এই অশনিসংকেত আমলে নিন
প্রতিপক্ষের চ্যালেঞ্জ তেমন না থাকায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সুযোগ ছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে সুগঠিত আদর্শিক জায়গায় দলটিকে ফিরিয়ে নেওয়া। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনেকটা চ্যালেঞ্জহীন রাজনৈতিক পরিবেশের সুযোগ নিতে পারেননি। দলকে দৃঢ়তার সঙ্গে লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রয়েছে। কিন্তু কঠিন বাস্তবতায় একা তার পক্ষে হাল ধরা সহজ নয়। এ জটিল পথে তাকে একাই হাঁটতে হচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচনি ডামাডোলে বিএনপি যখন কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করতে চাইছে তখন নানা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক অরাজকতা এবং কঠিন দলতন্ত্রের দাপটে আওয়ামী লীগ নেতাদের আচরণে বন্ধুভাবাপন্ন মানুষদের হেয় প্রতিপন্ন করা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বুমেরাং হয়ে দেখা দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য বিএনপির দলীয় কাঠামো ও নেতৃত্ব তেমন প্রজ্ঞা দিয়ে প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় লক্ষ্য স্থির করতে পারছে না। এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের যখন উচিত সাধারণ মানুষের আস্থার কাছে পৌঁছার, তখন তারা কপট আভিজাত্যের অচলায়তন ভেঙে নিচে নামতে পারছেন না।
যতবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হোঁচট খেয়েছে, ততবারই স্পষ্ট হয়েছে তাদের স্খলনের কারণ। তবুও দলটির নেতারা সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। একবার তো কয়েকজন সন্ত্রাসী গডফাদারের আসুরিক দাপটে সাধারণ মানুষের একাংশ আওয়ামী লীগের ওপর থেকে অনেকটা সমর্থন উঠিয়ে নিয়েছিল। মুক্তবুদ্ধির অনেক মানুষ আশা করেছিল এ শিক্ষা থেকে সতর্ক হবেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তেমনটি লক্ষ করা যায়নি। এ কারণেই নিকট অতীতে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে দাঁড়িয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পাড়ি দেওয়ার চিন্তা আওয়ামী লীগ করতে পারেনি। অথচ সুস্থ রাজনীতির পথে হাঁটলে জনগণের বিশ্বাসের জায়গাটি নড়বড়ে হতো না। আমাদের দুর্ভাগ্য, কোনো পক্ষের রাজনীতিই সরল পথ যেন খুঁজে পাচ্ছে না।
এবার নির্বাচনি ডামাডোলের সময় আবারও ছাত্রলীগ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। যদিও বিষয়টি নতুন কিছু নয়, তবুও মনে হচ্ছে এ সময়ে ছাত্রলীগের আচরণ আওয়ামী লীগের সামনে অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ সংকেতকে আমলে না এনে বালুতে মুখ লুকালে আখেরে চরম ক্ষতি হবে আওয়ামী লীগেরই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন চরম প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করছে ছাত্রলীগ। হল প্রশাসন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে ঠুঁটো জগন্নাথ। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের অঙ্গুলি হেলনেই পরিচালিত হয়। হলে সিট পাওয়ার জন্য এখন শিক্ষার্থীরা আর হাউজ টিউটরদের কাছে যায় না। ছাত্রলীগ নেতাদের আদেশেই সব হয়। ছাত্রলীগের অনেক শর্ত মেনেই তাদের হলে আসতে হয় এবং সময় সময় সতীর্থদের নির্যাতন ভোগ করতে হয়। আমাদের দেশে প্রভোস্ট আর হাউজ টিউটরদের পেছনে প্রচুর অর্থ খরচ হয়। কার্যত হল পরিচালনায় তাদের প্রয়োজন অনেকটা কমে আসছে। বাস্তব ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নির্দেশে যেহেতু সব হয়, তাই বাকি দাপ্তরিক কাজ হল অফিসের অফিসার আর কর্মচারীরাই করতে পারেন।
ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি তাদের হল পরিচালনায় একজন মাত্র ওয়ার্ডেন থাকেন। তিনি শিক্ষক হতে পারেন আবার অফিসারও হতে পারেন। বাকি কাজ হল অফিসই করে। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন ছাত্ররা-ছাত্রনেতারা ছাত্র কল্যাণে এগিয়ে আসতেন-প্রশাসনের কাছে নানা দাবি-দাওয়া উত্থাপন করতেন। এখন পরিস্থিতি পালটে গেছে, ছাত্রলীগের দাবি মেটাতে প্রশাসনকে ব্যস্ত থাকতে হয়। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ। কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন খেলার মাঠ খেলার অনুপোযোগী হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। অনেককাল পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাজেট বরাদ্দ দেয়। মাঠের সংস্কারকাজ অনেকটা এগিয়ে চলছিল; প্রায় সত্তর ভাগ কাজ সম্পন্নও হয়ে যায়। এতে সাধারণ ছাত্ররা বেশ খুশি। হঠাৎ শোনা গেল মাঠের উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দিয়েছে ছাত্রলীগ। কারণ ঠিকাদার চাহিদামতো চাঁদা দিতে পারছে না। সাধারণ ছাত্রদের আনন্দের প্রদীপ নিভে গেল।
নিয়োগ বাণিজ্যেও ছাত্রলীগের জড়িত থাকার কথা শোনা যায়। এখানে নেতাদের যুক্তি থাকে। যেমন তাদের অনেক অনুসারীকে নাস্তা এবং লাঞ্চ করাতে হয়। দল চালাতে হলে তাদের টাকা লাগে। তাই প্রশাসনকে তো এ রত্নদের সহযোগিতা করতেই হবে। মুশকিল হচ্ছে এসব তো রহস্যাবৃত থাকে না। তা পল্লবিত হয়। দিন শেষে দলকে এবং দলীয় সরকারকে এ দায় বহন করতেই হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যতই হেদায়েত করুন, ছাত্রলীগকে হাতে বই-খাতা তুলে নিতে বলুন না কেন, রাজনীতির গডফাদারদের আশ্রয়ে এরা শিক্ষাবিচ্যুত থাকতেই পছন্দ করে। অতি সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ দিই। কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ফাইনাল মৌখিক পরীক্ষা হবে। আমি ওদের বহিঃস্থ পরীক্ষক। পরীক্ষা কমিটি পরীক্ষকদের সঙ্গে সময় মিলিয়েই পরীক্ষার তারিখ স্থির করে। আমি অনেক হিসাব-নিকাশ করে দুটো দিন বের করেছি। সেভাবেই নোটিশ করা হয়েছে পরীক্ষার। পরীক্ষা শুরু হবে সকাল ৯টায়। অনেক শিক্ষার্থী, তাই দুদিন লাগবে পরীক্ষা শেষ করতে।
আমি পরীক্ষার দিন ভোর রাতে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখি। কিন্তু হঠাৎ আগের দিন সকালে পরীক্ষা কমিটির একজন শিক্ষক বিনীতভাবে জানালেন, একজন মন্ত্রী যাবেন একটা কিছু উদ্বোধন করতে। তাই প্রশাসন থেকে নির্দেশ এসেছে দুপুর ১২টার পর ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার জন্য। আমি জানালাম কোনো অসুবিধা নেই। আমি সকালে রওয়ানা হয়ে আসব। সন্ধ্যায় ফোন পেলাম পরীক্ষা কমিটির সভাপতি মহোদয়ের। দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠ। প্রশাসনের চেয়েও শক্তিশালী জায়গা থেকে আদেশ এসেছে। ছাত্রলীগ জানিয়ে দিয়েছে মন্ত্রী আসবেন বলে সেদিন কোনো ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া যাবে না।
আমি আশঙ্কার সঙ্গে ভাবলাম ছাত্রত্বের লেশ মাত্রও কি এসব প্রতাপশালী ছাত্রনেতার মধ্যে নেই? ওরা কি জানে না এভাবে হঠাৎ পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের ওপর কতটা মানসিক চাপ পড়তে পারে? পরীক্ষা কমিটির পক্ষে নতুন করে পরীক্ষা সাজানো কতটা কঠিন? হয়তো মন্ত্রী মহোদয় জানেন না। জানলে তার প্রতিক্রিয়া কী হতো জানি না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সব হজম করে নিতে হচ্ছে।
২০০৪ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। ভারতের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও মালদা সরকারি কলেজ যৌথভাবে একটি আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। বাংলাদেশ থেকে আমি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও দুজন অধ্যাপক গিয়েছিলাম। মালদা কলেজে আয়োজন ছিল। কাছেই এক হোটেলে ছিল আমাদের থাকার ব্যবস্থা। সকালে একটু আগে অনুষ্ঠান স্থলে চলে গিয়েছিলাম। আয়োজকরা তাদের অফিস ঘরে আমাদের বসালেন। আমরা ছাড়াও তিনজন সাংবাদিক ছিলেন। কতক্ষণ পর সবাই শশব্যস্ত হয়ে দাঁড়ালেন। ঘরে ঢুকলেন একজন সৌম্যকান্তি প্রৌঢ়। ফিনফিনে পাতলা পাঞ্জাবি পরা। জানলাম তিনি পশ্চিমবঙ্গের একজন পূর্ণমন্ত্রী। সঙ্গে তার পিএস। দরোজার কাছে একজন পুলিশ দাঁড়ানো। আর কোনো প্রোটকলের বালাই নেই। একজন সাংবাদিক উঠে চেয়ার খালি করে দিলেন। পরিচয় হলো। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বললেন। আমাদের কুশল জানতে চাইলেন। বাংলাদেশ থেকে আসতে কোনো বিড়ম্বনা হয়েছে কিনা তা-ও জানতে চাইলেন। মন্ত্রী অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন। জানলাম এজন্য কলেজের ক্লাস পরীক্ষার ব্যাঘাত ঘটেনি। কলেজের ক্লাস রুটিনমাফিকই চলেছে।
আমরা জানি বিএনপি আমলে ছাত্রদলের পরিচিতিও ছিল চাঁদাবাজ আর সন্ত্রাসী হিসাবে। হয়তো সবাই দুষ্কর্মে সঙ্গে যুক্ত ছিল না; কিন্তু দায়ভার থেকে মুক্তি পায়নি কেউ। এর খেসারত কি বিএনপি নেতাদের দিতে হয়নি?
এখন অনেক বেশি দুর্নাম কুড়াচ্ছে ছাত্রলীগ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেরা নিজেরাই মারামারি করছে। নবাগত শিক্ষার্থীদের ওপর নিকৃষ্ট র্যাগিংয়ের নায়ক হিসাবে অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্রলীগের নাম উঠে আসছে। কিন্তু ছাত্রলীগের উগ্রতা থামাতে লাগাম টেনে ধরছেন না সংশ্লিষ্ট নেতারা।
বিভিন্ন অরাজকতা ও চারিত্রিক স্খলনের জন্য আজ ছাত্রলীগ অভিযুক্ত। অথচ ছাত্রলীগের পরিচিতি এমন ছিল না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনেক আগে থেকেই অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় ছিল সংগঠনটি। সাধারণ মানুষের অনেক কাছের সংগঠন ছিল ছাত্রলীগ। দুর্ভাগ্য, আজ অনেকটা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সংগঠনটি। ছাত্রলীগ নামটি এখন নেতিবাচক শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এ বাস্তবতা নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জন্য একটি অশনিসংকেত। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে দাম্ভিক আওয়ামী লীগ নেতারা এসব সংকেতের পরোয়া করেন না। তারা পেছনে ফিরে তাকাতে চান না। ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পেছনের অন্যতম কারণ পর্যবেক্ষণ করা উচিত। নারায়ণগঞ্জ, ফেনীসহ দেশের অনেক স্থানে আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট কয়েকজন সন্ত্রাসী নেতার নাম সাধারণ মানুষ আতঙ্কের সঙ্গে উচ্চারণ করত। ভোটের রাজনীতিতে এরা আওয়ামী লীগকে অজনপ্রিয় করে তোলে। কিন্তু তখনো আওয়ামী লীগ এসব অশনিসংকেতকে পরোয়া করেনি। এর বিরূপ ফল দলটি হাতে হাতে পেয়েছিল।
আওয়ামী লীগের বিজ্ঞ নেতারা অনুধাবন করতে চান না যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে মোকাবিলা করাটাই শেষ কথা নয়, ভোটকেন্দ্রে সাধারণ ভোটার নিজেদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পেলে যেকোনো সময়েই গণেশ উলটে যেতে পারে। এজন্যই আমরা মনে করি, ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাচারী আচরণের কারণে যে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে একে গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে এখনি প্রতিবিধানের চেষ্টা করা উচিত। লালন তো বলেই গেছেন ‘সময় গেলে সাধন হবে না...।’
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই অশনিসংকেত আমলে নিন
প্রতিপক্ষের চ্যালেঞ্জ তেমন না থাকায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সুযোগ ছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে সুগঠিত আদর্শিক জায়গায় দলটিকে ফিরিয়ে নেওয়া। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনেকটা চ্যালেঞ্জহীন রাজনৈতিক পরিবেশের সুযোগ নিতে পারেননি। দলকে দৃঢ়তার সঙ্গে লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রয়েছে। কিন্তু কঠিন বাস্তবতায় একা তার পক্ষে হাল ধরা সহজ নয়। এ জটিল পথে তাকে একাই হাঁটতে হচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচনি ডামাডোলে বিএনপি যখন কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করতে চাইছে তখন নানা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক অরাজকতা এবং কঠিন দলতন্ত্রের দাপটে আওয়ামী লীগ নেতাদের আচরণে বন্ধুভাবাপন্ন মানুষদের হেয় প্রতিপন্ন করা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বুমেরাং হয়ে দেখা দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য বিএনপির দলীয় কাঠামো ও নেতৃত্ব তেমন প্রজ্ঞা দিয়ে প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় লক্ষ্য স্থির করতে পারছে না। এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের যখন উচিত সাধারণ মানুষের আস্থার কাছে পৌঁছার, তখন তারা কপট আভিজাত্যের অচলায়তন ভেঙে নিচে নামতে পারছেন না।
যতবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হোঁচট খেয়েছে, ততবারই স্পষ্ট হয়েছে তাদের স্খলনের কারণ। তবুও দলটির নেতারা সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। একবার তো কয়েকজন সন্ত্রাসী গডফাদারের আসুরিক দাপটে সাধারণ মানুষের একাংশ আওয়ামী লীগের ওপর থেকে অনেকটা সমর্থন উঠিয়ে নিয়েছিল। মুক্তবুদ্ধির অনেক মানুষ আশা করেছিল এ শিক্ষা থেকে সতর্ক হবেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তেমনটি লক্ষ করা যায়নি। এ কারণেই নিকট অতীতে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে দাঁড়িয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পাড়ি দেওয়ার চিন্তা আওয়ামী লীগ করতে পারেনি। অথচ সুস্থ রাজনীতির পথে হাঁটলে জনগণের বিশ্বাসের জায়গাটি নড়বড়ে হতো না। আমাদের দুর্ভাগ্য, কোনো পক্ষের রাজনীতিই সরল পথ যেন খুঁজে পাচ্ছে না।
এবার নির্বাচনি ডামাডোলের সময় আবারও ছাত্রলীগ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। যদিও বিষয়টি নতুন কিছু নয়, তবুও মনে হচ্ছে এ সময়ে ছাত্রলীগের আচরণ আওয়ামী লীগের সামনে অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ সংকেতকে আমলে না এনে বালুতে মুখ লুকালে আখেরে চরম ক্ষতি হবে আওয়ামী লীগেরই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন চরম প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করছে ছাত্রলীগ। হল প্রশাসন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে ঠুঁটো জগন্নাথ। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের অঙ্গুলি হেলনেই পরিচালিত হয়। হলে সিট পাওয়ার জন্য এখন শিক্ষার্থীরা আর হাউজ টিউটরদের কাছে যায় না। ছাত্রলীগ নেতাদের আদেশেই সব হয়। ছাত্রলীগের অনেক শর্ত মেনেই তাদের হলে আসতে হয় এবং সময় সময় সতীর্থদের নির্যাতন ভোগ করতে হয়। আমাদের দেশে প্রভোস্ট আর হাউজ টিউটরদের পেছনে প্রচুর অর্থ খরচ হয়। কার্যত হল পরিচালনায় তাদের প্রয়োজন অনেকটা কমে আসছে। বাস্তব ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নির্দেশে যেহেতু সব হয়, তাই বাকি দাপ্তরিক কাজ হল অফিসের অফিসার আর কর্মচারীরাই করতে পারেন।
ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি তাদের হল পরিচালনায় একজন মাত্র ওয়ার্ডেন থাকেন। তিনি শিক্ষক হতে পারেন আবার অফিসারও হতে পারেন। বাকি কাজ হল অফিসই করে। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন ছাত্ররা-ছাত্রনেতারা ছাত্র কল্যাণে এগিয়ে আসতেন-প্রশাসনের কাছে নানা দাবি-দাওয়া উত্থাপন করতেন। এখন পরিস্থিতি পালটে গেছে, ছাত্রলীগের দাবি মেটাতে প্রশাসনকে ব্যস্ত থাকতে হয়। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ। কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন খেলার মাঠ খেলার অনুপোযোগী হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। অনেককাল পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাজেট বরাদ্দ দেয়। মাঠের সংস্কারকাজ অনেকটা এগিয়ে চলছিল; প্রায় সত্তর ভাগ কাজ সম্পন্নও হয়ে যায়। এতে সাধারণ ছাত্ররা বেশ খুশি। হঠাৎ শোনা গেল মাঠের উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দিয়েছে ছাত্রলীগ। কারণ ঠিকাদার চাহিদামতো চাঁদা দিতে পারছে না। সাধারণ ছাত্রদের আনন্দের প্রদীপ নিভে গেল।
নিয়োগ বাণিজ্যেও ছাত্রলীগের জড়িত থাকার কথা শোনা যায়। এখানে নেতাদের যুক্তি থাকে। যেমন তাদের অনেক অনুসারীকে নাস্তা এবং লাঞ্চ করাতে হয়। দল চালাতে হলে তাদের টাকা লাগে। তাই প্রশাসনকে তো এ রত্নদের সহযোগিতা করতেই হবে। মুশকিল হচ্ছে এসব তো রহস্যাবৃত থাকে না। তা পল্লবিত হয়। দিন শেষে দলকে এবং দলীয় সরকারকে এ দায় বহন করতেই হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যতই হেদায়েত করুন, ছাত্রলীগকে হাতে বই-খাতা তুলে নিতে বলুন না কেন, রাজনীতির গডফাদারদের আশ্রয়ে এরা শিক্ষাবিচ্যুত থাকতেই পছন্দ করে। অতি সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ দিই। কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ফাইনাল মৌখিক পরীক্ষা হবে। আমি ওদের বহিঃস্থ পরীক্ষক। পরীক্ষা কমিটি পরীক্ষকদের সঙ্গে সময় মিলিয়েই পরীক্ষার তারিখ স্থির করে। আমি অনেক হিসাব-নিকাশ করে দুটো দিন বের করেছি। সেভাবেই নোটিশ করা হয়েছে পরীক্ষার। পরীক্ষা শুরু হবে সকাল ৯টায়। অনেক শিক্ষার্থী, তাই দুদিন লাগবে পরীক্ষা শেষ করতে।
আমি পরীক্ষার দিন ভোর রাতে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখি। কিন্তু হঠাৎ আগের দিন সকালে পরীক্ষা কমিটির একজন শিক্ষক বিনীতভাবে জানালেন, একজন মন্ত্রী যাবেন একটা কিছু উদ্বোধন করতে। তাই প্রশাসন থেকে নির্দেশ এসেছে দুপুর ১২টার পর ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার জন্য। আমি জানালাম কোনো অসুবিধা নেই। আমি সকালে রওয়ানা হয়ে আসব। সন্ধ্যায় ফোন পেলাম পরীক্ষা কমিটির সভাপতি মহোদয়ের। দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠ। প্রশাসনের চেয়েও শক্তিশালী জায়গা থেকে আদেশ এসেছে। ছাত্রলীগ জানিয়ে দিয়েছে মন্ত্রী আসবেন বলে সেদিন কোনো ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া যাবে না।
আমি আশঙ্কার সঙ্গে ভাবলাম ছাত্রত্বের লেশ মাত্রও কি এসব প্রতাপশালী ছাত্রনেতার মধ্যে নেই? ওরা কি জানে না এভাবে হঠাৎ পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের ওপর কতটা মানসিক চাপ পড়তে পারে? পরীক্ষা কমিটির পক্ষে নতুন করে পরীক্ষা সাজানো কতটা কঠিন? হয়তো মন্ত্রী মহোদয় জানেন না। জানলে তার প্রতিক্রিয়া কী হতো জানি না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সব হজম করে নিতে হচ্ছে।
২০০৪ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। ভারতের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও মালদা সরকারি কলেজ যৌথভাবে একটি আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। বাংলাদেশ থেকে আমি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও দুজন অধ্যাপক গিয়েছিলাম। মালদা কলেজে আয়োজন ছিল। কাছেই এক হোটেলে ছিল আমাদের থাকার ব্যবস্থা। সকালে একটু আগে অনুষ্ঠান স্থলে চলে গিয়েছিলাম। আয়োজকরা তাদের অফিস ঘরে আমাদের বসালেন। আমরা ছাড়াও তিনজন সাংবাদিক ছিলেন। কতক্ষণ পর সবাই শশব্যস্ত হয়ে দাঁড়ালেন। ঘরে ঢুকলেন একজন সৌম্যকান্তি প্রৌঢ়। ফিনফিনে পাতলা পাঞ্জাবি পরা। জানলাম তিনি পশ্চিমবঙ্গের একজন পূর্ণমন্ত্রী। সঙ্গে তার পিএস। দরোজার কাছে একজন পুলিশ দাঁড়ানো। আর কোনো প্রোটকলের বালাই নেই। একজন সাংবাদিক উঠে চেয়ার খালি করে দিলেন। পরিচয় হলো। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বললেন। আমাদের কুশল জানতে চাইলেন। বাংলাদেশ থেকে আসতে কোনো বিড়ম্বনা হয়েছে কিনা তা-ও জানতে চাইলেন। মন্ত্রী অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন। জানলাম এজন্য কলেজের ক্লাস পরীক্ষার ব্যাঘাত ঘটেনি। কলেজের ক্লাস রুটিনমাফিকই চলেছে।
আমরা জানি বিএনপি আমলে ছাত্রদলের পরিচিতিও ছিল চাঁদাবাজ আর সন্ত্রাসী হিসাবে। হয়তো সবাই দুষ্কর্মে সঙ্গে যুক্ত ছিল না; কিন্তু দায়ভার থেকে মুক্তি পায়নি কেউ। এর খেসারত কি বিএনপি নেতাদের দিতে হয়নি?
এখন অনেক বেশি দুর্নাম কুড়াচ্ছে ছাত্রলীগ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেরা নিজেরাই মারামারি করছে। নবাগত শিক্ষার্থীদের ওপর নিকৃষ্ট র্যাগিংয়ের নায়ক হিসাবে অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্রলীগের নাম উঠে আসছে। কিন্তু ছাত্রলীগের উগ্রতা থামাতে লাগাম টেনে ধরছেন না সংশ্লিষ্ট নেতারা।
বিভিন্ন অরাজকতা ও চারিত্রিক স্খলনের জন্য আজ ছাত্রলীগ অভিযুক্ত। অথচ ছাত্রলীগের পরিচিতি এমন ছিল না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনেক আগে থেকেই অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় ছিল সংগঠনটি। সাধারণ মানুষের অনেক কাছের সংগঠন ছিল ছাত্রলীগ। দুর্ভাগ্য, আজ অনেকটা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সংগঠনটি। ছাত্রলীগ নামটি এখন নেতিবাচক শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এ বাস্তবতা নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জন্য একটি অশনিসংকেত। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে দাম্ভিক আওয়ামী লীগ নেতারা এসব সংকেতের পরোয়া করেন না। তারা পেছনে ফিরে তাকাতে চান না। ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পেছনের অন্যতম কারণ পর্যবেক্ষণ করা উচিত। নারায়ণগঞ্জ, ফেনীসহ দেশের অনেক স্থানে আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট কয়েকজন সন্ত্রাসী নেতার নাম সাধারণ মানুষ আতঙ্কের সঙ্গে উচ্চারণ করত। ভোটের রাজনীতিতে এরা আওয়ামী লীগকে অজনপ্রিয় করে তোলে। কিন্তু তখনো আওয়ামী লীগ এসব অশনিসংকেতকে পরোয়া করেনি। এর বিরূপ ফল দলটি হাতে হাতে পেয়েছিল।
আওয়ামী লীগের বিজ্ঞ নেতারা অনুধাবন করতে চান না যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে মোকাবিলা করাটাই শেষ কথা নয়, ভোটকেন্দ্রে সাধারণ ভোটার নিজেদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পেলে যেকোনো সময়েই গণেশ উলটে যেতে পারে। এজন্যই আমরা মনে করি, ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাচারী আচরণের কারণে যে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে একে গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে এখনি প্রতিবিধানের চেষ্টা করা উচিত। লালন তো বলেই গেছেন ‘সময় গেলে সাধন হবে না...।’
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com