প্রাথমিক বৃত্তি নিয়ে কথা
jugantor
প্রাথমিক বৃত্তি নিয়ে কথা

  বিমল সরকার  

১৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বৃত্তি

টানা তেরো বছর বন্ধ থাকার পর সরকারের হুটহাট সিদ্ধান্তে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে অনুষ্ঠিত ২০২২ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা, পরীক্ষার ফল প্রকাশ এবং প্রকাশিত ফল স্থগিত করে পুনঃপ্রকাশ-সম্প্রতি এ সবকিছু নিয়ে যা ঘটেছে, তা খুবই অবাঞ্ছিত ও অনভিপ্রেত। ‘বড়দের কর্মফলপ্রসূত’ এ বিড়ম্বনা আর কেউ যেমনই হোক, ভুক্তভোগী কচিকাঁচা শিশুদের মনে চিরদিন বেদনা হয়ে থাকবে।

আমাদের দেশে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার প্রচলন হয় ১৯৬১ সালে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পাশাপাশি অষ্টম শ্রেণিতে বাছাই করা কিছু শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করত। প্রথমে মাসিক ৩০ টাকা হারে আবাসিক (রেসিডেনসিয়াল) ও ১২ টাকা হারে অনাবাসিক (নন-রেসিডেনসিয়াল) বৃত্তি চালু করা হয়। তবে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা জুনিয়র হাইস্কুলের মতোই একই সময়ে (১৯৬১) নাকি আরও আগে চালু হয়েছিল, তা সঠিকভাবে আমার জানা নেই।

প্রচলিত বৃত্তি পরীক্ষা উঠিয়ে দিয়ে সব শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক স্তরে ‘পিইসি’ (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা) এবং মাধ্যমিক স্তরে অষ্টম শ্রেণিতে জেডিসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) ও ‘জেডিসি’ (জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট) পরীক্ষা চালু করা হয় যথাক্রমে ২০০৯ ও ২০১০ সালে। এ দুটি বৃত্তি পরীক্ষা সবশেষ ২০০৮ ও ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

আমার অগ্রজ (শ্যামল সরকার) ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় সফল হয়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করার সংবাদে গোটা এলাকায় বেশ সাড়া পড়ে যায়। দাদা আমাদের মামার প্রযত্নে থেকে লেখাপড়া করেছে, এটি জানাজানির পর এলাকাবাসীর কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। দাদার সঙ্গে বৃত্তিধারী আরও কোনো শিক্ষার্থী আমাদের কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানা সদরের একমাত্র হাইস্কুলটিতে ১৯৬৭ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই।

দাদার আগে বা পরের দু-বছর আমাদের আশুতিয়াপাড়া গ্রাম (বর্তমানে পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড) বা আশপাশের আর কেউ বৃত্তি পেয়েছিল কিংবা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল কিনা, তা-ও আমার স্মৃতিতে নেই। সে সময় বৃত্তি পাওয়ার চেয়ে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়াটাও কম আলোচনার বিষয় ছিল না। ঢালাওভাবে অংশ নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

আমার ছোট মামা হীরেন্দ্র সরকার ছিলেন ময়মনসিংহের নান্দাইল থানার পাঁচানী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। ওই স্কুলেরই লাগোয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খ্যাতিমান আরেক শিক্ষক মামার বন্ধু সতীশ দেবনাথ। দুই বন্ধুর কঠোর পরিশ্রম আর কড়া শাসনে ছাত্ররা ক্রমাগত খুব ভালো করে।

সে বছর (১৯৬৬) দাদা এবং সত্যেন্দ্র দেবনাথ (সতীশ দেবনাথের ছেলে), নূরুল ইসলাম ও ফিরোজুর রহমান এ চারজন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সবাই বৃত্তি লাভ করে। থানা সদরের বাইরে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় এমন ফলাফলে কেবল স্কুল নয়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদেরও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল।

তখন ট্যালেন্টপুল বৃত্তিধারীদের সরকারি কোষাগার থেকে মাসিক ২০ টাকা করে দেওয়া হতো। কৃতী শিক্ষার্থীরা ছয় মাস অন্তর অন্তর (১২০ টাকা করে) তিন বছর পর্যন্ত টাকাটা স্কুল থেকে তুলতে পারত। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তিন বছরে (৩৬ মাস) মোট ৭২০ টাকার সঙ্গে বই, খাতা, কলম ইত্যাদি শিক্ষা-উপকরণ কেনার জন্য প্রতিবছর এককালীন দেওয়া হতো ৫০ টাকা করে তিন বছরে মোট আরও ১৫০ টাকা (আমার যতদূর মনে পড়ে)। যে স্কুলেই পড়ুক, তিন বছর (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি) বৃত্তিধারী শিক্ষার্থীর কোনো টিউশন ফি লাগবে না।

তার মানে প্রাথমিক স্তরে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া একজন শিশু-শিক্ষার্থীর আর্থিক অর্জন মোট ৮৭০ (টিউশন ফি’র টাকা যোগ করলে হাজার টাকার বেশি) টাকা। অঙ্কটা নিতান্ত সামান্য তো নয়ই, বরঞ্চ সময়ের নিরিখে অনেক বেশি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি বা ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক স্তরে বেসরকারি একজন স্কুলশিক্ষকের সরকারি আর্থিক অনুদানের পরিমাণ ছিল মাসিক ২০ টাকা। দুধের সের ২৫ পয়সা, হাঁসের ডিমের হালি ২৫ পয়সা। চালের সের (এক সের = ৯৩৩ গ্রাম) ৭৫ পয়সা আর ধানের মন ১৭-১৮ টাকা। খাসির মাংসের সের দুই টাকা আর দেড়-দুইশ টাকায় হালের একটি গরু।

এক মন পাটের দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা আর ১৬০ টাকা সোনার ভরি। সরিষার তেল চার টাকা আর এক সের ঘিয়ের দাম সাত টাকা। কৃষি জমিতে সারাদিন খাটিয়ে একজনকে পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া হতো বারো আনা বা পঁচাত্তর পয়সা। উল্লিখিত জিনিসপত্রের দরদামের বর্ণনাটি আমার নিজের দেখা ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে দেওয়া।

ঠিক সে সময়টিতে (১৯৬৬) একজন বৃত্তিধারী শিশু-শিক্ষার্থীর পাওয়া ৮৭০ কিংবা ১০০০ টাকা দিয়ে বাজার থেকে অনায়াসে মিলত-প্রথমত, ৬ ভরি সোনা অথবা ৫৫ মন ধান অথবা ৩৩ মন চাল (৬-৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাধারণ বাঙালি পরিবারের সারা বছরের খোরাক) অথবা ৫০০ সের খাসির মাংস কিংবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের ৫০ মাসের সরকারি অনুদান।

উল্লিখিত দ্রব্য ও বিষয়ের সঙ্গে এখনকার বাজারদরের তুলনার কথা কল্পনাও করা যায় না। বর্তমানে ৬ ভরি সোনার দাম চার লাখ ৮০ হাজার টাকা। ৩৩ মন চালের দাম ৯২ হাজার ৪০০ টাকা। আর ৫০০ সের খাসির মাংসের দাম সই সই পাঁচ লাখ টাকা।

এবার চার দশক পরের কথা খানিকটা ব্যক্ত করি। ২০০৬ সালে আমার মেয়ে ঐশী যখন প্রাথমিকে মেধাবৃত্তি পায়, তখন টাকার পরিমাণ মাসে ২০০ আর এককালীন হিসাবে ১৫০ টাকা। সে অনুযায়ী তিন বছরে একজন মেধাবী শিশু-শিক্ষার্থীর সর্বমোট টাকার পরিমাণ সাত হাজার ৩৫০ টাকা।

২০০৮ সালের পর প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয়। বৃত্তির পরিবর্তে পরের বছর থেকে চালু করা হয় পিইসি বা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। বৃত্তি পরীক্ষা তুলে দেওয়া হলেও সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান অব্যাহত থাকে।

ভয়াবহ করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে পরপর দু’বছর ২০২০ ও ২০২১ সালের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ইত্যবসরে সরকার পরীক্ষাটি উঠিয়ে দিয়ে ২০২২ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে ঠিক আগের মতোই শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ করে।

আর টানা চৌদ্দ বছর বন্ধ থাকার পর বাছাই করা শিক্ষার্থীদের আবারও বৃত্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার বন্দোবস্ত করে। ৩০ ডিসেম্বর ২০২২ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আকস্মিক ঘোষণায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও কম সময়ে অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষার পক্ষে-বিপক্ষে সচেতন মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।

জানা যায়, প্রাথমিকে মেধাবৃত্তির উল্লিখিত হার ২০১৬ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল। বর্তমানে মেধাবৃত্তির হার ৩০০ টাকা আর সাধারণে ২২৫ টাকা করে। সে অনুযায়ী, বৃত্তিধারী একজন মেধাবী শিশু-শিক্ষার্থী ৩৬ মাসে সরকারি কোষাগার থেকে পায় মোট ১০,৮০০ টাকা।

এ পরিমাণ টাকা দিয়ে কেনা যাবে দুই আনা ওজনের সোনা (ষোল আনায় এক ভরি) অথবা ১১ কেজি খাসির মাংস। সাধারণ গ্রেডধারীদের পাওয়া টাকার পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই আরও কম (আট হাজার একশ)।

মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তির টাকা দিয়ে সেকাল বা একালে কী পাওয়া যায় কিংবা কী পাওয়া যায় না, সেটি বড় কথা নয়। সবচেয়ে বড় হলো, ওদের উৎসাহ দেওয়ার বিষয়টি। ওদের চোখ দিয়েই আমরা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। শিশু-কিশোরসহ সবার এগিয়ে চলার পথ সুগম হোক। বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে কোনো ধরনের অনিয়ম-অব্যবস্থা বা বাণিজ্য কাম্য নয়।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

প্রাথমিক বৃত্তি নিয়ে কথা

 বিমল সরকার 
১৪ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ
বৃত্তি
ফাইল ছবি

টানা তেরো বছর বন্ধ থাকার পর সরকারের হুটহাট সিদ্ধান্তে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে অনুষ্ঠিত ২০২২ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা, পরীক্ষার ফল প্রকাশ এবং প্রকাশিত ফল স্থগিত করে পুনঃপ্রকাশ-সম্প্রতি এ সবকিছু নিয়ে যা ঘটেছে, তা খুবই অবাঞ্ছিত ও অনভিপ্রেত। ‘বড়দের কর্মফলপ্রসূত’ এ বিড়ম্বনা আর কেউ যেমনই হোক, ভুক্তভোগী কচিকাঁচা শিশুদের মনে চিরদিন বেদনা হয়ে থাকবে।

আমাদের দেশে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার প্রচলন হয় ১৯৬১ সালে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পাশাপাশি অষ্টম শ্রেণিতে বাছাই করা কিছু শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করত। প্রথমে মাসিক ৩০ টাকা হারে আবাসিক (রেসিডেনসিয়াল) ও ১২ টাকা হারে অনাবাসিক (নন-রেসিডেনসিয়াল) বৃত্তি চালু করা হয়। তবে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা জুনিয়র হাইস্কুলের মতোই একই সময়ে (১৯৬১) নাকি আরও আগে চালু হয়েছিল, তা সঠিকভাবে আমার জানা নেই।

প্রচলিত বৃত্তি পরীক্ষা উঠিয়ে দিয়ে সব শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক স্তরে ‘পিইসি’ (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা) এবং মাধ্যমিক স্তরে অষ্টম শ্রেণিতে জেডিসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) ও ‘জেডিসি’ (জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট) পরীক্ষা চালু করা হয় যথাক্রমে ২০০৯ ও ২০১০ সালে। এ দুটি বৃত্তি পরীক্ষা সবশেষ ২০০৮ ও ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

আমার অগ্রজ (শ্যামল সরকার) ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় সফল হয়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করার সংবাদে গোটা এলাকায় বেশ সাড়া পড়ে যায়। দাদা আমাদের মামার প্রযত্নে থেকে লেখাপড়া করেছে, এটি জানাজানির পর এলাকাবাসীর কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। দাদার সঙ্গে বৃত্তিধারী আরও কোনো শিক্ষার্থী আমাদের কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানা সদরের একমাত্র হাইস্কুলটিতে ১৯৬৭ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই।

দাদার আগে বা পরের দু-বছর আমাদের আশুতিয়াপাড়া গ্রাম (বর্তমানে পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড) বা আশপাশের আর কেউ বৃত্তি পেয়েছিল কিংবা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল কিনা, তা-ও আমার স্মৃতিতে নেই। সে সময় বৃত্তি পাওয়ার চেয়ে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়াটাও কম আলোচনার বিষয় ছিল না। ঢালাওভাবে অংশ নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

আমার ছোট মামা হীরেন্দ্র সরকার ছিলেন ময়মনসিংহের নান্দাইল থানার পাঁচানী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। ওই স্কুলেরই লাগোয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খ্যাতিমান আরেক শিক্ষক মামার বন্ধু সতীশ দেবনাথ। দুই বন্ধুর কঠোর পরিশ্রম আর কড়া শাসনে ছাত্ররা ক্রমাগত খুব ভালো করে।

সে বছর (১৯৬৬) দাদা এবং সত্যেন্দ্র দেবনাথ (সতীশ দেবনাথের ছেলে), নূরুল ইসলাম ও ফিরোজুর রহমান এ চারজন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সবাই বৃত্তি লাভ করে। থানা সদরের বাইরে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় এমন ফলাফলে কেবল স্কুল নয়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদেরও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল।

তখন ট্যালেন্টপুল বৃত্তিধারীদের সরকারি কোষাগার থেকে মাসিক ২০ টাকা করে দেওয়া হতো। কৃতী শিক্ষার্থীরা ছয় মাস অন্তর অন্তর (১২০ টাকা করে) তিন বছর পর্যন্ত টাকাটা স্কুল থেকে তুলতে পারত। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তিন বছরে (৩৬ মাস) মোট ৭২০ টাকার সঙ্গে বই, খাতা, কলম ইত্যাদি শিক্ষা-উপকরণ কেনার জন্য প্রতিবছর এককালীন দেওয়া হতো ৫০ টাকা করে তিন বছরে মোট আরও ১৫০ টাকা (আমার যতদূর মনে পড়ে)। যে স্কুলেই পড়ুক, তিন বছর (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি) বৃত্তিধারী শিক্ষার্থীর কোনো টিউশন ফি লাগবে না।

তার মানে প্রাথমিক স্তরে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া একজন শিশু-শিক্ষার্থীর আর্থিক অর্জন মোট ৮৭০ (টিউশন ফি’র টাকা যোগ করলে হাজার টাকার বেশি) টাকা। অঙ্কটা নিতান্ত সামান্য তো নয়ই, বরঞ্চ সময়ের নিরিখে অনেক বেশি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি বা ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক স্তরে বেসরকারি একজন স্কুলশিক্ষকের সরকারি আর্থিক অনুদানের পরিমাণ ছিল মাসিক ২০ টাকা। দুধের সের ২৫ পয়সা, হাঁসের ডিমের হালি ২৫ পয়সা। চালের সের (এক সের = ৯৩৩ গ্রাম) ৭৫ পয়সা আর ধানের মন ১৭-১৮ টাকা। খাসির মাংসের সের দুই টাকা আর দেড়-দুইশ টাকায় হালের একটি গরু।

এক মন পাটের দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা আর ১৬০ টাকা সোনার ভরি। সরিষার তেল চার টাকা আর এক সের ঘিয়ের দাম সাত টাকা। কৃষি জমিতে সারাদিন খাটিয়ে একজনকে পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া হতো বারো আনা বা পঁচাত্তর পয়সা। উল্লিখিত জিনিসপত্রের দরদামের বর্ণনাটি আমার নিজের দেখা ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে দেওয়া।

ঠিক সে সময়টিতে (১৯৬৬) একজন বৃত্তিধারী শিশু-শিক্ষার্থীর পাওয়া ৮৭০ কিংবা ১০০০ টাকা দিয়ে বাজার থেকে অনায়াসে মিলত-প্রথমত, ৬ ভরি সোনা অথবা ৫৫ মন ধান অথবা ৩৩ মন চাল (৬-৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাধারণ বাঙালি পরিবারের সারা বছরের খোরাক) অথবা ৫০০ সের খাসির মাংস কিংবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের ৫০ মাসের সরকারি অনুদান।

উল্লিখিত দ্রব্য ও বিষয়ের সঙ্গে এখনকার বাজারদরের তুলনার কথা কল্পনাও করা যায় না। বর্তমানে ৬ ভরি সোনার দাম চার লাখ ৮০ হাজার টাকা। ৩৩ মন চালের দাম ৯২ হাজার ৪০০ টাকা। আর ৫০০ সের খাসির মাংসের দাম সই সই পাঁচ লাখ টাকা।

এবার চার দশক পরের কথা খানিকটা ব্যক্ত করি। ২০০৬ সালে আমার মেয়ে ঐশী যখন প্রাথমিকে মেধাবৃত্তি পায়, তখন টাকার পরিমাণ মাসে ২০০ আর এককালীন হিসাবে ১৫০ টাকা। সে অনুযায়ী তিন বছরে একজন মেধাবী শিশু-শিক্ষার্থীর সর্বমোট টাকার পরিমাণ সাত হাজার ৩৫০ টাকা।

২০০৮ সালের পর প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয়। বৃত্তির পরিবর্তে পরের বছর থেকে চালু করা হয় পিইসি বা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। বৃত্তি পরীক্ষা তুলে দেওয়া হলেও সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান অব্যাহত থাকে।

ভয়াবহ করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে পরপর দু’বছর ২০২০ ও ২০২১ সালের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ইত্যবসরে সরকার পরীক্ষাটি উঠিয়ে দিয়ে ২০২২ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে ঠিক আগের মতোই শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ করে।

আর টানা চৌদ্দ বছর বন্ধ থাকার পর বাছাই করা শিক্ষার্থীদের আবারও বৃত্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার বন্দোবস্ত করে। ৩০ ডিসেম্বর ২০২২ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আকস্মিক ঘোষণায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও কম সময়ে অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষার পক্ষে-বিপক্ষে সচেতন মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।

জানা যায়, প্রাথমিকে মেধাবৃত্তির উল্লিখিত হার ২০১৬ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল। বর্তমানে মেধাবৃত্তির হার ৩০০ টাকা আর সাধারণে ২২৫ টাকা করে। সে অনুযায়ী, বৃত্তিধারী একজন মেধাবী শিশু-শিক্ষার্থী ৩৬ মাসে সরকারি কোষাগার থেকে পায় মোট ১০,৮০০ টাকা।

এ পরিমাণ টাকা দিয়ে কেনা যাবে দুই আনা ওজনের সোনা (ষোল আনায় এক ভরি) অথবা ১১ কেজি খাসির মাংস। সাধারণ গ্রেডধারীদের পাওয়া টাকার পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই আরও কম (আট হাজার একশ)।

মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তির টাকা দিয়ে সেকাল বা একালে কী পাওয়া যায় কিংবা কী পাওয়া যায় না, সেটি বড় কথা নয়। সবচেয়ে বড় হলো, ওদের উৎসাহ দেওয়ার বিষয়টি। ওদের চোখ দিয়েই আমরা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। শিশু-কিশোরসহ সবার এগিয়ে চলার পথ সুগম হোক। বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে কোনো ধরনের অনিয়ম-অব্যবস্থা বা বাণিজ্য কাম্য নয়।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন