক, অনেকেই পড়তে উৎসাহ পাবে না।

যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার

স্বার্থপরতার সব বৃত্ত ভাঙার পদক্ষেপ নিতে হবে: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

 মোহাম্মদ কবীর আহমদ 
১২ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জন্ম ১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি সিলেটে। তিনি সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন; উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন সিলেট এমসি কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর করেন যথাক্রমে ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে। ১৯৮১ সালে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইয়েটসের কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব বিষয়ে পিএইচডি করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ অধ্যাপক কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ মর্যাদাসম্পন্ন আরও বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

শিক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে এই শিক্ষাবিদ খোলামেলা আলোচনা করেছেন যুগান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোহাম্মদ কবীর আহমদ

যুগান্তর: উন্নত দেশগুলো চতুর্থ ও পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ যেভাবে মোকাবিলা করবে, বাস্তব পরিস্থিতির কারণে আমরা সেভাবে মোকাবিলা করতে পারব না। কারণ তাদের চলার গতি আর আমাদের চলার গতি ভিন্ন। আগামীতে একটা পর্যায়ে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সব দেশকে তুমুল প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হবে। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমরাও যাতে এগিয়ে থাকতে পারি সেজন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমাদের দেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জোরালো প্রস্তুতি এখনো বিশেষভাবে দৃশ্যমান নয়; পঞ্চম তো দূরের কথা। ২০৪১ সালে আমাদের উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারের এ ইচ্ছা মূলত জনগণেরই ইচ্ছা। আমরা তো চাই, বাংলাদেশ আরও আগেই উন্নত দেশের লক্ষ্যে পৌঁছাক।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আগামীতে সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব বাড়বে। আমরা দেখেছি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবনের সম্ভাবনা যত উজ্জ্বল হয়, যত দ্রুত নানা রকম প্রাপ্তি ঘটে, নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে তত দ্রুত একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এটি স্পষ্ট যে, আগামীতে সমগ্র বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব আরও বাড়বে। কাজেই এ খাতে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আমরা লক্ষ করেছি, নৈতিকতার অভাবে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলোতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বার্থপরতার দৃষ্টান্ত বাড়ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলা হলেও তারা হয়ে পড়ে বাজারসর্বস্ব। এসব লক্ষণ থেকেও আগামী দিনের বাস্তবতা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। আগামী দিনগুলোতে সামাজিক মূল্যবোধে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। কাজেই আগে থেকে সতর্কতামূলক প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ঐতিহ্য ধরে রাখা কঠিন হতে পারে। নানা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হলে জ্ঞানচর্চার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। একজন বিজ্ঞানীকে বিজ্ঞানের গবেষণায় সফল হওয়ার পাশাপাশি মানবিকতার চর্চায়ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সায়েন্স ও আর্টস যাতে একটি অপরটির পরিপূরক হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। একজন বিজ্ঞানীর গবেষণালব্ধ ফলাফল মানুষের অকল্যাণে যাতে ব্যবহৃত হতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। মানবসম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের কারও কৃপার পাত্র হতে হবে না।

যুগান্তর : লক্ষ করা যায়, প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলোতে প্রান্তিক মানুষের প্রতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা ক্রমেই কমতে থাকে। তেমন সমাজে বৈষম্য প্রকট হয়, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও একটা শূন্যতা বা নৈরাজ্য স্পষ্ট হতে থাকে, যেখানে মানুষের লোভের সঙ্গে যুক্ত হয় প্রযুক্তিগত সমস্যাও। এসব সমস্যার সমাধানে কী করণীয়?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমরা যে সমাজ গড়তে চাই সেখানে নৈতিকতা-মানবিকতাও বিশেষ গুরুত্ব পাওয়া উচিত। আমরা চাই, শিক্ষা ও দেশের সব ধরনের সেবায় প্রান্তিক মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। এটা যেন স্লোগানে সীমিত না থাকে তা নিশ্চিত করা দরকার। নারীর ক্ষমতায়নে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা প্রান্তিক পর্যায়ের পরিবারগুলোয় যাতে পৌঁছায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত সুযোগ না পেলে প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজটি কঠিন। মানুষের প্রতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা যাতে ক্রমে বাড়ে তা নিশ্চিত করা দরকার। সেটাই সবচেয়ে ভদ্রসমাজ, যেখানে নারী-পুরুষের বিভাজন থাকে না। সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের, বিশেষত নারীদের শিক্ষা বিস্তার ও কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আমাদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বিভিন্ন মহলের স্বার্থপরতা। স্বার্থপরতার সব বৃত্ত ভাঙার পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে কঠোর হতে হবে।

যুগান্তর : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবিকভাবে কাজে লাগিয়ে সর্বত্র সুফল পাওয়া নিশ্চিত করতে পঞ্চম শিল্পবিপ্লবে বেশি জোর দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে আমরা যাতে পিছিয়ে না পড়ি, সেজন্য কী করণীয়?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনকে সহজ করে তুলেছে। আবার উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহার কিছু মানুষের জন্য চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয়েছে; কারণ এর ফলে আমাদের মতো দেশে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। আমার তো মনে হয়, কোনো এক সময় যুদ্ধে পদাতিক বাহিনীর কার্যকারিতা খুবই নগণ্য হয়ে পড়বে। মূল যুদ্ধ চালাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ড্রোনের মতো অস্ত্র; যেখানে বিজ্ঞানীদের ভূমিকা সমরপতিদের সমান বা বেশিই হবে। নৈতিকতার স্খলনে সন্ত্রাস বেড়ে যেতে পারে। আমাদের নীতির ঘরে যাতে কোনো রকম শূন্যতা না থাকে, আগামীতে আমাদের যাতে কারও দয়ার ওপর নির্ভর করে চলতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা যাতে অন্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে না পড়ি, তা নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের দেশের মানুষের ব্যতিক্রমী মানবিক মূল্যবোধ সারা বিশ্বে প্রশংসিত। এ মূল্যবোধে হাজার বছরের সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে; যা মানুষকে একই সঙ্গে নিজেকে এবং অপরকে নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের সংস্কৃতির মূল বার্তাটি হলো, অন্যকে বাদ দিয়ে ভালো থাকা যায় না। লালন শাহ কিংবা শাহ আবদুল করিমের মতো একজন ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন তাদের সমৃদ্ধ ভাবনার কারণে। আধুনিক জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি এসব মনীষীর ভাবনার কথাগুলো মনে রেখে আমরা যত সফলভাবে পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব, তা অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় হবে।

যুগান্তর : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিছু মানুষের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই উদ্বেগ কতটা যৌক্তিক?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এ উদ্বেগ যে একেবারে অযৌক্তিক তা নয়। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক উচ্চতর জ্ঞান অদূরভবিষ্যতেও আমরা সেভাবে তৈরি করতে পারব না। ফলে বিদেশ থেকে যখন আমরা এ জ্ঞান সংগ্রহ করব, তখন আমাদের শর্তে তা করতে পারব না। এতে আমাদের বিপদ থেকেই যাবে। তবে দেশে দেশে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে নিরাপত্তার বিষয়টির একটা সুরাহা হয়তো হবে। তাছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না বাড়লে আমাদের সব কর্মকাণ্ডে-শিক্ষা থেকে নিয়ে কৃষি, চিকিৎসা থেকে নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কমে যাবে। অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অনিবার্য ও নির্বিকল্প হয়ে পড়ছে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাজকে স্বাগত জানানোর বিকল্প নেই। কাজেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহারকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা উচিত এবং একই সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সবারই উচিত দক্ষতা বাড়ানোর ওপর মনোনিবেশ করা। নিজেদের দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব হলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোনো সমস্যা তৈরি করবে না।

যুগান্তর : পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের কী কী বিষয় বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের প্রধান অনুষঙ্গ প্রযুক্তি ও মানবিকতার সম্মিলন। কেউ প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনের পরও যখন নৈতিকতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে, তখন নানা বিচ্যুতি দেখা দেয়। আমরা তো সেটা করতে চাই না। আমরা যে সমাজ গড়তে চাই সেখানে নৈতিকতা থাকবে, নীতি থাকবে, মানবিকতা থাকবে। কোনো কোনো দেশে ও সমাজে যন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরতা দেখা যায়। পঞ্চম শিল্পবিপ্লব এ অতিনির্ভরতার প্রতিফলন দেখাতে পারে। তাতে নৈতিকতা ও মানবিকতার ক্ষেত্রে যাতে কোনো রকম শৈথিল্য না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষানীতি, সমাজনীতি, কৃষিনীতি ইত্যাদিতে এসব সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকতে হবে। সব ধরনের সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যাতে কোনো রকম বৈষম্যের সৃষ্টি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা সাম্য ও মানবিকতার সম্মিলন চাই। আমাদের মনে রাখতে হবে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের বিকল্প নেই।

যুগান্তর : প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের তেমন সুখকর নয়। নতুন শিক্ষাক্রমের সাফল্য নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শুধু পাঠ মুখস্থ করা এবং পরীক্ষা দেওয়ার আয়োজন করে যে শিক্ষাব্যবস্থা, তার তুলনায় নতুন শিক্ষাপদ্ধতি একেবারেই আলাদা। এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে শেখায়, তাদের মুখস্থ করার পরিবর্তে বিষয়বস্তুর গভীরে গিয়ে জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করে। এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীর চিন্তাভাবনা প্রকাশের পাশাপাশি আত্মবিকাশের সুযোগও করে দেয়। আধুনিক এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা বাড়ায়, পাঠগ্রহণ আনন্দময় করে এবং সমগ্র শিক্ষাদান পদ্ধতিকে অংশগ্রহণমূলক করে তোলে। নতুন শিক্ষাক্রমের মূল কথা হলো সৃজনশীলতা। শিক্ষায় আমাদের বিনিয়োগ তুলনামূূলক কম। ১৯৭৪ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে বলা হয়েছিল, জিডিপির পাঁচ থেকে সাত শতাংশ শিক্ষায় বিনিয়োগ হওয়া উচিত। সেই লক্ষ্য আজও বাস্তবায়িত হয়নি। লক্ষ করা যাচ্ছে, বাজেট স্বল্পতার কারণে শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের বেতনভাতা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নতুন পাঠক্রম বাস্তবায়নে যত রকম প্রশিক্ষণ দরকার, সেসব প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আয়োজনটা সুসম্পন্ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলে চলবে না। যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া এ পাঠক্রম পড়ানোর মতো দক্ষ শিক্ষক পাওয়া কঠিন। প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা ও সমন্বয়হীনতা-এসব সীমাবদ্ধতা কাটানোর পদক্ষেপও নিতে হবে। পাঠক্রম বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে কোনো রকম ষড়যন্ত্র হয় কিনা সেদিকেও কর্তৃপক্ষকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এ খাতের সবরকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, সতর্ক না থাকলে অতিগুরুত্বপূর্ণ ও অতিসুন্দর আয়োজনও বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গণমাধ্যমের উচিত এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া। অন্য দশটি সেক্টরের সঙ্গে এ সেক্টরকে না মিলিয়ে এ খাতে সবরকম অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

যুগান্তর : বাজেট স্বল্পতা তো একটি বাস্তবতা। কর্তৃপক্ষ চাইলেই কি এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে, দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে হলে, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে চাইলে অবশ্যই তা সম্ভব। বাজেটে কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমানো যেতে পারে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে-প্রতিবছরই জিডিপির এক থেকে দেড় শতাংশ বাড়ানো উচিত। স্বনির্ভর হতে হলে শিক্ষা খাতের বাজেট বাড়ানোর বিকল্প নেই। দেশে অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, আরও হবে। এসব প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় দরকার দক্ষ জনবল। সেই জনবল বিদেশ থেকে না এনে দেশেই তৈরি করতে হবে। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ না বাড়ালে কাঙ্ক্ষিত সময়ে এ দক্ষ জনবল কীভাবে তৈরি হবে? দেশে সুপার ম্যানেজারের পদে যে মানের দক্ষ জনবল দরকার, তার জন্য যাতে বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে না হয়, সেজন্য শিক্ষার মান অনেক বাড়াতে হবে। প্রয়োজনীয় আর্থিক বিনিয়োগ না হলে তা-ও সম্ভব হবে না। আশার কথা, আমাদের দেশে উচ্চ বেতনের জনবলের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। বস্তুত দক্ষ জনবল তৈরি করা সম্ভব হলে দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশেও তাদের কর্মসংস্থান হবে।

যুগান্তর : প্রাথমিকের শিক্ষকতায় মেধাবীদের আগ্রহী করতে আকর্ষণীয় বেতন প্রদানের কথা অতীতে আপনি বারবার উল্লেখ করছেন। এখন তো প্রাথমিকের শিক্ষকরা আগের চেয়ে বলা যায় আকর্ষণীয় বেতন পাচ্ছেন। এটা যথেষ্ট কি?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আগের থেকে ভালো, কিন্তু আকর্ষণীয় নয়। বর্তমান বাজারমূল্যের কথা বিবেচনায় রাখলে প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন যদি ধরুন সত্তর হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলো, স্কুলের পাশে আবাসনের ব্যবস্থা করে শিক্ষকদের স্বল্প বা বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা করা গেল, তাহলে মেধাবীরা এ পেশায় আগ্রহী হবেন, এটা আশা করা যায়। একজন মেধাবী শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থী যে মানের শিক্ষা পাবে, তুলনামূলক কম মেধাবী শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা সেই মানের শিক্ষা পাবে না। প্রতিটি প্রাইমারি স্কুলকে একেকটা সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসাবে তৈরি করা গেলে, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর সমাহার ঘটানো সম্ভব হলে নতুন পাঠক্রম কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাস্তবায়ন সম্ভব। একটি প্রাইমারি স্কুলে ভালো খেলার মাঠ, একটা অডিটোরিয়াম, ডিজিটাল ক্লাসরুম (যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রেজেন্টেশন দেবে, ইংরেজি শিখবে, বাংলা শিখবে, জীবন দক্ষতা শিখবে) ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব হলে, দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া গেলে নতুন পাঠক্রম কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো।

যুগান্তর : দেশে তরুণরা ভালো ভালো কাজ করছে, যা আমাদের আশাবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করে। আবার এটাও লক্ষ করা যায়, তরুণদের অনেকের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। উচ্চ নৈতিকতা ও উন্নত মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত সীমিত হয়ে পড়ার কারণ কী?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষার দুটো বিষয় আছে। শিক্ষার ভেতরে একটা সংস্কৃতি থাকে, নৈতিকতা থাকে, মুখস্থনির্ভর শিক্ষা যা শেখায় না (শিক্ষার সংস্কৃতি হচ্ছে মনকে উদার করা, বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ রাখা; যে কোনো ধরনের অশুভ, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকা, মানবিকতার চর্চা করা)। শিক্ষার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান-প্রযুক্তিসহ সব বিষয়ে বৈশ্বিক মানের কৌশল শিক্ষা দেওয়া, জীবন দক্ষতা শেখানো এবং শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ আকর্ষণীয় করা। মুখস্থনির্ভর শিক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েও অনেকে কর্মক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা দেখাতে পারে না। সে দক্ষ জনবল প্রতিবেশী অন্য দেশের কর্মীদের সঙ্গে দক্ষতার দিক থেকেও পেরে উঠছে না। কারণ, ওই সংস্কৃতির ফোকাসটা সে জানতে পারে না। শিক্ষা মানুষকে নৈতিকতার চর্চা করতে শেখায়; সৌন্দর্যের চর্চা করতে শেখায়। মুখস্থনির্ভর শিক্ষা যে জনবল তৈরি করে, তারা প্রশ্ন করার পরিবর্তে আদেশ পালন করতেই বেশি পছন্দ করে। নীতির প্রশ্নে তারা আপস করে, সেটিই স্বাভাবিক। তাদের এমন জনসম্পদ দেশের কল্যাণে কী ভূমিকা রাখতে পারবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

যুগান্তর : বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থী ভাষা ও গণিতে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এ দুই বিষয়ে একেবারে গোড়া থেকে অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মানোন্নয়নের মূলে থাকা উচিত একীভূত ও একমুখী মানসম্মত শিক্ষা চালু করা। শিক্ষার্থীরা ভাষা ও গণিতে দক্ষতা অর্জনে যেন সক্ষম হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পূর্ণ নাগরিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া নির্ভর করছে শিক্ষার্থী শৈশবে কতটা মানসম্মত শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে তার ওপর।

যুগান্তর : কোনো কোনো শিক্ষকের অর্থের পেছনে ছোটাছুটির বিষয়টি বিভিন্ন আলোচনায় আসে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আত্মত্যাগের মানসিকতা নিয়ে যারা শিক্ষকতায় আসেন, তারা নগদ কী পেলেন সে হিসাব কখনই করেন না। তাদের একমাত্র চিন্তা থাকে কী করে পাঠ্য বিষয় শিক্ষার্থীদের সামনে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা যায়। এমন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের সংখ্যা কী হারে কমছে এ বিতর্কে না গিয়ে সাধারণভাবে বলা যায়, এমন অনেকেই আছেন, যারা এ পেশাকে অন্য আর দশটি পেশায় নিয়োজিত কর্মজীবীদের মতো চাকরি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিও এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী। শিক্ষকদের জন্য বিনিয়োগ বাড়লে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের সংখ্যা যে অনেকগুণ বেড়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

যুগান্তর : মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে শিক্ষক সমাজের কী করণীয়?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পাঠ্যপুস্তককেন্দ্রিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি শিক্ষকদের একটি করণীয় হচ্ছ শিক্ষার্থীদের উন্নত নৈতিকতার চর্চায় উদ্বুদ্ধ করা। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানের বিষয়ে শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত যে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকসমাজের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে উন্নত নৈতিকতার চর্চা যে আরও বাড়বে, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়।

যুগান্তর : যেসব শিশু পরিবার থেকে যথাযথ শিক্ষা পায় না তাদের নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি হবে কীভাবে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : একটি শিশু স্কুলের পাশাপাশি পরিবারে যে শিক্ষা পায় সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে পরিবারের কর্তা অনৈতিক কাজে নিজেকে যুক্ত রাখেন, সন্তানকে পরিপূর্ণ নৈতিকতার শিক্ষা প্রদানে তার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। যে শিশু পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মানসম্মত কিছু শিখতে পারে না, সে যেন সমাজ থেকে শিখতে পারে, সেজন্য পর্যাপ্ত বিকল্প সুযোগ থাকা দরকার। তার জন্য তখন স্কুলই হয়ে যায় একমাত্র জায়গা; যেখানে ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভের পার্থক্য নির্ণয়সহ নৈতিকতার অন্য বিষয়গুলো সে শিখতে পারে। তবে ব্যাপক অর্থে পুরো সমাজটাই একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একটি শিশু যাতে সবসময় স্কুল ও সমাজ থেকে ঠিক শিক্ষা পায় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।

যুগান্তর : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় না। এতে অনেক ক্ষেত্রে মেধার অপচয় হয়। এ সমস্যার সামধানে কী করণীয়?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সারা দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান বাড়ানো সম্ভব হলে, পাবলিক-প্রাইভেট সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নীত করা সম্ভব হলে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নত মানের হলে তখন আর শিক্ষার্থীদের অনেক দূরের জেলা শহর থেকে রাজধানীতে বা দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ভর্তির জন্য ছুটতে হবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বাড়লে, শিক্ষার্থীদের বেতন ইত্যাদি সহনীয় পর্যায়ে নামলে এ খাতটিও মানসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তারে বড় অবদান রাখতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন হার্ভার্ড, বেসরকারি খাতের উজ্জ্বল উদাহরণ।

যুগান্তর : শিক্ষার্থীদের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমাদের লক্ষ্য থাকবে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বিশ্বমানে উন্নীত করা। তবে মনে রাখতে হবে, কোনো শিক্ষার্থী যদি নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ না পায়, সংস্কৃতির অন্তর্গত শিক্ষা ও মূল্যবোধের সঙ্গে সে নিবিড়ভাবে পরিচিত হতে না পারে, তাহলে তার দক্ষতা উন্নত হলেও সে সুনাগরিক হতে পারবে না। একই সঙ্গে এ-ও বলা যায়, সংস্কৃতির অভাব তাকে প্রকৃত বিশ্বমানে পৌঁছাতে দেবে না। কোনো শিক্ষার্থী নিজ সংস্কৃতির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ না পেলে তার দশা হয় শেকড়বিহীন উদ্ভিদের মতো। কেউ কায়মনে বাঙালি না হলে সে বিশ্বমানব হতে পারবে না। জাপানিরা, কোরিয়ানরা এবং আরও বহু দেশের শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্বতা বজায় রেখে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করে। আমাদেরও তা-ই করা উচিত।

যুগান্তর : বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : দেশের অনেক বিদ্যালয়েই বিজ্ঞান শিক্ষার আধুনিক উপকরণের অভাব রয়েছে, যোগ্যতাসম্পন্ন বিজ্ঞানের শিক্ষকের অভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে মেয়েদের তেমন উৎসাহ প্রদান করা হয় না, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে মেয়েদের নিরুৎসাহিত করা হয়। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীকে শৈশব থেকে বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী করতে হবে। স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষার আধুনিক উপকরণ সরবরাহ করা হলে বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়বে। বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ যত বাড়ানো হবে, আমাদের শিক্ষা তত বৈশ্বিক মানের দিকে যাবে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমলে স্বাভাবিকভাবেই দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যাও কমে যাবে। দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা কমলে সামান্য প্রযুক্তির জন্যও বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হবে। বিজ্ঞানীর সংখ্যা কমে গেলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে।

যুগান্তর : দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক কোনো ধরনের শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : দুই ধরনের শিক্ষাই একই সঙ্গে চলার কথা। তত্ত্ব না জানলে তার প্রয়োগ করা যাবে না, প্রয়োগ না থাকলে শুধু তত্ত্ব মূল্যহীন হয়ে যায়। তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক-এ দুই শিক্ষার সমন্বয় সাধন করতে হবে।

যুগান্তর : প্রযুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানচর্চায় গুরুত্ব বাড়ানো উচিত। এ বিষয়ে আপনার মত কী?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমাদের দেশে প্রচুর প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও ডাক্তার প্রয়োজন, প্রচুর নার্সের প্রয়োজন। দেশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে বিএসসি ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ বৈষম্য দূর করা গেলে, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি যে নেতিবাচক ধারণা তা দূর করা গেলে প্রতিটি বিষয়েই বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আগ্রহ বাড়বে। তবে প্রযুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানের গবেষণায় অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।

যুগান্তর : আর্টস কেন জরুরি?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : সারা পৃথিবী এখন বুঝতে পেরেছে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির পাশাপাশি আর্টসের চর্চাও জরুরি। বিজ্ঞানীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। কেবল তাহলেই বিজ্ঞানীরা তাদের আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারবেন।

যুগান্তর : শিশুদের জন্য বইবান্ধব পরিবেশ কতটা জরুরি?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : কোনো পরিবারে বই পড়ার অনুকূল পরিবেশ না থাকলে সেই পরিবারের শিশুরা বই পাঠে আগ্রহী হবে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। দুঃখজনক হলো, আমাদের দেশের বেশির ভাগ পরিবার বইবান্ধব নয়। সচ্ছল পরিবারের ড্রইং রুমে বা অন্য কোথাও বইয়ের আলমারি দৃশ্যমান নয়। এখন শিশু-শিক্ষার্থীদের বই পড়ার পরিবর্তে বই থেকে বিভিন্ন বিষয় মুখস্থ করতে বলা হয়। স্কুল শেষে যেসব শিক্ষার্থীকে কোচিং সেন্টারে দৌড়াতে হয়, তাদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার সময় কোথায়? এসব শিশু পাঠ্যবইয়ের প্রতি কতটা মনোযোগী এটাও এক প্রশ্ন। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় যেসব বইমেলা হয়, সেসব বইমেলায় যেসব শিশু আগ্রহ নিয়ে বই কেনে, তারা সেগুলো পড়ার মতো যথেষ্ট সময় পায় কিনা এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।

যুগান্তর : এখনো দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর বাবা-মা-অভিভাবক মনে করেন, পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়া খুব একটা জরুরি নয়। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শহরের বাইরে বিস্তীর্ণ গ্রামীণ জনপদে কয়টি পরিবারে বই আছে? শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় এখনো বই পড়ার বিষয়ে তুলনামূলক ভালো পরিবেশ বিরাজ করছে। এর বাইরে দেশের বেশির ভাগ পরিবার বইবান্ধব নয়। সেসব পরিবারের শিশু বই পড়াটাকে এক ধরনের শাস্তি হিসাবে বিবেচনা করে। দেশে মানসম্পন্ন বইয়েরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। শিশুর বইগুলো এমন হওয়া উচিত, যাতে সেগুলো দেখার পর শিশুরা তা আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করে।

যুগান্তর : গত কয়েক বছরে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলেও বই কেনায় তাদের আগ্রহ বাড়েনি। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এটা দুঃখজনক। এখন সারা দেশের স্কুলগুলোতেও মানসম্পন্ন গ্রন্থাগার নেই। আমাদের প্রত্যাশা ছিল সারা দেশে বই পড়ার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। বাস্তবে এটি ঘটেনি।

যুগান্তর : শিক্ষার্থীরা যাতে বই নিয়ে আনন্দ অনুভব করে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে কী করা দরকার?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিশুর জন্য আনন্দময় পরিবেশে বই পড়ার ব্যবস্থা করার কাজটি কঠিন। কারণ শিশুর মনস্তত্ত্ব বোঝা সহজ নয়। আমরা যাকে আনন্দময় বলি, তারা তা না-ও ভাবতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয়, পরিবারে বই পড়ার চর্চা থাকলে। আর পুরো সমাজ বইবান্ধব হলে তো কথাই নেই। শিশুরা তখন বই পড়াটাকে একটা চর্চা হিসাবেই নেবে, তাতে আনন্দও খুঁজে নেবে। সমাজটা বইবান্ধব না হলে শিশুদের যতই আনন্দময় পরিবেশে বই হাতে বসিয়ে দেওয়া হোক, অনেকেই পড়তে উৎসাহ পাবে না।

যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ধন্যবাদ।

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন