সড়কে চলাফেরার আতঙ্ক দূর হোক
মিঠে কড়া সংলাপ
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
২৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যেভাবে গণমৃত্যু শুরু হয়েছে এবং সেসব মৃত্যুর সারি সারি লাশের দৃশ্য দেখে দেশের মানুষ যেভাবে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন, তাতে সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করা আর মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে! কারণ সড়কপথে চলাচলরত বাস, ট্রাক, টেম্পো, অটো ইত্যাদি যেকোনো যানবাহনই এ দেশের মানুষের জীবনের জন্য আদৌ নিরাপদ নয়। আর এজন্য সরকারি সংস্থা বিআরটিএ, পরিবহণ শ্রমিক সংগঠন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সবাই সমভাবে দায়ী।
কারণ এ ক্ষেত্রে বেপরোয়া বাস-ট্রাকচালকরা সরাসরি দোষী বা দায়ী হলেও এসব বাস-ট্রাকচালকের লাইসেন্স প্রদানকারী এবং যানবাহনগুলোর ফিটনেস প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ হিসাবে বিআরটিএ নামক সরকারি প্রতিষ্ঠানটি যেমন দায়ী; তেমনি পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন কর্তৃক দোষী পরিবহণ শ্রমিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক যথাযথ দায়িত্ব-কর্তব্য পালন না করার কারণে তারাও দায়ী।
তাছাড়া বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের আমাদের দেশে যানবাহন চলাচলের উপযুক্ত রাস্তা সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে বলেও মনে হয় না। সারা দেশে কত কিলোমিটার পাকা রাস্তা এবং সেসব রাস্তায় কত সংখ্যক বাস-ট্রাক চলাচল করা সম্ভব, সে সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা থাকলে অফিস কক্ষে বসে দিনরাত তারা বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের অগণিত যানবাহন চলাচলের অনুমতি প্রদান করে দেশের সীমিত রাস্তাঘাট-হাইওয়েকে ব্যবহার অনুপোযোগী করাসহ মৃত্যুফাঁদে পরিণত করতেন না। এ অবস্থায় এসব ক্ষেত্রে তারা যে অন্ধ, সে কথাটি বলাই বাহুল্য।
উপরন্তু রাস্তায় চলাচল অযোগ্য বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক যানবাহনের ফিটনেস প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ হিসাবে তারা যা করে চলেছেন, সেসব কারণেও সড়ক দুর্ঘটনার নামে মানুষের জীবনহানি ঘটে চলেছে! কারণ ব্রেক, টায়ার, গিয়ার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ নষ্ট বা খারাপ-এমন যানবাহনও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ফিটনেস সনদ পেয়ে যায়! আর এভাবে বিআরটিএ কর্তৃক ফিটনেসবিহীন যানবাহনকে রাস্তায় চলাচলের অনুমতি প্রদান করায় সারা দেশের রাস্তাঘাট; বিশেষ করে হাইওয়েগুলো জনসাধারণের জীবনের জন্য অনিরাপদ এবং খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন নামক সংগঠনটিও সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী। কারণ যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই তারা তাদের সংগঠনের সদস্য হিসাবে সংশ্লিষ্ট বাস-ট্রাকের চালককে রক্ষা করতে উঠেপড়ে লেগে যান এবং এ ক্ষেত্রে কোনো বাস-ট্রাকচালক শত দোষে দোষী হলেও তাদের বাঁচানোই তাদের মুখ্য ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায়। ফলস্বরূপ পরিবহণ শ্রমিক নেতাদের চেষ্টা-তদবিরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দোষী পরিবহণ চালকরা শাস্তি না পাওয়ায় পরবর্তী সময়ে তারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সুতরাং এ কথাটি নিঃসন্দেহে বলা যায়, পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনও বেপরোয়া গাড়িচালকদের অন্ধ সমর্থক হওয়ায় হাইওয়েতে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।
এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সারা দেশের রাস্তাঘাট, হাইওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন এবং এ লক্ষ্যে পুলিশ বাহিনীতে সর্বশেষ হাইওয়ে পুলিশের সংযোজন ঘটানো হয়েছে। কিন্তু এ পুলিশ বাহিনী এবং হাইওয়ে পুলিশ এ ক্ষেত্রে কতটা সার্থক, সে কথাটি আমরা সবাই জানি; বরং পুলিশকে ‘ফুলিশ’ বানিয়ে রাস্তাঘাটে যত্রতত্র বাস দাঁড় করিয়ে যানজট সৃষ্টি করা, হাইওয়েতে পর্যন্ত একটির পাশে আরও কয়েকটি বাস এলোমেলোভাবে দাঁড় করিয়ে হাইওয়ে আটকে রাখা পরিবহণ শ্রমিকদের জন্য এখন একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর যারা রাস্তা বা হাইওয়েতে চলাফেরা করেন, তাদের সবাই এসব দৃশ্য দেখে প্রমাদ গুনলেও বছরের পর বছর ধরে এসব ঘটনার প্রতিকার করার কেউ নেই; পুলিশ বাহিনীকে এক্ষেত্রে সাক্ষী গোপাল বলেই মন হয়!
আর এসব কারণেই আমাদের দেশের পরিবহণ শ্রমিকরা অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারীভাবে রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে থাকেন; বিশেষ করে হাইওয়েতে তারা অবাধ রাজত্ব কায়েম করে নিজেদের খেয়াল খুশিমতো যত বেশি স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছেন, যেখানে সেখানে ওভারটেকিং করতে দ্রুতগতিতে বিপরীত লাইনে/উলটোপথে ঢুকে পড়ে, অপর দিক থেকে আগত ছোটখাটো গাড়িকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছেন, বাস-ট্রাকে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটিয়ে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটাচ্ছেন। অথচ তাদের এসব খামখেয়ালি বা উন্মত্ততাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
পরিবহণ শ্রমিক নেতারা কোমর বেঁধে মাঠে নেমে অঘটন ঘটন পটীয়সী গাড়িচালকদের রক্ষা করে চলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মুখে হাত দিয়ে বসে আছেন, বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ নীরবতা পালন করছেন; অন্যদিকে দেশের মানুষ এসবের মাশুল গুণে চলেছেন। আর এসব ঘটনার সর্বশেষ বড় উদাহরণ হলো, মাদারীপুরে একটি বাসের রাস্তার রেলিং উড়িয়ে খাদে নেমে পড়ার ঘটনায় অকুস্থলেই ১৯ জনের প্রাণহানি।
এ ঘটনায় সে মুহূর্তে বিপরীত দিক থেকে আসা কোনো যানবাহন থাকলে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে দুটি যানবাহন মিলে আরও অধিকসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারত। কারণ দুর্ঘটনাকবলিত বাসটির চালক অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বেপরোয়া এবং নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাসটি চালিয়ে উন্মত্ত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে হয়তো দেখা যেত, হয় তিনি মাদকাসক্ত অথবা মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিলেন।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এসব মানসিক বিকারগ্রস্ত গাড়িচালকের হাতে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হলেও এবং প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেলেও এ শ্রেণির বাস-ট্রাকচালকের হাত থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। আর কী কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না, সে কথাটিও আমাদের সবারই জানা। লেখাটির শেষাংশে তাই কোনো রাখঢাক না করেই সমস্যাটির প্রতিকারের দিকে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই-প্রথমেই বিআরটিএ, পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং বাস-ট্রাক মালিকদের লোভ-লালসা সংযত করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে লোভ-লালসা বলতে আর্থিক লোভ-লালসার কথাটিই বলা হচ্ছে। বিআরটিএ’র সব পর্যায় থেকে যদি কঠিন শপথ গ্রহণের মাধ্যমে ঘুস বাণিজ্য বন্ধ করে ফিটনেসবিহীন যানবাহনকে রাস্তায় নামতে না দেওয়া হয়, অযোগ্য ব্যক্তির হাতে লাইসেন্স তুলে না দেওয়া হয়, তাহলে সড়ক-মহাসড়কে অবশ্যই দুর্ঘটনা কমে আসবে। পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনগুলো চাঁদা তোলা বন্ধ করে চাঁদাবাজির টাকায় পকেট ভারী না করলে বা না করতে পারলে সমিতির নেতাদের অপরাধী গাড়িচালকদের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা কমে যাবে। এতে পরিবহণ শ্রমিকরা রাস্তাঘাটে যা খুশি তাই করার শক্তি ও সাহস হারিয়ে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে গাড়ি চালাতে বাধ্য হবেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ যদি ব্যক্তিস্বার্থে পরিবহণ শ্রমিকদের পকেটে না ঢুকে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে সড়ক-মহাসড়কে পরিবহণ শ্রমিকরা সংযত হতে বাধ্য হবেন। বাস-ট্রাক মালিকরা যদি অতি মুনাফার বশবর্তী হয়ে বাসে অধিক যাত্রী, ট্রাকে অতিরিক্ত মালামাল পরিবহণে পরিবহণ শ্রমিকদের বাধ্য না করেন, অতিরিক্ত ট্রিপ মারতে বাধ্য না করেন, তাহলে সেসব ক্ষেত্রেও সড়ক ও জনপথ পরিবহণ ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনবে এবং সড়ক দুর্ঘটনা বহুলাংশে কমে আসবে।
সবশেষে বলতে চাই, বিআরটিএ নামক সরকারি প্রতিষ্ঠানটিকে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি। সনাতনী বা পুরোনো সিস্টেমে এ সংস্থাটি পরিচালিত হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না। বর্তমান অবস্থায় বিআরটিএ’র এক একটি অফিসে মৌচাকের মতো ভিড় এটাই প্রমাণ করে যে, সেখানে মধু আছে এবং সরকারি-বেসরকারি বহু লোকই সেই মধু আহরণে ব্যস্ত! এ অবস্থায় এ প্রতিষ্ঠানে পোস্টিং পেতেও লাইন লেগে থাকে। আর ঊর্ধ্বতন সরকারি ব্যক্তিরাও এ প্রতিষ্ঠানে নিজেদের লোকদের প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে থাকেন। কারণ এ প্রতিষ্ঠানের চাকরিও একটি লোভনীয় চাকরি হিসাবে পরিগণিত। এ কার্যালয়টি দালালদের আখড়া হিসাবেও পরিচিত।
এ অফিস থেকে কাজ পেতে হলে দালাল ধরতে হয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এ দপ্তরটিকেও নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি কাজ বলেই বিবেচিত হওয়া উচিত। প্রয়োজনে বর্তমান মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করেও দপ্তরটি ঢেলে সাজানো যেতে পারে। কথাটি বলার কারণ হলো, সংস্থাটি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন বা দেশের মানুষের মনে আস্থা সৃষ্টি-কোনোটিই আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে করে উঠতে পারেনি। আর দেশের মানুষকে তাই এখনো মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়েই সড়কপথে চলাচল করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আমরা আতঙ্কমুক্ত অবস্থায় সড়ক-মহাসড়কে চলাফেরা করতে চাই।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
মিঠে কড়া সংলাপ
সড়কে চলাফেরার আতঙ্ক দূর হোক
সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যেভাবে গণমৃত্যু শুরু হয়েছে এবং সেসব মৃত্যুর সারি সারি লাশের দৃশ্য দেখে দেশের মানুষ যেভাবে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন, তাতে সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করা আর মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে! কারণ সড়কপথে চলাচলরত বাস, ট্রাক, টেম্পো, অটো ইত্যাদি যেকোনো যানবাহনই এ দেশের মানুষের জীবনের জন্য আদৌ নিরাপদ নয়। আর এজন্য সরকারি সংস্থা বিআরটিএ, পরিবহণ শ্রমিক সংগঠন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সবাই সমভাবে দায়ী।
কারণ এ ক্ষেত্রে বেপরোয়া বাস-ট্রাকচালকরা সরাসরি দোষী বা দায়ী হলেও এসব বাস-ট্রাকচালকের লাইসেন্স প্রদানকারী এবং যানবাহনগুলোর ফিটনেস প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ হিসাবে বিআরটিএ নামক সরকারি প্রতিষ্ঠানটি যেমন দায়ী; তেমনি পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন কর্তৃক দোষী পরিবহণ শ্রমিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক যথাযথ দায়িত্ব-কর্তব্য পালন না করার কারণে তারাও দায়ী।
তাছাড়া বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের আমাদের দেশে যানবাহন চলাচলের উপযুক্ত রাস্তা সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে বলেও মনে হয় না। সারা দেশে কত কিলোমিটার পাকা রাস্তা এবং সেসব রাস্তায় কত সংখ্যক বাস-ট্রাক চলাচল করা সম্ভব, সে সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা থাকলে অফিস কক্ষে বসে দিনরাত তারা বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের অগণিত যানবাহন চলাচলের অনুমতি প্রদান করে দেশের সীমিত রাস্তাঘাট-হাইওয়েকে ব্যবহার অনুপোযোগী করাসহ মৃত্যুফাঁদে পরিণত করতেন না। এ অবস্থায় এসব ক্ষেত্রে তারা যে অন্ধ, সে কথাটি বলাই বাহুল্য।
উপরন্তু রাস্তায় চলাচল অযোগ্য বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক যানবাহনের ফিটনেস প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ হিসাবে তারা যা করে চলেছেন, সেসব কারণেও সড়ক দুর্ঘটনার নামে মানুষের জীবনহানি ঘটে চলেছে! কারণ ব্রেক, টায়ার, গিয়ার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ নষ্ট বা খারাপ-এমন যানবাহনও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ফিটনেস সনদ পেয়ে যায়! আর এভাবে বিআরটিএ কর্তৃক ফিটনেসবিহীন যানবাহনকে রাস্তায় চলাচলের অনুমতি প্রদান করায় সারা দেশের রাস্তাঘাট; বিশেষ করে হাইওয়েগুলো জনসাধারণের জীবনের জন্য অনিরাপদ এবং খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন নামক সংগঠনটিও সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী। কারণ যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই তারা তাদের সংগঠনের সদস্য হিসাবে সংশ্লিষ্ট বাস-ট্রাকের চালককে রক্ষা করতে উঠেপড়ে লেগে যান এবং এ ক্ষেত্রে কোনো বাস-ট্রাকচালক শত দোষে দোষী হলেও তাদের বাঁচানোই তাদের মুখ্য ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায়। ফলস্বরূপ পরিবহণ শ্রমিক নেতাদের চেষ্টা-তদবিরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দোষী পরিবহণ চালকরা শাস্তি না পাওয়ায় পরবর্তী সময়ে তারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সুতরাং এ কথাটি নিঃসন্দেহে বলা যায়, পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনও বেপরোয়া গাড়িচালকদের অন্ধ সমর্থক হওয়ায় হাইওয়েতে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।
এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সারা দেশের রাস্তাঘাট, হাইওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন এবং এ লক্ষ্যে পুলিশ বাহিনীতে সর্বশেষ হাইওয়ে পুলিশের সংযোজন ঘটানো হয়েছে। কিন্তু এ পুলিশ বাহিনী এবং হাইওয়ে পুলিশ এ ক্ষেত্রে কতটা সার্থক, সে কথাটি আমরা সবাই জানি; বরং পুলিশকে ‘ফুলিশ’ বানিয়ে রাস্তাঘাটে যত্রতত্র বাস দাঁড় করিয়ে যানজট সৃষ্টি করা, হাইওয়েতে পর্যন্ত একটির পাশে আরও কয়েকটি বাস এলোমেলোভাবে দাঁড় করিয়ে হাইওয়ে আটকে রাখা পরিবহণ শ্রমিকদের জন্য এখন একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর যারা রাস্তা বা হাইওয়েতে চলাফেরা করেন, তাদের সবাই এসব দৃশ্য দেখে প্রমাদ গুনলেও বছরের পর বছর ধরে এসব ঘটনার প্রতিকার করার কেউ নেই; পুলিশ বাহিনীকে এক্ষেত্রে সাক্ষী গোপাল বলেই মন হয়!
আর এসব কারণেই আমাদের দেশের পরিবহণ শ্রমিকরা অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারীভাবে রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে থাকেন; বিশেষ করে হাইওয়েতে তারা অবাধ রাজত্ব কায়েম করে নিজেদের খেয়াল খুশিমতো যত বেশি স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছেন, যেখানে সেখানে ওভারটেকিং করতে দ্রুতগতিতে বিপরীত লাইনে/উলটোপথে ঢুকে পড়ে, অপর দিক থেকে আগত ছোটখাটো গাড়িকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছেন, বাস-ট্রাকে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটিয়ে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটাচ্ছেন। অথচ তাদের এসব খামখেয়ালি বা উন্মত্ততাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
পরিবহণ শ্রমিক নেতারা কোমর বেঁধে মাঠে নেমে অঘটন ঘটন পটীয়সী গাড়িচালকদের রক্ষা করে চলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মুখে হাত দিয়ে বসে আছেন, বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ নীরবতা পালন করছেন; অন্যদিকে দেশের মানুষ এসবের মাশুল গুণে চলেছেন। আর এসব ঘটনার সর্বশেষ বড় উদাহরণ হলো, মাদারীপুরে একটি বাসের রাস্তার রেলিং উড়িয়ে খাদে নেমে পড়ার ঘটনায় অকুস্থলেই ১৯ জনের প্রাণহানি।
এ ঘটনায় সে মুহূর্তে বিপরীত দিক থেকে আসা কোনো যানবাহন থাকলে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে দুটি যানবাহন মিলে আরও অধিকসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারত। কারণ দুর্ঘটনাকবলিত বাসটির চালক অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বেপরোয়া এবং নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাসটি চালিয়ে উন্মত্ত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে হয়তো দেখা যেত, হয় তিনি মাদকাসক্ত অথবা মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিলেন।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এসব মানসিক বিকারগ্রস্ত গাড়িচালকের হাতে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হলেও এবং প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেলেও এ শ্রেণির বাস-ট্রাকচালকের হাত থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। আর কী কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না, সে কথাটিও আমাদের সবারই জানা। লেখাটির শেষাংশে তাই কোনো রাখঢাক না করেই সমস্যাটির প্রতিকারের দিকে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই-প্রথমেই বিআরটিএ, পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং বাস-ট্রাক মালিকদের লোভ-লালসা সংযত করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে লোভ-লালসা বলতে আর্থিক লোভ-লালসার কথাটিই বলা হচ্ছে। বিআরটিএ’র সব পর্যায় থেকে যদি কঠিন শপথ গ্রহণের মাধ্যমে ঘুস বাণিজ্য বন্ধ করে ফিটনেসবিহীন যানবাহনকে রাস্তায় নামতে না দেওয়া হয়, অযোগ্য ব্যক্তির হাতে লাইসেন্স তুলে না দেওয়া হয়, তাহলে সড়ক-মহাসড়কে অবশ্যই দুর্ঘটনা কমে আসবে। পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনগুলো চাঁদা তোলা বন্ধ করে চাঁদাবাজির টাকায় পকেট ভারী না করলে বা না করতে পারলে সমিতির নেতাদের অপরাধী গাড়িচালকদের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা কমে যাবে। এতে পরিবহণ শ্রমিকরা রাস্তাঘাটে যা খুশি তাই করার শক্তি ও সাহস হারিয়ে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে গাড়ি চালাতে বাধ্য হবেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ যদি ব্যক্তিস্বার্থে পরিবহণ শ্রমিকদের পকেটে না ঢুকে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে সড়ক-মহাসড়কে পরিবহণ শ্রমিকরা সংযত হতে বাধ্য হবেন। বাস-ট্রাক মালিকরা যদি অতি মুনাফার বশবর্তী হয়ে বাসে অধিক যাত্রী, ট্রাকে অতিরিক্ত মালামাল পরিবহণে পরিবহণ শ্রমিকদের বাধ্য না করেন, অতিরিক্ত ট্রিপ মারতে বাধ্য না করেন, তাহলে সেসব ক্ষেত্রেও সড়ক ও জনপথ পরিবহণ ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনবে এবং সড়ক দুর্ঘটনা বহুলাংশে কমে আসবে।
সবশেষে বলতে চাই, বিআরটিএ নামক সরকারি প্রতিষ্ঠানটিকে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি। সনাতনী বা পুরোনো সিস্টেমে এ সংস্থাটি পরিচালিত হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না। বর্তমান অবস্থায় বিআরটিএ’র এক একটি অফিসে মৌচাকের মতো ভিড় এটাই প্রমাণ করে যে, সেখানে মধু আছে এবং সরকারি-বেসরকারি বহু লোকই সেই মধু আহরণে ব্যস্ত! এ অবস্থায় এ প্রতিষ্ঠানে পোস্টিং পেতেও লাইন লেগে থাকে। আর ঊর্ধ্বতন সরকারি ব্যক্তিরাও এ প্রতিষ্ঠানে নিজেদের লোকদের প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে থাকেন। কারণ এ প্রতিষ্ঠানের চাকরিও একটি লোভনীয় চাকরি হিসাবে পরিগণিত। এ কার্যালয়টি দালালদের আখড়া হিসাবেও পরিচিত।
এ অফিস থেকে কাজ পেতে হলে দালাল ধরতে হয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এ দপ্তরটিকেও নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি কাজ বলেই বিবেচিত হওয়া উচিত। প্রয়োজনে বর্তমান মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করেও দপ্তরটি ঢেলে সাজানো যেতে পারে। কথাটি বলার কারণ হলো, সংস্থাটি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন বা দেশের মানুষের মনে আস্থা সৃষ্টি-কোনোটিই আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে করে উঠতে পারেনি। আর দেশের মানুষকে তাই এখনো মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়েই সড়কপথে চলাচল করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আমরা আতঙ্কমুক্ত অবস্থায় সড়ক-মহাসড়কে চলাফেরা করতে চাই।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট