মেট্রোরেল ও সাংস্কৃতিক বলয়
গত বছর ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেল চালুর মধ্য দিয়ে যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে। বছরটি ছিল সাংস্কৃতিক জগতের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ ওই বছর পূর্ণ হয় ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার সত্তর বছর। উত্তরা থেকে মতিঝিল মোট ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ শুরু হয়েছে উত্তরা আবাসিক এলাকা থেকে, শেষ হয়েছে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় পৌঁছে। ১৬টি স্টেশনের মধ্যে উত্তরায় রয়েছে তিনটি, মিরপুরে পাঁচটি এবং শের-এ-বাংলা নগরে দুটি স্টেশন।
ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজারসহ সবকটি উপশহর ও নগরই ঢাকা উত্তরের অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো পরিকল্পিত হয়েছিল ষাটের দশকে। তারপরই শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয় ও মতিঝিল-এ চারটি স্টেশন ঢাকা দক্ষিণের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে শাহবাগ থেকে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত তিনটি স্টেশন মিলে তৈরি হয়েছে এমন একটি বলয়, যাকে ঠিক আবাসিক এলাকা বা বাণিজ্যিক এলাকা বলা যায় না, বলতে হয় সাংস্কৃতিক বলয়। সাংস্কৃতিক বলয় এ জন্য যে, বঙ্গভঙ্গের পর এখানেই স্থাপিত হয় একে একে সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।
স্টেশন তিনটির অবস্থান ঢাকার সবচেয়ে সবুজ ও ব্যস্ত এলাকার ঠিক মাঝখানে। সবচেয়ে সবুজ এজন্য যে, এখানেই রমনা গ্রিনের অবস্থান; সবচেয়ে ব্যস্ত এজন্য যে, এখানেই পুরোনো ও নতুন ঢাকার সংযোগস্থল। নদী মোড় নেয় যেভাবে জলস্রোতের প্রাবল্যের কারণে, মেট্রোরেল এখানে এসে সেভাবে মোড় নিয়েছে জনস্রোতের কারণে। নদীর বাঁকের জন্য বাংলাদেশ পৃথিবী বিখ্যাত; মেট্রোরেলও এখানে এসে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করে হয়ে উঠেছে বিশিষ্ট। একইসঙ্গে স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে, যেভাবে গঙ্গা স্বর্গ থেকে অবতরণ করে এলোকেশে চলে আসে অনাহুত অনার্যের ঘরে। সত্যেন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বিস্ময়ে বিহ্বল-চিত্ত ভগীরথ ভগ্ন-মনোরথ/বৃথা বাজাইল শঙ্খ, নিলে বেছে তুমি নিজ পথ।’
সংস্কৃতির যেসব প্রধান ভিত্তির কথা আমরা কল্পনা করতে পারি, এর সবই রয়েছে তার চলার পথের দুই পাশে। নদীর উভয় পাশে যেমন লোকালয়, মেট্রোরেলের উভয় পাশে তেমনি এসব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থান। প্রথম পর্যায়েই রয়েছে জাতীয় জাদুঘর, গণগ্রন্থাগার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে রয়েছে এমন কতগুলো প্রতিষ্ঠান, যেগুলো প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পুরান ঢাকায়। ষাটের দশকের পর থেকে স্থানান্তরিত হতে শুরু করে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে। ঢাকা জাদুঘর প্রথম স্থাপিত হয় ১৯১৩ সালের ২০ মার্চ, পুরোনো সেক্রেটারিয়েট ভবনে। ১৯৮৩ সালে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে শাহবাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় একই ভবনে ১৯২১ সালে, ষাটের দশকে স্থানান্তরিত হয়ে আসে নীলক্ষেত এলাকায়। তবে বলয়ের একেবারে মধ্যস্থলে আদি ও অকৃত্রিম প্রতীকের মতো দাঁড়িয়ে আছে বাংলা একাডেমি, যেটি নির্মিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গের পর অতিথিশালা হিসাবে। ব্রিটিশ শাসন পরিষদের তিন সদস্যের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বর্ধমানের মহারাজা স্যার বিজয় চাঁদ মাহতাব ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে কিছুকাল এ ভবনে অবস্থান করেন বলে এর নামকরণ করা হয় বর্ধমান হাউজ। বঙ্গভঙ্গের সময় লর্ড কার্জনের নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয় কার্জন হল। মহারাজা মাহতাব ১৯০৩ সালে গথিক শৈলীতে ‘কার্জন হল গেট’ নির্মাণ করেন বর্ধমানে। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী ঢাকায় যখন নির্মিত হয় টাউন হল (১৯০৪-১৯০৮)-তারও নামকরণ করা হয় কার্জন হল। একই চৌহদ্দিতে প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি দেশভাগের পর, নায়েবে নাজিমদের বাসস্থান নিমতলীতে।
এতদিন আমাদের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন। ষাটের দশকে পুরান ঢাকার সঙ্গে নতুন ঢাকার সংযোগ সাধিত হতো ঘোড়ার গাড়ি বা রিকশার মাধ্যমে। এর ষাট বছর পর দুই ঢাকা যুক্ত হলো বিদ্যুৎচালিত সর্বাধুনিক মেট্রোরেলের মাধ্যমে। পুরান ঢাকা ছিল ঘোড়ার গাড়ি অধ্যুষিত মোগল আমলের শহর; কোনো টাউন সার্ভিস না থাকায় এটি আজও একান্তই মধ্যযুগীয় যোগাযোগব্যবস্থার অধীন। মেট্রোরেল এসে সব ছিন্নসূত্র জোড়া লাগিয়ে পুরান ও নতুন ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে গাঁথল এক সুতায়। এখন বলয়ের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আসা দরকার একই ছাতার নিচে। ঢাকা শুধু অপরিকল্পিত কংক্রিটের জঞ্জালই নয়, অপরিকল্পিত সাংস্কৃতিক স্থাপনারও শহর। জাতীয় নাট্যমঞ্চ তৈরি করা হয়েছে বিআরটিসি বাস ডিপোর কাছে আর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের কাছে। না আছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সঙ্গে বাংলা একাডেমির সম্পর্ক, না আছে এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে জাতীয় আর্কাইভের সম্পর্ক। একে তুলনা করা যায় ব্রিটিশ আমলের পঙ্গু রেল যোগাযোগব্যবস্থার সঙ্গে-যেখানে ছিল না ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ এবং কলকাতার সঙ্গে ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ। নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন্য এখন দরকার সমন্বিত ভারসাম্যপূর্ণ কতগুলো উদ্যোগের বাস্তবায়ন।
এক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যার মধ্যে অন্যতম : ১. সাংস্কৃতিক বলয় কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষ বলয়ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের পরিধি ও শৃঙ্খলার সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে এবং দিকনির্দেশনা দেবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্থাপন করবে সংযোগ করিডোর। ২. প্রধান বলয়ের পশ্চাদ্ভূমিতে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত জগন্নাথ হল, শহিদ মিনার, পুরোনো কলা ভবন ও এশিয়াটিক সোসাইটি। এর মধ্যে জগন্নাথ হলে পুনরুজ্জীবন করা দরকার হবে ১৯৫২ সালের প্রাদেশিক পরিষদের পার্লামেন্ট-যেখানে বসবে বলয়ের অধিভুক্ত প্রতিটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের বাছাই করা প্রতিনিধি ও সদস্যদের নিয়ে লেখক-শিল্পীদের অধিবেশন। ৩. ঢাকা জাদুঘর সত্তর বছর (১৯১৩-১৯৮৩) পর স্থানান্তরিত হয়ে আসে শাহবাগে। এশিয়াটিক সোসাইটি সত্তর বছর (১৯৫২-২০২২) পূর্ণ করার পর এখন স্থানান্তরিত হয়ে আসতে পারে বলয়ের ভেতরে। ৪. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, চামেলি হাউজে (একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত) আসতে পারে এশিয়াটিক সোসাইটি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। ৫. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সিরডাপ ভবন স্থানান্তর করা যেতে পারে কূটনৈতিক এনক্লেভ বা পূর্বাচলে। ৬. শিল্পকলা একাডেমি থেকে মিন্টো রোড পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বলয়ের পরিধি বিস্তৃত করা যেতে পারে-যেখানে আদিতে স্থাপিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা। ৭. বিভাগীয় শহরগুলোয় সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করতে হবে, এরও রূপরেখা তৈরি ও তত্ত্বাবধান করবে সাংস্কৃতিক কর্তৃপক্ষ।
ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, মিরপুর কলেজ, ঢাকা
mahmoodnasirjahangiri@gmail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
মেট্রোরেল ও সাংস্কৃতিক বলয়
গত বছর ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেল চালুর মধ্য দিয়ে যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে। বছরটি ছিল সাংস্কৃতিক জগতের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ ওই বছর পূর্ণ হয় ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার সত্তর বছর। উত্তরা থেকে মতিঝিল মোট ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ শুরু হয়েছে উত্তরা আবাসিক এলাকা থেকে, শেষ হয়েছে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় পৌঁছে। ১৬টি স্টেশনের মধ্যে উত্তরায় রয়েছে তিনটি, মিরপুরে পাঁচটি এবং শের-এ-বাংলা নগরে দুটি স্টেশন।
ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজারসহ সবকটি উপশহর ও নগরই ঢাকা উত্তরের অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো পরিকল্পিত হয়েছিল ষাটের দশকে। তারপরই শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয় ও মতিঝিল-এ চারটি স্টেশন ঢাকা দক্ষিণের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে শাহবাগ থেকে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত তিনটি স্টেশন মিলে তৈরি হয়েছে এমন একটি বলয়, যাকে ঠিক আবাসিক এলাকা বা বাণিজ্যিক এলাকা বলা যায় না, বলতে হয় সাংস্কৃতিক বলয়। সাংস্কৃতিক বলয় এ জন্য যে, বঙ্গভঙ্গের পর এখানেই স্থাপিত হয় একে একে সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।
স্টেশন তিনটির অবস্থান ঢাকার সবচেয়ে সবুজ ও ব্যস্ত এলাকার ঠিক মাঝখানে। সবচেয়ে সবুজ এজন্য যে, এখানেই রমনা গ্রিনের অবস্থান; সবচেয়ে ব্যস্ত এজন্য যে, এখানেই পুরোনো ও নতুন ঢাকার সংযোগস্থল। নদী মোড় নেয় যেভাবে জলস্রোতের প্রাবল্যের কারণে, মেট্রোরেল এখানে এসে সেভাবে মোড় নিয়েছে জনস্রোতের কারণে। নদীর বাঁকের জন্য বাংলাদেশ পৃথিবী বিখ্যাত; মেট্রোরেলও এখানে এসে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করে হয়ে উঠেছে বিশিষ্ট। একইসঙ্গে স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে, যেভাবে গঙ্গা স্বর্গ থেকে অবতরণ করে এলোকেশে চলে আসে অনাহুত অনার্যের ঘরে। সত্যেন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বিস্ময়ে বিহ্বল-চিত্ত ভগীরথ ভগ্ন-মনোরথ/বৃথা বাজাইল শঙ্খ, নিলে বেছে তুমি নিজ পথ।’
সংস্কৃতির যেসব প্রধান ভিত্তির কথা আমরা কল্পনা করতে পারি, এর সবই রয়েছে তার চলার পথের দুই পাশে। নদীর উভয় পাশে যেমন লোকালয়, মেট্রোরেলের উভয় পাশে তেমনি এসব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থান। প্রথম পর্যায়েই রয়েছে জাতীয় জাদুঘর, গণগ্রন্থাগার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে রয়েছে এমন কতগুলো প্রতিষ্ঠান, যেগুলো প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পুরান ঢাকায়। ষাটের দশকের পর থেকে স্থানান্তরিত হতে শুরু করে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে। ঢাকা জাদুঘর প্রথম স্থাপিত হয় ১৯১৩ সালের ২০ মার্চ, পুরোনো সেক্রেটারিয়েট ভবনে। ১৯৮৩ সালে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে শাহবাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় একই ভবনে ১৯২১ সালে, ষাটের দশকে স্থানান্তরিত হয়ে আসে নীলক্ষেত এলাকায়। তবে বলয়ের একেবারে মধ্যস্থলে আদি ও অকৃত্রিম প্রতীকের মতো দাঁড়িয়ে আছে বাংলা একাডেমি, যেটি নির্মিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গের পর অতিথিশালা হিসাবে। ব্রিটিশ শাসন পরিষদের তিন সদস্যের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বর্ধমানের মহারাজা স্যার বিজয় চাঁদ মাহতাব ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে কিছুকাল এ ভবনে অবস্থান করেন বলে এর নামকরণ করা হয় বর্ধমান হাউজ। বঙ্গভঙ্গের সময় লর্ড কার্জনের নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয় কার্জন হল। মহারাজা মাহতাব ১৯০৩ সালে গথিক শৈলীতে ‘কার্জন হল গেট’ নির্মাণ করেন বর্ধমানে। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী ঢাকায় যখন নির্মিত হয় টাউন হল (১৯০৪-১৯০৮)-তারও নামকরণ করা হয় কার্জন হল। একই চৌহদ্দিতে প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি দেশভাগের পর, নায়েবে নাজিমদের বাসস্থান নিমতলীতে।
এতদিন আমাদের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন। ষাটের দশকে পুরান ঢাকার সঙ্গে নতুন ঢাকার সংযোগ সাধিত হতো ঘোড়ার গাড়ি বা রিকশার মাধ্যমে। এর ষাট বছর পর দুই ঢাকা যুক্ত হলো বিদ্যুৎচালিত সর্বাধুনিক মেট্রোরেলের মাধ্যমে। পুরান ঢাকা ছিল ঘোড়ার গাড়ি অধ্যুষিত মোগল আমলের শহর; কোনো টাউন সার্ভিস না থাকায় এটি আজও একান্তই মধ্যযুগীয় যোগাযোগব্যবস্থার অধীন। মেট্রোরেল এসে সব ছিন্নসূত্র জোড়া লাগিয়ে পুরান ও নতুন ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে গাঁথল এক সুতায়। এখন বলয়ের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আসা দরকার একই ছাতার নিচে। ঢাকা শুধু অপরিকল্পিত কংক্রিটের জঞ্জালই নয়, অপরিকল্পিত সাংস্কৃতিক স্থাপনারও শহর। জাতীয় নাট্যমঞ্চ তৈরি করা হয়েছে বিআরটিসি বাস ডিপোর কাছে আর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের কাছে। না আছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সঙ্গে বাংলা একাডেমির সম্পর্ক, না আছে এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে জাতীয় আর্কাইভের সম্পর্ক। একে তুলনা করা যায় ব্রিটিশ আমলের পঙ্গু রেল যোগাযোগব্যবস্থার সঙ্গে-যেখানে ছিল না ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ এবং কলকাতার সঙ্গে ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ। নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন্য এখন দরকার সমন্বিত ভারসাম্যপূর্ণ কতগুলো উদ্যোগের বাস্তবায়ন।
এক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যার মধ্যে অন্যতম : ১. সাংস্কৃতিক বলয় কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষ বলয়ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের পরিধি ও শৃঙ্খলার সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে এবং দিকনির্দেশনা দেবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্থাপন করবে সংযোগ করিডোর। ২. প্রধান বলয়ের পশ্চাদ্ভূমিতে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত জগন্নাথ হল, শহিদ মিনার, পুরোনো কলা ভবন ও এশিয়াটিক সোসাইটি। এর মধ্যে জগন্নাথ হলে পুনরুজ্জীবন করা দরকার হবে ১৯৫২ সালের প্রাদেশিক পরিষদের পার্লামেন্ট-যেখানে বসবে বলয়ের অধিভুক্ত প্রতিটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের বাছাই করা প্রতিনিধি ও সদস্যদের নিয়ে লেখক-শিল্পীদের অধিবেশন। ৩. ঢাকা জাদুঘর সত্তর বছর (১৯১৩-১৯৮৩) পর স্থানান্তরিত হয়ে আসে শাহবাগে। এশিয়াটিক সোসাইটি সত্তর বছর (১৯৫২-২০২২) পূর্ণ করার পর এখন স্থানান্তরিত হয়ে আসতে পারে বলয়ের ভেতরে। ৪. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, চামেলি হাউজে (একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত) আসতে পারে এশিয়াটিক সোসাইটি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। ৫. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সিরডাপ ভবন স্থানান্তর করা যেতে পারে কূটনৈতিক এনক্লেভ বা পূর্বাচলে। ৬. শিল্পকলা একাডেমি থেকে মিন্টো রোড পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বলয়ের পরিধি বিস্তৃত করা যেতে পারে-যেখানে আদিতে স্থাপিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা। ৭. বিভাগীয় শহরগুলোয় সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করতে হবে, এরও রূপরেখা তৈরি ও তত্ত্বাবধান করবে সাংস্কৃতিক কর্তৃপক্ষ।
ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, মিরপুর কলেজ, ঢাকা
mahmoodnasirjahangiri@gmail.com