নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

এসব কি মন্দার লক্ষণ নয়?

 ড. আর এম দেবনাথ 
২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

আজ শনিবার, চৈত্র মাস মানে বসন্তকালের শেষ মাসের ১১ তারিখ। এদিকে শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। সামনে পবিত্র ঈদ-আমাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। মাঝে ১৪ এপ্রিল বাঙালির শুভ নববর্ষ। এ উপলক্ষ্যেও জমে ওঠে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য। উত্তরবঙ্গের ঢাকাস্থ রিকশাওয়ালারা দিন গুনছে কবে তারা ‘দেশে’ ফিরে যাবে। সামনে বোরো ফসল তোলার মৌসুম। বোরো আমাদের সবচেয়ে বড় ফসল এখন। এ উপলক্ষ্যে সারা দেশে কৃষি শ্রমিকদের কদর বাড়ে।

এখন উত্তরবঙ্গসহ সারা দেশেই কর্মসংস্থান ক্ষেত্রে মন্দা যাচ্ছে। বৈশাখের শুরুতেই রিকশাওয়ালা ও শ্রমজীবী মানুষ কিছু রোজগারের টাকা নিয়ে গ্রামে যাবে। গ্রামে টাকার খরার এই দিনে কিছুটা হলেও ‘ক্যাশ’ যাবে। এ প্রেক্ষাপটেই এবারের পবিত্র রমজান এবং পহেলা বৈশাখ। কেমন হবে বেচাকেনা, কেমন জমবে বাজার?

গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত কি স্বচ্ছন্দে বাজারে যেতে পারবে? ব্যবসায়ী ও দোকানদার, আমদানিকারক এবং পণ্যের সিন্ডিকেটওয়ালারা কি এই পবিত্র মাসে রোজাদারদের একটু স্বস্তি দেবে? নানা প্রশ্ন মনে। এর উত্তর বরাবরের মতো এবারও আমার কাছে নেই। তবে এর মধ্যেও আজকের আলোচনা শুরু করতে পারি দুটি উদাহরণ দিয়ে।

উদাহরণ দুটির মধ্যে একটি বিদেশের এবং একটি দেশের। খুবই আশাপ্রদ দুটো খবর। রোজাদারদের জন্য স্বস্তির খবর। বিদেশের বড় খবরটি হচ্ছে আমিরাতের। শিরোনাম : ‘রমজানে আমিরাতে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড়, রোজার আগেই আবর দেশগুলোতে শুরু হয়ে যায় মূল্য ছাড়ের ছড়াছড়ি। সেই ধারাবাহিকতা এবারও অব্যাহত আছে।’ খালিজ টাইমসের খবরটিতে দেখা যায়, রোজার আগেই ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে হাইপার মার্কেট ও সুপার মার্কেটগুলো।

১০ হাজারের বেশি খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ছাড় পাচ্ছেন আমিরাতের বাসিন্দারা। আমিরাতজুড়ে ৯৭টি আউটলেটে রমজান উপলক্ষ্যে বিশাল মূল্যছাড় দিচ্ছে হাইপার মার্কেটস নামের প্রতিষ্ঠানটি। তারা জানিয়েছে-মুদি, খাদ্যপণ্য, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ইলেকট্রনিকস, গৃহসজ্জাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত পণ্যের ওপর, ৬০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় পাবেন ক্রেতারা। একে তারা ‘প্রাইস লক’ নাম দিয়েছেন। প্রশ্ন, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা কি এমন কিছু অতীতে করেছেন কিংবা এবার করছেন? আমার জানামতে কখনো না, এবারও নয়।

তবে এর মধ্যে একটি ছোট্ট খবরে মনে কিছু আশা জাগে। আশা জাগে, বড় ব্যবসায়ীরা না হোক, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ মূল্যছাড় এবার দিচ্ছেন। কোথায়? খবরটি কিশোরগঞ্জের। এর শিরোনাম : ‘কিশোরগঞ্জে রমজান মাসে ১০ টাকা লিটার দুধ বিক্রির ঘোষণা’। এই ঘোষণা দিয়েছেন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের গরুর খামার মালিক এরশাদ উদ্দিন। ১০ টাকা লিটারে তিনি দুই মেট্রিক টন দুধ বিক্রি করবেন।

এ ব্যবসায়ী মূল্যছাড়ের বিষয়ে কোত্থেকে উৎসাহিত হয়েছেন? উৎসাহিত হয়েছেন সৌদি আরবের উদাহরণ থেকে। সেখানে হজ করতে গিয়ে তিনি তা দেখে এসেছেন। এর থেকেই তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। সাধুবাদ এ খামারিকে। তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আরও কেউ করেছেন কিনা আমার জানা নেই, অন্তত কোনো খবরে তা দেখিনি। করে থাকলে তাদেরও সাধুবাদ। কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা তো এ ধরনের উদ্যোগে আসেননি। বরং তাদেরকে সরকার ও প্রশাসন অনুরোধ জানাচ্ছে রমজান মাসে মূল্যবৃদ্ধি না করতে। প্রশাসন আবার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে।

একটি খবরে দেখলাম পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে বলা হয়েছে : ‘রমজানে পণ্যের দাম বাড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।’ এদিকে আমাদের বড় ব্যবসায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ব্যবসায়ীদের ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তার খবরের শিরোনাম হচ্ছে : ‘বড় শিল্প গ্রুপগুলোকে রমজানে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রিতে এগিয়ে আসার আহ্বান’। তাহলে কী দাঁড়াল? আরব বিশ্বের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া দূরের কথা, কিশোরগঞ্জের সামান্য দুধের খামারওয়ালার কাছ থেকেও আমাদের বড় ব্যবসায়ীরা কোনো শিক্ষা নিলেন না। শিক্ষা যা নিয়েছেন তা বরং উলটো।

খবরের কাগজে দেখলাম সরকার ভোগ্যপণ্যের চট্টগ্রামভিত্তিক সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। বলা হয়েছে, ‘দেশের বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি প্রশাসন।’ চট্টগ্রাম থেকে প্রেরিত যুগান্তরের এ খবরটিতে ‘রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা’ প্রকাশ করা হচ্ছে।

দেখা যাচ্ছে, সিন্ডিকেট রমজান মাস আসার আগেই সব ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে তাদের একটা ফন্দি প্রকাশ পাচ্ছে। রমজানে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে এ অভিযোগ করা যাবে না। চাল, চিনি, সয়াবিন, ছোলা, মটর, খেজুর ইত্যাদির দাম তারা আগেই বাড়িয়ে রেখেছেন। এখন দুই-এক টাকা কেজিতে কমিয়ে সরকারকে ‘বুঝ’ দেওয়া যাবে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। এই হচ্ছে আমাদের বাজারের পরিস্থিতি।

অথচ এবারের পবিত্র রমজান এসেছে, পহেলা বৈশাখ আসছে কঠিন এক সময়ে। পণ্যমূল্য আকাশছোঁয়া। এরই মধ্যে একটা খবর পেলাম। নোটিশ দেওয়া হয়েছে তিতাস গ্যাস থেকে যার যার গ্যাসবিলের কাগজ জমা দিতে। বসবে মিটার। তার মানে মিটারভিত্তিক গ্যাস চার্জ হবে। এতে আশঙ্কা-বাসাবাড়ির গ্যাসের দামও বুঝি বাড়বে, তাই নয় কি? এমন সময়ে এসব করা হচ্ছে, যখন পণ্য কেনার সামর্থ্য হারিয়েছে মানুষ। গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত তাদের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমিয়েছে। চাল বাদে সব পণ্য কেনা তাদের দিন দিন কমছে। যে কিনত তিন কেজি চিনি, সে কিনছে দুই কেজি। যে কিনত দুই লিটার সয়াবিন তেল, সে কিনছে এক লিটার। দুধের ভোগও কমিয়েছে তারা। সবজি, মাছ-মাংস কেনাও কমিয়েছে। যেখানেই সম্ভব, সেখানে তারা ভোগ কমিয়েছে। বিদেশি ফল কেনা বেশ কমেছে।

পরিস্থিতি অনেকটা মন্দার মতো। একটি কাগজের খবরের শিরোনাম হচ্ছে : ‘কেনার সাধ্য কম, রোজার পণ্যের চাহিদায় ভাটা, রোজার পণ্য আমদানি গত বছরে তুলনায় কম। খেজুর ছাড়া ছোলা মটর, মসুর ডাল ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়তির দিকে’। তার মানে হচ্ছে, পণ্যের মূল্য এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে মানুষ আর তা ক্রয় করতে পারছে না। মানুষ কম কিনছে, কম খাচ্ছে, কম ভোগ করছে। একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জানুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ সময়ের মধ্যে মসুর ও সয়াবিন বাদে ছোলা, মটর, খেজুর, পাম অয়েল ও চিনির আমদানি কমেছে। এ তথ্যে বোঝা যাচ্ছে, মানুষের যেহেতু ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, তাই তারা ভোগ কমিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করছে। এটা অর্থনৈতিক মন্দা নয়তো কী? দাম বাড়তির দিকে, ক্রয়ক্ষমতা কম, বেকারত্ব, কর্মহীনতা ইত্যাদি মন্দারই লক্ষণ নয় কি?

অর্থনীতির এ অবস্থার মধ্যে একটা আশার আলো হচ্ছে, সরকার বিশেষ কার্ডে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করবে বাজারে। আরও এক কোটি গরিব মানুষকে ১৫ টাকা কেজিতে চাল দেবে। বিনামূল্যে ৩০ কেজি করে চালও দেবে। এসব গরিবদের জন্য। সরকার এই দায়িত্ব পালন করছে অনেক দিন ধরেই। এ ছাড়া টিসিবির খোলাবাজারি বেচাকেনা চালু আছে। ন্যায্যমূল্যে টিসিবি সময় সময় নানা ভোগ্যপণ্য বিক্রি করেছে।

বলা বাহুল্য, এসব হচ্ছে জরুরি পদক্ষেপ। মানুষকে বাঁচানোর জন্য। প্রান্তিক মানুষের এ ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। কিন্তু প্রশ্ন, মধ্যবিত্তের কী হবে? মধ্যবিত্ত ছেড়ে দিলাম, সরকারের নানাবিধ পদক্ষেপ সত্ত্বেও মাঠপর্যায়ে অবস্থা কী? তা বোঝার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘কেয়ারের’ একটি জরিপের আশ্রয় নিতে পারি। তারা জরিপ করেছে দেশের উত্তর ও হাওড় অঞ্চলের আটটি জেলায়।

এ জরিপে দেখা গেছে, ৮২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে পারছে না। খাদ্যবহির্ভূত খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে ৭২ শতাংশ মানুষ। জরিপে আরও দেখা গেছে, আয় কমে ব্যয় বেড়ে যাওয়া মানুষ গবাদি পশু বিক্রি করছেন। এনজিওর কাছ থেকে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ এবং মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নেওয়ার পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এ সম্পর্কে তারা জরিপে প্রচুর তথ্য/পরিসংখ্যান দিয়েছে। আরও বলা হচ্ছে, টিসিবি থেকে খাদ্য কেনার মানুষের সংখ্যা দেড় শতাংশ থেকে ২০ দশমিক ৪ শতাংশে পৌঁছেছে। বোঝা যাচ্ছে, গরিবের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তও টিবিসির লাইনে দাঁড়াচ্ছে। এসবই টিকে থাকার চেষ্টা, সংগ্রাম।

নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের অবস্থা কী, তা বোঝার জন্য দু-একটি ঘটনা এখানে বলা যায়। গত সপ্তাহে একটি ব্যাংকে গিয়েছিলাম, আমন্ত্রণ পেয়ে। সেখানে অনেক কথা। লোকে তুলছে বেশি, জমা দিচ্ছে কম। ফলে ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাতের অবনমন ঘটছে। এ ঋণ-আমানতের অনুপাত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী থাকার কথা ৮৩ শতাংশ। কিন্তু অনেক ব্যাংকের এই অনুপাত অনেক বেশি। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মের বাইরে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর উপায় নেই। ঋণ দিতে হচ্ছে। ঋণের চাহিদা টাকার অঙ্কে বেড়েছে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে। অথচ সেভাবে আমানত বাড়ছে না।

এ কারণে ঋণ-আমানত অনুপাত ৯০-৯৫ শতাংশে পৌঁছেছে কারও কারও ক্ষেত্রে। এটা মারাত্মক প্রবণতা। এ কারণে ‘কলমানি মার্কেটে’ সুদের হার বেড়ে ৮-৯ শতাংশে ঠেকছে প্রায় প্রতিদিন। এসব খবর দিতে দিতে ম্যানেজার বলছিলেন, ‘লোনের’ টাকা আদায় হচ্ছে না। গৃহনির্মাণ ঋণ ইত্যাদির গ্রাহকরা কিস্তির টাকা দিতে পারছেন না। তাদের কাতর আর্তি-সংসার চলছে না, কিস্তি দেব কোত্থেকে। এসব লোন ‘ওভারডিউ’ হচ্ছে, দুদিন পরে তা খেলাপি ঋণে পরিণত হবে। ম্যানেজার এসব নিয়ে খুবই চিন্তাগ্রস্ত। একদিকে রিকভারির জন্য প্রধান কার্যালয়ের চাপ, অন্যদিকে গ্রাহকদের কিস্তি পরিশোধে অপারগতা। এটা ইচ্ছাকৃত খেলাপির ঘটনা নয়। মধ্যবিত্ত যে ঋণ নিয়েছে, তা পরিশোধের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।

ম্যানেজারের এসব কথার সত্যতা মেলে একটি খবর থেকে। একটি কাগজে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম হচ্ছে : ‘মূল্যস্ফীতিতে সঞ্চয় কমছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর; তিন মাসে ব্যাংকগুলোর আমানত কমেছে চার হাজার ২৯৪ কোটি টাকা’। বলা হচ্ছে, রেমিট্যান্সের টাকাও সব তুলে ফেলা হচ্ছে। আগে তা হতো না। অথচ এটা হওয়ার কথা নয়। আমানত কম-বেশি সবসময়ই বাড়ে। কমে না। কিন্তু এখন তা শুরু হয়েছে। বলা বাহুল্য, এ পরিস্থিতির মধ্যেই এসেছে রোজা, আসছে পহেলা বৈশাখ। বাজারের হাল কী হবে?

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন