এভাবেই কি চলবে দেশের শিক্ষাঙ্গন
jugantor
এভাবেই কি চলবে দেশের শিক্ষাঙ্গন

  হাসান মামুন  

০১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

মূলত ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে শিক্ষাঙ্গন পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তৃতা দিতে গিয়ে বিদায়ি রাষ্ট্রপতিও এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন কিছুদিন আগে। স্বভাবতই কোনো ছাত্র সংগঠনের নাম না নিয়ে তিনি তখন যা বলেন, সেটা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনটির ওপরই গিয়ে বর্তায়। অবশ্য বলা যেতে পারে, পদাধিকারবলে বেশকিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য থাকাকালে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের অন্তত একাংশ যা করে চলেছে এবং তাতে শিক্ষার পরিবেশের যে গুরুতর অবনতি ঘটছে, সেক্ষেত্রে তিনি কী ভূমিকা রেখেছেন?

এসব ঘটনা তাকে পীড়িত করেছে নিশ্চয়ই? কিন্তু কখনো কোথাও এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তিনি বক্তব্য রেখেছেন বলে মনে পড়ে না। আচার্য হলেও এসব ঘটনা রোধে তার কোনো কার্যকর ক্ষমতা রয়েছে বলে অবশ্য জানা যায় না। তারপরও রাষ্ট্রপতির জোরালো বক্তব্য বা ভূমিকার একটা প্রভাব নিশ্চয়ই আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ভিসির মতো দায়িত্বশীলদের ডেকে তিনি নিশ্চয়ই জানতে চাইতে পারেন, কেন তারা অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না?

গত এক দশক বা যুগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কত যে অনাকাঙ্ক্ষিত, এমনকি নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়েছে ছাত্রলীগের বেপরোয়া নেতাকর্মীরা! এর একটারও উল্লেখ না করলেও জনগণের স্মৃতি কিন্তু তাদের সঙ্গে প্রতারণা করবে না। তবু ভালো, অন্তত বিদায়বেলায় রাষ্ট্রপতি শিক্ষাঙ্গনে দখলদারি ও তা ঘিরে অপরাধমূলক ঘটনাবলিতে উদ্বেগ জানিয়ে বললেন, এতে ছাত্ররাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধা ধরে রাখতে পারছে না মানুষ।

রাষ্ট্রপতি যেদিন ওই বক্তব্য রাখেন, তার আগের দিন এবং তার পরদিনও ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তরা কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো দুষ্কর্ম করে সংবাদ শিরোনাম হয়। এর মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায়, মনে পড়ে, উচ্চ আদালতকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। যেসব ঘটনার নিষ্পত্তি হলো কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই হতে পারে বা পারত, সেটা প্রক্টর পর্যায়েও হচ্ছে না দেখেই সংক্ষুব্ধ মানুষজন কিন্তু উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছেন।

এ ধরনের ঘটনায় কীভাবে তদন্ত পরিচালনা করতে হবে, সেটাও বাতলে দিয়েছিলেন আদালত। এবং দেখা গেল, একাধিক তদন্ত শেষে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের শুধু নয়, সংশ্লিষ্ট হল প্রভোস্টের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। শিক্ষাঙ্গন পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে, উচ্চ আদালত এসব ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতে বাধ্য করতে পারেন। অসহায়বোধ করা জনসাধারণের মধ্যে তেমন প্রত্যাশাও জেগেছে বৈকি। দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর শিক্ষামন্ত্রীও রয়েছেন। তাকেও কিন্তু দেশ কাঁপানো এসব ঘটনায় কখনো নড়েচড়ে বসতে দেখা যায়নি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষে হয়তো হস্তক্ষেপের সুযোগ তেমন নেই। প্রচলিত বিধিবিধান হয়তো সেক্ষেত্রে তাকে আটকাবে। কিন্তু এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বক্তব্য দিতেও কি কখনো দেখা গেছে তাকে? আমার জানা নেই। সম্প্রতি রমজানের শুরুতেই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে খবর মিলছে ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে ইফতার ও সেহরির সময় খাবারের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার এবং দেখা যাচ্ছে, এর পেছনেও আছে ছাত্রলীগের ক্ষমতাধরদের চাঁদাবাজি, ফাও খাওয়া ইত্যাদি বহুদিনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এসব খবর পড়ার সময়ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী মানুষদের অনির্বচনীয় লজ্জায় পড়তে হয়।

ছাত্ররাজনীতির নামে যা হচ্ছে, সে বিষয়ে রাখা রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে ফিরে আসি। এই যে রাষ্ট্রপতি সেদিন ওই বক্তব্য রাখলেন, সেটা নিজে থেকে রেখেছেন বলেই বিশ্বাস করতে চাই। নাকি সংশয় নিয়ে বলব, এ বিষয়ে হয়তো তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে নিয়েছিলেন। কিংবা জেনে বুঝে নিয়েছিলেন তার মনোভাব। এমনও কি হতে পারে, প্রধানমন্ত্রীই চেয়েছেন-তিনি ওই রকম বক্তব্য রাখুন? আমরা আসলে জানি না এবং সম্ভবত এটা জানতে চাওয়াও যাবে না।

এখানে শুধু এটুকু বলা যাবে, রাষ্ট্রপতির সেদিনকার বক্তব্যে শিক্ষাঙ্গনের চলমান ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন মানুষ কিছুটা হলেও খুশি হয়েছিলেন। নিজেদের মনোবেদনা রাষ্ট্র ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের কারও বক্তব্যে প্রতিফলিত হলে নাগরিক হিসাবে তারা কিছুটা সম্মানিতও বোধ করেন বৈকি। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও তারা কিন্তু ভালোভাবে অবহিত। তবে তারা নিশ্চয়ই উচ্চ পদাধিকারী কারও তার দায়িত্বের আওতায় থাকা কোনো বিষয়ে নির্লিপ্ততাও দেখতে চায় না। এতে নাগরিক উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়।

আমরা একজন নতুন রাষ্ট্রপতিও পেয়ে গেছি এর মধ্যে এবং যথাসময়ে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। আমরা কি আশা করব না-বিদায়ি রাষ্ট্রপতি শিক্ষাঙ্গন পরিস্থিতি নিয়ে কদিন আগে যা বলেছিলেন, তিনি সে ধারায় আরও কিছুটা অগ্রসর হবেন? এটা অবশ্য জাতীয় নির্বাচনের বছর। এ সময়ে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত একজন রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দুর্বৃত্তদের রোধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ডাকবেন বলে মনে হয় না। তবে সরকার চাইলে ভিন্ন কথা।

সরকার চাইলে তো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই পরিস্থিতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। মূল দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরন না বদলালে তার সহযোগী বা ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ কোনো সংগঠনের কার্যকলাপ বদলাবে বলেও কি আশা করা যায়? বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসে যা ঘটে চলেছে, সারা দেশেও কমবেশি একই ঘটনা ঘটছে বললে ভুল হবে না। কেন্দ্র ও প্রান্ত এক্ষেত্রে পরস্পরকে প্রভাবিত করছে বললেও কি ভুল হবে? আর এ প্রক্রিয়া চলমান দীর্ঘদিন ধরে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও কমবেশি এ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে বলে লোকের বিশ্বাস।

দলীয়ভাবে বিভক্ত শিক্ষক-রাজনীতি এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। শিক্ষকদের প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের ভূমিকার কথাও কারও অজানা নেই। ছাত্রলীগ বা এ ধরনের সংগঠনের দুর্বৃত্ত অংশটির মোকাবিলায় তাদের আসলে করার আর কিছু নেই। কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে দায়িত্ব পালন করতে গেলে তাদের কী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়, সে খবরও মাঝে মাঝে পাওয়া যায়। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ন্যায়সঙ্গত নিষ্পত্তি করতে যাওয়া ছাত্র উপদেষ্টা শিক্ষককে গেট বন্ধ করে আটকে রাখার খবর সংবাদপত্রে এসেছিল কদিন আগে। ক্ষমতা মদমত্ত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের অন্যায় চাপের মুখে এক শিক্ষকের হার্ট ফেল করে মারা যাওয়ার ঘটনাও কারও স্মৃতি থেকে মুছবে না।

দেশে অবশ্য এখন অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এর সংখ্যা সম্ভবত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিগুণ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সংকটের চিত্রটিও ভিন্ন। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দখলদারত্ব থেকে উদ্ভূত সমস্যা অন্তত সেখানে নেই। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং এ পর্যায়ের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকটের প্রধান দিক হলো অবনতিশীল ছাত্ররাজনীতি এবং সরকারের পক্ষ থেকে এটি রোধের কোনো প্রয়াস না থাকা।

আমরা বরং দেখি-বিভিন্ন সময়ে তার জন্য যে কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাহুবলে বলীয়ান ছাত্রসংগঠনটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে ‘রিজার্ভ ফোর্স’ হিসাবে। অনেক সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একযোগেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এরকম চলতে থাকলে এটা আশা করার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি থাকে না যে, পুলিশ কখনো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দুর্বৃত্তপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী মানের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করছে এবং এ কঠিন সময়ে তারা কতটা বাজার উপযোগী, সে প্রশ্নও রয়েছে। ওখানে ব্যয় হওয়া রাষ্ট্রীয় অর্থের পরিমাণ ও এর সদ্ব্যবহার নিয়ে জিজ্ঞাসাও বিরাট। উপযুক্ত গবেষণা ও জ্ঞান সৃষ্টিতে এগুলো কতটা পিছিয়ে পড়ছে, তা নিয়েও মাঝে মাঝে আলোচনা হয়ে থাকে। এরই মধ্যে অবনতিশীল এবং সম্ভবত সর্বোচ্চ খারাপ অবস্থায় উপনীত তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি আমাদের বড় মনোযোগের বিষয় হওয়া দরকার। রাষ্ট্রক্ষমতায় পটপরিবর্তন হলে তখনকার শাসক দলের ছাত্রসংগঠন এসে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতিও যদি ঘটায়, সেটাও জাতির প্রত্যাশা পূরণ করবে বলে মনে হয় না।

আর উন্নতির আশা করা তো অত্যন্ত কঠিন। লোকে আশা করতেই ভুলে যাচ্ছে যেসব বিষয়ে, তার একটি হলো শিক্ষাঙ্গনের নৈরাজ্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও এ ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করতে যায়-জীবনের একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি লাভের অধিকারটি সম্ভবত তাদের ন্যূনতম দাবি। মানসম্মত শিক্ষা লাভ করতে আরও কিছু শর্ত অবশ্য পরিপূরণ করতে হবে। তবে সেগুলো কোনো কাজেই আসবে না, যদি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাস দখল করে যা খুশি কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে- প্রতিকারহীনভাবে।

দেশের প্রথম নাগরিক, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ও বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে রাষ্ট্রপতির অন্তত একটি নৈতিক ভূমিকা এখানে থাকতে পারে। প্রধান বিচারপতি আর আপিল বিভাগও এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন কিনা, বিনীতভাবে এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই করা যাবে। আর নিজেদের ছাত্রসংগঠনকে কেবল ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ বলে ঘোষণার মধ্যেই নিশ্চয় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না একটি সরকারের ভূমিকা। মেয়াদের শেষ সময়ে তারা এ বিষয়ে অন্তত কিছু সংস্কারমূলক ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে পারেন। আর দীর্ঘদিন পর রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা ফিরতে চান, তাদের ২৭ দফায় কি এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়েছে?

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

এভাবেই কি চলবে দেশের শিক্ষাঙ্গন

 হাসান মামুন 
০১ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

মূলত ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে শিক্ষাঙ্গন পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তৃতা দিতে গিয়ে বিদায়ি রাষ্ট্রপতিও এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন কিছুদিন আগে। স্বভাবতই কোনো ছাত্র সংগঠনের নাম না নিয়ে তিনি তখন যা বলেন, সেটা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনটির ওপরই গিয়ে বর্তায়। অবশ্য বলা যেতে পারে, পদাধিকারবলে বেশকিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য থাকাকালে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের অন্তত একাংশ যা করে চলেছে এবং তাতে শিক্ষার পরিবেশের যে গুরুতর অবনতি ঘটছে, সেক্ষেত্রে তিনি কী ভূমিকা রেখেছেন?

এসব ঘটনা তাকে পীড়িত করেছে নিশ্চয়ই? কিন্তু কখনো কোথাও এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তিনি বক্তব্য রেখেছেন বলে মনে পড়ে না। আচার্য হলেও এসব ঘটনা রোধে তার কোনো কার্যকর ক্ষমতা রয়েছে বলে অবশ্য জানা যায় না। তারপরও রাষ্ট্রপতির জোরালো বক্তব্য বা ভূমিকার একটা প্রভাব নিশ্চয়ই আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ভিসির মতো দায়িত্বশীলদের ডেকে তিনি নিশ্চয়ই জানতে চাইতে পারেন, কেন তারা অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না?

গত এক দশক বা যুগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কত যে অনাকাঙ্ক্ষিত, এমনকি নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়েছে ছাত্রলীগের বেপরোয়া নেতাকর্মীরা! এর একটারও উল্লেখ না করলেও জনগণের স্মৃতি কিন্তু তাদের সঙ্গে প্রতারণা করবে না। তবু ভালো, অন্তত বিদায়বেলায় রাষ্ট্রপতি শিক্ষাঙ্গনে দখলদারি ও তা ঘিরে অপরাধমূলক ঘটনাবলিতে উদ্বেগ জানিয়ে বললেন, এতে ছাত্ররাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধা ধরে রাখতে পারছে না মানুষ।

রাষ্ট্রপতি যেদিন ওই বক্তব্য রাখেন, তার আগের দিন এবং তার পরদিনও ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তরা কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো দুষ্কর্ম করে সংবাদ শিরোনাম হয়। এর মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায়, মনে পড়ে, উচ্চ আদালতকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। যেসব ঘটনার নিষ্পত্তি হলো কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই হতে পারে বা পারত, সেটা প্রক্টর পর্যায়েও হচ্ছে না দেখেই সংক্ষুব্ধ মানুষজন কিন্তু উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছেন।

এ ধরনের ঘটনায় কীভাবে তদন্ত পরিচালনা করতে হবে, সেটাও বাতলে দিয়েছিলেন আদালত। এবং দেখা গেল, একাধিক তদন্ত শেষে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের শুধু নয়, সংশ্লিষ্ট হল প্রভোস্টের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। শিক্ষাঙ্গন পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে, উচ্চ আদালত এসব ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতে বাধ্য করতে পারেন। অসহায়বোধ করা জনসাধারণের মধ্যে তেমন প্রত্যাশাও জেগেছে বৈকি। দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর শিক্ষামন্ত্রীও রয়েছেন। তাকেও কিন্তু দেশ কাঁপানো এসব ঘটনায় কখনো নড়েচড়ে বসতে দেখা যায়নি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষে হয়তো হস্তক্ষেপের সুযোগ তেমন নেই। প্রচলিত বিধিবিধান হয়তো সেক্ষেত্রে তাকে আটকাবে। কিন্তু এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বক্তব্য দিতেও কি কখনো দেখা গেছে তাকে? আমার জানা নেই। সম্প্রতি রমজানের শুরুতেই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে খবর মিলছে ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে ইফতার ও সেহরির সময় খাবারের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার এবং দেখা যাচ্ছে, এর পেছনেও আছে ছাত্রলীগের ক্ষমতাধরদের চাঁদাবাজি, ফাও খাওয়া ইত্যাদি বহুদিনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এসব খবর পড়ার সময়ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী মানুষদের অনির্বচনীয় লজ্জায় পড়তে হয়।

ছাত্ররাজনীতির নামে যা হচ্ছে, সে বিষয়ে রাখা রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে ফিরে আসি। এই যে রাষ্ট্রপতি সেদিন ওই বক্তব্য রাখলেন, সেটা নিজে থেকে রেখেছেন বলেই বিশ্বাস করতে চাই। নাকি সংশয় নিয়ে বলব, এ বিষয়ে হয়তো তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে নিয়েছিলেন। কিংবা জেনে বুঝে নিয়েছিলেন তার মনোভাব। এমনও কি হতে পারে, প্রধানমন্ত্রীই চেয়েছেন-তিনি ওই রকম বক্তব্য রাখুন? আমরা আসলে জানি না এবং সম্ভবত এটা জানতে চাওয়াও যাবে না।

এখানে শুধু এটুকু বলা যাবে, রাষ্ট্রপতির সেদিনকার বক্তব্যে শিক্ষাঙ্গনের চলমান ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন মানুষ কিছুটা হলেও খুশি হয়েছিলেন। নিজেদের মনোবেদনা রাষ্ট্র ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের কারও বক্তব্যে প্রতিফলিত হলে নাগরিক হিসাবে তারা কিছুটা সম্মানিতও বোধ করেন বৈকি। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও তারা কিন্তু ভালোভাবে অবহিত। তবে তারা নিশ্চয়ই উচ্চ পদাধিকারী কারও তার দায়িত্বের আওতায় থাকা কোনো বিষয়ে নির্লিপ্ততাও দেখতে চায় না। এতে নাগরিক উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়।

আমরা একজন নতুন রাষ্ট্রপতিও পেয়ে গেছি এর মধ্যে এবং যথাসময়ে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। আমরা কি আশা করব না-বিদায়ি রাষ্ট্রপতি শিক্ষাঙ্গন পরিস্থিতি নিয়ে কদিন আগে যা বলেছিলেন, তিনি সে ধারায় আরও কিছুটা অগ্রসর হবেন? এটা অবশ্য জাতীয় নির্বাচনের বছর। এ সময়ে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত একজন রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দুর্বৃত্তদের রোধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ডাকবেন বলে মনে হয় না। তবে সরকার চাইলে ভিন্ন কথা।

সরকার চাইলে তো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই পরিস্থিতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। মূল দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরন না বদলালে তার সহযোগী বা ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ কোনো সংগঠনের কার্যকলাপ বদলাবে বলেও কি আশা করা যায়? বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসে যা ঘটে চলেছে, সারা দেশেও কমবেশি একই ঘটনা ঘটছে বললে ভুল হবে না। কেন্দ্র ও প্রান্ত এক্ষেত্রে পরস্পরকে প্রভাবিত করছে বললেও কি ভুল হবে? আর এ প্রক্রিয়া চলমান দীর্ঘদিন ধরে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও কমবেশি এ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে বলে লোকের বিশ্বাস।

দলীয়ভাবে বিভক্ত শিক্ষক-রাজনীতি এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। শিক্ষকদের প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের ভূমিকার কথাও কারও অজানা নেই। ছাত্রলীগ বা এ ধরনের সংগঠনের দুর্বৃত্ত অংশটির মোকাবিলায় তাদের আসলে করার আর কিছু নেই। কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে দায়িত্ব পালন করতে গেলে তাদের কী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়, সে খবরও মাঝে মাঝে পাওয়া যায়। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ন্যায়সঙ্গত নিষ্পত্তি করতে যাওয়া ছাত্র উপদেষ্টা শিক্ষককে গেট বন্ধ করে আটকে রাখার খবর সংবাদপত্রে এসেছিল কদিন আগে। ক্ষমতা মদমত্ত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের অন্যায় চাপের মুখে এক শিক্ষকের হার্ট ফেল করে মারা যাওয়ার ঘটনাও কারও স্মৃতি থেকে মুছবে না।

দেশে অবশ্য এখন অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এর সংখ্যা সম্ভবত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিগুণ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সংকটের চিত্রটিও ভিন্ন। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দখলদারত্ব থেকে উদ্ভূত সমস্যা অন্তত সেখানে নেই। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং এ পর্যায়ের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকটের প্রধান দিক হলো অবনতিশীল ছাত্ররাজনীতি এবং সরকারের পক্ষ থেকে এটি রোধের কোনো প্রয়াস না থাকা।

আমরা বরং দেখি-বিভিন্ন সময়ে তার জন্য যে কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাহুবলে বলীয়ান ছাত্রসংগঠনটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে ‘রিজার্ভ ফোর্স’ হিসাবে। অনেক সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একযোগেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এরকম চলতে থাকলে এটা আশা করার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি থাকে না যে, পুলিশ কখনো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দুর্বৃত্তপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী মানের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করছে এবং এ কঠিন সময়ে তারা কতটা বাজার উপযোগী, সে প্রশ্নও রয়েছে। ওখানে ব্যয় হওয়া রাষ্ট্রীয় অর্থের পরিমাণ ও এর সদ্ব্যবহার নিয়ে জিজ্ঞাসাও বিরাট। উপযুক্ত গবেষণা ও জ্ঞান সৃষ্টিতে এগুলো কতটা পিছিয়ে পড়ছে, তা নিয়েও মাঝে মাঝে আলোচনা হয়ে থাকে। এরই মধ্যে অবনতিশীল এবং সম্ভবত সর্বোচ্চ খারাপ অবস্থায় উপনীত তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি আমাদের বড় মনোযোগের বিষয় হওয়া দরকার। রাষ্ট্রক্ষমতায় পটপরিবর্তন হলে তখনকার শাসক দলের ছাত্রসংগঠন এসে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতিও যদি ঘটায়, সেটাও জাতির প্রত্যাশা পূরণ করবে বলে মনে হয় না।

আর উন্নতির আশা করা তো অত্যন্ত কঠিন। লোকে আশা করতেই ভুলে যাচ্ছে যেসব বিষয়ে, তার একটি হলো শিক্ষাঙ্গনের নৈরাজ্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও এ ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করতে যায়-জীবনের একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি লাভের অধিকারটি সম্ভবত তাদের ন্যূনতম দাবি। মানসম্মত শিক্ষা লাভ করতে আরও কিছু শর্ত অবশ্য পরিপূরণ করতে হবে। তবে সেগুলো কোনো কাজেই আসবে না, যদি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাস দখল করে যা খুশি কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে- প্রতিকারহীনভাবে।

দেশের প্রথম নাগরিক, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ও বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে রাষ্ট্রপতির অন্তত একটি নৈতিক ভূমিকা এখানে থাকতে পারে। প্রধান বিচারপতি আর আপিল বিভাগও এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন কিনা, বিনীতভাবে এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই করা যাবে। আর নিজেদের ছাত্রসংগঠনকে কেবল ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ বলে ঘোষণার মধ্যেই নিশ্চয় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না একটি সরকারের ভূমিকা। মেয়াদের শেষ সময়ে তারা এ বিষয়ে অন্তত কিছু সংস্কারমূলক ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে পারেন। আর দীর্ঘদিন পর রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা ফিরতে চান, তাদের ২৭ দফায় কি এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়েছে?

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন