দেশে গণতন্ত্রচর্চার কয়েকটি দুর্বল দিক
চেতনায় বুদ্বুদ
বদিউর রহমান
১৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেক মহামূল্যবান চিন্তার প্রকাশ আছে। গণতন্ত্র একটা ধারণা, এটা একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা। গণতন্ত্রের কথা এলো মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে। গণতন্ত্র পরিবারেও থাকে, সমাজেও আছে। তবে রাজনীতিতে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় এটা বেশি আলোচিত। আমি বুঝি, গণের তন্ত্রই গণতন্ত্র।
গণ অর্থাৎ জনগণ, এ জনগণ মেজরিটিতে যা ঠিক করে এবং মাইনরিটি তা মেনে নেয়-তাই আমাদের প্রচলিত গণতন্ত্র। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এ মেজরিটি নিয়ে। মেজরিটিটা বিবেচ্য হবে কীভাবে? কোনো নির্দিষ্ট একটা এলাকায় নির্বাচনে ওই এলাকার সব প্রাপ্তবয়সের ভোটের বিচারে মেজরিটি বিবেচ্য হবে, নাকি ওই এলাকায় মোট ভোটারের যে কজন ভোট দিতে গেল তাদের অর্থাৎ প্রদত্ত ভোটের মেজরিটিতে মেজরিটি বিবেচ্য হয়ে? পরিষ্কার করে বললে, এক আসনে ভোটার সংখ্যা এক লাখ, সহি মেজরিটি ভাবতে হলে এই এক লাখের অর্ধেকের বেশি হবে এ ক্ষেত্রে মেজরিটি, অর্থাৎ কমপক্ষে ৫০ হাজার এক। এখন যদি এক লাখ ভোটারের মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজার ভোট দিতে যায় কিংবা আরও কম এক হাজার, তাহলে প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকের থেকে এক বেশি হলেই তা নির্বাচনি-মেজরিটি হয়ে গেল বর্তমান রীতিতে। এটা কি প্রকৃতই মেজরিটি হলো? অবশ্যই নয়। এমনতরো মেজরিটি দিয়ে তথাকথিত নির্বাচন হয়তো জায়েজ করা যায়; কিন্তু ওই আসনের নির্বাচিত প্রার্থীকে মেজরিটি ভোটে নির্বাচিত বলা চলে না।
কিন্তু আমরা বলি, আমরা চালিয়ে নিই। এমন ক্ষেত্রে বরং বলা যেতে পারে যে, এহেন নির্বাচনে মেজরিটি নির্বাচন বর্জন করেছে, নির্বাচনে আগ্রহ দেখায়নি, নির্বাচনে আস্থা রাখেনি। অতএব, একটা অতি ক্ষুদ্রাংশের মেজরিটি দিয়ে মেজরিটি ভোটে নির্বাচিত যেমন বলা যায় না, বলা ঠিকও হবে না, তেমনি এমন মেজরিটির গ্রহণযোগ্যতা স্বীকৃতিতেও আসে না।
আর নির্বাচনে কোনো একক প্রার্থী হলে তো বিনা নির্বাচনেই তিনি নির্বাচিত হয়ে যান। সে ক্ষেত্রে দুরকম ধারণা হতে পারে। এক, ওই একক প্রার্থী সব ভোটারের আস্থাভাজন-এমন ধারণা থেকে অন্য কেউ তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে সাহসী হননি। এমন হাইপোথিসিস থেকে তাকে মেজরিটি ভোটের অধিকারী ভাবা যেতে পারে। কিন্তু কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকলে তার মেজরিটি-পপুলারিটি কখনো পরীক্ষিত বলা চলে না। বরং এ জাতীয় ক্ষেত্রে তাকে নির্বাচনবিহীনভাবে নির্বাচিত বলাই সংগত। কিন্তু উপায় তো নেই। একজনকে তো নির্বাচিত-তা যেভাবেই হোক, করতে হবে।
এমন সমস্যায় সমাধানের জন্য আইনিভাবে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। আমাদের ফেনীতে যে চেয়ারম্যান পদে প্রায় সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান, তার পেছনের কারণ কি কেউ সাহস করে কখনো বলতে পেরেছেন? ওটা তো আর সংসদে মেজরিটিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নয় যে, অন্য কেউ জেনেশুনে হেরে যাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাবেন না। তাহলে নিশ্চয়ই ফেনীতে এমন এক রাজত্ব কায়েম হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের প্রার্র্থীর বিরুদ্ধে আর কেউ চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে সাহসী হননি।
উত্তরটা হলো, সেখানে ভয় বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে। আওয়ামী শাসনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের আইনটাই প্রকৃত অর্থে বেআইনি হয়ে গেছে। সংসদে পাস হলেই সব আইন কিন্তু আইন হয় না। বাকশালও সংসদে পাশ হয়েছিল, কিন্তু ওটা আইন হিসাবে টিকে থাকতে পারেনি।
আশা করা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ এবং অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের আইন আওয়ামী লীগ প্রত্যাহার করে নেবে। দুই নির্বাচনি সিস্টেমে জনগণ অর্থাৎ ভোটাররা আস্থাহীন হয়ে পড়েছেন বিধায় অন্য প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনাগ্রহী হয়েছেন। এই ভেবে যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। অতএব, তার প্রার্থী হয়ে অথবা হেরে যাওয়ার চেয়ে প্রার্থী না হওয়াই অধিক শ্রেয়।
দেশে বর্তমানে এমন ধারণাই প্রবল হয়েছে। এটা হয়েছে এ জন্য যে, নির্বাচন কমিশন যেমন সঠিকভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়নি, তেমনি সরকারও নিজদলীয় প্রার্থীকে নানাভাবে অনেক অবৈধ সুযোগ করে দিয়ে থাকে, যা বিরোধীদলীয় প্রার্থী পায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারদলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয় এ জন্য যে, সরকারদলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী হলেও সরকারদলীয় হিসাবে তিনি বিরোধীদলীয় প্রার্থী থেকে অনেক ভালো অবস্থানে থাকতে পারেন।
এমন ক্ষেত্রে সরকারদলীয় প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতাও তুলনামূলক বিবেচনায় প্রাধান্য পায়, যেখানে দেখা যায় বিদ্রোহী প্রার্থী বেশি গ্রহণযোগ্য। সুষ্ঠু ভোটের প্রতি অনাস্থার ধারণা একটা নেতিবাচক লক্ষণ। এতে মূলত নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের ওপর অনাস্থাই প্রকাশ পায়। বল প্রয়োগে নির্বাচিত হয়ে যাওয়া অবশ্যই গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত হিসাবে বিবেচিত হয়ও না, হতে পারেও না।
দলীয় প্রার্থী ঠিক করার সময় আমরা হালে কী দেখছি? আমরা দেখছি যে, কোথাও হয় এমপি সাহেব নিজেই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী ঠিক করে দিয়েছেন। সেটা তথাকথিত তৃণমূল কমিটির গণতান্ত্রিক বাছাই বাহ্যত বলা হলেও সিদ্ধান্তটি এমপি সাহেবই নিয়েছেন। এমনও শোনা যায়, তিনি যে তালিকা করে দেন, সেটাতেই বাছাই কমিটি সায় দেয়। এটা তাহলে কেমন গণতন্ত্র হলো? এক ব্যক্তিক গণতন্ত্রই গণতন্ত্র হিসাবে রূপ পেল।
জিয়াউর রহমান যখন দল করলেন, তখন দলের মহাসচিব ঠিক করার জন্য তিনি নাকি গণতান্ত্রিক পন্থায় এগোলেন। অন্যান্য সদস্যসহ তা ঠিক করবেন মেজরিটি ভোটে। কিন্তু জিয়া যেমন যোগ্যতা ঠিক করে দিলেন, তা মেলাতে গিয়ে দেখা যায় যে, ওসব যোগ্যতায় তার পছন্দের বদরুদ্দোজা চৌধুরীই শুধু আছেন। শোনা গল্প, কিন্তু গণতান্ত্রিক নির্বাচনটা কেমন হলো? তাহলে আরও দেখলাম যে, একব্যক্তিক গণতন্ত্র দলীয় ক্ষেত্রে গণতন্ত্র বহাল রেখেই একব্যক্তির ইচ্ছাকেই সমর্থন দিয়ে দিল।
আগেভাগে কারও পছন্দের কথা বা পূর্বশর্ত না দিয়ে কোনো প্রার্থী বাছাইয়ের আলোচনা হলে, সব দিকের চুলচেরা বিশ্লেষণ হলে, তবেই তো তাকে গণতান্ত্রিক বাছাই বলা যায়। সে ক্ষেত্রে দলীয়প্রধান তার নিজস্ব পছন্দ থাকলে তার পক্ষেও তার মতামত রাখতে পারেন। অন্যের মেজরিটিতে তা নির্ভয়ে বিবেচনা করতে পারলেই তো তা গণতান্ত্রিক হতো। নচেৎ চাপিয়ে দেওয়া, শর্ত দিয়ে দেওয়া মূলত একব্যক্তিক ইচ্ছার প্রতিফলনের নামান্তর মাত্র। সবার সম্মতি নেওয়া সে ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে পড়ে। অন্যেরা তখন ভয়ে কিংবা নিজ অবস্থান ঠিক রাখতে ‘কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন মেনে নেয়, এটাকে কোনোভাবেই গণতন্ত্র বলা যায় না, এটা নিছক একব্যক্তিক গণতন্ত্র, যা গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরতন্ত্রের ভিন্নরূপ মাত্র।
গণতন্ত্রে এ একব্যক্তিক গণতন্ত্রের আরেক রূপ দেখা যায় ভিন্নভাবে। এ পন্থায় গণতান্ত্রিক চর্চা হয়। এখানে একটা তেলেসমাতি ঘটে। ধরুন সংসদীয় বোর্ড কোনো এক পদে একজন প্রার্থী ঠিক করতে বৈঠকে বসল। বৈঠকের মূল বিষয় হচ্ছে নির্দিষ্ট পদে প্রার্থী বাছাই করে তাকে নিজদলীয় প্রার্থীরূপে ঘোষণা করা হবে। ভালো, বড় উত্তম, আমরা গণতান্ত্রিক পন্থায় আস্থাশীল এবং এ গণতন্ত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। চা পান হলো, ওই সঙ্গে একজন উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়নের কথাও হলো।
কিন্তু কেউ কোনো নাম বা তার দোষ-গুণ নিয়ে আলোচনা করলেন না। সবাই একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনিও কিছু বললেন না, তিনিও কারও নাম নিলেন না। নির্বাচনি বোর্ডের সদস্যরা কী বুঝে ওই প্রার্থী নির্বাচনের ভার দলীয় প্রধানের ওপর ন্যস্ত করে দিলেন! এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটা কি গণতান্ত্রিক হলো? আপনি বলতে পারেন অবশ্যই গণতান্ত্রিক হয়েছে। সব সদস্য একজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন-তাহলে গণতান্ত্রিক নয় কেন? হ্যাঁ, সিদ্ধান্তটা হয়তো বা গণতান্ত্রিক হয়েছে, কিন্তু নির্দিষ্ট পদে প্রার্থী বাছাইটা তো গণতান্ত্রিক হয়নি।
কেননা, বোর্ডের সব সদস্য আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কয়েকজন সম্ভাব্য যোগ্য প্রার্থী থেকে একজনকে মেজরিটিতে বাছাই করেননি। তারা এক ব্যক্তিকে বাছাইয়ের দায়িত্ব দিয়ে, তাদের ধারণামতে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিলেও, প্রার্থী বাছাইয়ে তারা স্বৈরতান্ত্রিক পথেই এগিয়েছেন। এক ব্যক্তিকে পছন্দের ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হলে তা তাদের দেওয়া গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের স্বৈরতান্ত্রিক রূপই হবে, অন্য কিছু নয়।
এমন লজিক্যাল এনালজি এক্ষেত্রে ড্র করা যাবে না যে, ওই এক ব্যক্তিকে যেহেতু ১০-১৫ ব্যক্তি ক্ষমতা দিয়েছেন, সুতরাং ওই এক ব্যক্তির পছন্দ মানে ওই ১০-১৫ ব্যক্তির পছন্দ। ওই এক ব্যক্তির পছন্দ ওই এক ব্যক্তিরই পছন্দ। ওটা কোনোক্রমেই ক্ষমতাদানকারী ১০-১৫ ব্যক্তির পছন্দ নয়। হয়তো দেখা যাবে, তারা অর্থাৎ ওই ১০-১৫ জন ওই একব্যক্তির পছন্দের জনকে চেনেনও না, জানেনও না, পছন্দও করেন না। কিন্তু উপায় নেই, তারা তো ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছেন।
এমন একব্যক্তিক গণতন্ত্রের পেছনে দুটি বিষয় কাজ করে থাকে। এক. হয়তো ওই ব্যক্তি আগেই ১০-১৫ জনের কাছে তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে রাখেন যে, নির্দিষ্ট প্রার্থী পছন্দের ভার আমার ওপর ন্যস্ত করে দেবেন। যেহেতু ক্ষমতাটা আপনাদের ১০-১৫ জনের, সেহেতু আপনারা আমাকে ক্ষমতাটা দিয়ে দিলে সেটি গণতান্ত্রিক হয়ে গেল। আমরা কোনো সমালোচনায় পড়ব না।
কাক চোখ বুজে যখন কিছু লুকায়, তখন ভাবে যে অন্যেরা কেউ দেখছে না, কিন্তু অন্যদের চোখ যে খোলা তা চোখ বন্ধ করে বুঝতে পারে না। দুই. নয়তো ওই ১০-১৫ জন ওই একজনের ভয়ে বা প্রভাবে এত বেশি ভীত বা প্রভাবিত থাকেন যে, তারা কোনো নাম প্রস্তাব করে তার বিরাগভাজন হতেই চায় না। এমন আস্থা থেকে তারা এক ব্যক্তিকে সে ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া নিরাপদ ভাবেন। কিন্তু গণতন্ত্রে তা ভাবার কোনো সুযোগ নেই, ভয়তন্ত্রে তা থেকে থাকতে পারে।
অতএব, প্রথমেই এক ব্যক্তির অভিপ্রায়েই হোক, কিংবা অন্য সবার ভয়ের কারণেই হোক, একজনকে এমন ক্ষমতা অর্পণ কোনোক্রমেই গণতান্ত্রিক রেওয়াজ হতে পারে না। ওই এক ব্যক্তির অভিপ্রায়ও যদি ১০-১৫ জনের আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে গৃহীত হতো, তা হলেও তাকে আমরা কিছুটা হলেও গণতান্ত্রিক বলতে পারতাম, কেননা তার প্রস্তাব গণতান্ত্রিকভাবে গৃহীত হয়েছে বলা যেত। কিন্তু তাকে ক্ষমতা দিয়ে দিলে তিনি একাই প্রার্থী নির্বাচন করেন, আর আমরা ওই নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক বলব, তা হতে পারে না। আমরা কখনো একব্যক্তিক গণতন্ত্রকে গণতন্ত্র বলি না, বলবও না। এমন গণতন্ত্র বরং গণতন্ত্রকেই বেকায়দায় ফেলে দেয়, যার পরিণাম ভালো হয় না।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
চেতনায় বুদ্বুদ
দেশে গণতন্ত্রচর্চার কয়েকটি দুর্বল দিক
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেক মহামূল্যবান চিন্তার প্রকাশ আছে। গণতন্ত্র একটা ধারণা, এটা একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা। গণতন্ত্রের কথা এলো মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে। গণতন্ত্র পরিবারেও থাকে, সমাজেও আছে। তবে রাজনীতিতে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় এটা বেশি আলোচিত। আমি বুঝি, গণের তন্ত্রই গণতন্ত্র।
গণ অর্থাৎ জনগণ, এ জনগণ মেজরিটিতে যা ঠিক করে এবং মাইনরিটি তা মেনে নেয়-তাই আমাদের প্রচলিত গণতন্ত্র। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এ মেজরিটি নিয়ে। মেজরিটিটা বিবেচ্য হবে কীভাবে? কোনো নির্দিষ্ট একটা এলাকায় নির্বাচনে ওই এলাকার সব প্রাপ্তবয়সের ভোটের বিচারে মেজরিটি বিবেচ্য হবে, নাকি ওই এলাকায় মোট ভোটারের যে কজন ভোট দিতে গেল তাদের অর্থাৎ প্রদত্ত ভোটের মেজরিটিতে মেজরিটি বিবেচ্য হয়ে? পরিষ্কার করে বললে, এক আসনে ভোটার সংখ্যা এক লাখ, সহি মেজরিটি ভাবতে হলে এই এক লাখের অর্ধেকের বেশি হবে এ ক্ষেত্রে মেজরিটি, অর্থাৎ কমপক্ষে ৫০ হাজার এক। এখন যদি এক লাখ ভোটারের মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজার ভোট দিতে যায় কিংবা আরও কম এক হাজার, তাহলে প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকের থেকে এক বেশি হলেই তা নির্বাচনি-মেজরিটি হয়ে গেল বর্তমান রীতিতে। এটা কি প্রকৃতই মেজরিটি হলো? অবশ্যই নয়। এমনতরো মেজরিটি দিয়ে তথাকথিত নির্বাচন হয়তো জায়েজ করা যায়; কিন্তু ওই আসনের নির্বাচিত প্রার্থীকে মেজরিটি ভোটে নির্বাচিত বলা চলে না।
কিন্তু আমরা বলি, আমরা চালিয়ে নিই। এমন ক্ষেত্রে বরং বলা যেতে পারে যে, এহেন নির্বাচনে মেজরিটি নির্বাচন বর্জন করেছে, নির্বাচনে আগ্রহ দেখায়নি, নির্বাচনে আস্থা রাখেনি। অতএব, একটা অতি ক্ষুদ্রাংশের মেজরিটি দিয়ে মেজরিটি ভোটে নির্বাচিত যেমন বলা যায় না, বলা ঠিকও হবে না, তেমনি এমন মেজরিটির গ্রহণযোগ্যতা স্বীকৃতিতেও আসে না।
আর নির্বাচনে কোনো একক প্রার্থী হলে তো বিনা নির্বাচনেই তিনি নির্বাচিত হয়ে যান। সে ক্ষেত্রে দুরকম ধারণা হতে পারে। এক, ওই একক প্রার্থী সব ভোটারের আস্থাভাজন-এমন ধারণা থেকে অন্য কেউ তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে সাহসী হননি। এমন হাইপোথিসিস থেকে তাকে মেজরিটি ভোটের অধিকারী ভাবা যেতে পারে। কিন্তু কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকলে তার মেজরিটি-পপুলারিটি কখনো পরীক্ষিত বলা চলে না। বরং এ জাতীয় ক্ষেত্রে তাকে নির্বাচনবিহীনভাবে নির্বাচিত বলাই সংগত। কিন্তু উপায় তো নেই। একজনকে তো নির্বাচিত-তা যেভাবেই হোক, করতে হবে।
এমন সমস্যায় সমাধানের জন্য আইনিভাবে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। আমাদের ফেনীতে যে চেয়ারম্যান পদে প্রায় সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান, তার পেছনের কারণ কি কেউ সাহস করে কখনো বলতে পেরেছেন? ওটা তো আর সংসদে মেজরিটিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নয় যে, অন্য কেউ জেনেশুনে হেরে যাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাবেন না। তাহলে নিশ্চয়ই ফেনীতে এমন এক রাজত্ব কায়েম হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের প্রার্র্থীর বিরুদ্ধে আর কেউ চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে সাহসী হননি।
উত্তরটা হলো, সেখানে ভয় বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে। আওয়ামী শাসনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের আইনটাই প্রকৃত অর্থে বেআইনি হয়ে গেছে। সংসদে পাস হলেই সব আইন কিন্তু আইন হয় না। বাকশালও সংসদে পাশ হয়েছিল, কিন্তু ওটা আইন হিসাবে টিকে থাকতে পারেনি।
আশা করা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ এবং অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের আইন আওয়ামী লীগ প্রত্যাহার করে নেবে। দুই নির্বাচনি সিস্টেমে জনগণ অর্থাৎ ভোটাররা আস্থাহীন হয়ে পড়েছেন বিধায় অন্য প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনাগ্রহী হয়েছেন। এই ভেবে যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। অতএব, তার প্রার্থী হয়ে অথবা হেরে যাওয়ার চেয়ে প্রার্থী না হওয়াই অধিক শ্রেয়।
দেশে বর্তমানে এমন ধারণাই প্রবল হয়েছে। এটা হয়েছে এ জন্য যে, নির্বাচন কমিশন যেমন সঠিকভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়নি, তেমনি সরকারও নিজদলীয় প্রার্থীকে নানাভাবে অনেক অবৈধ সুযোগ করে দিয়ে থাকে, যা বিরোধীদলীয় প্রার্থী পায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারদলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয় এ জন্য যে, সরকারদলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী হলেও সরকারদলীয় হিসাবে তিনি বিরোধীদলীয় প্রার্থী থেকে অনেক ভালো অবস্থানে থাকতে পারেন।
এমন ক্ষেত্রে সরকারদলীয় প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতাও তুলনামূলক বিবেচনায় প্রাধান্য পায়, যেখানে দেখা যায় বিদ্রোহী প্রার্থী বেশি গ্রহণযোগ্য। সুষ্ঠু ভোটের প্রতি অনাস্থার ধারণা একটা নেতিবাচক লক্ষণ। এতে মূলত নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের ওপর অনাস্থাই প্রকাশ পায়। বল প্রয়োগে নির্বাচিত হয়ে যাওয়া অবশ্যই গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত হিসাবে বিবেচিত হয়ও না, হতে পারেও না।
দলীয় প্রার্থী ঠিক করার সময় আমরা হালে কী দেখছি? আমরা দেখছি যে, কোথাও হয় এমপি সাহেব নিজেই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী ঠিক করে দিয়েছেন। সেটা তথাকথিত তৃণমূল কমিটির গণতান্ত্রিক বাছাই বাহ্যত বলা হলেও সিদ্ধান্তটি এমপি সাহেবই নিয়েছেন। এমনও শোনা যায়, তিনি যে তালিকা করে দেন, সেটাতেই বাছাই কমিটি সায় দেয়। এটা তাহলে কেমন গণতন্ত্র হলো? এক ব্যক্তিক গণতন্ত্রই গণতন্ত্র হিসাবে রূপ পেল।
জিয়াউর রহমান যখন দল করলেন, তখন দলের মহাসচিব ঠিক করার জন্য তিনি নাকি গণতান্ত্রিক পন্থায় এগোলেন। অন্যান্য সদস্যসহ তা ঠিক করবেন মেজরিটি ভোটে। কিন্তু জিয়া যেমন যোগ্যতা ঠিক করে দিলেন, তা মেলাতে গিয়ে দেখা যায় যে, ওসব যোগ্যতায় তার পছন্দের বদরুদ্দোজা চৌধুরীই শুধু আছেন। শোনা গল্প, কিন্তু গণতান্ত্রিক নির্বাচনটা কেমন হলো? তাহলে আরও দেখলাম যে, একব্যক্তিক গণতন্ত্র দলীয় ক্ষেত্রে গণতন্ত্র বহাল রেখেই একব্যক্তির ইচ্ছাকেই সমর্থন দিয়ে দিল।
আগেভাগে কারও পছন্দের কথা বা পূর্বশর্ত না দিয়ে কোনো প্রার্থী বাছাইয়ের আলোচনা হলে, সব দিকের চুলচেরা বিশ্লেষণ হলে, তবেই তো তাকে গণতান্ত্রিক বাছাই বলা যায়। সে ক্ষেত্রে দলীয়প্রধান তার নিজস্ব পছন্দ থাকলে তার পক্ষেও তার মতামত রাখতে পারেন। অন্যের মেজরিটিতে তা নির্ভয়ে বিবেচনা করতে পারলেই তো তা গণতান্ত্রিক হতো। নচেৎ চাপিয়ে দেওয়া, শর্ত দিয়ে দেওয়া মূলত একব্যক্তিক ইচ্ছার প্রতিফলনের নামান্তর মাত্র। সবার সম্মতি নেওয়া সে ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে পড়ে। অন্যেরা তখন ভয়ে কিংবা নিজ অবস্থান ঠিক রাখতে ‘কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন মেনে নেয়, এটাকে কোনোভাবেই গণতন্ত্র বলা যায় না, এটা নিছক একব্যক্তিক গণতন্ত্র, যা গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরতন্ত্রের ভিন্নরূপ মাত্র।
গণতন্ত্রে এ একব্যক্তিক গণতন্ত্রের আরেক রূপ দেখা যায় ভিন্নভাবে। এ পন্থায় গণতান্ত্রিক চর্চা হয়। এখানে একটা তেলেসমাতি ঘটে। ধরুন সংসদীয় বোর্ড কোনো এক পদে একজন প্রার্থী ঠিক করতে বৈঠকে বসল। বৈঠকের মূল বিষয় হচ্ছে নির্দিষ্ট পদে প্রার্থী বাছাই করে তাকে নিজদলীয় প্রার্থীরূপে ঘোষণা করা হবে। ভালো, বড় উত্তম, আমরা গণতান্ত্রিক পন্থায় আস্থাশীল এবং এ গণতন্ত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। চা পান হলো, ওই সঙ্গে একজন উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়নের কথাও হলো।
কিন্তু কেউ কোনো নাম বা তার দোষ-গুণ নিয়ে আলোচনা করলেন না। সবাই একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনিও কিছু বললেন না, তিনিও কারও নাম নিলেন না। নির্বাচনি বোর্ডের সদস্যরা কী বুঝে ওই প্রার্থী নির্বাচনের ভার দলীয় প্রধানের ওপর ন্যস্ত করে দিলেন! এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটা কি গণতান্ত্রিক হলো? আপনি বলতে পারেন অবশ্যই গণতান্ত্রিক হয়েছে। সব সদস্য একজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন-তাহলে গণতান্ত্রিক নয় কেন? হ্যাঁ, সিদ্ধান্তটা হয়তো বা গণতান্ত্রিক হয়েছে, কিন্তু নির্দিষ্ট পদে প্রার্থী বাছাইটা তো গণতান্ত্রিক হয়নি।
কেননা, বোর্ডের সব সদস্য আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কয়েকজন সম্ভাব্য যোগ্য প্রার্থী থেকে একজনকে মেজরিটিতে বাছাই করেননি। তারা এক ব্যক্তিকে বাছাইয়ের দায়িত্ব দিয়ে, তাদের ধারণামতে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিলেও, প্রার্থী বাছাইয়ে তারা স্বৈরতান্ত্রিক পথেই এগিয়েছেন। এক ব্যক্তিকে পছন্দের ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হলে তা তাদের দেওয়া গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের স্বৈরতান্ত্রিক রূপই হবে, অন্য কিছু নয়।
এমন লজিক্যাল এনালজি এক্ষেত্রে ড্র করা যাবে না যে, ওই এক ব্যক্তিকে যেহেতু ১০-১৫ ব্যক্তি ক্ষমতা দিয়েছেন, সুতরাং ওই এক ব্যক্তির পছন্দ মানে ওই ১০-১৫ ব্যক্তির পছন্দ। ওই এক ব্যক্তির পছন্দ ওই এক ব্যক্তিরই পছন্দ। ওটা কোনোক্রমেই ক্ষমতাদানকারী ১০-১৫ ব্যক্তির পছন্দ নয়। হয়তো দেখা যাবে, তারা অর্থাৎ ওই ১০-১৫ জন ওই একব্যক্তির পছন্দের জনকে চেনেনও না, জানেনও না, পছন্দও করেন না। কিন্তু উপায় নেই, তারা তো ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছেন।
এমন একব্যক্তিক গণতন্ত্রের পেছনে দুটি বিষয় কাজ করে থাকে। এক. হয়তো ওই ব্যক্তি আগেই ১০-১৫ জনের কাছে তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে রাখেন যে, নির্দিষ্ট প্রার্থী পছন্দের ভার আমার ওপর ন্যস্ত করে দেবেন। যেহেতু ক্ষমতাটা আপনাদের ১০-১৫ জনের, সেহেতু আপনারা আমাকে ক্ষমতাটা দিয়ে দিলে সেটি গণতান্ত্রিক হয়ে গেল। আমরা কোনো সমালোচনায় পড়ব না।
কাক চোখ বুজে যখন কিছু লুকায়, তখন ভাবে যে অন্যেরা কেউ দেখছে না, কিন্তু অন্যদের চোখ যে খোলা তা চোখ বন্ধ করে বুঝতে পারে না। দুই. নয়তো ওই ১০-১৫ জন ওই একজনের ভয়ে বা প্রভাবে এত বেশি ভীত বা প্রভাবিত থাকেন যে, তারা কোনো নাম প্রস্তাব করে তার বিরাগভাজন হতেই চায় না। এমন আস্থা থেকে তারা এক ব্যক্তিকে সে ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া নিরাপদ ভাবেন। কিন্তু গণতন্ত্রে তা ভাবার কোনো সুযোগ নেই, ভয়তন্ত্রে তা থেকে থাকতে পারে।
অতএব, প্রথমেই এক ব্যক্তির অভিপ্রায়েই হোক, কিংবা অন্য সবার ভয়ের কারণেই হোক, একজনকে এমন ক্ষমতা অর্পণ কোনোক্রমেই গণতান্ত্রিক রেওয়াজ হতে পারে না। ওই এক ব্যক্তির অভিপ্রায়ও যদি ১০-১৫ জনের আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে গৃহীত হতো, তা হলেও তাকে আমরা কিছুটা হলেও গণতান্ত্রিক বলতে পারতাম, কেননা তার প্রস্তাব গণতান্ত্রিকভাবে গৃহীত হয়েছে বলা যেত। কিন্তু তাকে ক্ষমতা দিয়ে দিলে তিনি একাই প্রার্থী নির্বাচন করেন, আর আমরা ওই নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক বলব, তা হতে পারে না। আমরা কখনো একব্যক্তিক গণতন্ত্রকে গণতন্ত্র বলি না, বলবও না। এমন গণতন্ত্র বরং গণতন্ত্রকেই বেকায়দায় ফেলে দেয়, যার পরিণাম ভালো হয় না।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান