ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরানো কেন জরুরি
গেল সপ্তাহজুড়ে ছিল বিশ্ব ব্যাংকব্যবস্থার উদ্বেগজনক খবর। বার্ষিক মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবে এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ।
২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ছিল প্রায় ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা আমাদের জিডিপির প্রায় ৬০ গুণ বেশি। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন অর্থনীতির যেকোনো বিপর্যয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে।
চলমান অর্থনীতিতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা একটি অপরিহার্য মাধ্যম। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম দুটি ব্যাংক হলো ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) এবং নিউইয়র্কের সিগনেচার ব্যাংক। সাধারণ মানুষের আমানতের অর্থ দিয়েই ব্যাংক পরিচালিত হয়। উল্লেখিত ব্যাংক দুটি সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ ব্যাংক দুটিতে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আমানত হিসাবে রেখেছিলেন। কিন্তু আমানতকারীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হলো, মাত্র দুদিনের ব্যবধানে ব্যাংক দুটি দেউলিয়া বা বন্ধ বা অবসায়িত হয়ে গেছে। এ খবরে গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দেশের শীর্ষপদে থাকা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জনগণকে আশ্বস্ত করার লক্ষ্যে কড়া বার্তা দিয়ে বলেছেন, যারা দুটি ব্যাংক বন্ধের জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাংক খাত ও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে বড় ক্ষতি থেকে বাঁচাতে যা যা করণীয়, তার সবই করা হবে।
প্রেসিডেন্ট যতই আশ্বস্ত করার চেষ্টা করুন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, এ বক্তব্যে কেউই আশ্বস্ত হতে পারছেন না। কেননা, এরই মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের হস্তক্ষেপে দেউলিয়া সিলিকন ভ্যালির যুক্তরাজ্য শাখা মাত্র এক পাইন্ডের প্রতীকী দামে কিনে নিয়েছে এইচএসবিসি। ফলে বিনিয়োগকারীরা আর কোনোমতেই আস্থা রাখতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য ব্যাংকগুলোও আশঙ্কাজনক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গত মঙ্গলবার সে দেশের ব্যাংকগুলোর বাজার মূলধন কমেছে এক দিনে ৯০ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকা, যা আমাদের জাতীয় বাজেটের প্রায় দেড়গুণ)। এ নিয়ে গত চার দিনে ব্যাংকগুলো বাজার মূলধন হারিয়েছে মোট ১৯০ বিলিয়ন বা ১৯ হাজার কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকব্যবস্থার এ বিপর্যয় থেকে রেহাই পাচ্ছে না আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোও, সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক। এ সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারদর কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। ব্যাংকটিতে নতুন বিনিয়োগ আসার খবর প্রচার করা সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন না। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৮ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রে এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাংক বিপর্যয়।
শুরুতেই বলেছিলাম, মার্কিন অর্থনীতির একটা প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থাকে বিশ্বব্যাপী। সেই প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার নেতিবাচক ফল হিসাবে গত মঙ্গলবার জাপানের টপিক্স ব্যাংকের সূচকের পতন হয়েছে সাত শতাংশ। টপিক্সের এ পতন গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এ ছাড়া জাপানের মিতসুবিশি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের শেয়ারদর কমেছে ৮ দশমিক ১ শতাংশ। পতনের হাওয়া লেগেছে ইউরোপেও। গত সোমবার স্পেনের স্যানটানডার ও জার্মানির কমার্স ব্যাংকের শেয়ারদরও কমেছে ১০ শতাংশেরও বেশি। দরপতনের মধ্যে পড়েছে সুইজারল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংক ক্রেডিট সুইসের শেয়ার। গত বুধবার ব্যাংকটির শেয়ারদর কমেছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। যদিও ক্রেডিট সুইসের ২০২১ ও ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদনও দরপতনের একটি কারণ। প্রতিবেদন বলছে, গত বছর ক্রেডিট সুইস লোকসান দিয়েছে ৮০০ কোটি ডলার। তবে সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচারের ঘটনায় ক্রেডিট সুইসের ওপর বিনিয়োগকারীরা পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুটি সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার প্রধান যে কারণগুলো রয়েছে তা হলো, নীতি সুদহার বৃদ্ধি, ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (বিটকয়েনসহ ডিজিটাল মুদ্রা) বড় অঙ্কের বিনিয়োগ, স্টার্টআপ খাতে ছোট উদ্যোগে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ, আগ্রাসী ঋণ বিতরণ, গৃহায়ন খাতে বড় আকারের বিনিয়োগ। এসভিবি ব্যাংকটির এক দিনে শেয়ারপতন ঘটে ৬০ শতাংশ। এতে আমানতকারীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমানতকারীরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে এক দিনেই ব্যাংক থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলার তুলে নেয়। এসভিবির গ্রাহকদের মোট আমানতের মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ বিমাকৃত, বাদবাকি আমানতের কোনো বিমা নেই। সে ক্ষেত্রে একজন আমানতকারীর যত অর্থই জমা থাকুক না কেন, তিনি বিমাকৃত মাত্র ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার ফেরত পাবেন। বাদবাকি বিমাহীন আমানতের জন্য পাবেন রিসিভারশিপ সার্টিফিকেট, যা ব্যাংকের সহায়-সম্বল বিক্রি করার পর নগদায়নের ব্যবস্থা হতে পারে, যা এখন অনিশ্চিত। নিউইয়র্কের সিগনেচার ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাংকটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়। ২০২২ সালের শেষে এসে ব্যাংকটির মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১১১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সিতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করে ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের এ ব্যাংক বিপর্যয় বিশ্ব অর্থনীতিকে নাড়া দিলেও এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে কতটা পড়তে পারে তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত পরিচালিত হচ্ছে ৬১টি ব্যাংক দ্বারা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে ছয়টি, তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক, ৪৩টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং নয়টি বিদেশি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে যেসব কারণে ব্যাংক বন্ধ হয়েছে, সেসব কারণ বাংলাদেশে নেই। ফলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে ঝুঁকি নেই। তবে দুর্বল যেসব ব্যাংক রয়েছে, সেগুলোতে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্যের বিপরীতে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। তারা সুনির্দিষ্ট চারটি কারণের কথা বলেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো সুশাসনের ঘাটতি। তারপরে রয়েছে ব্যাংক পরিচালনায় পরিচালকদের মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ; ব্যাংকগুলোর বড় অঙ্কের ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়া এবং ব্যাংকের হিসাব পদ্ধতিতে বড় ধরনের ফাঁকি। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা ঝুঁকিতে রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইমেজ রক্ষার্থে নীতি সহায়তা দিয়ে কিছু ব্যাংকের বন্ধ হওয়া রহিত করছে।
আমরা মনে করি, খেলাপি ঋণের একটি বড় অভিশাপ এখনো ব্যাংকগুলোর ওপর রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। যদিও কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, কারসাজির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হয়েছে, প্রকৃত খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আমরা যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যও আমলে নেই, তাহলে বলতে হবে, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট প্রদত্ত ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, কোনো দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট প্রদত্ত ঋণের ২-৩ শতাংশের বেশি হওয়া বিপজ্জনক। খেলাপি ঋণের বাইরে আমাদের ব্যাংকব্যবস্থায় ঝুঁকি রয়েছে সুশাসন ও হিসাব পদ্ধতিতে। কারণ এসব খাতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর পর্ষদ শুধু নীতি প্রণয়ন করে। সেই নীতি বাস্তবায়ন করে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। তারা পর্ষদের বৈঠকে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও আমানতের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়। এর আলোকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ঋণ বিতরণ ও আমানত সংগ্রহ করে। এসব কাজে পর্ষদ হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ঋণ ও আমানতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পাশাপাশি প্রতি পর্ষদ সভায় ঋণ অনুমোদন করে। নবায়নের প্রস্তাবও অনুমোদন করে। বড় অঙ্কের ঋণগুলোর সবই পর্ষদের মাধ্যমে পাশ হচ্ছে। কিন্তু যখন খেলাপি হচ্ছে তখন পর্ষদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রে দেউলিয়া হলে পর্ষদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ব্যাংক বিপর্যয়ে নিশ্চিন্ত না থেকে এ দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনার দাবি করছি।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরানো কেন জরুরি
গেল সপ্তাহজুড়ে ছিল বিশ্ব ব্যাংকব্যবস্থার উদ্বেগজনক খবর। বার্ষিক মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবে এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ।
২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ছিল প্রায় ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা আমাদের জিডিপির প্রায় ৬০ গুণ বেশি। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন অর্থনীতির যেকোনো বিপর্যয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে।
চলমান অর্থনীতিতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা একটি অপরিহার্য মাধ্যম। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম দুটি ব্যাংক হলো ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) এবং নিউইয়র্কের সিগনেচার ব্যাংক। সাধারণ মানুষের আমানতের অর্থ দিয়েই ব্যাংক পরিচালিত হয়। উল্লেখিত ব্যাংক দুটি সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ ব্যাংক দুটিতে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আমানত হিসাবে রেখেছিলেন। কিন্তু আমানতকারীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হলো, মাত্র দুদিনের ব্যবধানে ব্যাংক দুটি দেউলিয়া বা বন্ধ বা অবসায়িত হয়ে গেছে। এ খবরে গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দেশের শীর্ষপদে থাকা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জনগণকে আশ্বস্ত করার লক্ষ্যে কড়া বার্তা দিয়ে বলেছেন, যারা দুটি ব্যাংক বন্ধের জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাংক খাত ও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে বড় ক্ষতি থেকে বাঁচাতে যা যা করণীয়, তার সবই করা হবে।
প্রেসিডেন্ট যতই আশ্বস্ত করার চেষ্টা করুন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, এ বক্তব্যে কেউই আশ্বস্ত হতে পারছেন না। কেননা, এরই মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের হস্তক্ষেপে দেউলিয়া সিলিকন ভ্যালির যুক্তরাজ্য শাখা মাত্র এক পাইন্ডের প্রতীকী দামে কিনে নিয়েছে এইচএসবিসি। ফলে বিনিয়োগকারীরা আর কোনোমতেই আস্থা রাখতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য ব্যাংকগুলোও আশঙ্কাজনক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গত মঙ্গলবার সে দেশের ব্যাংকগুলোর বাজার মূলধন কমেছে এক দিনে ৯০ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকা, যা আমাদের জাতীয় বাজেটের প্রায় দেড়গুণ)। এ নিয়ে গত চার দিনে ব্যাংকগুলো বাজার মূলধন হারিয়েছে মোট ১৯০ বিলিয়ন বা ১৯ হাজার কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকব্যবস্থার এ বিপর্যয় থেকে রেহাই পাচ্ছে না আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোও, সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক। এ সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারদর কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। ব্যাংকটিতে নতুন বিনিয়োগ আসার খবর প্রচার করা সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন না। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৮ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রে এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাংক বিপর্যয়।
শুরুতেই বলেছিলাম, মার্কিন অর্থনীতির একটা প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থাকে বিশ্বব্যাপী। সেই প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার নেতিবাচক ফল হিসাবে গত মঙ্গলবার জাপানের টপিক্স ব্যাংকের সূচকের পতন হয়েছে সাত শতাংশ। টপিক্সের এ পতন গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এ ছাড়া জাপানের মিতসুবিশি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের শেয়ারদর কমেছে ৮ দশমিক ১ শতাংশ। পতনের হাওয়া লেগেছে ইউরোপেও। গত সোমবার স্পেনের স্যানটানডার ও জার্মানির কমার্স ব্যাংকের শেয়ারদরও কমেছে ১০ শতাংশেরও বেশি। দরপতনের মধ্যে পড়েছে সুইজারল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংক ক্রেডিট সুইসের শেয়ার। গত বুধবার ব্যাংকটির শেয়ারদর কমেছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। যদিও ক্রেডিট সুইসের ২০২১ ও ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদনও দরপতনের একটি কারণ। প্রতিবেদন বলছে, গত বছর ক্রেডিট সুইস লোকসান দিয়েছে ৮০০ কোটি ডলার। তবে সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচারের ঘটনায় ক্রেডিট সুইসের ওপর বিনিয়োগকারীরা পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুটি সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার প্রধান যে কারণগুলো রয়েছে তা হলো, নীতি সুদহার বৃদ্ধি, ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (বিটকয়েনসহ ডিজিটাল মুদ্রা) বড় অঙ্কের বিনিয়োগ, স্টার্টআপ খাতে ছোট উদ্যোগে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ, আগ্রাসী ঋণ বিতরণ, গৃহায়ন খাতে বড় আকারের বিনিয়োগ। এসভিবি ব্যাংকটির এক দিনে শেয়ারপতন ঘটে ৬০ শতাংশ। এতে আমানতকারীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমানতকারীরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে এক দিনেই ব্যাংক থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলার তুলে নেয়। এসভিবির গ্রাহকদের মোট আমানতের মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ বিমাকৃত, বাদবাকি আমানতের কোনো বিমা নেই। সে ক্ষেত্রে একজন আমানতকারীর যত অর্থই জমা থাকুক না কেন, তিনি বিমাকৃত মাত্র ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার ফেরত পাবেন। বাদবাকি বিমাহীন আমানতের জন্য পাবেন রিসিভারশিপ সার্টিফিকেট, যা ব্যাংকের সহায়-সম্বল বিক্রি করার পর নগদায়নের ব্যবস্থা হতে পারে, যা এখন অনিশ্চিত। নিউইয়র্কের সিগনেচার ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাংকটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়। ২০২২ সালের শেষে এসে ব্যাংকটির মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১১১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সিতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করে ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের এ ব্যাংক বিপর্যয় বিশ্ব অর্থনীতিকে নাড়া দিলেও এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে কতটা পড়তে পারে তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত পরিচালিত হচ্ছে ৬১টি ব্যাংক দ্বারা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে ছয়টি, তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক, ৪৩টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং নয়টি বিদেশি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে যেসব কারণে ব্যাংক বন্ধ হয়েছে, সেসব কারণ বাংলাদেশে নেই। ফলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে ঝুঁকি নেই। তবে দুর্বল যেসব ব্যাংক রয়েছে, সেগুলোতে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্যের বিপরীতে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। তারা সুনির্দিষ্ট চারটি কারণের কথা বলেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো সুশাসনের ঘাটতি। তারপরে রয়েছে ব্যাংক পরিচালনায় পরিচালকদের মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ; ব্যাংকগুলোর বড় অঙ্কের ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়া এবং ব্যাংকের হিসাব পদ্ধতিতে বড় ধরনের ফাঁকি। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা ঝুঁকিতে রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইমেজ রক্ষার্থে নীতি সহায়তা দিয়ে কিছু ব্যাংকের বন্ধ হওয়া রহিত করছে।
আমরা মনে করি, খেলাপি ঋণের একটি বড় অভিশাপ এখনো ব্যাংকগুলোর ওপর রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। যদিও কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, কারসাজির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হয়েছে, প্রকৃত খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আমরা যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যও আমলে নেই, তাহলে বলতে হবে, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট প্রদত্ত ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, কোনো দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট প্রদত্ত ঋণের ২-৩ শতাংশের বেশি হওয়া বিপজ্জনক। খেলাপি ঋণের বাইরে আমাদের ব্যাংকব্যবস্থায় ঝুঁকি রয়েছে সুশাসন ও হিসাব পদ্ধতিতে। কারণ এসব খাতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর পর্ষদ শুধু নীতি প্রণয়ন করে। সেই নীতি বাস্তবায়ন করে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। তারা পর্ষদের বৈঠকে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও আমানতের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়। এর আলোকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ঋণ বিতরণ ও আমানত সংগ্রহ করে। এসব কাজে পর্ষদ হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ঋণ ও আমানতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পাশাপাশি প্রতি পর্ষদ সভায় ঋণ অনুমোদন করে। নবায়নের প্রস্তাবও অনুমোদন করে। বড় অঙ্কের ঋণগুলোর সবই পর্ষদের মাধ্যমে পাশ হচ্ছে। কিন্তু যখন খেলাপি হচ্ছে তখন পর্ষদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রে দেউলিয়া হলে পর্ষদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ব্যাংক বিপর্যয়ে নিশ্চিন্ত না থেকে এ দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনার দাবি করছি।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়