দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্য বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতটুকু
jugantor
স্বদেশ ভাবনা
দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্য বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতটুকু

  আবদুল লতিফ মন্ডল  

২২ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

২০২১-২০৪১ মেয়াদকালীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় যে দুটি প্রধান ‘স্বপ্ন’ প্রাধান্য পেয়েছে, এর একটি হলো ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যেখানে দারিদ্র্য হবে সুদূর অতীতের ঘটনা। অন্যটি হলো বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যেখানে বর্তমান মূল্যে মাথাপিছু আয় হবে ১২,৫০০ মার্কিন ডলার।

প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ বাস্তবায়নের প্রথম হাতিয়ার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ২০২০-জুন ২০২৫)। ২০২১-২০৪১ মেয়াদের প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার যে লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে, তা বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দারিদ্র্যহার ও চরম দারিদ্র্যহার হ্রাসের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

বলা হয়েছে, এ পরিকল্পনা মেয়াদে দারিদ্র্য ১৫.৬ এবং চরম দারিদ্র্য ৭.৪ শতাংশে নেমে আসবে। ২০২০ ও ২০২১ সালে কোভিড-১৯-এর অভিঘাতে শিল্প ও সেবা খাতে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও মজুরি হ্রাস; ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাব; ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্যপণ্য, সার, শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির মূল্যবৃদ্ধি; জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয়বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির উচ্চহার প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন অনেকটা বিপর্যস্ত, তখন দারিদ্র্যহার হ্রাসে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতটুকু, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

দেশে এ মুহূর্তে দারিদ্র্যহার কত তা সরকারিভাবে জানানো হচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১৬ সালের হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যহার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থমন্ত্রীর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের একটানা এক যুগের বেশি শাসনামলের অর্জন নিয়ে একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘দারিদ্র্যের হার ৪১.৫ থেকে কমে ২০.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।’ অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় ব্যবহৃত এ তথ্য পুরোনো।

এ তথ্য করোনাভাইরাসের প্রকোপের আগের। এর সত্যতা মেলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এতে বলা হয়েছে, ‘২০১৯ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশে নেমেছে বলে হিসাব করা হয়।’ এদিকে দেশের কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান/সংস্থা, যেমন-সিপিডি, পিপিআরসি, বিজিডির মতে, করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান/সংস্থাগুলোর গবেষণার ফলাফলে প্রাপ্ত দারিদ্র্যহারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও করোনাকালীন তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে সরকার এখন পর্যন্ত জনগণকে জানায়নি দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যহার কত।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দারিদ্র্য নিরসন কৌশলের প্রধান প্রধান উপাদানের মধ্যে রয়েছে-এক. জিডিপিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হার অর্জন : অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রক্ষেপিত গড় প্রবৃদ্ধিহার প্রতিবছর ৮ শতাংশ। এ প্রবৃদ্ধি হার অর্জনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। দুই. কোভিড-১৯-এর অভিঘাতে সৃষ্ট দারিদ্র্য থেকে ঘুরে দাঁড়ানোকে সর্বোচ্চ ও তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকার প্রদান : এতে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো কোভিড-১৯-এর কারণে বেকার হয়ে পড়াদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা; তাদের স্বল্প খরচে ঋণ সুবিধার মাধ্যমে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প পুনরুদ্ধারে সহায়তা করা; সরকার ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের গতিশীল বাস্তবায়নে অনানুষ্ঠানিক খাতকে রক্ষা করা। তিন. প্রবৃদ্ধি ও কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে কর্মসৃজন : এ উপাদানে যেসব বিষয়ের জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো-গ্রামাঞ্চলে অকৃষি খাতে কর্মসৃজনের মাধ্যমে দরিদ্র কৃষকদের আয় বৃদ্ধি; ব্যাংক অর্থায়নে উত্তম অভিগম্যতা এবং প্রযুক্তি; প্রশিক্ষণ, বাজারজাতকরণ এবং মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতকে শক্তিশালীকরণ। চার. দারিদ্র্যকেন্দ্রিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ শক্তিশালীকরণ: অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে দারিদ্র্যকেন্দ্রিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ উন্নয়নের ওপর জোর এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে দরিদ্রদের অভিগম্যতার উন্নতি বিধানে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাঁচ. বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা (বিডিপি) ২১০০-এর বাস্তবায়ন : একুশ শতকব্যাপী বাস্তবায়িতব্য বিডিপি-২১০০ একটি দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত ও সামষ্টিক পরিকল্পনা, যা জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খাদ্য ও পানি নিরাপত্তা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হলো বিডিপি-২১০০ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ। ছয়. বৈদেশিক অভিবাসন থেকে কর্মসৃজন ও আয় উপার্জন ত্বরান্বিতকরণ : এ লক্ষ্য অর্জনে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-১. বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি রপ্তানি করতে বর্তমান ও নতুন সম্ভাব্য শ্রমঘাটতির দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে সরকারি প্রচেষ্টা শক্তিশালী করা; ২. প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সম্ভাব্য অভিবাসীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা; ৩. অভিবাসনের খরচ কমানোর উপায় বের করা; ৪. অভিবাসনের খরচ বহন করতে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে এককালীন ঋণের সুবিধা প্রদান করা; ৫. ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে রেমিটেন্সের বিনিময় হার হ্রাসকৃত বাজার হারের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক করা; ৬. অভিবাসী কর্মীদের ভালো ব্যাংকিং সেবা প্রদান নিশ্চিত করা। ৭. সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার প্রবর্তন : দেশে দরিদ্র ও চরম দরিদ্ররা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। তাই একধরনের স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচি পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে শুরুর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ৮. জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের বাস্তবায়নকে শক্তিশালীকরণ : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসের একটি উপায় হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত। এ কর্মসূচিকে অধিকতর কার্যকর করতে এতে জিডিপির অংশ বৃদ্ধি করা। ৯. উন্নয়নের আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসন : দেশে দারিদ্র্যের তীব্রতা যে জেলা ও উপজেলা ভিত্তিতে আলাদা, তা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। কিছু কিছু দরিদ্র জেলা ও উপজেলা দীর্ঘমেয়াদে দারিদ্র্য ও বঞ্চনার শিকার। বিভিন্ন নীতিগত ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে উন্নয়নের আঞ্চলিক ভারসাম্য বজায়ে জোর দেওয়া হয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রায় তিন বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। আর আছে দুই বছর। এদিকে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, ঋণ সংকট, নিত্যপণ্যের চড়া দাম, মানবসৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি এবং সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে আগামী দুই বছরে বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ পাঁচটি ঝুঁকি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সাম্প্রতিকতম ‘গ্লোবাল রিস্কস রিপোর্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, দারিদ্র্য নিরসনে চিহ্নিত কৌশলগুলোর সর্বাগ্রে রয়েছে জিডিপিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধিহার অর্জন এবং এ হার গড়ে প্রতিবছর ৮ শতাংশ। সরকারি হিসাবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৯৪ শতাংশ (বাজেট বক্তৃতা ২০২২-২৩)। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) ৬.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বিশ্বব্যাংকের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬.১ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়, দারিদ্র্য নিরসনে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে যে উচ্চহারে গড়ে প্রতিবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধিহার অর্জনের (আট শতাংশ) প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নেই।

কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকারত্বের হার হ্রাসের ওপর যে জোর দেওরা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। Labour Force Survey ২০১৬-১৭তে দেশে শ্রমশক্তির চূড়ামণি যুব বেকারত্ব হারের উল্লেখ ছিল মোট শ্রমশক্তির ১০.৬ শতাংশ। এ হার বেড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। আইএলওর তথ্যের বরাত দিয়ে গত ৬ জানুয়ারি একটি দৈনিকের (কালবেলা) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে তরুণ বেকারের সংখ্যা ৭ কোটি ৩৫ লাখ। অর্থনীতির সংজ্ঞামতে, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসের একটি উপায় হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত হলেও দেশে এ কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসে কাক্সিক্ষত সাফল্য বয়ে আনতে পারছে না। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-অর্থ বরাদ্দের স্বল্পতা, উপকারভোগী নির্বাচনে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।

উন্নয়নে আঞ্চলিক ভারসাম্য আনার তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চল বা বিভাগ রংপুরে দারিদ্র্যহার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্যান্য দরিদ্র অঞ্চল যেমন বরিশাল ও রাজশাহীর অবস্থারও কোনো উন্নতি নেই।

কোভিড-১৯-এর অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে অনিশ্চয়তার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা, দেশে ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং টাকার মানের অবমূল্যায়ন, মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে দারিদ্র্য হ্রাসের নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুবই কম। তবে আমাদের চেষ্টা থাকুক নির্ধারিত লক্ষ্যের যতটা সম্ভব কাছাকাছি যাওয়া।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

স্বদেশ ভাবনা

দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্য বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতটুকু

 আবদুল লতিফ মন্ডল 
২২ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

২০২১-২০৪১ মেয়াদকালীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় যে দুটি প্রধান ‘স্বপ্ন’ প্রাধান্য পেয়েছে, এর একটি হলো ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যেখানে দারিদ্র্য হবে সুদূর অতীতের ঘটনা। অন্যটি হলো বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যেখানে বর্তমান মূল্যে মাথাপিছু আয় হবে ১২,৫০০ মার্কিন ডলার।

প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ বাস্তবায়নের প্রথম হাতিয়ার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ২০২০-জুন ২০২৫)। ২০২১-২০৪১ মেয়াদের প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার যে লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে, তা বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দারিদ্র্যহার ও চরম দারিদ্র্যহার হ্রাসের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

বলা হয়েছে, এ পরিকল্পনা মেয়াদে দারিদ্র্য ১৫.৬ এবং চরম দারিদ্র্য ৭.৪ শতাংশে নেমে আসবে। ২০২০ ও ২০২১ সালে কোভিড-১৯-এর অভিঘাতে শিল্প ও সেবা খাতে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও মজুরি হ্রাস; ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাব; ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্যপণ্য, সার, শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির মূল্যবৃদ্ধি; জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয়বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির উচ্চহার প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন অনেকটা বিপর্যস্ত, তখন দারিদ্র্যহার হ্রাসে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতটুকু, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

দেশে এ মুহূর্তে দারিদ্র্যহার কত তা সরকারিভাবে জানানো হচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১৬ সালের হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যহার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থমন্ত্রীর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের একটানা এক যুগের বেশি শাসনামলের অর্জন নিয়ে একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘দারিদ্র্যের হার ৪১.৫ থেকে কমে ২০.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।’ অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় ব্যবহৃত এ তথ্য পুরোনো।

এ তথ্য করোনাভাইরাসের প্রকোপের আগের। এর সত্যতা মেলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এতে বলা হয়েছে, ‘২০১৯ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশে নেমেছে বলে হিসাব করা হয়।’ এদিকে দেশের কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান/সংস্থা, যেমন-সিপিডি, পিপিআরসি, বিজিডির মতে, করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান/সংস্থাগুলোর গবেষণার ফলাফলে প্রাপ্ত দারিদ্র্যহারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও করোনাকালীন তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে সরকার এখন পর্যন্ত জনগণকে জানায়নি দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যহার কত।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দারিদ্র্য নিরসন কৌশলের প্রধান প্রধান উপাদানের মধ্যে রয়েছে-এক. জিডিপিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হার অর্জন : অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রক্ষেপিত গড় প্রবৃদ্ধিহার প্রতিবছর ৮ শতাংশ। এ প্রবৃদ্ধি হার অর্জনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। দুই. কোভিড-১৯-এর অভিঘাতে সৃষ্ট দারিদ্র্য থেকে ঘুরে দাঁড়ানোকে সর্বোচ্চ ও তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকার প্রদান : এতে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো কোভিড-১৯-এর কারণে বেকার হয়ে পড়াদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা; তাদের স্বল্প খরচে ঋণ সুবিধার মাধ্যমে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প পুনরুদ্ধারে সহায়তা করা; সরকার ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের গতিশীল বাস্তবায়নে অনানুষ্ঠানিক খাতকে রক্ষা করা। তিন. প্রবৃদ্ধি ও কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে কর্মসৃজন : এ উপাদানে যেসব বিষয়ের জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো-গ্রামাঞ্চলে অকৃষি খাতে কর্মসৃজনের মাধ্যমে দরিদ্র কৃষকদের আয় বৃদ্ধি; ব্যাংক অর্থায়নে উত্তম অভিগম্যতা এবং প্রযুক্তি; প্রশিক্ষণ, বাজারজাতকরণ এবং মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতকে শক্তিশালীকরণ। চার. দারিদ্র্যকেন্দ্রিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ শক্তিশালীকরণ: অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে দারিদ্র্যকেন্দ্রিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ উন্নয়নের ওপর জোর এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে দরিদ্রদের অভিগম্যতার উন্নতি বিধানে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাঁচ. বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা (বিডিপি) ২১০০-এর বাস্তবায়ন : একুশ শতকব্যাপী বাস্তবায়িতব্য বিডিপি-২১০০ একটি দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত ও সামষ্টিক পরিকল্পনা, যা জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খাদ্য ও পানি নিরাপত্তা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হলো বিডিপি-২১০০ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ। ছয়. বৈদেশিক অভিবাসন থেকে কর্মসৃজন ও আয় উপার্জন ত্বরান্বিতকরণ : এ লক্ষ্য অর্জনে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-১. বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি রপ্তানি করতে বর্তমান ও নতুন সম্ভাব্য শ্রমঘাটতির দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে সরকারি প্রচেষ্টা শক্তিশালী করা; ২. প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সম্ভাব্য অভিবাসীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা; ৩. অভিবাসনের খরচ কমানোর উপায় বের করা; ৪. অভিবাসনের খরচ বহন করতে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে এককালীন ঋণের সুবিধা প্রদান করা; ৫. ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে রেমিটেন্সের বিনিময় হার হ্রাসকৃত বাজার হারের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক করা; ৬. অভিবাসী কর্মীদের ভালো ব্যাংকিং সেবা প্রদান নিশ্চিত করা। ৭. সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার প্রবর্তন : দেশে দরিদ্র ও চরম দরিদ্ররা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। তাই একধরনের স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচি পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে শুরুর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ৮. জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের বাস্তবায়নকে শক্তিশালীকরণ : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসের একটি উপায় হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত। এ কর্মসূচিকে অধিকতর কার্যকর করতে এতে জিডিপির অংশ বৃদ্ধি করা। ৯. উন্নয়নের আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসন : দেশে দারিদ্র্যের তীব্রতা যে জেলা ও উপজেলা ভিত্তিতে আলাদা, তা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। কিছু কিছু দরিদ্র জেলা ও উপজেলা দীর্ঘমেয়াদে দারিদ্র্য ও বঞ্চনার শিকার। বিভিন্ন নীতিগত ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে উন্নয়নের আঞ্চলিক ভারসাম্য বজায়ে জোর দেওয়া হয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রায় তিন বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। আর আছে দুই বছর। এদিকে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, ঋণ সংকট, নিত্যপণ্যের চড়া দাম, মানবসৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি এবং সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে আগামী দুই বছরে বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ পাঁচটি ঝুঁকি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সাম্প্রতিকতম ‘গ্লোবাল রিস্কস রিপোর্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, দারিদ্র্য নিরসনে চিহ্নিত কৌশলগুলোর সর্বাগ্রে রয়েছে জিডিপিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধিহার অর্জন এবং এ হার গড়ে প্রতিবছর ৮ শতাংশ। সরকারি হিসাবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৯৪ শতাংশ (বাজেট বক্তৃতা ২০২২-২৩)। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) ৬.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বিশ্বব্যাংকের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬.১ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়, দারিদ্র্য নিরসনে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে যে উচ্চহারে গড়ে প্রতিবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধিহার অর্জনের (আট শতাংশ) প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নেই।

কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকারত্বের হার হ্রাসের ওপর যে জোর দেওরা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। Labour Force Survey ২০১৬-১৭তে দেশে শ্রমশক্তির চূড়ামণি যুব বেকারত্ব হারের উল্লেখ ছিল মোট শ্রমশক্তির ১০.৬ শতাংশ। এ হার বেড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। আইএলওর তথ্যের বরাত দিয়ে গত ৬ জানুয়ারি একটি দৈনিকের (কালবেলা) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে তরুণ বেকারের সংখ্যা ৭ কোটি ৩৫ লাখ। অর্থনীতির সংজ্ঞামতে, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসের একটি উপায় হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত হলেও দেশে এ কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসে কাক্সিক্ষত সাফল্য বয়ে আনতে পারছে না। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-অর্থ বরাদ্দের স্বল্পতা, উপকারভোগী নির্বাচনে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।

উন্নয়নে আঞ্চলিক ভারসাম্য আনার তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চল বা বিভাগ রংপুরে দারিদ্র্যহার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্যান্য দরিদ্র অঞ্চল যেমন বরিশাল ও রাজশাহীর অবস্থারও কোনো উন্নতি নেই।

কোভিড-১৯-এর অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে অনিশ্চয়তার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা, দেশে ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং টাকার মানের অবমূল্যায়ন, মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে দারিদ্র্য হ্রাসের নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুবই কম। তবে আমাদের চেষ্টা থাকুক নির্ধারিত লক্ষ্যের যতটা সম্ভব কাছাকাছি যাওয়া।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন