ভোক্তারা একটু স্বস্তি চান
jugantor
আশেপাশে চারপাশে
ভোক্তারা একটু স্বস্তি চান

  চপল বাশার  

২১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষ যাতে ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য এবং সহজেই সব ধরনের সেবা পেতে পারেন, সেজন্য সরকার ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংস্থাটি গঠিত হয় ১৩ বছর আগে, ২০১০ সালে। সংস্থাটি প্রতি বছর বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করে সাড়ম্বরে। এ বছর দিবসটি পালিত হয়েছে গত ১৫ মার্চ।

অধিদপ্তর সীমিত আকারে দিবস পালন করলেও গণমাধ্যমে প্রচার-প্রোপাগান্ডা কম করেনি। জাতীয় দৈনিকে পূর্ণপৃষ্ঠা ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে, যেখানে স্থান পেয়েছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনদের বাণী। ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত ‘ভোক্তা অধিকার ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক বিশাল নিবন্ধে অধিদপ্তরের পরিচিতি, গঠন-কাঠামো, কার্যক্রম এবং ভোক্তা অধিকারবিরোধী অপরাধ ও দণ্ড সম্পর্কিত বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু ১৩ বছরে অধিদপ্তর কী কাজ করেছে, কতজনকে দণ্ড দিয়েছে, কী তাদের সাফল্য তার উল্লেখ পাওয়া গেল না। সাফল্যের উল্লেখ ও বিবরণ না থাকলে কী করে বোঝা যাবে যে অধিদপ্তরের গঠন সার্থক হয়েছে, এটি কার্যকর অবদান রাখছে?

বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা যাদের ভোক্তা বলি, তাদের খুব সামান্যসংখ্যকই ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ সম্পর্কে জানেন। অধিদপ্তরের মূল কার্যক্রম তথা অপরাধবিরোধী অভিযান দৃশ্যমান ও ফলপ্রসূ হলে ভোক্তারা বুঝতে পারতেন তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য সরকারের একটি সংস্থা তৎপর রয়েছে। তাহলে ভোক্তারাও অধিদপ্তরের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। অসাধু ব্যবসায়ীরাও নিজেদের স্বার্থেই অপরাধ করতে সাহস পেত না।

আইন অনুযায়ী প্রতারিত ভোক্তারা অধিদপ্তরের কাছে সংশ্লিষ্ট অপরাধী তথা বিক্রেতা, দোকানদার, ব্যবসায়ী বা সেবা প্রদানকারীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগ করা হলেও সেগুলোর নিষ্পত্তি হয় খুব কম। অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে ই-কমার্স খাতে অনিয়ম-অস্থিরতা গত চার বছরে হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতের ভুক্তভোগীরা অধিদপ্তরে ধরনা দিচ্ছেন লিখিত অভিযোগ নিয়ে। মূলত ই-কমার্সে বা অনলাইনে কেনাকাটায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরাই গত অর্থবছরে অধিদপ্তরে ২৫ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে মাত্র তিন হাজার অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে, বাকি ২২ হাজার পড়ে আছে।

অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বিলম্ব

ভোক্তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হওয়ার এবং অপরাধবিরোধী অভিযানে মন্থরগতির কারণ জানতে চাইলে অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ এর জন্য পর্যাপ্ত জনবলের অভাবকেই দায়ী করে। গণমাধ্যমকে অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ বলেছে, সংস্থাটির জন্য ৩৬৬ পদের মঞ্জুরি রয়েছে। এর বিপরীতে সারা দেশে জনবল আছে ১৮২। অর্থাৎ সংস্থাটিতে অর্ধেক পদই শূন্য রয়েছে। মাঠপর্যায়ে অভিযান পরিচালনার জন্য আছে মাত্র ১০৮ জন। ঢাকায় আড়াই কোটি মানুষের জন্য সংস্থার কমকর্তা রয়েছেন মাত্র পাঁচজন। পর্যাপ্ত জনবল দেওয়া হলে সংস্থাটিকে অবশ্যই কার্যকর করা সম্ভব বলে কর্তৃপক্ষ মনে করে।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভোক্তার অধিকার রক্ষার জন্য যে আইনটি বলবৎ আছে, তা বর্তমান পরিস্থিতিতে অনুপযোগী। সময়োপযোগী একটি আইন করা প্রয়োজন। ভোক্তা অধিকার আইন সংশোধন করে একটি খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের পর সেটি সংসদে যাবে অনুমোদনের জন্য। সংশোধিত আইন পাশ হলে কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়বে, অসাধু ব্যক্তিদের শাস্তির আওতাও বাড়বে। ২০০৯ সালে যখন আইনটি প্রণয়ন করা হয়, সে সময়ে ই-কমার্স বা অনলাইনে কেনাবেচার প্রচলন তেমন ছিল না, তাই এ খাতের অপরাধ সম্পর্কে আইনে কিছু বলা নেই। প্রস্তাবিত নতুন আইনে অনলাইন কেনাকাটায় অপরাধের বিষয়টি সংযোজিত হয়েছে। নতুন আইন হলে সংস্থার কর্মকাণ্ড বেগবান হবে বলে কর্তৃপক্ষ মনে করে।

সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যমান আইন ভোক্তা অধিকারবিষয়ক অপরাধ দমনে যথেষ্ট নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত অধিদপ্তরের ক্রোড়পত্রে দেখা যায়, ১৯ ধরনের অপরাধের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড অথবা একই সঙ্গে উভয় দণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে। কারাদণ্ডের মেয়াদ এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে। আর অর্থদণ্ড বা জরিমানা ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত করা যাবে। কর্তৃপক্ষ বলেছে, অধিদপ্তর ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ৬২ হাজারের বেশি অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে অপরাধীদের কাছ থেকে ১০৮ কোটি টাকার বেশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে। জরিমানা ছাড়াও অপরাধীকে জেলে পাঠানোর বিধান আইনে থাকলেও তা করা হয়নি।

অপরাধী জেলে যায় না কেন

অভিযান চালিয়ে অপরাধীকে হাতেনাতে ধরা এবং শাস্তির আওতায় আনা হয়। শাস্তি দেওয়া হয় শুধু অর্থদণ্ড বা জরিমানা। আইনে বিধান থাকলেও এখন পর্যন্ত কাউকেও জেলে পাঠানো হয়নি। কেন কারাদণ্ড দেওয়া হয়নি-এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তারা অভিযোগ করেন, বিদ্যমান আইন যথেষ্ট নয়। যুগোপযোগী আইন অর্থাৎ আরও শক্ত আইন তারা চান। অথচ বিদ্যমান আইনটাই তো তারা প্রয়োগ করেন না। হয়তো অপরাধীরা প্রভাবশালী বা ক্ষমতাশালী, এ কারণেই জেলে পাঠানো হয় না। এটা অবশ্য অনুমান মাত্র, না হলে নমনীয় মনোভাবের আর কী কারণ থাকতে পারে?

কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, ঢাকা মহানগরীতে আড়াই কোটি মানুষের জন্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা রয়েছেন পাঁচজন। এ সংখ্যা খুবই নগণ্য সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে একটি পরামর্শ দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সারা দেশে অধিদপ্তরের শতাধিক কর্মকর্তা রয়েছেন। ঢাকা শহর বিরাট এলাকা। এখানে জনসংখ্যা বেশি, ব্যবসা-বাণিজ্যও বেশি, ভোক্তাও বেশি। ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘিত হয় ঢাকাতেই বেশি। ঢাকার বাইরে কর্মরত শতাধিক কর্মকর্তাকে যদি সাময়িকভাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাজধানীতে আনা হয় এবং তাদের নেতৃত্বে নগরীর সর্বত্র যুগপৎ অভিযান পরিচালনা করা হয়, তাহলে নিশ্চয়ই ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। এই যুগপৎ অভিযান থেকেই সরকার অনুধাবন করতে পারবে জনবল কতটা বাড়ানো প্রয়োজন।

সমন্বয়ের অভাব

ভোক্তার অধিকার রক্ষায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি আরও কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটশন (বিএসটিআই), নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। এসব সংস্থা তাদের নিজস্ব আইন ও বিধি অনুযায়ী কাজ করে। সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সবকটি সংস্থা যদি সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করত, তাহলে ভোক্তাদের কোনো সমস্যা থাকত না। ভোক্তা অধিকার সুরক্ষিত থাকত। সমন্বয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক সরকার, কারণ সব সংস্থাই সরকারের অধীনে।

ভোক্তা কারা? যারা খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপণ্য ক্রয় করেন এবং পরিবহণ, হাসপাতাল, সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সার্ভিস বা সেবা গ্রহণ করেন, তারা সবাই ভোক্তা। সে হিসাবে দেশের প্রত্যেক মানুষ, ধনী বা গরিব, সবাই ভোক্তার দলে। ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষা আর জনগণের স্বার্থরক্ষা একই কথা। ভোক্তাদের যদি স্বস্তিতে রাখা যায়, তাহলে দেশও শান্তিতে থাকবে।

কোনো ভোক্তাই স্বস্তিতে নেই

কিন্তু নির্মম সত্য হলো, দেশের কোনো ভোক্তাই স্বস্তিতে নেই। দ্রব্যমূল্যের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মধ্যস্বত্বভোগী-ফড়িয়া-পাইকারি-খুচরা বিক্রেতা সবাই একযোগে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে অসহায় ভোক্তাদের বিরুদ্ধে।

ভোক্তাদের বাঁচাবে কে? তাদের পক্ষে তো কেউ নেই। সরকারের মাথাব্যথা নেই, সরকারি দল গদি রক্ষায় ব্যস্ত। বিরোধী দলের একমাত্র কাজ সরকারি দলের বিরুদ্ধে কথা বলা, ভোক্তাদের দুর্ভোগের গুরুত্ব তাদের কাছে নগণ্য। এ অবস্থায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যদি সক্রিয় থাকত, তাহলেও কিছুটা কাজ হতো। কিন্তু তারাও নীরব।

এ মুহূর্তে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরকে সক্রিয় করা, সংস্থাকে পর্যাপ্ত জনবল দেওয়া, বিদ্যমান আইনকে সময়োপযোগী ও কঠোর করা প্রয়োজন। সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে, সংস্থাটি যেন সারা বছর দেশের সর্বত্র সক্রিয় থেকে ভোক্তাদের অধিকার সত্যিকার অর্থেই সংরক্ষণ করে। তাহলে যদি অসহায় ভোক্তারা কিছুটা স্বস্তি পান।

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

basharbd@gmail.com

আশেপাশে চারপাশে

ভোক্তারা একটু স্বস্তি চান

 চপল বাশার 
২১ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষ যাতে ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য এবং সহজেই সব ধরনের সেবা পেতে পারেন, সেজন্য সরকার ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংস্থাটি গঠিত হয় ১৩ বছর আগে, ২০১০ সালে। সংস্থাটি প্রতি বছর বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করে সাড়ম্বরে। এ বছর দিবসটি পালিত হয়েছে গত ১৫ মার্চ।

অধিদপ্তর সীমিত আকারে দিবস পালন করলেও গণমাধ্যমে প্রচার-প্রোপাগান্ডা কম করেনি। জাতীয় দৈনিকে পূর্ণপৃষ্ঠা ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে, যেখানে স্থান পেয়েছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনদের বাণী। ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত ‘ভোক্তা অধিকার ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক বিশাল নিবন্ধে অধিদপ্তরের পরিচিতি, গঠন-কাঠামো, কার্যক্রম এবং ভোক্তা অধিকারবিরোধী অপরাধ ও দণ্ড সম্পর্কিত বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু ১৩ বছরে অধিদপ্তর কী কাজ করেছে, কতজনকে দণ্ড দিয়েছে, কী তাদের সাফল্য তার উল্লেখ পাওয়া গেল না। সাফল্যের উল্লেখ ও বিবরণ না থাকলে কী করে বোঝা যাবে যে অধিদপ্তরের গঠন সার্থক হয়েছে, এটি কার্যকর অবদান রাখছে?

বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা যাদের ভোক্তা বলি, তাদের খুব সামান্যসংখ্যকই ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ সম্পর্কে জানেন। অধিদপ্তরের মূল কার্যক্রম তথা অপরাধবিরোধী অভিযান দৃশ্যমান ও ফলপ্রসূ হলে ভোক্তারা বুঝতে পারতেন তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য সরকারের একটি সংস্থা তৎপর রয়েছে। তাহলে ভোক্তারাও অধিদপ্তরের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। অসাধু ব্যবসায়ীরাও নিজেদের স্বার্থেই অপরাধ করতে সাহস পেত না।

আইন অনুযায়ী প্রতারিত ভোক্তারা অধিদপ্তরের কাছে সংশ্লিষ্ট অপরাধী তথা বিক্রেতা, দোকানদার, ব্যবসায়ী বা সেবা প্রদানকারীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগ করা হলেও সেগুলোর নিষ্পত্তি হয় খুব কম। অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে ই-কমার্স খাতে অনিয়ম-অস্থিরতা গত চার বছরে হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতের ভুক্তভোগীরা অধিদপ্তরে ধরনা দিচ্ছেন লিখিত অভিযোগ নিয়ে। মূলত ই-কমার্সে বা অনলাইনে কেনাকাটায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরাই গত অর্থবছরে অধিদপ্তরে ২৫ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে মাত্র তিন হাজার অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে, বাকি ২২ হাজার পড়ে আছে।

অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বিলম্ব

ভোক্তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হওয়ার এবং অপরাধবিরোধী অভিযানে মন্থরগতির কারণ জানতে চাইলে অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ এর জন্য পর্যাপ্ত জনবলের অভাবকেই দায়ী করে। গণমাধ্যমকে অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ বলেছে, সংস্থাটির জন্য ৩৬৬ পদের মঞ্জুরি রয়েছে। এর বিপরীতে সারা দেশে জনবল আছে ১৮২। অর্থাৎ সংস্থাটিতে অর্ধেক পদই শূন্য রয়েছে। মাঠপর্যায়ে অভিযান পরিচালনার জন্য আছে মাত্র ১০৮ জন। ঢাকায় আড়াই কোটি মানুষের জন্য সংস্থার কমকর্তা রয়েছেন মাত্র পাঁচজন। পর্যাপ্ত জনবল দেওয়া হলে সংস্থাটিকে অবশ্যই কার্যকর করা সম্ভব বলে কর্তৃপক্ষ মনে করে।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভোক্তার অধিকার রক্ষার জন্য যে আইনটি বলবৎ আছে, তা বর্তমান পরিস্থিতিতে অনুপযোগী। সময়োপযোগী একটি আইন করা প্রয়োজন। ভোক্তা অধিকার আইন সংশোধন করে একটি খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের পর সেটি সংসদে যাবে অনুমোদনের জন্য। সংশোধিত আইন পাশ হলে কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়বে, অসাধু ব্যক্তিদের শাস্তির আওতাও বাড়বে। ২০০৯ সালে যখন আইনটি প্রণয়ন করা হয়, সে সময়ে ই-কমার্স বা অনলাইনে কেনাবেচার প্রচলন তেমন ছিল না, তাই এ খাতের অপরাধ সম্পর্কে আইনে কিছু বলা নেই। প্রস্তাবিত নতুন আইনে অনলাইন কেনাকাটায় অপরাধের বিষয়টি সংযোজিত হয়েছে। নতুন আইন হলে সংস্থার কর্মকাণ্ড বেগবান হবে বলে কর্তৃপক্ষ মনে করে।

সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যমান আইন ভোক্তা অধিকারবিষয়ক অপরাধ দমনে যথেষ্ট নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত অধিদপ্তরের ক্রোড়পত্রে দেখা যায়, ১৯ ধরনের অপরাধের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড অথবা একই সঙ্গে উভয় দণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে। কারাদণ্ডের মেয়াদ এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে। আর অর্থদণ্ড বা জরিমানা ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত করা যাবে। কর্তৃপক্ষ বলেছে, অধিদপ্তর ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ৬২ হাজারের বেশি অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে অপরাধীদের কাছ থেকে ১০৮ কোটি টাকার বেশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে। জরিমানা ছাড়াও অপরাধীকে জেলে পাঠানোর বিধান আইনে থাকলেও তা করা হয়নি।

অপরাধী জেলে যায় না কেন

অভিযান চালিয়ে অপরাধীকে হাতেনাতে ধরা এবং শাস্তির আওতায় আনা হয়। শাস্তি দেওয়া হয় শুধু অর্থদণ্ড বা জরিমানা। আইনে বিধান থাকলেও এখন পর্যন্ত কাউকেও জেলে পাঠানো হয়নি। কেন কারাদণ্ড দেওয়া হয়নি-এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তারা অভিযোগ করেন, বিদ্যমান আইন যথেষ্ট নয়। যুগোপযোগী আইন অর্থাৎ আরও শক্ত আইন তারা চান। অথচ বিদ্যমান আইনটাই তো তারা প্রয়োগ করেন না। হয়তো অপরাধীরা প্রভাবশালী বা ক্ষমতাশালী, এ কারণেই জেলে পাঠানো হয় না। এটা অবশ্য অনুমান মাত্র, না হলে নমনীয় মনোভাবের আর কী কারণ থাকতে পারে?

কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, ঢাকা মহানগরীতে আড়াই কোটি মানুষের জন্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা রয়েছেন পাঁচজন। এ সংখ্যা খুবই নগণ্য সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে একটি পরামর্শ দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সারা দেশে অধিদপ্তরের শতাধিক কর্মকর্তা রয়েছেন। ঢাকা শহর বিরাট এলাকা। এখানে জনসংখ্যা বেশি, ব্যবসা-বাণিজ্যও বেশি, ভোক্তাও বেশি। ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘিত হয় ঢাকাতেই বেশি। ঢাকার বাইরে কর্মরত শতাধিক কর্মকর্তাকে যদি সাময়িকভাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাজধানীতে আনা হয় এবং তাদের নেতৃত্বে নগরীর সর্বত্র যুগপৎ অভিযান পরিচালনা করা হয়, তাহলে নিশ্চয়ই ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। এই যুগপৎ অভিযান থেকেই সরকার অনুধাবন করতে পারবে জনবল কতটা বাড়ানো প্রয়োজন।

সমন্বয়ের অভাব

ভোক্তার অধিকার রক্ষায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি আরও কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটশন (বিএসটিআই), নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। এসব সংস্থা তাদের নিজস্ব আইন ও বিধি অনুযায়ী কাজ করে। সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সবকটি সংস্থা যদি সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করত, তাহলে ভোক্তাদের কোনো সমস্যা থাকত না। ভোক্তা অধিকার সুরক্ষিত থাকত। সমন্বয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক সরকার, কারণ সব সংস্থাই সরকারের অধীনে।

ভোক্তা কারা? যারা খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপণ্য ক্রয় করেন এবং পরিবহণ, হাসপাতাল, সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সার্ভিস বা সেবা গ্রহণ করেন, তারা সবাই ভোক্তা। সে হিসাবে দেশের প্রত্যেক মানুষ, ধনী বা গরিব, সবাই ভোক্তার দলে। ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষা আর জনগণের স্বার্থরক্ষা একই কথা। ভোক্তাদের যদি স্বস্তিতে রাখা যায়, তাহলে দেশও শান্তিতে থাকবে।

কোনো ভোক্তাই স্বস্তিতে নেই

কিন্তু নির্মম সত্য হলো, দেশের কোনো ভোক্তাই স্বস্তিতে নেই। দ্রব্যমূল্যের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মধ্যস্বত্বভোগী-ফড়িয়া-পাইকারি-খুচরা বিক্রেতা সবাই একযোগে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে অসহায় ভোক্তাদের বিরুদ্ধে।

ভোক্তাদের বাঁচাবে কে? তাদের পক্ষে তো কেউ নেই। সরকারের মাথাব্যথা নেই, সরকারি দল গদি রক্ষায় ব্যস্ত। বিরোধী দলের একমাত্র কাজ সরকারি দলের বিরুদ্ধে কথা বলা, ভোক্তাদের দুর্ভোগের গুরুত্ব তাদের কাছে নগণ্য। এ অবস্থায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যদি সক্রিয় থাকত, তাহলেও কিছুটা কাজ হতো। কিন্তু তারাও নীরব।

এ মুহূর্তে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরকে সক্রিয় করা, সংস্থাকে পর্যাপ্ত জনবল দেওয়া, বিদ্যমান আইনকে সময়োপযোগী ও কঠোর করা প্রয়োজন। সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে, সংস্থাটি যেন সারা বছর দেশের সর্বত্র সক্রিয় থেকে ভোক্তাদের অধিকার সত্যিকার অর্থেই সংরক্ষণ করে। তাহলে যদি অসহায় ভোক্তারা কিছুটা স্বস্তি পান।

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

basharbd@gmail.com

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন